|
ধারাবাহিক উপন্যাসঃ
কাক-জ্যোৎস্নায় কাক-ভোর (পর্ব-২৭)
শাশ্বত
স্বপন
পরের দিন সকালবেলায় ক্ষত-বিক্ষত অবস্থায় কালীকে পাটক্ষেতের স্যাঁতস্যাঁতে
মাটির উপর পাওয়া গেল। পুরোপুরি নগ্ম সে। নখ আর দাঁতের আঁচড়ে স্তন্য আর উরু
কালচে দাগে ভরে আছে। অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছে সে। যে ভালোবাসা, যে যৌনস্বাদ সে
পাশার কাছ থেকে পেতে চেয়েছিল, সে স্বাদ ৯জন পুরুষের কাছ থকে বিভৎস্যভাবে
পেয়েছে। ওরা প্রতিশোধ নিয়েছে, ভয়ঙ্কর প্রতিশোধ। দেমাগ দেখানোর প্রতিশোধ,
দেহের স্বাদ স্বেচ্ছায় না দেবার প্রতিশোধ, কালীপদের সাক্ষ্য দেবার প্রতিশোধ,
লুকায়িত পতিতা হবার প্রতিশোধ। জীবনে আর কালীকে স্বামী পেতে হবে না--আর
পেলেও মা হতে হবে না। এটা বর্তমানের নয়,এ ঘটনা '৭১ এর আগেও ছিল,৭১ এর পরেও
আছে; হয়তো কখনো কম, কখনো বেশী। কালী মরেনি, কালীরা কখনও মরে না।
চারদিকে আজ অসংখ্য মানুষের কোলাহল। কালীর আজ 'কালী' পূজার অধিবাস। চারদিকে
যেন ঢোল বাজছে। অসংখ্য ঢোল, বাঁশি, কাশি, ঘন্টা বাজছে।ব্রাক্ষনেরা ছুটছে
কালীর মন্দিরে। কালী দেবী কালির মত নগ্ন হয়ে আছে। অসুরদের সাথে যুদ্ধ করে
ক্ষত-বিক্ষত হয়ে গেছে। ব্রাক্ষনেরা আহত কালীকে মন্দিরে নিয়ে আসল। কুমারকে
দিয়ে ক্ষত সারান হল। তারপর শুরু হল পূজা। কালীকে দেখতে মানুষ আসছে আর যাচ্ছে।
পুলিশ ঘন ঘন আসছে। সাংবাদিক পাগলের মত খবর সংগ্রহের নেশায় ছুটে চলেছে কালীর
মা-বাবা, ঠাকুমা, আত্নীয়-স্বজন, আরও গন্যমান্য ব্যক্তিদের কাছে। কালী যে
কয়েকজন ধর্ষকের নাম বলল, তারা সবাই চেনা-জানা মানুষ । এখন যেন তারা এক একজন
অসুর বনে গেছে। এখন দরকার সত্যিকারের কালীকে, এখন দরকার দেবী দূর্গাকে,
নারীরা একজন কালী চায়, নারীরা একজন দূর্গা চায়।
কালীর ছবিসহ পুরো ঘটনা পেপারে ছাপানো হয়েছে। আগাছার মত বেড়ে উঠা ডজন ডজন
দৈনিক, দিস্তা দিস্তা সাপ্তাহিকে কালীর ধর্ষন ঘটনা ছাপানো হয়েছে। পুলিশ
প্রশাসনের কানে ঝাঁ ঝাঁ শব্দে ফোন আর কটুকথা কম্পীত হচ্ছে। রাত আর দিনের
ঘুম সমান হয়ে গেছে। ডান হাত কাজ করতে বলছে, বা হাত নিষেধ করছে। প্রশাসনের
অবস্থা কুল রাখি না শ্যাম রাখি। ডান হাতের চেয়ে বা হাতের পাল্লা ভারি হচ্ছে।
সারাদেশ জেনে গেছে। ক্ষমতাসীন ও বিরোধি দলের টনক নড়ছে। তারপর শ্লোগান ...।
