[প্রথমপাতা]

 

 

 

ঘরের পাশে যেন জয়নুল!

 


কাজী ইনসানুল হক

২০১১ সালের জাপানে ভয়াবহ সুনামির পর অফিস কর্তৃপক্ষ জানিয়ে দিল, সুনামিসৃষ্ট অনিশ্চিত অর্থনৈতিক সংকটের কারণে বাসাভাড়ায় ভুর্তকি আর দেওয়া হবে না। অর্থাৎ, হয় নিজ পকেট থেকে পুরো বাসাভাড়া দিতে হবে অথবা বাসা বদলে কিছুটা অর্থের সাশ্রয় করতে হবে।
সিদ্ধান্ত নিলাম বাসাই বদলাব। প্রায় দুই যুগ কোম্পানির বাসায় ছিলাম। নানা নিয়মকানুন। পান থেকে চুন খসলেই সমস্যা। বয়সের ভারে ন্যুব্জ বৃদ্ধা কানরি সান (বিল্ডিং ম্যানেজমেন্ট কোম্পানির প্রতিনিধি) প্রতিনিয়ত জ্ঞান দেন।
জাপানে বাসা বদলানোর নানা ঝক্কি। অগ্রিম ও কি-মানি আলাদা খরচ। বাসা খোঁজা সময়সাপেক্ষ। ফুদোসান (হাউজিং এজেন্ট) কয়েকটা বাসা দেখালেন। একটা পছন্দ হলো। কিন্তু মূল মালিক হয়তো বলে দিলেন বিদেশিদের ভাড়া দেবেন না। সব পরিশ্রম বৃথা গেল।
এই বিদেশি আবার বিশেষ বিদেশি। সাদা গাত্রবর্ণ ভিন্ন ব্যাপার। এশিয়ানদের ব্যাপারে বাড়ির মালিকদের নানা অভিযোগ। কারিখেকোদের ঘর নোংরা হয়। গোটা এলাকায় মসলার গন্ধ। চীনারা একজনের ঘরে পাঁচ-ছয়জন থাকে ইত্যাদি।
আমার বন্ধু জাহিদের পরিচিত জাপানি এক ফুদোসানকে জানালাম বাসার খোঁজ দিতে। তাঁকে বললাম, স্টেশন থেকে যেন ১২ থেকে ১৫ মিনিটের হাঁটাপথের দূরত্বে হয়। তিনি হেসে বললেন, সবাই কাছাকাছি থাকতে চায়, স্টেশন থেকে বেশি দূরে কেউ যেতে চায় না। যত দূর, ভাড়া তত কম; যত কাছে, তত বেশি। ১০ মিনিট দূরত্বের মধ্যে অন্তত ২৫টি বাসার কাগজপত্র দিয়ে বললেন, দেখুন, কোনটি আপনার পছন্দ।
ফুদোসান আমাকে বলেছিলেন, কমপক্ষে ৫০টি বাসা না দেখে নাকি জাপানিরা বাসা বদলায় না। ছয় মাস চলে যায় এই বাসা দেখাদেখি নিয়ে। আমার বেলায় সেটি হলো না। না দেখেই বাসা চূড়ান্ত হলো। সেটা বেশ মজার।
এক রোববার ফুদোসানের প্রতিনিধি আমাকে বাড়ি দেখাতে নিয়ে গেলেন। বাড়ির মালিক বেশ দূরে থাকেন। তাঁর আসতে একটু দেরি হবে। তাঁর অপেক্ষায় আমরা বাড়িটির কাছে পার্কের পাশে গাড়ি থামালাম। গাড়ির ইঞ্জিন বন্ধ করে পার্কের ভেতর তাকিয়ে একটা ভাস্কর্য দেখে চমকে উঠলাম। প্রায় ছুটে গেলাম পার্কের ভেতরে। ছায়া সুনিবিড়, পল্লভশোভিত নির্জন পার্কের এক কোনায় ওই ভাস্কর্য।
আমার চমকানোর কারণ, আমাদের শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনের চিত্রকল্পের সঙ্গে পার্কের ওই ভাস্কর্যের মিল দেখে। জয়নুল আবেদিনের লড়াই বা সংগ্রামের (দ্য স্ট্রাগল) ভাব-ধারণা নিয়ে নির্মিত এবং সোনারগাঁ লোকশিল্প জাদুঘরে সংরক্ষিত কাদায় আটকানো কাঠবোঝাই গরুর গাড়ির চাকা ঠেলা গাড়োয়ানের সেই বিখাত ভাস্কর্যের অদ্ভুত মিল। এটিও কাঠবোঝাই, তবে হাতে টানা গাড়ি, সামনে চালক, ভার টানছে, পেছনে স্ত্রী ও সন্তান ঠেলছে। জয়নুল আবেদিনের চালক কাদায় আটকানো গাড়ি ঠেলছে আর জাপানের চালক পাহাড়ের উঁচুনিচু সামাল দিচ্ছে। দুজনেই কর্মঠ, জীবন সংগ্রামের কঠিন বাস্তবতার প্রতীক। একই লড়াই, একই সংগ্রাম, দেশ দুটো আলাদা—জাপান আর বাংলাদেশ। ওশিন আমলের এই ছবি এখন জাপানিদের জাদুঘরে ঠাঁই নিয়েছে আর আমরা এখনো নিরন্তর লড়াই করছি।
এলাকাটি টোকিওর ইতাবাশি ওয়াডের তকুমারু। পাহাড়ি উঁচুনিচু এলাকা। সামান্য সমতলে চাষাবাদ। ভাস্কর্যটি অতীত দিনের জাপানিদের যাপিত জীবনের এফিটাফ। নাম মিদোরি নো মিচি। ৩০ বছর আগে এই পার্কে ভাস্কর্যটি বসানো হয়েছে। কোনো নির্দিষ্ট ভাস্করের নাম জানা যায়নি, তবে যাঁরা এই কর্মযজ্ঞে ছিলেন, সবার নাম খোদিত আছে।
বাসা না দেখেই সিদ্ধান্ত নিলাম, এখানেই থাকব। ঘরের পাশে জয়নুল আবেদিন, ঘরের পাশে বাংলাদেশ প্রতিদিন। প্রায় দুই বছর কাটল এই বাসায়। স্টেশন থেকে দূরে। পাহাড়ের উঁচু পথ, প্রতিদিন পথ ভাঙার ক্লান্তি; না, কোনোটাই তত কষ্টের নয়। বাড়তি পাওনা, প্রতিদিন ভোরে জানালা খুললেই দূরের ফুজি পাহাড় দেখা যায়। টোকিওর দোতলা বাসার দোতলা থেকে ফুজি দেখা যায়, বিশ্বাস করানো কঠিন। কিন্তু এটাই সত্যি। ফুজি পাহাড় দেখার জন্য আমন্ত্রণ।

কাজী ইনসানুল হক, টোকিও
kaziensan@gmail.com

 

 

WARNING: Any unauthorized use or reproduction of 'Community' content is strictly prohibited and constitutes copyright infringement liable to legal action.  

[প্রথমপাতা]