[প্রথমপাতা] |
একুশ শতক ছড়ার শতক,
গড়ার শতক বিশ্ব
মোমিন মেহেদী
'একুশ শতক ছড়ার শতক, গড়ার শতক বিশ্ব
এই সময়ের চাকা চালাও না হলে নিঃশ্ব-
হতেই হবে হতেই হবে সত্য কথা এই
এর উপরে অন্যকোন সত্য জানা নেই৷'
আমাদের দেশে স্বাধীনতার গর্বিত উত্তরাধিকার আমরা৷ উত্তরাধিকার বাংলা ভাষারও৷
সেই ভাষার উত্তরাধিকারের সূত্র ধরে আমরা পেয়েছি বাংলা ভাষার অসংখ্য
ছড়া-ছড়াকার, কবি-কবিতা, গল্প-গল্পকার, উপন্যাস-উপন্যাসিক,
প্রবন্ধ-প্রবন্ধকারসহ বিভিন্ন অঙ্গনের রঙধনু৷ এই রঙধনু আছে বলেই আমাদের
বাংলাদেশ সাহিত্য-সংস্কৃতির উচ্ছাস৷ উচ্ছল আঁচল আর আদরমাখা বর্তমান৷ এই
আদরের রেশ ধরেই কাল-কালানত্মরে কাটা হয়েছে ছড়া৷ গড়ে উঠেেেছ চযর্াপদের মত
অনন্য গ্রন্থও৷ আর এভাবেই ছড়ার বিস্তৃত পরিক্রমায় যদি আমাদের মাঝে হয়ে উঠেছে
বটবৃৰ৷ প্রকৃতভাবেই যদি বাংলা ছড়া নতুন দিনের নতুন আলোয় উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে
তাহলেই হয়তো আমরা খুঁজে পাব আমাদের সঠিক গতিপথ৷ তবে সেৰেত্রে আমাদের
ছড়াঙ্গনের পথিকৃত্দেরকে হতে হবে বিচৰণ ও সচেতন৷ তা না হলে এই আধুনিককতার
আলোয় এসেও অন্ধকারেডুবে যাবে ছড়ার আগামী৷ সেই অন্ধকারের সুযোগে 'ধরা যাবে
না ছোঁয়া যাবে না/ বলা যাবে না কথা/ রক্ত দিয়ে পেলাম শালার এমন স্বাধীনতা'র
মত অসংখ্য অনবদ্য অনন্য ছড়ার জনক আবু ছালেহর ছড়াকে নিজের ছড়া বলে প্রকাশ
করার দুঃসাহস দেখাবে ছড়াঙ্গনের ধাপ্পাবাজখ্যাত পরকীয় কথিত ছড়াকারেরা৷ এদের
রম্নখে দিতে না পারলে বাংলা ছড়ার শত বছরের ঐতিহ্যকে অন্ধকারের কুঠুরীতে
কাটাতে হবে আগামী দিনগুলো৷ আমরা যারা ছড়ার মঙ্গলপ্রাথর্ী তাদের দিকে তাকিয়ে
হলেও সচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে৷ তা না হলে এই শ্রেনীর ছড়ার দূবৃত্তরা আবু
ছালেহর ছড়া থেকে শুরম্ন করে নতুন প্রজন্মের ছড়াকার তানজিল রিমনের ছড়া
পর্যনত্ম নিজের নামে চালিয়ে দিচ্ছে৷ এই বর্তমান থেকে বেরিয়ে আসতে হবে
আমাদেও সবাইকে৷ তারপরও একটি কথা বলতেই হয়, অমিত সম্ভাবনা রয়েছে ছড়া
মাধ্যমটির৷ নতুন যুগের নতুন ছড়াকাররা সেই নতুন ভাবধারার ছড়া লিখে পূর্ণতা
দান করবে৷ প্রবীন ছড়াকারদের এমন প্রত্যয়ের মুখে চুনকালি মেখে এগিয়ে আসছে
অন্ধকারের সাথী তথাকথিত ছড়াকারেরা৷ এই তথাকথিত ছড়াকারদের বাইরে রয়েছে
আমাদের অসংখ্য প্রথিতযশা এবং সৃজনশীল ছড়াকার৷ সেই প্রথিতযশাাদের,
সৃজনশীলদের তালিকা এতটাই লম্বা যে, উলেস্নখ করতে গেলে পৃষ্টার পর পৃষ্ঠা
শেষ হয়ে গেলোও শেষ হবে না ৷ সেই দৃষ্টিকোণ থেকে ধারাবাহিকভাবে উঠে আসতে পারে