তারপর ঘুম। সবাই ক্লান্ত। নারীবাদিরা আর কি করতে পারে। তাদেরও তো সংসার আছে।'
নিজের খেয়ে বনের মোষ তাড়ান' --মুখে যতটুকু বলা যায়--কর্মে ততটুকু দেখানো
যায় না। টেলিযোগাযোগের উন্নতির ফলে আসতে আসতে সব স্তিমিত হয়ে যায়। তারপর
কখন, কোথায়, কবে কোন বন ফুল ঝরে গেল আকাশ যেমন সুবিশাল স্মৃতি ধারক হয়েও মনে
রাখে না, তেমনি মনে রাখে না পৃথিবীর মানুষ। মনে রাখে না সমাজ, মনে রাখে না
সময়। এরকম ঘটনা প্রতিনিয়ত ঘটছে। এ যেন এক নরমাল ঘটনা। এখানে অবাক হবার
বিছুই নেই। ঘটনা যদি কিছু থাকে, তবে তা ঘটবেই। কালীর ঘটনা ছিল, তা ঘটে গেছে।
স্রষ্টা আছেন। একজন গেছেন আর একজন পাঠাবেন । নারীর তো আর কমতি নেই। নারী
আসবেই এবং পরিবেশে তার বাঁচার অভিযোজন ক্ষমতা পুরুষের চেয়ে যেহেতু বেশি তাই
সে বেঁচে থাকবেই, ঘটনা ঘটবেই। এ যেন, The sun rises in the east and set in
the west.
দীর্ঘ এক মাস কালী হাসপাতালে মৃত্যুর সথে যুদ্ধ করে বেঁচে গেল। সে এখন
বাড়িতে । সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত--এমন কি রাতেও কালীদের বাড়িতে মানুষ আসে
আর যায়। তুলসী, শেফালি, অনিতা, ক্ষনে ক্ষনে কাদঁছে। কালীপদ হুমকি উপেক্ষা
করে একের পর এক আইনের পা জড়িয়ে ধরছে। পত্রিকা ও আইনের চোখে ঘুম এসে গেছে।
কিন্তু হায় ! এক আইনজীবি বলছে, আহা, বিচার হলে কি মেয়ের আগের অবস্থা ফিরে
পাবেন ?
আবার পুলিশ বলছে, বিচার করে কিছু হবে না। এদেশে যা হয়, তাই হবে। মিছিমিছি
আপনার টাকা খরচ। ঐ ছেলেরা আপনার অন্য মেয়েকে ক্ষতি করতে পারে। তাই বলছি
চাইপা যান। ওদের ক্ষেপিয়ে শান্তি পাবেন না।
আবার কোন সরকার দলীয় নেতা বলছে, আত্মীয়-স্বজন যেহেতু কোলকাতায় আছে। আপনি ওকে
কোলকাতা পাঠিয়ে দিন। আপনিও বাঁচুন, আমাদেরও বাঁচতে দিন।
এই না হলে কি গনতান্ত্রিক দেশ? দুই-এক পার্সেন্ট মানুষের সম্পদ দেশের
আটানব্বই ভাগ মানুষের সম্পদের সমান । কালী দেশ ছেড়ে চলে যাবে, বিচারও
স্তব্ধ হয়ে যাবে। আইনের বাণী নিরবে কাঁদে কালীপদের বুকে। এই মূহুর্তে এই
দেশ, তার দেশ মনে হচ্ছে না। এ পৃথিবীতে তার কোন দেশ নেই--তার কোন সমাজ নেই।
গরীবের আছে গ্রাম্য বিচার, আছে ফতুয়া, আছে লাল ঘর। গরীবের জন্য থানা নেই,
হাই কোর্ট নেই, জর্জ কোর্ট নেই। এই কোর্ট-ফোর্ট এর নিয়ম কানুন তার জানা নাই।
