|
ধারাবাহিক উপন্যাসঃ
কাক-জ্যোৎস্নায় কাক-ভোর (পর্ব-২৪)
শাশ্বত
স্বপন
কালী আজ মনে মনে ভাবে সরস্বতী পূজা করলে যদি
বিদ্যাই পাওয়া যেত, তবে ভিন্ন ধর্মের ছাত্র-ছাত্রীরা হিন্দুদের চেয়ে ভাল
রেজাল্ট করতে পারত না। কালী ক্লাশে দেখেছে সব বছর মুসলমান ছেলেমেয়েরাই ভাল
রেজাল্ট করে। দুই একজন ছাড়া বাকী হিন্দুদের মেধাতালিকা অনেক নীচে পড়ে থাকে।
সরস্বতী দেবী বানাতে বানাতে রামপ্রসাদ কয়েকরাত ঘুমাতেও পারে না। তারপর
স্কুলে পূজার ব্যাপারে সব দায়িত্ব তার, অথচ কোন বাষির্ক পরীক্ষায় ২/১ বিষয়ে
ফেল না করে সে উত্তীর্ণ হতে পারেনি। কালী দেখেছে যারা রাত-দিন পরিশ্রম করছে,
তারাই ভাল রেজাল্ট করছে। এসবের মধ্যে সরস্বতীর কোন স্পর্শ সে খুঁজে পায় না।
এখন সে চোখ মুখ বুজে সব নিয়ম পালন করে যায়, কোন কিছুই ভেবে চিন্তে করে না।
যা করতে হয়, তাই করে। এখন সম্মুখে শুধু ধু ধু বালুচর। সে বালুচর দিয়ে পাশা
আর সে ছুটবে। লোকালয় হতে বহু দূরে, তারা চলে যাবে। ধর্মের দেয়াল আর বিষাক্ত
সমাজকে পেছনে রেখে তারা ছুটবে। তারা চিরতরে এমন স্থানে যেতে চায় যেখানে রাম
নেই, কৃষ্ণ নেই, নবী নেই, ফাদার নেই, বর্ণ-বৈষম্য নেই, সাদা কালোর তফাৎ নেই।
আছে শুধু ফুল-পাখি-জীবজন্তু--যাদের মাঝে এসব কখনও ছিল না—কোনদিন থাকবেও না।
কালী জানে, স্বয়ং ভগবানও তাকে সুন্দর করবে না, সাদা-কালোর এই বৈষম্যও
ভাঙ্গবে না। কারণ তিনিই এগুলো সৃষ্টি করেছেন। তিনি সৃষ্টি করেছেন বাইবেল,
গীতা, কোরান, ত্রিপিটক—আরো শত শত গ্রন্থ। কালী এটাও ভাবে, জীবনে কেউ তাকে
বিয়ে তো দূরের কথা ভালবাসার সত্যিকারের ছোঁয়াও দেয়নি, অথচ পাশা...। নিশ্চয়
ভগবান তাকে পাঠিয়েছে। তা কি হয়? সে তো বিধর্মী। তাহলে স্রষ্টা কি ধর্মবিভেদ
ভেঙ্গে ফেলতে চান। কালীর দিনগুলি দ্বিধায় দ্বিধায় কাটে। কত প্রশ্ন তার মনে।
কাউকে সে প্রশ্ন করতে পারে না। পাশাকে প্রশ্ন করলে সে এড়িয়ে যায়। এসব
প্রশ্ন নিয়ে সে কোন কথা বলতে চায় না। কেন চায় না ? পাশা তাও কোন উত্তর দেয়
না। স্রষ্টা কি কালীকে কষ্ট দেবার জন্য পাশাকে তার হৃদয়ে বসিয়েছেন ? কালী
ভাবে, ভেবে ভেবে কূল-কিনারা পায় না। ভাবতে ভাবতে তার রাত কাটে, দিন কাটে,
বার্ষিক পরীক্ষা তার ভাল হয়নি। লেখাপড়া করতে ভাল লাগে না, সে গোয়াল ঘরে গিয়ে
স্বপ্নাকে প্রশ্ন করে, আচ্ছা স্বপ্না। তুই আমার দুঃখ বুঝিস ? তোদের কি
জাতভেদ আছে ? সাদা-কালো আছে ?