যুগ-যুগানত্মের সেরাদের নাম৷ ছড়া মােেনই অনন্য৷ অন্য স্বাদের কবিতা৷ আমাদের
কবিতাপুরম্নষ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর 'ছিন্নপত্রাবলী'তে ৫সেপ্টেম্বর ১৮৯৪
এর একটি পত্র-বিচিত্রায় ছড়া প্রসঙ্গে উল্লেখ করেন- 'ৃছড়া'র একটা স্বতন্ত্র
রাজ্য আছে, সেখানে কোনো আইন কানুন নেই- মেঘরাজ্যের মতো৷ৃ' ছড়া কোন নিয়ম
কানুন না মানলেও দাঁড়িয়ে যায় নিয়ম মেনেই৷ যেমন-
'বৃষ্টি পড়ে টাপুর টুপুর, নদী এলো বান৷
শিব ঠাকুরের বিয়ে হল, তিন কন্যে দান৷
এক কন্যে রাঁধেন বাড়েন, এক কন্যে খান৷
এক কন্যে না খেয়ে বাপের বাড়ি যান৷৷'
কবিগুরম্নর এই ছড়ার মত করেই এগিয়ে চলে ছন্দবদ্ধ জীবন তরী৷ এখানে উল্লেখ্য
যে, পরবর্তীতে এই ছড়াটি কিঞ্চিত্ পরিবর্তিতরূপে শিশুপাঠ্যে অন্তর্ভূক্ত হয়৷
'নদী' শব্দের জায়গায় 'নদে' এবং 'না খেয়ে' শব্দযুগল হয়ে যায় 'রাগ করে'৷ এতে
অবশ্য ছড়ার অর্থগত বা চিত্রগত কোন ব্যাঘাত ঘটে না৷ তবে রবীন্দ্রনাথের 'কোনো
আইন কানুন নেই' কথাটি বোধ করি আমাদের মধ্যে একটা বিভ্রান্তি তৈরি করে দেয়৷
কাল্পনিক কোনো টাইম মেশিনে চড়ে যদি এ মুহূর্তে কয়েকশ' বছর পেছনে চলে যাই
তাহলে কী দেখবো আমরা ? টাপুর টুপুর বৃষ্টিঝরা বর্ষায় নদীতে যে প্লাবন নামে
তাতে চলাচলের একমাত্র মাধ্যম পায়ে হাঁটা পথগুলো চারদিকের থৈ থৈ বর্ষায় তলিয়ে
গেলে যোগাযোগের একমাত্র ও সর্বত্রগামী মাধ্যম নৌ চলাচলই হয়ে উঠে সহজলভ্য৷
মাঠ-ঘাট পানিতে তলিয়ে গিয়ে মানুষগুলো যখন পরিপূর্ণ বেকার হয়ে উঠে, বসে বসে
খাওয়া আর পুঁথি-পাঁচালির আসর, গান বাজনা এসব বিনোদনে নিজেদের ডুবিয়ে দেয়া
ছাড়া আর কী করার থাকে এদের৷ শুরু হয়ে যায় সামাজিক অন্যান্য পার্বন উত্সবও৷
এবং তখনই আমাদের প্রাচীন গ্রাম-বাংলায় এই দীর্ঘ কর্ম অবসরে বিয়ে-বাদ্যিরও
ধুম লেগে যায়৷ অতএব শিব ঠাকুরের বিয়ের মৌসুম যে এটাই তা আর বলার অপেক্ষা
রাখে না৷ প্রাচীন ব্রাহ্মণ্য সমাজে যে বহুবিবাহের চল খুব জোরেশোরেই ছিলো
এটাও স্বীকৃত৷ তাছাড়া মেয়ে আইবুড়ো হওয়ার আগেই কন্যাদান সম্পন্ন না হলে যে
ব্রহ্মপাপ ঘনিয়ে আসে তাতে একত্রে তিন কন্যা একপাত্রে দান করা ছাড়া
কন্যাদায়গ্রস্ত পিতার গতিই বা কী ! বর্ণহিন্দু সমাজের এই শাস্ত্রীয়
কূপমণ্ডুকতাকে দুটোমাত্র চিত্রকল্পিত শ্লেষযুক্ত বাক্যের অটুট বাঁধনে যে
ছড়াকার এতো চমত্কারভাবে উপস্থাপন করেছিলেন, তাতে আইন-কানুনের ব্যত্যয় কি
চোখে পড়ে কোথাও ? শাস্ত্র রক্ষার্থে তিনকন্যে যখন তিন সতীন হয়ে উঠে, আবহমান
বাঙালি সমাজে এর কী দুঃসহ ফলাফল প্রতিফলিত হতে থাকে তাও সেই ছড়াকার পরবর্তী
