দূতাবাস ও প্রবাসী কমিউনিটি
কাজী ইনসানুল হক
গেল বছর দুজন সাবেক দূতাবাস কর্মকর্তার জাপান সফরের সময় কমিউনিটির সাথে
সৌজন্য সাক্ষাৎকারের সুযোগ হলো জাপন বনিক সমিতির আতিথেয়তায়।
ব্যাক্তিগত সফরে জাপানে বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রদূত জনাব আশরাফ উদ্দৌলা
এসেছেন, তিনি সময় দিয়েছেন, সন্ধায় আমরা একসাথে বসতে পারি কিনা জানিয়ে বন্ধু
বাদল চাকলাদার ফোন করলেন। হা যাবো সিদ্ধান্ত নিলাম। আমার দীর্ঘ জাপান
প্রবাস জীবনে যে কজন রাষ্ট্রদূত কমিউনিটির সাথে সুসম্পর্ক রেখে এবং
প্রবাসীদের ভালবাসা নিয়ে বিদায় নিয়েছেন সেই সংখাটি হাতেগোনা বলে মনে হয়েছে।
জনাব আশরাফ উদ্দৌলা, জনাব মাসুদ বীন মোমিন. এই দুজনকে জাপান প্রবাসীরা মনে
রেখেছেন। ছোট খাট ভাল মন্দ ছাড়া এ দুজনের সময়ই দূতাবাস ও কমিউনিটির মধ্যে
চমৎকার সম্পর্ক বিদ্যমান ছিল। দূতাবাসের অন্যান্য কর্মকর্তারাও সবার প্রিয়
ছিলেন বলে তাদের বিদায়ে প্রবাসীরা ঘটা করে তাদের বিদায় জানিয়েছেন। কারো কারো
একাধিকবার বিদায় সম্বর্ধনা হয়েছে।
(ছবি আশরাফ উদ্দৌলা ও আবুল মনসুর)
বিশেষ দুটো কারনে বীর
মুক্তিযোদ্ধা আশরাফ উদ্দৌলাকে জাপান প্রবাসীরা মনে রাখবে কারন তিনি
বাংলাদেশ সরকারের বর্তমান নিজস্ব জমিতে আমাদের দূতাবাস স্থাপনের সিদ্ধান্ত
ও ব্যাবস্থা নিয়েছিলেন ও সরকারকে রাজী করাতে সক্ষম হয়েছিলেন। তার সময়ই জমির
রেজিস্ট্রেশন ও একাধিক কিস্তি পরিশোধ করা হয়েছিল। দ্বীতিয়ত তার
পৃস্টপোষকতায় জাপান প্রবাসী ব্যাবসায়ীদের প্রতিস্ঠান বাংলাদেশ চেম্বার অফ
কমার্স এন্ড ইন্ডাস্ট্রিজ জাপান প্রতিস্ঠা হয়েছিল। যদিও যে অভিপ্রায় নিয়ে
জাপানে বাংলাদেশের বণিক সমিতির প্রতিস্ঠা তা নানান কারনে কাংখিত লক্ষে পৌছতে
পারেনাই বলে প্রতিয়মান হয়।
বাংলাদেশ দূতাবাসের সাবেক কমার্শিয়াল কাউন্সিলর ও বর্তমান পেট্রবাংলার
চেয়ারম্যান জনাব আবুল মনসুর ফায়েজুল্লাহ রাষ্ট্রীয় কাজে জাপানে এসেছিলেন।
টোকিওতে শহীদ মিনার প্রতিস্ঠার সময় তিনি ও তখনকার দূতাবাসের অন্যান্য
কর্মকর্তাদের অবদানের কথা আমরা ভুলিনি। একজন চমৎকার মানুষ হিসেবে তিনি
জাপান প্রবাসীদের প্রিয়জন। জাপান বনিক সমিতি আয়োজিত অনুস্ঠানে তাকে শুভেচ্ছা
জানাতে প্রবাসীদের ঢল বসে গিয়েছিল।
দুজনার সাথে সৌজন্য সাক্ষাৎ এর উদ্দেশ্যে বেশ অনেকেই এসেছিলেন। সবাই মিলে
মতামত শেয়ার করেছি। দুজনেই বারবার বলেছেন, দূতাবাস নিয়ে কোন আলোচনা যেন আমরা
না করি। আর দূতাবাস আপনাদের প্রবাসে বাংলাদেশ। রাষ্ট্রদূত সহ দূতাবাসের
সবাই এক অর্থে আপনাদের অতিথী। তাই দূতাবাস ও কমিউনিটির মধ্যে
