প্রথমপাতা  

সাম্প্রতিক সংবাদ 

 স্বদেশ

আন্তর্জাতিক

বাংলাদেশ কমিউনিটি

লাইফ স্টাইল

এক্সক্লুসিভ

বিনোদন

স্বাস্থ্য

বর্তমানের কথামালা

 শিল্প-সাহিত্য

 প্রবাসপঞ্জী 

আর্কাইভ

যোগাযোগ

 

 

 

 

 

আয়নাতে ঐ মুখ দেখবে যখন
 

 

 

- ড. এস, এম, আবে কাউছার

 

 

"আয়নাতে ঐ মুখ দেখবে যখন - কপোলের কালো তিল পড়বে চোখে" - শিল্পী মাহমুদুন্নবীর গাওয়া এই চিরসবুজ গানটির সাথে আমরা কমবেশি সবাই পরিচিত। কিন্তু কপলের কালো তিলটি চোখে পরার এ দর্পণ, আরশি কিংবা আয়না নিয়ে কতটুকুই বা জানি বা চিন্তা করি? এ বস্তুটিই যে প্রত্যেক মানুষকে নিজেকে চিনতে শিখিয়েছে। এনে দিয়েছে তার আপন পরিচয়। বাংলা সাহিত্যে এ আয়না নিয়ে কতই না গান, কবিতা, উপন্যাস, ইত্যাদি রচিত হয়েছে । -এবার আসুন, এ আয়নায় একটু চোখে চোখ রাখি ।

আয়না দেখি, আয়নাও দেখে। দেখা দেখি করি আপন মনে। নিরালায় বসে আয়নার সামনে এসে কত ভাবি আনমনে, কত কী, রূপকথার কতকথা। আয়নার সামনে দাঁড়ানো সহজ কোন কাজ নয়। নিজের কত ব্যর্থতা অকপটেই স্বীকার করছি একান্ত আপন মনে এ আয়নার সামনেই। আয়না দেখা ও আয়নার প্রতিচ্ছবিকে দেখা, এ যেন মনের গহীনে সত্যের উঁকিঝুঁকি!!

একেবারে সভ্যতার আদিকাল হতেই কাঁচ মানুষের নিকট পরিচিত। খৃষ্টপূর্ব ৫০০০ সন হতে মিশরীয়গণ কাঁচ উৎপাদন করে আসছে। কাঁচ একটি অজৈব (inorganic) পদার্থ যার ভিস্কোসিটি বা সান্দ্রতা উচ্চ এবং যা গলিত অবস্থা হতে প্রস্তুত করা হয়। যেকোন কাঁচে আয়রণ অক্সাইডের (Fe2O3) পরিমাণ ০.০৩৫% এর কম হওয়া বাঞ্ছনীয় (তবে রঙিন কাঁচ ব্যতিরেকে)। কাঁচ প্রধানতঃ চারটি পর্যায়ে সম্পন্ন করা হয়, যেমন- গলন (melting), আকৃতি প্রদান (shaping), পাইন দেয়া (annealing) (কাঁচের ভিতর টান বা strain কমানো) এবং সুসমাপ্তি (finishing)।

আয়না বা গ্লাস উৎপাদনের মূল উপাদান হল সবচেয়ে সস্তা জিনিস আর তা হল বালি বা সিলিকা বা কোয়ার্টজ বা SiO2। সাধারণ অবস্থায় এটি একটি সিলিকার পলিমার বা সংক্ষেপে (SiO2)n বলে। আরো দুইটি উপাদান প্রয়োজন হয়, সেগুলি হল- সোডা (Na2O) এবং চুন বা লাইম (CaO)। অতি সাধারণভাবে বলা যায় - যখন এগুলির মিশ্রণকে প্রায় ১২০০-১৩০০ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেডে উত্তপ্ত করা হয়, তখন এগুলি গলতে শুরু করে এবং তৎক্ষণাৎ যদি ঠাণ্ডা করা যায় তাহলে কাঁচের জন্ম হয়। কাঁচের সাধারণ ফর্মূলা - Na2O.CaO.5SiO2। কাঁচের ধরণ অনুসারে উপাদানগুলোর শতকরা সংযুক্তি বিভিন্ন হয়ে থাকে। রঙিন কাঁচ (colored glass) তৈরীতে অবস্থান্তর মৌলের (transition elements) অক্সাইড (যেমন- Ti, V, Cr, Mn, Fe, Co, Ni, Cu ইত্যাদি) দ্বারা কাঁচকে রঙিন করা হয়। আবার যে সকল মৌলের কণা নিজেরাই রঙিন তাদের দ্বারা কাঁচকে রঙিন করা যায় যেমন- সেলেনিয়াম রেড (SeO2) যা রাস্তার বাতি (traffic light) তৈরীতে ব্যবহৃত হয়। এছাড়া আরো বিভিন্ন প্রকারের কাঁচের ব্যবহার রয়েছে।