দুটি বাক্যের অনিবার্য চিত্রকল্প এঁকে ঠিকই বুঝিয়ে দেন গোটা সামাজিক
চিত্রের বিশদ রূপ৷ ১৩০১ বঙ্গাব্দে তাঁর 'লোকসাহিত্য' রচনায় 'ছেলেভুলানো ছড়া-১'
পর্বে তিনি বলেন- 'ৃছড়াগুলিও শিশু-সাহিত্য, তাহারা মানবমনে আপনি জন্মিয়াছে৷ৃ
ইহার মধ্যে ভাবের পরস্পর সম্বন্ধ নাই,ৃ কতকগুলি অসংলগ্ন ছবি নিতান্ত
সামান্য প্রসঙ্গসূত্র অবলম্বন করিয়া উপস্থিত হইয়াছে৷ৃ গাম্ভীর্য নয়, অর্থের
মারপ্যাঁচ নয়, সুরময় ধ্বনিই ছড়ার প্রাণ৷ৃ ছড়াও কলাবিচারশাস্ত্রের বাহির,
মেঘবিজ্ঞানও শাস্ত্রনিয়মের মধ্যে ভালো করিয়া ধরা দেয় নাই৷ৃ এবং ছড়াগুলিও
ভারহীনতা অর্থবন্ধনশূন্যতা এবং চিত্রবৈচিত্র্য-বশতই চিরকাল ধরিয়া শিশুদের
মনোরঞ্জন করিয়া আসিতেছে- শিশুমনোবিজ্ঞানের কোনো সূত্র সম্মুখে ধরিয়া রচিত
হয় নাই৷ৃ' কবিগুরম্নর মতের আনেক মূল্য৷ তার মতামত আমরা মানি আর না মানি
স্বিকার করতে হবে যে, সাহিত্য যখনো তার লেখ্যরূপ পায়নি, মুখে মুখে রচিত
শ্লোক, গান বা ছড়াই যখন সকল সামাজিক কর্মকাণ্ডের শ্রুতিমাধ্যম হয়ে বহমান,
আধুনিক শাস্ত্রবিচারিক পণ্ডিতদের আবির্ভাব নিশ্চয় এর পূর্বে ঘটে নাই ! বরং
লোকায়ত সাহিত্য থেকেই যে পরবর্তী কলাশাস্ত্রের উদ্ভব, এটাই চিরনত্মন সত্য
কথা৷ ইচ্ছে করলেই একজন ছড়াকার কবি হয়ে উঠতে পারে, কিন্তু একজন ইচ্ছে করলেই
কবি থেকে ছড়াকার হতে পারেনা৷ এই হলো কবি ছড়াকার আর কিশোর কবিতার কবির
ব্যবচ্ছেদচিহ্ন৷
'ঘুম পাড়ানি মাসি পিসি আমার বাড়ি এসো৷
শেজ নেই, মাদুর নেই, পুঁটুর চোখে বোসো৷৷
বাটা ভরে পান দেব, গাল ভরে খেয়ো৷
খিড়কি দুয়ার খুলে দেব, ফুড়ুত্ করে যেয়ো৷৷
১৩০১-১৩০২ বঙ্গাব্দে 'ছেলেভুলানো ছড়া-২' পর্বে রবীন্দ্রনাথ বলেন- 'আমাদের
অলংকারশাস্ত্রে নয় রসের উল্লেখ আছে, কিন্তু ছেলেভুলানো ছড়ার মধ্যে যে রসটি
পাওয়া যায়, তাহা শাস্ত্রোক্ত কোনো রসের অন্তর্গত নহে৷ৃ ছেলে ভুলানো ছড়ার
মধ্যে তেমনি একটি আদিম সৌকুমার্য আছে- সেই মাধুর্যটিকে বাল্যরস নাম দেওয়া
যাইতে পারে৷ তাহা তীব্র নহে, গাঢ় নহে, তাহা অত্যন্ত সি্নগ্ধ সরস এবং
যুক্তি-সংগতিহীন৷' রবীন্দ্রনাথ কথিত অলংকারশাস্ত্রের এই নয়টি রস হচ্ছে
শৃঙ্গার বা আদিরস, বীররস, রৌদ্ররস, হাস্যরস, করুণরস, ভয়ানক, বীভত্স,
অদ্ভুত এবং শান্তরস৷ রস তো আর এমনি এমনি টস টস করে না ! তার পেছনে নয়টি
স্থায়ী ভাব রয়েছে বলে পণ্ডিত-মহলে স্বীকৃত৷ ভাব থেকেই রসের উত্পত্তি৷ রতি
স্থায়ী ভাব থেকে শৃঙ্গার বা আদিরস, উত্সাহ থেকে বীররস, ক্রোধ থেকে
রৌদ্ররস, হাস থেকে হাস্যরস, শোকভাব থেকে করুণরস, ভয় থেকে ভয়ানক, জুগুপ্সা