সৌজন্য সম্পর্ক রাখা উভয়ের জন্য মঙ্গলজনক। দূতাবাসের সাবেক এই দুজন প্রিয়
মানুষের সান্নিধ্যে দুটো আনন্দঘন সন্ধ্যার স্মৃতি জাপান প্রবাসী কমিউনিটির
সুখ স্মৃতি হয়ে থাকবে।
জাপান প্রবাসীরা ভালবাসতে, আপন করে নিতে জানে আবার উন্নাসিক মানষিকতার
দূতাবাস কর্মকর্তাদের অবজ্ঞা করতেও জানে। মনে আছে দূতাবাসের একজন অফিস
সহযোগী, নাম হেনরী হঠাৎ অসুস্থ হয়ে কর্মক্ষম হলে জাপান প্রবাসীরাই সবাই
মিলে তার চিকিৎসা ও কিছু নগদ অর্থ ফিক্সড ডিপোজিটের ব্যাবস্থা করে তাকে দেশে
পাঠানোর ব্যাবস্থা করে।
বাংলাদেশের জাতীয় দূর্যোগে প্রবাসীরা দল মত নির্বিশেষে সহায়তার হাত প্রশস্ত
করেছে। স্বল্প সময়ের প্রস্তুতিতে বাংলাদেশের বন্যা, সিডর ও আইলা -তে নগদ
অর্থ সংগ্রহ করে বাংলাদেশে ত্রান তহবিলে পাঠানো হয়।
২০১১ সালের ১১ মার্চ, নয় মাত্রার ভূমিকম্প ও স্মরনকালের ভয়বহ ৎসুনামীর সময়
সর্বপ্রথম বাংলাদেশ দূতাবাস-কে টোকিও থেকে সরিয়ে ফেলার হঠকারী সিদ্ধান্ত
নিয়ে তৎকালীন পররাস্ট্র মন্ত্রী দীপু মনি ও রাস্ট্রদূত মজিবর রহমান ভূইয়া
নিন্দিত হলেও কমিউনিটি নেত্রীবৃন্দ দূতাবাসের পাশে দাড়ান। ১৩ মার্চ
দূতাবাসের কনফারেন্স রুমে সমবেত হন। দূতাবাসে ইমারজেন্সি সেল খোলা হয়। জরুরী
খাদ্য সামগ্রী নিয়ে প্রবাসীদের পক্ষ থেকে মাসুদূর রহমান মাসুদ, দেলওয়ার
হোসেন ও দূতাবাসের পক্ষ থেকে মাসুদুর রহমান ও নাজমুল হূদা বড় একটি বাস ও
দুটো সিডান কার নিয়ে শত প্রতিকুলতা উপেক্ষা করে দূর্গত মিয়াগী অঞ্চলে গিয়ে
আটকে পড়া প্রায় ষাট জন প্রবাসীকে টোকিওতে নিয়ে আসেন। প্রবাসীরাই, বিশেষ করে
গাড়ী ব্যাবসায়ীরা তাদের নিজবাড়ীতে ভাগাভাগী করে আশ্রয় দেন। মসজিদেও কারো
কারো আশ্রয়ের ব্যাবস্থা করা হয়।
জাপানে শহীদ মিনার প্রতিস্ঠা লগ্নে কিছু কার্যক্রমে তৎকালীন রাষ্ট্রদূত
কমিউনিটির বিরাগভাজন হন ও বিদায়লগ্নে প্রকাশ্যে ক্ষমাপ্রার্থনা করে নিরবে
তাকে জাপান ছাড়তে হয়। এক রাষ্ট্রদূতকে সাংস্কৃতিক অনুস্ঠানে প্রকাশ্য
অপমানিত করা হয়েছিল সেই গর্হিত কাজটি প্রবাসী হিসেবে এখনও আমাদেরকে লজ্জা
দেয়। বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীদের সহযোগী একজন কুটনীতিককে দূতাবাসের ভিতরেই ঘৃনা
জানানো হয়েছিল। সেই কবে জাপানে ছিলেন এবং এখন দুনিয়া থেকে বিদায় নিয়েছেন
সেই মিজারুল কায়েসের কথা এখনও জাপান প্রবাসীরা শ্রদ্ধার সাথে স্মরন করে।
একথা সত্য, প্রজাতন্ত্রের কর্মী হিসেবে নিরপেক্ষ ও নির্মোহের আদর্শবানী সহ
কাগুজে অংগীকারের মধ্যেও ক্ষমতাসীন সরকারের দলীয় আন অফিসিয়াল নির্দেশ
অমান্য করলে তাদের পোস্টিং, প্রমোশন সবই খুইতে হয় তাই সরকার পরিবর্তনের সাথে
