[প্রথমপাতা]

 

 

 

 

 

প্রিয় বন্ধু বদরুলের সায়োনারা জাপান

  

কাজী ইনসানুল হক
 

 

২২ নভেম্বর, ২০১১ বন্ধুবর বদরুল জাপানে তার ২২ বছরের প্রবাস জীবনের ইতি টেনে স্বদেশে ফিরে যাবে। 'স্থায়ী বাসিন্দার সনদ' ও স্থায়ী চাকুরি -সব ছেড়ে তার এই স্বদেশ ফেরা। বদরুলের ভাষায়...জাপানের কাছে আমি চির ঋনী, আমি অনেক পেয়েছি, অনেক শিখেছি এ দেশটির কাছ থেকে। তবে সন্তানদের কথা ভেবেই আমার এই ঘরে ফেরা। ওদের এদেশেই জন্ম তবে ওদের পড়াশোনা ও ভবিষ্যতের কথা ভেবেই ওদেরকে দেশে পাঠিয়েছিলাম, এবার আমিও যাচ্ছি। বাকীটা সময় সবাই একসংগে থাকবো বলে...।
 

প্রিয় বন্ধু বদরুলের এই বিদায়ে বুকের গভীরে মুচড়ে ওঠে। গত রাতে চোখে ঘুম আসেনি, বারবার বদরুলের চেহারাটা মনের পর্দায় ভেসে ওঠে। কাল থেকে বদরুলের মোবইলে আমার মোবইলে ইচ্ছে করলেও সংযোগ ঘটাতে পারবে না। ওর মেইল মেসেজ থেকে ......আপনি কই? আমি সজলদা, জিকো, আরিফ, তুহিন শিবুয়ায়, আপনি মুনির সহ আসেন, জুয়েল কাজ শেষে আসবে..... এরকম মেসেজ আর আসবে না, কোনো শর্টমেসেজে আর বদরুল জানান দেবেনা .....আমি আছি।

 

এই প্রবাসে আমরা ২০-২৫-৩০ বহর , রক্ত সম্পর্কহীন এই প্রবাসীরাই আমাদের নিকটজন। আপদ বিপদে একজন আরেকজনের কাছাকাছি, সম্পর্কের গভীরতা রক্ত সম্পর্কের চেয়েও কোনো অংশে কম নই বরং বেশি। প্রিয়জন বঞ্চিত ভিনদেশে আমরা বেছে থাকি একজন আরেকজন কে অবলম্বন করেই।
 


গত দেড় যুগ বলতে গেলে প্রতি রোববার ও মাঝেমধ্যে শনিবার কিংবা জাতীয় ছুটির দিন আমরা কজন একসঙ্গে যেকোনো অনুষ্ঠানে, যে কোনো দাওয়াতে , কিংবা জাপানে আসা কারো স্বজনদের উপলক্ষে বদরুল-সজল-ইনসান-জুয়েল -মুনির-জিকো-আরিফ-তুহিন, অস্থ পান্ডবের সারম্ভর উপস্থিতি। টোকিও মটর শো, বুক ফেআর, ফিল্ম শো সবখানে , একসাথে, দলবেধে। অনুষ্ঠান শেষে কোনো কফি সপ কিংবা ফামিলি রেস্টুরেন্টে মধ্য রাত অব্দি আড্ডা। শেষ ট্রেন এ ঘরে ফেরা। ট্রেন এ উঠবার আগেও প্লাটফর্মে দাড়িয়ে শেষ ট্রেন এর শেষ হুইসেলের অপেক্ষা। আবার এক সপ্তাহের প্রতিক্ষা। বাংলায় প্রাণ খুলে কথা বলার অপেক্ষা, কোথাও যেতে হলে দলবধে, একসাথে, বড় কোনো স্টেশনে অপেক্ষা, বদরুল সময় মত হাজির , সজলদা ও আমি , মুনির , জুয়েল কখনো সময়মত কখনো ১০-১৫ মিনিট লেট ,তুহিন ,আরিফ স্বাভাবিক তবে লেট লতিফ জিকো , ঘরে বসেই দিব্বি চালিয়ে দেয় ..এখন স্টেশনে কিংবা ভুল ট্রেন এ উঠেছিলাম ......তুহিন আর জিকোর ১০ মিনিট পর ওয়াশ রুমের অছিলায় বাইরে যাওয়া আর ফুক ফুক ধোঁয়া উড়িয়ে টোকিওর বাতাসে কার্বন ছড়ানো।