গরু হাম্বা করে উঠল। কালী নিজে নিজেই উত্তর নিল, নাই। সে যেন দিন দিন
মানসিক রোগী হয়ে যাচ্ছে, তার কথাবার্তা অশালীন। সে স্বপ্নাকে বলে চলেছে,
তোর আর আমার মধ্যে তফাৎ কি ? তুই বাচ্চা দিবি, আমিও দিমু। তোর কোরবানী হলে
তোর মাংস মানুষে খাবে। আমাকেও কোন পুরুষে খাবে।এখনও অনেকে খেতে চায়। তোদের
কিনতে টাকা লাগে আর আমাদের বিক্রি করতেও ক্রেতাকে টাকা দিতে হয়। তোদের
সাদা-কালোর বৈষম্য নাই, ধর্ম-কর্ম নাই, আমাদের আছে। আর এজন্যই তো আমরা
শ্রেষ্ঠ জীব। আচ্ছা, তোরা কি তোদের শ্রেষ্ঠ জীব ভাবিস ? গরু তিনবার হাম্বা
করে উঠল। কালী ভাবল, হয়তো গরুরা নিজেদের শ্রেষ্ঠ ভাবে। কারণ তারা তাদের
দেহের সমস্ত অংশ মানুষের কল্যাণে বিলিয়ে দেয়।মানুষ কেন যে তাদের পশু মানে
নির্মম, নির্দয় জীব হিসাবে কোরবানি দেয়? পশু তো মানুষেরা। ধর্মক্ষেত্রে যে
যার ধর্মকে বড় ভাবে--যে যার ভাষাকে বড় ভাবে। যেমন অক্ষম অথবা অপরাধী মা-বাবা
হলেও ছেলে মেয়েরা তাদেরকেই শ্রেষ্ঠ ব্যক্তিত্ব অথবা সবচেয়ে প্রিয় মনে করে।
গরুরা তাদের জীবনের এত বড় দানের জন্য শ্রেষ্ঠ ভাবতেও পারে। আবার নাও পারে,
শ্রেষ্ঠ ভাবা অথবা ক্ষমতার লোভ তাদের নেই।
আজ কালীর কিছুই ভাল লাগছে না। কালীপদ, মোহন ও সুলতানের বিপক্ষে সাক্ষ্য
দিয়েছে। কালী সে কথাই ভাবছে। সুলতান মাস্তান ছেলে, তার বাবার কোন ক্ষতি করে
কিনা। শরীরটা খারাপ লাগছে বলে পাশা বিকেল বেলা বাড়ীতে চলে আসে। সারাদিন কালী
কিছু খায়নি। পাশা বাসায় এসে কালীর উদাসীন ভাব দেখল। করুণ চোখে পাশার দিকে
সে তাকিয়ে রইল। পাশা উত্তর ঘরে চলে গেল। সেও উত্তর ঘরে গেল।
-স্কুলে যাওনি ?
- না।
-কেন?
-সুলতান প্রতিশোধ নেবে। পাশা চল ,আমরা পালিয়ে যাই।ওরা আমাকে এসিড ছুঁড়ে
মারবে।
কালী আর কোন কথা বলল না। পাশা ভাবছে, পালিয়ে তারা কোথায় যাবে?
-সন্ধ্যাতারা, আমার সাথে গেলে তোমার কি অবস্থা হবে, ভেবে দেখেছ ?