থেকে বীভত্স, বিস্ময় থেকে অদ্ভুত এবং শম স্থায়ী ভাব থেকে শান্তরস৷
রসশাস্ত্র অনুসারে এই নয়টি স্থায়ী ভাব নাট্য বা কাব্যে বিভাব, অনুভাব ও
ব্যভিচারী ভাবের সংযোগে নয়টি রসে সার্থক পরিণতি লাভ করে৷ ছড়ায় সাধারনত এই ৯
রসের শিরা্ই ঝরে ঝরে পরে৷ আমাদের বাংলাভাষার সহজ সরল ছড়াকারগন দুহাজার
বছরের পুরনো সংস্কৃত অলংকার শাস্ত্র অধ্যয়ন ও বুত্পত্তিলাভ করে অবশেষে মুখে
মুখে ছড়া কাটতে শুরু করেছিলেন ৷ সেই সময়ের হাত ধরে এগিয়ে আসেন সুকুমার রায়,
খান মুহম্মদ মঈনুদ্দীন, সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত, আব্দুল কাদির, ফজলুল করিম,
শামসুর রাহমান, এখলাসউদদীন আহমদ, ফয়েজ আহমদ, কাজী কাদের নেওয়াজ, আল মাহমুদ,
সৈয়দ শামসুল হক, সুকুমার বড়ুয়া, আহসান হাবিব, আসাদ চেীধুরী, আবু ছালেহ,
ফারম্নক নওয়াজ, আশরাফুল আলম পিনটু, সুজন বড়ুয়া, আলী ইমাম, নাসির আহমেদ, লুত্ফর
রহমান রিটন, আমীরম্নল ইসলাম, আবু হাসান শাহরিয়ার, রিফাত নিগার শাপলা, আহসান
মালেক, রাশেদ রউফ, নাসের মাহমুদ, আলম তালুকদার, তাহমিনা কোরাইশী, আসলাম সানী,
খান মুহম্মদ মঈনুদ্দীন, ফারম্নক হোসেন, বকুল হায়দার, জগলূল হায়দার, মানসুর
মুজাম্মিল প্রমুখ৷ শতবছরের নয় হাজার বছরের ছড়াযাত্রায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আর
কাজী নজরম্নল ইসলাম হামাগুড়ি দেয়া শুরম্ন করলেও ছড়াকে ছড়িয়ে দিয়েছে মূলত
আমাদের লোক সাহিত্য৷ ছড়া সাহিত্যেরর আঁতুর ঘর আমাদের চযর্াপদ৷ চযর্াপদেই
প্রথম ছড়াযাত্রার জয়ধনি শোনা যায়৷ যার প্রমান হিসেবে বলা যায় দুই অথবা চার
লাইনের পঙতিগুলোর কথা৷ সাহিত্য গবেষক সৈয়দ মোহাম্মদ শাহেদ তাঁর
গবেষণা-সন্দর্ভ 'ছড়ায় বাঙালী সমাজ ও সংস্কৃতি' গ্রন্থে রবীন্দ্র-ভাবনায়
ছড়াসম্পর্কিত বৈশিষ্ট্যের যে নির্যাস দাঁড় করান তা হচ্ছে: (১) ছড়া
নির্দিষ্ট নিয়ম-কানুনের অধীন নয়, (২) ছড়ায় ভাব পরস্পর সম্বন্ধহীন ও
যুক্তিসঙ্গতিবিহীন, (৩) ছড়ার চিত্র অসংলগ্ন, (৪) অর্থবোধের চেয়ে সুরময়
ধ্বনিই ছড়ার প্রাণস্বরূপ, (৫) ছড়া কলাবিচার-শাস্ত্র কিংবা শাস্ত্রীয় রসে
বিচার্য নয়, (৬) ছড়ায় যতির ভূমিকা শুধু বিরতির জন্য নয় এবং (৭) ছড়ার ছন্দ
প্রাকৃত ভাষার ছন্দ এবং শব্দও প্রমান দেয় যে, ছড়া মানুষের সহজসাধ্য এবং
সাহসী শব্দঘর৷ এই ঘরে থেকেই ছড়া পেেেয়ছে তার মূলধারার পথ৷ যোগীন্দ্রনাথ
কর্তৃক সংগৃহীত একটি ছড়া পরবর্তীকালে আমাদের দেশের শিশু পাঠ্যে যে বিবর্তিত
রূপ নিয়ে পঠিত হতে থাকে, তা হচ্ছে এরকম-
আতা গাছে তোতা পাখি
ডালিম গাছে মৌ,
এত ডাকি তবু কথা
কও না কেন বৌ !