সাধারণতঃ কাঁচ তৈরীর জন্য বালির গুনাগুন নিয়ন্ত্রণ করে তিনটি কারণ, যথা- ১) বালিকণার আকার এমন হতে হবে যাতে এর ব্যাস মোটামোটি ০.৮৪১ মিলিমিটারের মধ্যে, ২) সিলিকার উপস্থিতি হতে হবে প্রাচুর্যপূর্ণ অর্থাৎ সিলিকা বা কোয়ার্টজ (SiO2) এর পার্সেন্ট (৯০ ভাগ বা তার উপর) বেশি এবং ৩) আয়রন (Fe), ক্রোমিয়াম (Cr), কোবাল্ট (Co) ইত্যাদি অনুপস্থিত থাকবে বা খুব অল্প পরিমাণে থাকতে হবে। বাংলাদেশে এরকম বালির উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়:- শেরপুর জেলার বালিজুরীতে, হবিগঞ্জ জেলার শাহজীবাজার ও তেলিয়াপাড়ায়, কুমিল্লা জেলার চৌদ্দগ্রাম উপজেলায় ইত্যাদি নামক স্থানে এ কাঁচ বালির সন্ধান পাওয়া গেছে। তবে কাঁচ উৎপাদনে চুনের প্রধান উৎস ডলোমাইট (CaCO3, MgCO3), চুনাপাথর বা লাইমস্টোন (CaCO3), এছাড়াও সোডা অ্যাশ (Na2CO3), কোল পাউডার, ইত্যাদি কেমিক্যাল বিদেশ থেকে আমদানি করতে হয় ।

যুগের সঙ্গে পরিবর্তন হচ্ছে মানুষের রুচিবোধ ও চাহিদার। বর্তমানে কংক্রিট ও কাঠের জায়গা দখল করে নিচ্ছে কাঁচ। মানব জীবনে কাঁচের ব্যবহার অনেক। একসময় কাঁচ শুধুমাত্র ব্যবহৃত হত জানালায় কিন্তু এখন বিস্তর। বর্তমান স্থাপত্যের ধারা এবং প্রযুক্তির উন্নয়নের ফলে ভবনে কাঁচের ব্যবহারে এসেছে অভূতপূর্ব পরিবর্তন। বর্তমানে নবায়ন যোগ্য শক্তির উপর বেশি গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে। তাই ভবনে এখন ব্যবহৃত হচ্ছে ফটোভোল্টিক কাঁচ। প্রতিবছরই উল্লেখযোগ্য হারে কাঁচের চাহিদা বাড়ছে। তবে বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত মাত্র চারটি প্রতিষ্ঠান কাঁচ উৎপাদন করছে, সেগুলো হলো: পিএইচপি ফ্লোট গ্লাস ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড, নাসির গ্লাস ইন্ডাস্ট্রিজ, উসমানিয়া গ্লাস শিট ফ্যাক্টরি লিমিটেড ও এমইবি গ্লাস ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড। দালান, দোকানপাট, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান কিংবা অফিসে সাজসজ্জায় দেয়ালের পরিবর্তে সবচেয়ে বেশি ব্যবহূত হচ্ছে ফ্লোট গ্লাস।

এমনকি কাঁচের সাথে জড়িয়ে আছে ধর্ম, ইতিহাস, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি। মনুষ্য সভ্যতায় কাঁচের অবদান অনেক এবং যুগে যুগে তা বেড়েই চলেছে। আমরা মানুষ মাত্রই আয়নায় আমাদের অয়বয়ব দেখতে পছন্দ করি। আদিকাল থেকে এখনও একটি প্রথা চালু আছে যে, বিবাহ অনুষ্ঠানে বর ও কনে পরস্পরের মুখ দেখাদেখি করে এ আয়নার ভিতর দিয়ে। এই আয়নাই একটি নব দম্পতিকে কতই না আপন করে দেয়! আমাদের প্রিয় লেখক হুমায়ূন আহমেদের সুন্দর ও জনপ্রিয় দুটি উপন্যাসও আছে এই আয়নাকে নিয়ে- প্রথমটি 'আয়নাঘর' আর দ্বিতীয়টি হল 'মিসির আলির চশমা'।

-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এর কবিতার অংশবিশেষ দিয়েই শেষ করছি-
"আয়না দেখেই চমকে বলে, মুখ যে দেখি ফ্যাকাশে, বেশিদিন আর বাঁচব না তো – ভাবছে বসে একা সে"।

লেখক: প্রফেসর, রসায়ন বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় । জুলাই ২৬, ২০১৬।

 
 

WARNING: Any unauthorized use or reproduction of 'Community' content is strictly prohibited and constitutes copyright infringement liable to legal action.

[প্রথমপাতা]