-যা আছি তার চেয়ে খারাপ হবে না। আমি সব বুঝি। তবুও এ বিশ্বের সব অন্যায়,
বৈষম্য পেরিয়ে প্রয়োজনে মরে যেতে চাই।
কালীর মানসিক অবস্থার কথা ভেবে শেফালী ওকে গীতা পড়তে বলল। সে করুণ চোখে
মায়ের দিকে তাকাল। কোন কথা না বলে পড়তে শুরু করল। ` যে ব্যক্তি গীতা বলিতে
বলিতে মারা যায়, তার শুভ গতি হয়।। (৬২) মহাপাপীও যদি গীতা শ্রবণ করে তবে
তাহার মহাপাপ নষ্ট হয়--সে মুক্তি ভাগী হয়। (৬১)গীতা পাঠ করিয়া সে কাজ আরম্ভ
হয় সে কাজই নির্দোষ ভাবে সুসম্পন্ন হয়। গীতা পাঠী যদি অন্যায় ভাবে পৃথিবী
হরণ করিয়ালয়--গীতা পাঠের ফলে তাহার সে পাপ ও নষ্ট হয় ।' কালীর আর পড়তে ইচ্ছে
করল না। ভাবছে,তাই হয়তো বিজেপিরা ভারত হরণ করছে আর গীতা পাঠ করছে অথবা করবে।
এদেশের বহু দুণীর্তিবাজ, চোরাচালানকারী, ধর্ম ব্যবসায়ীরা হজ্ব পালন করে
আলহাজ্ব হয়। ভাবে, পাপ সব দূর হয়ে গেছে। বিল ক্লিনটন, জর্জবুশ--যারা
পৃথিবীটাকে ফুটবল ভেবে খেলছে-যারা সারা বিশ্বকে গিলে খেতে চায় হিটলারের
মত;তারাও বাইবেল পড়ে, পড়ে সব পাপ দূর করে। এই কারইে হয়তো নারীদের নিয়ে এত
নির্যাতনের খেলা তৈরী হচ্ছে, চলছে। এবার সময এসেছে যুদ্ধের, নারীরা
জাগবে-পাপ করবে। গীতা পড়বে, হজ্ব করবে, পাপ দূর করবে।
মাঝে মাঝে মনে হয়, পৃথিবীটা ধ্বংশ হয়ে যাক, ৩য় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হোক। এভাবে
নারী অবহেলিত, নির্যাতিত হতে থাকলে তারাই হয়তো ৩য় বিশ্বযুদ্ধের সূচনা করবে।
হেলেনের জন্য যেমন ট্রয় নগরী ধ্বংশ হয়েছিল, নারীদের জন্য বিশ্বনগরী ধ্বংশ
হবে কারণ নারী যুগ যুগের আঘাত পাওয়া শক্ত পাথর--সে সহ্য করতে পারে
গর্ভজ্বালা--সে সহ্য করতে পারে মৃত্যু জ্বালা। তার সহ্য ক্ষমতা অসীম কিন্তু
আর সহ্য করবে না, পাহাড় ধসে দেবে - যে পাহাড় কুসংস্কার, আর নির্যাতনের।
বিশ্বযুদ্ধের পর তেলাপোকার মাঝে বেঁচে থাক বর্ণ-বৈষম্য, সাদা-কালো, ক্ষমতা,
দুর্ণীতি ইত্যাদি। তেলাপোকা সর্বভুক প্রাণী--সে সব কুটি কুটি করে খেয়ে
ফেলবে। সব চিরতরে বিলীন হলে আবার শুরু হোক হবে জীবনের ব্যাপক বিস্তার।
যেখানে আজকের দুনিয়ার মন্দ কিছু থাকবে না। কালী গীতা পড়ে আর ভাবে। তার মনে
হয় সে পাগল হয়ে যাচ্ছে। বইটি রেখে সে বিছানায় ঘুমিয়ে পড়ল।
ARNING:
Any unauthorized use or reproduction of 'Community' content
is strictly prohibited and constitutes copyright infringement liable to
legal action.
[প্রথমপাতা] |
লেখকের আগের লেখাঃ
..........[লেখক
আর্কাইভ]
|