 

পুরো সময়টা আমরা মেতে থাকি আড্ডায়। আড্ডার বিষয় নানাবিধ, তবে অতীত স্মৃতি চারণেই বেশি। সাহিত্য , লেখালেখি নিয়েও কথা হয় অনেক, বদরুলের ছড়া , জুয়েলের আবৃতি ,পরবাস মাগাজিন নিয়েও অনেক কথা হয়। নতুন বিষয় নতুন কোনো ভাবনা। নতুন কোনো বিষয় নিয়ে অনুষ্ঠান ,সেমিনার করার আইডিয়া কিন্তু এই আড্ডা থেকেই, জিকো নিমিষেই পোস্টার , ব্যানার বানিয়ে ফেলে , মুনিরের আর্ট সেন্স কাজে লাগে , সজলদরা সুন্দর গদ্য একটা ছক তৈরী করে । পরচর্চা কিংবা রাজনীতি নিয়ে অনর্থক সময় অপচয়ের কিছুটা হলেও আমরা কমিয়ে ফেলেছি এই আড্ডা থেকেই। মাঝে মধ্যে চাচা-ভাতিজা আর মামা-ভাগনার তর্ক আমাদের বাড়তি আনন্দ দেয়। বদরুল আমাদের মাঝে সব চেয়ে বাতিক্রম। ওর সাথে কারো কখন ঝগড়া -কথা কাটাকাটি হয়েছে বলে জানা নেই । কম কথা বলে তবে ওর উপস্থিতি আড্ডাকে প্রাণবন্ত করে তোলে। নববর্ষের প্রথম দিন আমরা কজন একাধিকবার শিনকানসেন আওমোরি, নিগাতা, মরিওকা , হাকোদাতে ভ্রমন করেছি । জাপানের অনেক প্রত্যন্ত অঞ্চলেও এক রাতের জন্য ঘুরতে গেছি । সারা রাত জেগে সুধু আড্ডা আর আড্ডা ।

 

জাপানের কমিউনিটিতে বদরুল একজন সজ্জন বাক্তি , তাকে সবাই পছন্দ করে । তার বিদায়ে তাই আনুষ্ঠানিক ভাবে অনেক সংগঠন তাকে বিদায় সম্বর্ধনা দিয়েছে , অনেকে তার বিদায় চোখের জল লুকাতে পারেনি । একজন ছড়াকার, একজন লেখক আমাদের বন্ধু বদরুলের এই পরিচিতি আমাদেরকেও মর্যাদাবান করেছে। তাকে নিয়ে আমাদের এটাই অহংকার ।

 

অফিস শেষে আমি আজ ছুটে গেছি ওর কাছে , ওর স্টেশন শিবুয়ায় , দিনভর পরিশ্রমে বদরুল ক্লান্ত , তারপরেও আমরা একখানে বসলাম, খেলাম, কিছু কেনাকাটা করলাম , চির চেনা হাচিকোর সামনে আমার মোবইলে ওর শেষ ছবি তুললাম, একজন আমাদের দুজনের একসাথে ছবি তুলে দিল , বিদায় বেলায় স্টেশনের গেটে আমরা দুজনকে বুকে জড়িয়ে ধরলাম, অনেক্ষণ চুপচাপ । না চোখে পানি আসে নি , বুকের পাজরে কোনো সানাই বাজে নি , তবে কি যেন হারানোর একটি সকরুণ আর্তি আমাদের দুজনকে জানিয়ে দিল এটাই নিয়তি। মাথা নামিয়ে আমরা দুজনেই ট্রেন এ ঢুকে গেলাম । এই প্রথম , শেষ ট্রেন , শেষ হুইসেল এর অপেক্ষা নয়, আমরা সময়ের অনেক আগেই যে যার ট্রনের আশ্রয়ে লুকালাম ।
বন্ধু বিদায় ।

 

[প্রথমপাতা]