তবে জজকোর্ট, সুপ্রীম কোট--এই শব্দ গুলিকে তাদের ভয় আছে। কালীপদরা যদি শুনে
কারো কেইছ জজকোর্ট বা হাই কোর্টে উঠেছে তবে তারা কেঁপে উঠে। কালীকে দেখতে
যারা আসে তারা সবাই আহারে আহারে করে আর জজকোর্ট, হাইকোর্টের কথা বলে।
স্বপ্নার বাচ্চা হয়েছে আজ ১২ দিন হল। দর্শকরা কালীকে দেখে আবার বাছুরটাকেও
দেখে। অনেকেই গাছের পাতা, খড়ের কুটা ইত্যাদি স্বপ্নাকে খেতে দিচ্ছে। শিশুরা
বাছুর টাকে কলাপাতা খাওয়াচ্ছে আর হাসছে। তাদের কাছে মনে হয়, এখানে মেলা
মিলেছে। বাছুরটা দেখতে খুব সুন্দর। কালী স্বাভাবিক থাকলে এই বাছুরটারও একটা
নাম দেওয়া হত। বাচ্চা জন্ম হওয়াতে স্বপ্নার খাদ্যের পরিমান বেড়ে গেছে। সে
কালীকে তার এই অবস্থায় একদিনও দেখেনি । তার বাচ্চার নাম দেওয়া হয়নি। সে
ক্ষূধার তারনায় দ্রুত খেয়ে চলেছে। আর ক্ষনে ক্ষনে হাম্বা হাম্বা করে ডাকছে।
তার চোখে বেয়ে অশ্রু ঝড়ছে। সে বুঝেছে সব। বর্তমানের মানুষের হিংস্রতা দেখলে
মনে হয় হিংস জীবজন্তুর সংখ্যা অনেক কমে গেছে। আর তাই মানুষ সেই হিংস্র
জন্তুর শূন্যস্থানে পূরন করছে। পশুদের লেজ খসে যাচ্ছে আর মানুষের লেজ
গজাচ্ছে।
মাস খানিক পর, কালী তার ধর্মে এখন পূর্ণ বিশ্বাসি। সে বুঝতে পারছে কোন
জন্মের কর্মফলই তাকে এখানে টেনে এনেছে। এ জন্মে তার নরক ভোগ হচ্ছে। তার
কপালে আরো দুঃখ আছে। সে ভাবে ভগবানের কাছে সবাই সমান । তবে কেন তাকে এখানে
এই অবস্থায় আর ঐ নারীদের, যারা রূপসী, যাদের মাটির সাথে সম্পর্ক খুবই কম,
কেন তাদের সুরম্য নিকেতনে পাঠাল ? নিশ্চয় কারণ আছে। আর এই কারণ পূর্বজন্মের
কর্মফল। নয়তো কেন সে নারী হল ? পুরুষ হয়ে জন্ম নিতে পারত না?অনেক ভুল
করেছে। ভগবানের কাছে সে সারাদিন ক্ষমা চায়। সাথে এই ক্ষমাও চায়--এ দেহ নিযে
সে পৃথিবীর বুকে থাকতে চায় না--সে দেহ ত্যাগ করতে চায়--ভগবান যেন এই
অপরাধের ক্ষমা করেন। সে শুয়ে শুয়ে একটি পদ্য লিখল--
জেনেছি আমার ধর্মের পাতা থেকে
মানুষের মৃত্যুর পরও জন্ম থাকে
যদি মরনের পরে, জন্ম হয়গো আমার,
সে জন্ম যেন, পাই তোমাকে।
সে জন্মে যেন, সব বাঁধা যায় বেঁকে।
ARNING:
Any unauthorized use or reproduction of 'Community' content
is strictly prohibited and constitutes copyright infringement liable to
legal action.
[প্রথমপাতা] |
লেখকের আগের লেখাঃ
..........[লেখক
আর্কাইভ]
|