এমন অনবদ্য ছড়ার মাধ্যমে পরিচিত সেই যোগীন্দ্রনাথ সরকার কর্তৃক সংগৃহীত ও
১৩০৬ বঙ্গাব্দে ছড়ার প্রথম সংকলিত গ্রন্থ 'খুকুমণির ছড়া'র ১ম সংস্করণের
ভূমিকায় রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী বলেন- 'ৃবয়স্ক মানবের চরিত্র বিভিন্ন দেশে
বিভিন্নরূপ৷ৃকিন্তু শিশু-চরিত্র বোধ করি সর্বদেশেই ও সর্বকালেই একরূপ৷ৃ
মানব-শিশু যখন সূতিকাগার হইতে প্রথম বাহির হইয়া সংসারের সহিত পরিচয় আরম্ভ
করে, তখন শাদা চামড়া ও কাল চামড়া উভয়েরই অভ্যন্তরে ঠিক একজাতীয় বুদ্ধিবৃত্তি
বর্তমান থাকে৷ যাঁহাদের অবকাশ আছে, তাঁহারা বাঙ্গালীর ছেলের 'ছড়া' ও
ইংরেজের ছেলের 'নার্শারী গান' মিলাইয়া দেখিবেন, উভয়ের মধ্যে কি অদ্ভুত
রকমের সৌসাদৃশ্য বর্তমান৷ৃ কেবল শিশু-প্রকৃতি কেন, বয়স্ক মনুষ্যের
প্রকৃতিতেও যে অংশটুকু মানবজাতির সাধারণ, তাহারও পরিচয় এই বিভিন্ন দেশের
ছড়া-সাহিত্যে সুস্পষ্ট পাওয়া যাইবে৷ৃ বাঙ্গালীর শিশুসাহিত্য বা ছড়া সাহিত্য,
যাহা লোকমুখে প্রচারিত হইয়া যুগ ব্যাপিয়া আপন অস্তিত্ব বজায় রাখিয়াছে, কখন
লিপিশিল্পের যোগ্য বিষয় বলিয়া বিবেচিত হয় নাই, সেই সাহিত্য সর্বতোভাবে
অতুলনীয়৷ৃ' বিশ্বব্যাপী ছড়ার অভিন্ন রূপ এবং মানবজাতির নৃতাত্তি্বক ও
বুদ্ধিবৃত্তিক বা মনস্তাত্তি্বক সাযুজ্যের কারণে আবহমান লোকছড়ার মধ্যেও এই
মিল বা অভিন্নতা দেখা যায়৷ এবং এই লোকছড়া উচ্চমানের অতুলনীয় সাহিত্য হিসেবে
বিবেচিত৷ অতএব, প্রসঙ্গটা যখন এবার সাহিত্যের মধ্যেই নাক গলিয়ে দেয়, তখন আর
এইসব ছড়ার সাহিত্যকীর্তি হিসেবে বিচার-বিশ্লেষণই বা বাদ থাকে কী করে !
রবীন্দ্রনাথের সুরে সুর মিলিয়ে এবার ছন্দবিশারদরাও ঝাঁপিয়ে পড়লেন
নিক্তি-পাল্লা নিয়ে৷ সেই যে শুরম্ন আজো পত্রিকার পাতায় লিখে চলছেন হাজার
হাজার লেখা৷ ১৩৪৮ বঙ্গাব্দে মোহিতলাল মজুমদার তাঁর 'বাংলা কবিতার ছন্দ'
গ্রন্থে ছড়ার ছন্দ নিয়ে বৈশিষ্ট্যময় মন্তব্য করেন- 'এই ছন্দের সাধারণ
রূপটির প্রধান উপাদান দুইটি- ১. ইহার ধ্বনিস্থানের সংখ্যা সর্বদাই চার,এবং
২. আদ্য বণের্র ঝোঁকটিকে সমৃদ্ধ করিবার জন্য ধ্বনিস্থানের উপযুক্ত অবকাশে
হসন্তের সনি্নবেশ৷'
ৃদাদখানি বেল,/ মুসুরির তেল,/ সরিষার কৈ,
চিনি-পাতা চাল,/ দুটা পাকা ডাল,/ ডিম-ভরা দৈ৷
ু(কাজের ছেলে/যোগীন্দ্রনাথ সরকার)
আমাদের দুইবাংলার ছড়া সাহিত্যের কথা বলতে গেলে বলতে হয়,উপেন্দ্রকিশোর,
অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর, প্রমথ চৌধুরী, সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত, সুকুমার রায়,