সাথে তারা রাতারাতি "জিয়ার সৈনিক" থেকে "বঙ্গবন্ধুর আদর্শ" হয়ে ওঠেন এবং
ভাইস ভার্সা।
লুৎফর রহমান রিটন
মনে পড়ে আমাদের বন্ধু
আওয়ামী ঘরানার বলে পরিচিত ছড়াকার লুৎফর রহমান রিটন টোকিওতে প্রথম সচিব হয়ে
এলেন তখন দূতাবাসের সবাই বঙ্গবন্ধুর নিবেদিত প্রান। কমাসের মধ্যে সরকারের
পরিবর্তন হলো। বি এন পি ক্ষমতায় এলো, রাতারাতি রাষ্ট্রদূত থেকে সবাই
জাতীয়তাবাদী হয়ে গেলেন। দূতাবাসে রিটনের চেয়ার উঠিয়ে দেয়া হলো, তার বাসা
ভাড়া বন্দ করা হলো, বেতন বন্দ। মেয়ে নদীর স্কুল বন্ধ হবার উপক্রম। রিটনের
স্ত্রীর তখন মারাত্নক অসুস্থ, অপারেশন উত্তর সময়ে রিটনের সে অবস্থার সাক্ষী
আমরা কজন। বিল পরিশোধ করতে পারবেনা বলে ডিসেম্বরের প্রচন্ড শীতে হিটার না
জ্বালিয়ে এক রুমে সবাই জবুথবু। রিটন তার বাড়ীর দরজায় "বাস্তুভিটা" নামকরন
করে সাটিয়ে দিয়েছিলেন। রিটন "কল ব্যাক" এর অপেক্ষায়। টিকেট আসবে, দেশে যাবে।
অবশ্য সেই না যাওয়াটাই তার জন্য মঙ্গল হয়েছে। নইলে রিটনের ভাগ্যে "ডিম
থেরাপী" বরাদ্ধ ছিল।
মনে আছে বি এন পি জামানায় টোকিও সফরে এসে তারেক রহমান আমাদের দূতাবাসকে
দলীয় কার্যালয়ের মত ব্যাবহার করেছেন, সঙ্গে ছিলেন মাহমুদুর রহমান।
আজ দূতাবাসের সবাই "আওয়ামী যোদ্ধা"। অনেকের মতে জাপানস্থ বাংলাদেশ দূতাবাস
এখন "দূতাবাস লীগ"৷ বর্তমান রাষ্ট্রদূত কে ধন্যবাদ তিনি 'স্ট্রেইট', কোন
ভান নেই, ভনিতা নেই। শতভাগ দলীয় আনুগত্য। লীগের বাইরে কাউকে দূতাবাসে চাননা।
টকশো, সেমিনার করেন সেখানে অংশগ্রহনকারী সবাই
একদলের একমতের। ২০১৬ সালের ডিসেম্বর মাসে বর্তমান রাষ্ট্রদূত ব্যাক্তিগত
ছুটিতে জাপানের বাইরে থাকায় জাপানস্থ বাংলাদেশ দূতাবাসে ১৬ই ডিসেম্বর এর
জাতীয় অনুস্ঠানটি দু'সপ্তাহ পর ৩০শে ডিসেম্বর পালন করার ঘটনাও আছে।
দূতাবাসের আয়োজিত একটি জাতীয় অনুষ্ঠানে একটি অপ্রিতিকর ঘটনার জন্য
রাষ্ট্রদূত, ক্ষমতাসীন দ্'জন দলীয় কর্মীকে দূতাবাস থেকে বের করে দিয়েছিলেন
৷ পরে ঢাকার নির্দেশে তাদের একজনকে তিনটি করে আমন্ত্রন পত্র পাঠান।
প্রবাসীদের আয়োজিত কোন অনুস্ঠানে আমন্ত্রন পেলে ব্যাস্ততার অজুহাতে না আসার
রেকর্ড বেশী। উদাহরণস্বরূপ ২০১৭ সালের ২১ শে ফেব্রুয়ারী উপলক্ষ্যে জাপান
কমিউনিটির আয়োজিত অনুষ্ঠানের ২৯ মিনিট পূর্বে একজন কর্মকর্তার মাধ্যমে একটি
ফোনে জানালেন যে, রাষ্ট্রদূত ব্যস্ততার কারনে যেতে পারবেন না ৷ জাতীয়
অনুস্ঠানে রাষ্ট্রদূতের প্রতিনিধি হিসেবে দূতাবাসের কর্মকর্তাই পাঠান।
কিন্তু অতি দূঃখজনক হলেও বাস্তব সত্য যে, রেস্টুরেন্ট উদ্বোধনীর জন্য টোকিও
থেকে অনেক দূরে যাওয়ার ঘটনাও আছে ৷
