[প্রথমপাতা]

 

 

 

পেছনে ফেলে আসি-০২: হাশেম খানের সঙ্গে আমার অলৌকিক ঘটনার কথা

 

-লুৎফর রহমান রিটন- 

 

 

আমি যখন একেবারেই ছোট্ট বালক, ক্লাশ টুতে পড়ি, স্কুলের পাঠ্যসূচিতে সবচে প্রিয় বই ছিলো বাংলা টেক্সট বইটি। ‘সবুজ সাথী’ নাম ছিলো বইটির। পাতায় পাতায় চাররঙা চমৎকারসব ইলাস্ট্রেশন করেছিলেন হাশেম খান নামের একজন শিল্পী। বইটির গদ্য-পদ্য সব ক’টা লেখাই আমার মুখস্ত ছিলো। মিনি নামের সেই বেড়াল ছানাটির গল্প—‘তোমরা হয়তো ভাবিয়াছ মিনি একটি মেয়ের নাম। আসলে তাহা নহে। মিনি আমার ছোট বোন সুফিয়ার পোষা বেড়াল। সে হেনাদের বাড়ি হইতে উহা আনিয়াছিলো।’ কিংবা ‘মাহমুদের একজোড়া কবুতর আছে’। অথবা ‘একদা এক বাঘের গলায় হাঁড় ফুটিয়াছিল।’ এবং ‘জুলেখা বাদশার মেয়ে। তাহার ভারী অহংকার। সব সময় মুখ ভার করিয়া থাকে।’ এইসব রচনার ভেতর থেকে হাশেম খানের আঁকা বেড়ালের মিঁয়াও, কবুতরের বাকুম বাকুম, বাঘের হালুম আমি যেনো বা শুনতে পেতাম। আমার চোখের সামনে ভেসে উঠতো জুলেখা নামের দুখী রাজকন্যার মুখটি। পাঠ্য বইতে হাশেম খান নামের সেই শিল্পীর আঁকা চার রঙা ছবির কল্যাণেই আমি ঢাকায় বাস করেও বাংলাদেশের ছয়টি ঋতুকে চিনে নিতে পেরেছিলাম। গ্রীস্ম-বর্ষা-শরৎ-হেমন্ত-শীত এবং বসন্ত—এই ছয়টি ঋতুতে বাংলাদেশের রূপটি কী রকম পালটে যায় সেটা আমি হাশেম খানের ছবি দেখেই অনুভব করেছিলাম প্রথম। পরে গ্রামে বেড়াতে গিয়ে হাশেম খানের আঁকা ষড় ঋতুর ছবির সঙ্গে মিলিয়ে মিল্যে আমি অনায়াসে বুঝে নিতাম—এটা শরৎ কাল। কিংবা এটা বসন্ত কাল। এক কথায় অজানা অচেনা একজন হাশেম খানই আমাকে ঋতু চিনিয়েছেন।

কানাডায় থিতু হবার পর বুঝলাম এখানে ঋতু মোটে চারটি। এর মধ্যে ‘ফল’সিজনে অর্থাৎ শীতের আগমনী কালটায় কানাডা তার রূপ পালটায়। লক্ষ হাজার ম্যাপল এবং অন্যান্য বৃক্ষের সবুজ পাতাগুলো ফল-এর সময় ক্রমশঃ ঝলমলে হলুদ, উজ্জ্বল কমলা এবং টকটকে লাল বর্ণ ধারণ করে। অজস্র বৃক্ষের কোটি কোটি পত্র-পল্লব কানাডাকে রঙিন করে তোলে। কানাডার শেষ বিকেল এবং একেকটা সন্ধ্যা তখন হয়ে ওঠে আগুনলাগা সন্ধ্যা। অস্তগামী সূর্যের তীর্যক আলো বর্ণিল পাতা ভেদ করে আছড়ে পড়ে চারপাশে। অটোয়ার সুবিশাল গ্যেটিন্যু পার্কে আমি তখন পাগলের মতো গাড়ি ড্রাইভ করি। পার্কের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে যেতে গাড়িতেই ঘন্টাখানেক লাগে। আমার ডানে বামে সামনে পেছনে তখন প্রকৃতির অপরূপ ক্যানভাসে উজ্জ্বল রঙের অপূর্ব সিম্ফনি। আমি চিৎকার করে উঠি—ওইযে ওটা হাশেম খানের পেইন্টিং! আমার পাশের সিটে বসা শার্লি আমার সঙ্গে সহমত পোষণ করে—ইস! এই সময়টায় হাশেম ভাইকে যদি কানাডায় আনা যেতো!

আমার শৈশব-কৈশোরকে রাঙিয়ে দেয়া শিল্পী হাশেম খান পরবর্তীকালে আমার বহু ছড়ার বইয়ের প্রচ্ছদ এঁকেছেন, ছবি এঁকেছেন। আমাদের ছড়াকারদের মধ্যে এককভাবে হাশেম খান সবচে বেশি প্রচ্ছদ আর অলঙ্করণ করেছেন আমার বইতেই। শুধু কি তাই? ক্লাশ ফাইভের ‘আমার বই’ নামের টেক্সট বইতে আমার ‘ফেব্রুয়ারির গান’ নামের ছড়াটার ইলাস্ট্রেশনও এই হাশেম খানেরই করা। কী সৌভাগ্য আমার! এককালের ছোট্টশিশু রিটনের ক্লাশ টু-র পাঠ্যবইয়ের প্রিয় আঁকিয়ে পরবর্তীকালে ছোট্টশিশুদের পাঠ্যবইয়ে স্থান পাওয়া রিটনের ছড়ারও অলঙ্করণ করছেন!!

এক জীবনে এই প্রাপ্তিটাকে আমার কেমন অলৌকিক বলে মনে হয়! ক্লাশ টুতে পড়ার সময় আমি তো স্বপ্নেও ভাবিনি যে দূর ভবিষ্যতে একদিন ওরকম একটা পাঠ্যবইতে আমারও ছড়া থাকবে এবং ওটারও ইলাস্ট্রেশন করবেন সেই একই শিল্পী!

আমার শৈশবকে রঙিন-বর্ণাঢ্য করে তোলা সেই শিল্পী, আমাকে ছয়টি ঋতু চেনানো সেই শিল্পী হাশেম খানের আজ জন্মদিন। বারো হাজার তিনশ কিলোমিটার দূরের দেশ কানাডা থেকে প্রিয় শিল্পী হাশেম খানকে জন্মদিনের শুভেচ্ছা।
হাশেম খান, আপনি আমার প্রণতি গ্রহণ করুন।

 

 

 

WARNING: Any unauthorized use or reproduction of 'Community' content is strictly prohibited and constitutes copyright infringement liable to legal action. 

 

 

[প্রথমপাতা]

 

 

লেখকের আগের লেখাঃ