গুরুসদয় দত্ত, সুনির্মল বসু, অন্নদাশঙ্কর রায় অন্যতম ৷ তবে উলেস্নখিতদের
মধ্যে একমাত্র সুকুমার রায় ছাড়া আর কাউকেই আধুনিক ছড়া সাহিত্যের আদর্শ
হিসেবে অনিবার্য প্রভাব নিয়ে রাজত্ব করতে দেখি না আমরা৷ সুকুমার তাঁর ছড়ায়
যে হাস্যরস, স্যাটায়ার, হিউমার, ননসেন্স ইমেজ দিয়ে এক বিদ্রুপাত্মক
কৌতুকময় জগত্ গড়ে তুলেন, ছড়া সাহিত্যে সুকুমার ঘরাণা হিসেবেই তা
প্রতিষ্ঠিত হয়ে দাপটের সাথে এখনো রাজত্ব করে যাচ্ছেন৷ তিনি লিখেছেন-
সব লিখেছে এই কেতাবে দুনিয়ার সব খবর যত
সরকারী সব অফিসখানার কোন্ সাহেবের কদর কত৷
কেমন ক'রে চাটনি বানায়, কেমন ক'রে পোলাও করে,
হরেক রকম মুষ্টিযোগের বিধান লিখছে ফলাও ক'রে৷
ু(কি মুস্কিল!/আবোল তাবোল/সুকুমার রায়)
মাত্র ছত্রিশ বছরের স্বল্পায়ুর কারণেই কিনা জানি না, সুকুমার রায়কে ছড়া
সম্পর্কিত তাত্তি্বক কোনো আলোচনায় আমরা পাই না৷ অন্যদিকে দীর্ঘায়ু হবার
কারণেই হয়তো ছড়াকার হিসেবে সার্থকতা না পেলেও অন্নদাশঙ্কর রায়কে নিরেট
তাত্তি্বক আলোচনায় উঠে আসতে দেখি আমরা৷ অন্নদাশঙ্কর রায় যখন তাঁর
সমাজতত্ত্ব নিয়ে আবির্ভূত হন ছড়া-আলোচনায়, তখন তিনি আর ছড়ার লোকায়ত পর্যায়ে
নেই৷ সরাসরি চলে এসেছেন আধুনিক ছড়ার উঠোনে৷ অর্থাত্ আলোচনার একটা পর্যায়ে
এসে আমাদের পণ্ডিত ব্যক্তিগণ লোকায়ত ছড়াগুলো কীভাবে রচিত হয়েছে তার নমূনা
মাথায় রেখে আধুনিক ছড়া কীভাবে লিখিত হওয়া উচিত্ এই প্রাসঙ্গিক আলোচনায়ও
নিজেদের সমপ্রসারিত করে দেন৷ তিনি লিখেছেন-
তেলের শিশি ভাঙলো বলে
খুকুর 'পরে রাগ করো,
তোমরা সবাই বুড়ো খোকা
ভারত ভেঙে ভাগ করো
তার বেলা ?
ু(অন্নদাশঙ্কর রায়)
এখলাসউদ্দিন আহমদ সম্পাদিত 'ছড়ায় ছড়ায় ছন্দ'-এ ছড়ার রূপবিচার করতে গিয়ে
অন্নদাশঙ্কর তাঁর মতামতটা তুলে ধরেন এভাবে- 'ৃপুরাতন ছড়া যেন একটা ভাঙ্গা
আয়নার জোড়া দেওয়া এক রাশ টুকরো৷ একটাকে আরেকটার সঙ্গে খাপ খাওয়ানোর উপায়
নেই৷ কতকগুলি টুকরো বেমালুম হারিয়ে গেছে৷ কতকগুলিকে ভুল জায়গায় বসানো হয়েছে৷
সেই জন্যে সেই আয়না দিয়ে আমরা অতীতের মুখ দেখতে পাচ্ছিনে৷ পাচ্ছি একরাশ
ইমেজ৷ কিন্তু ধ্বনি মোটামুটি ঠিকই আছে৷ ছড়া মুখে মুখে কাটবার জিনিস,
লেখনীমুখে রচনা করবার জিনিস নয়৷ লেখনি তাকে ধরে রাখতে পারে, কিন্তু চোখ দিয়ে
পড়ার জন্যে নয়, কান দিয়ে শোনার জন্য৷ কান যদি বলে, এ ছড়া নয়, তবে এ ছড়া নয়৷
এ পদ্য৷ৃ' মজার ব্যাপার হচ্ছে অন্নদাশঙ্কর নিজেও ছড়ার নাম দিয়ে দীর্ঘ
বেয়ালি্লশ চরণের পদ্য লেখা থেকে নিজেকে নিবৃত রাখতে পারেন নি !