বিষয়টা অপমানজনক, প্রধান অতিথী হিসেবে সেই তরুন কর্মকর্তার পাশে বিশেষ অতিথী
হয়তো একজন মুক্তিযোদ্ধা অথবা জাপানী সাবেক রাষ্ট্রদূত।
সাংবাদিকদের প্রয়োজন নেই, নব্য একজন সাংবাদিককে আমন্ত্রন করেন, তিনি একই
নিউজ খ্যাত অখ্যাত চ্যানেল ও অনলাইন টিভি ও পত্রিকায় প্রচার করেন, জাপানের
যে বাংলা পোর্টালগুলো কমিউনিটির সেবা দিয়ে আসছে তাদের কাছে দূতাবাস কখনও
কোন জরুরী খবর, নির্দেশ প্রকাশ করতে দিয়েছেন তা জানা নেই।
বঙ্গবন্ধুর উপর একটি প্রকাশনার সময় একটি পোর্টাল সম্পাদক নিজে উপস্থিত থেকে
নিউজটি করবার আগ্রহ প্রকাশ করলে তাকে অনুমতি দেয়া হয়নি, বলা হয়েছে কোন
সাংবাদিক আমন্ত্রন করা হয়নি অথচ সেখানে সাংবাদিক সহ অনেককে দেখা গেছে।
তথ্য কর্মকর্তা হিসেবে একজন নিয়োগ পেয়েছেন, তিনি প্রচারের দায়িত্ব পালন
করেন। বিভিন্ন মিডিয়াতে প্রেস রিলিজ টাইপের সংবাদ পাঠান। জাতীয় দিবস গুলোতে
জাপানের পত্রিকায় বিজ্ঞাপন হিসেবে বাংলাদেশের প্রচার দেখি। মূলধারার কোন
পত্রিকায় বাংলাদেশকে নিয়ে যে দু' একটা নিউজ, ফিচার দেখি তা জাপানীদের তৈরী।
দেশের জন্য বর্তমান দূতাবাসের প্রচেষ্টা আছে অনেক। কাজও যে হচ্ছেনা তা নয়।
গুলশান ট্রাজেডির পর জাপানীদের মাঝে আস্থা তৈরীর কঠিন দায়িত্বটা সামলানোর
জন্য তিনি ধন্যবাদ পেতে পারেন। তবে আগে থেকে চলমান কিছু কাজের কোন অগ্রগতি
নেই। নাগাসাকি শান্তি পার্কে বাংলাদেশের শান্তির ভাস্কর্য স্থাপনের কাজটি
বন্ধ। জাপান বাংলাদেশ বিমান সার্ভিসের কোন খবর নেই। ইন্টার্নী ভিসায় আসা
কর্মীরা কেন পালিয়ে যাচ্ছে এবং এই সুযোগটা কেন সংকুচিত হচ্ছে তার জন্য কোন
ব্যাখ্যা জানা নেই।
জাপান আপাতত সাড়ে তিন লক্ষ এবং ২০২৫ এর মধ্যে পাঁচ লক্ষ শ্রমিক নেবে ৷
দূর্ভাগ্য, বাংলাদেশ এই লিস্টে নেই। এটা কুটনৈতিক ব্যার্থতা, এই ব্যার্থতার
দায় বর্তমান রাষ্ট্রদূতকেই নিতে হবে।
প্রবাসী কমিউনিটিকে দূতাবাসের অবজ্ঞার সর্বশেষ উদাহরন-
আমাদের প্রানপ্রিয়
টোকিওর শহীদ মিনারটি এখন আর আগের যায়গায় নেই, সরিয়ে ফেলা হয়েছে। টোকিও
অলিম্পিক ২০২০ উপলক্ষে সেখানে নির্মান কাজ চলছে। তশিমা-কু কতৃপক্ষ নিশ্চয়ই
দূতাবাসের জ্ঞাতসারে সব করছেন। দূতাবাসের কি উচিত ছিলনা, শহীদ মিনারটি নতুন
করে কবে কোথায় কখন প্রতিস্থাপন করা হবে সে বিষয়ে তথ্য প্রবাসীদের জানানো?
এই দায়িত্বহীনতার জবাব কি?
এখনও সময় আছে, প্রধানমন্ত্রীর কাছে অনুরোধ, পররাষ্ট্র মন্ত্রী সমীপে আবেদন,
যোগ্য ও অভিজ্ঞ কাউকে জাপানে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত করুন, অকর্মন্যরাই
দলবাজী করে সরকারের ভাবমূর্তির
বারোটা বাজায়।
টোকিও
১৩ ফেব্রুয়ারী ২০১৯
kaziensan@gmail.com
|