কী বিশাল নদী ! মাঝখানে চর
নাও থেকে নেমে হাঁটি বরাবর৷ৃ
(মামার বাড়ী যাওয়া/ ছোটদের ছড়া/ অন্নদাশঙ্কর রায়)
কলকাতা থেকে মার্চ ১৯৮০ সালে প্রকাশিত ধীমান দাশগুপ্ত সম্পাদিত সংকলন 'একশো
ছড়া'এ ছড়া বিষয়ে অন্নদাশঙ্কর রায়ের স্পষ্টোক্তি- 'ৃ কবিতার মতো ছড়ার
নির্দিষ্ট নিয়ম নেই, ছড়া বানাবার৷ ছড়া হয় আকস্মিক, ইররেগুলার৷ সেখানে আর্ট
আছে, আরটিফিসিয়ালিটির স্থান নেই৷ ছড়া হবে ইররেগুলার, হয়তো একটু আন্ ইভেন৷
বাকপটুতা, কারিকুরি নয়৷ কবিতা থেকে ছড়া আলাদা৷ ছড়াকে কবিতার মধ্যে ঢোকাতে
গেলে কবিতাকে ব্যাপ্ত করে নিতে হয়৷ কবিতা তো যে কোনো ভাবেই হয়, যে কোনো
ছন্দে, এমনকি গদ্যেও৷ ভাব ও ছন্দ তো থাকবেই, এ ছাড়াও ছড়ায় থাকবে ইমেজ ও মিল৷
ছড়ার ইমেজ মিল রেখে আসে না, পারম্পর্য কম৷ৃ ছড়া হলেই হালকা, সরস হবে তা কেন
? সব কিছু নিয়েই ছড়া হয়েছে, বীভত্স রস নিয়েও হয়েছে৷ৃ ইদানিং আমাদের ছড়া
সাহিত্যে কিছু হায়েনা আর শেয়ালের আগমন ঘটেছে৷ তারা আমাদের ছড়া সাহিত্যের
সময়কে অসময়ের মুখোমুখি করে দিতে উঠে লেগেছে৷ এই তালিকায় রয়েছেন একটি
বেসরকারী স্যাটেলাইট চ্যানেলের কয়েকজন কর্মকতর্া৷ তাদেরকে বাদ দিলে দেখা
যাবে ছড়া নিয়ে মনে প্রানে কাজ করছেন বেশ কয়েকজন ছড়া অনত্মপ্রান ছড়াকার্৷
কেননা, অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর ছড়াকে চিত্রশিল্প ও সংগীত শিল্পের দৃষ্টিতে
পর্যবেক্ষণ করেছেন৷ ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ লোকসাহিত্য সংক্রান্ত বিভিন্ন
রচনায় ছড়াকে বিজ্ঞানসম্মতভাবে বিচারের জন্য সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন৷
মুহম্মদ এনামুল হক সুকুমার সেনের মতো ছড়ায় লোকসাহিত্যের প্রাচীন রূপের
সন্ধান করেছেন৷ ডাক ও খনার বচন এবং মন্ত্রের সাথে ছড়ার পার্থক্য নির্দেশ
করতে গিয়ে তিনি তাঁর 'মণীষা-মঞ্জুষা' গ্রন্থে মন্তব্য করেন যে, ৃছড়ায় উপদেশ
নাই, চিত্র আছে৷ সৈয়দ আলী আহসান তাঁর 'কবিতার কথা ও অন্যান্য বিবেচনা'
গ্রন্থে লোকসাহিত্য প্রসঙ্গে ছড়া-নির্মাণের পদ্ধতিকে অসচেতন প্রয়াস মনে করে
মন্তব্য করেন যে, 'ৃ সচেতন বুদ্ধির কুশলতায় ছড়াগুলো নির্মিত হয়নি- এগুলো
অপরিমিত অবকাশের আনন্দ সঞ্চয়৷' আর নীলরতন সেন ১৯৭৮ সালে কলকাতা থেকে
প্রকাশিত সঞ্জীব সরকার সম্পাদিত 'লোকায়ত সংস্কৃতির পরিপ্রেক্ষিত ও রূপরেখা'
সংকলনে লোক কাব্যের ছন্দ বিষয়ে বলতে গিয়ে ছড়ার উচ্চারণ বৈশিষ্ট্যের দিকে
দৃষ্টি আকর্ষণ করেন- 'ৃছড়ায় আবৃত্তির সুর বা গীতের পঠন ভঙ্গি থাকায় তা
ঝোঁকালো, সুরাশ্রয়ী এবং উচ্চারণে দ্রুত সংকোচন-বিবর্ধন মাত্রিক৷ৃ স্বভাব
আবৃত্তির ব্যত্যয় এতে বাঞ্ছনীয় নয়৷ আমাদের ছড়া নিয়ে রয়েছে বিভিন্ন মতভেদ,
অলোচনা, সমালোচনাও৷ উদাহরন স্বরম্নপ বলা যায়, ক) ছড়া ও সঙ্গীতের পার্থক্য:
১. ছড়া আবৃত্তি বা ধ্বনিনিভর্র৷ অন্যদিকে সঙ্গীত তাল ও সুর নির্ভর৷ ২. ছড়ার
সুর একটানা বৈচিত্র্যহীন৷ অন্যদিকে সঙ্গীতের সুর বিচিত্র বা বৈচিত্র্যময়৷
খ) ছড়া ও শিশু-কবিতার পার্থক্য: ১. ছড়ার বিষয়বস্তু উদ্ভট, অসঙ্গত৷
শিশু-কবিতার বিষয়বস্তু সাধারণত সুসঙ্গত হয়ে থাকে৷ ২. ছড়ার আকার হ্রস্ব৷
শিশু-কবিতার আকার দীর্ঘও হয়ে থাকে৷ ৩. ছড়ার ছন্দ শ্বাসাঘাত প্রধান প্রাকৃত
বাংলা ছন্দ অর্থাত্ স্বরবৃত্ত৷ কিন্তু শিশু-কবিতার যে কোন ছন্দ হতে পারে৷
৪. ছড়ার পরিণতি আকস্মিক৷ অন্যদিকে শিশু-কবিতার পরিণতি সুষ্ঠু ও পরিকল্পিত৷
হাজার বছরের পথপরিক্রমায় ছড়ার যে ঐতিহ্যিক উত্তরাধিকার বহন করছি আমরা, তাকে
অক্ষত ও সুশৃক্সখল রাখার প্রত্যয়ে আমরা আসলেই কি সত্ ও আন্তরিক কিনা তা
এখনো স্পষ্ট হয়ে উঠেনি৷ তাহলে হয়তো আমাদের জন্য মানুষের ছদ্ম-পরিচয়ধারী
গরিলার মতোই ছড়ার নামে অছড়ার উত্পাত নিয়ন্ত্রণে অবশ্যই বাংলা ছড়ার
নির্ধারণসূত্রটাকে সুষ্ঠুভাবে ধারণ করা সম্ভব হতো৷ সেক্ষেত্রে উপরোক্ত
বৈশিষ্ট্যগুলোকে যদি আমরা ক্লাসিক ছড়ার শর্ত হিসেবে জুরি বানিয়ে নিই তাতে
বাংলা ছড়ার কোন ক্ষতি বৃদ্ধি ঘটবে কিনা বা প্রয়োজনীয় আইডেণ্টিটি তৈরি হবে
কিনা, তা হয়তো ভাবনার সময় হয়েছে এখন৷ এই ভাবনাই দেখিয়ে দেবে যার যার পথ৷ এই
পথই এনে দিতে পারে বিবেকের হারিয়ে যাওয়া আয়না৷ এই আয়নায় মুখ রেখে দেখে নিতে
পারেন প্রকৃত আর কৃত্রিমতার রম্নপ৷ আমাদের ছড়াময় আগামী গড়তে যা্রা
তারম্নন্যের স্রোতে পাল তুলে দিয়ে বর্তমানে কাজ করে যাচ্ছেন, তারা হলেন,
ছড়াকার পলাশ মাহবুব, নীহার মোশারফ, লোকমান আহম্মদ আপন, মোমিন মেহেদী, কামাল
হোসাইন, শানত্মা ফারজানা, সাজ্জাদ হুসাইন, ইশতিয়াক আহমেদ, মানিক চক্রবতর্ী,
উত্তম মিত্র, একে আজাদ, উত্তম বিশ্বাস, জসীম আল ফাহিম, পৃথি্বশ চক্রবতর্ী,
আনজুমান আরা রিমা, মুনীরা বিনতে ইউসুফ, নবীর হোসাইন, তানজিল রিমন, জামসেদ
ওয়াজেদ, মিলন সব্যসাচী, মঈন মুরসালিন, কাদের বাবু প্রমুখ৷ এই তালিকার
বাইরেও কিছু তথাকথিত ছড়াকার রয়েছেন, যাদের ছড়ার চেয়ে বড়গলাই বেশি শোনা যায়৷
কারন একুশ শতকের এই ছড়ার বিপস্নবঅ সময়ে দেখা যাচ্ছে 'চোরের মা'র বড় গলা'৷
আমরা এই বড় গলা থেকে বেরিয়ে এসে দেখতে চাই স্বণর্ালি সুখ আঁকা বাংলাদেশ৷
যেখানে 'ঘুম পাড়ানি মাসি পিসি মোদের বাড়ি এসো/খাট নেই পালঙ্ক পিড়ি পেতে
বসো'র মতো অসংখ্য ছড়া কাটা হবে প্রতিনিয়ত৷ করা হবে অন্যায়ের বিরম্নদ্ধে
ছড়ায় ছড়ায় প্রতিবাদ৷ এই প্রতিবাদ ঘরে বাইরে/ এই প্রতিবাদ খুব চাইরে/ ঠিক
তাদের-ই জন্য৷
mominmahadi@gmail.com
www.mominmahadi.blogspot.com
০১৭১২৭৪০০১৫
[প্রথমপাতা] |
|