প্রথমপাতা  

সাম্প্রতিক সংবাদ 

 স্বদেশ

আন্তর্জাতিক

বাংলাদেশ কমিউনিটি

লাইফ স্টাইল

এক্সক্লুসিভ

বিনোদন

স্বাস্থ্য

বর্তমানের কথামালা

 শিল্প-সাহিত্য

 প্রবাসপঞ্জী 

আর্কাইভ

যোগাযোগ

 

 

 

 

 

আলকেমি নির্মাণের কারিগর
 

 

 

- ড. এস, এম, আবে কাউছার

 

 

লোহাকে সোনায় পরিণত করা ? এ কেমন কথা ? হ্যাঁ মধ্যযুগে যখন আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞান এখনকার মতো বিস্তৃতি লাভ করেনি তখন একশ্রেনীর মানুষের মনে ধারনা তৈরি হয় যে লোহা/বা অন্য কোন ধাতুকে একধরনের পরশপাথরের (Philosopher's stone) ছোঁয়ায় দুস্প্রাপ্য এবং মূল্যবান ধাতু সোনাতে রূপান্তর করা সম্ভব । শুধু তাই নয়, গাছের ছাল-বাকল-পাতা থেকে সঞ্জীবনী সুধা (elixer) তৈরি করে এবং তা পানের মাধ্যমে সকল প্রকার রোগ-ব্যাধি হতে মুক্ত থেকে সুদীর্ঘ জীবন লাভ করা যায়- মানুষের আয়ু যাবে বহুগুন বেড়ে !! আর তখন মানুষের অজ্ঞানতার অন্ধকার যুগে তৈরি হওয়া এই সেই বিদ্যাই আলকেমি বিদ্যা । লোহা থেকে সোনা বানানো কিংবা জীবনকে দীর্ঘায়িত করার বাসনাই ছিল আলকেমিবিদ্যার মূল উদ্দেশ্য । এ আলকেমিবিদ্যা নিয়ে যারা চর্চা করেছেন তাদেরকে "আলকেমি/ Alchemy" বলা হয় ।

"আলকেমি" শব্দটির উদ্ভব হয়েছে ফরাসি alquemie শব্দ হতে যা আবার এসেছে ল্যাটিন alchymia, সেটি আবার এসেছে আরবি al-kimiya শব্দ হতে । 'আল' হচ্ছে 'the' এর আরবী এবং 'কিমিয়া' এসেছে 'কেম' থেকে, যার অর্থ 'কালো মাটি'। মিশরের নীল নদের তীরের মাটি কালো হওয়ায় এ নাম, কেননা "আলকেমি" ব্যপক চর্চা মূলত শুরু হয়েছে মিশর থেকেই । আলকেমি যদিও অধিভৌতিক এবং অবৈজ্ঞানিক একটি বিদ্যা তথাপি আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞানে আলকেমির প্রভাব ও অবদান স্বীকার না করে উপায় নেই । কেননা আধুনিক রসায়নের উদ্ভব হয়েছে আলকেমি চর্চা থেকে এবং আধুনিক 'Chemistry' শব্দটিরও উদ্ভব হয়েছে এ 'Alchemy' শব্দ হতে । অন্যদিকে এক একজন আলকেমিস্টকে বলা হয় Chemist, পরে এতে 'ry' যুক্ত হয়ে "Chemistry" শব্দটির চয়ণ হয়েছে ।

প্রথমতঃ আলকেমির চর্চা ছিল আধ্যাত্মিকতা কেন্দ্রিক । যাতে আলকেমিবিদগণ আধ্যাত্মিক দৃষ্টিকোণ থেকে আলকেমির চর্চা করেছেন যেখানে মানবসত্ত্বার রূপান্তরটি ছিল মূল উদ্দেশ্য । মধ্যযুগ পর্যন্ত চলতে থাকে এই প্রবণতা । এ সময় পর্যন্ত আলকেমি ছিলো রূপকধমী এবং সাধারণ ধাতু থেকে মহামূল্যবান ধাতুতে রূপান্তর । আর রোগাক্রান্ত, ক্ষয়িষ্ণু, বিপথগম্য মানুষকে নিখুঁত, স্বাস্থ্যবান, আদর্শবান ও চিরতরুন ব্যক্তিতে রূপান্তর । মহামূল্যবান ধাতুতে রূপান্তরের এ পরশপাথরটিকে তুলনা করা হত আধ্যাত্মিক শক্তির সাথে । তারপর ক্রমশঃ আলকেমির চর্চা আধ্যাত্মিক থেকে বস্তুগত বিষয়ের দিকে ঝুঁকে পড়ে । আলকেমি আধ্যাত্মিক সীমানা অতিক্রম করে পুরোপুরি ভৌতবিজ্ঞানের দিকে প্রবেশ করে । এমনকি অনেক 'আলকেমিষ্ট' লোহা বা অন্য কোনো ধাতব বস্তুকে সোনায় পরিণত করার বিদ্যা অর্জনের জন্য সারাজীবন পর্যন্ত কাটিয়ে দেন । জানা যায় স্বনামধন্য চিত্রকর লিওনার্দো দ্যা ভিঞ্চি এবং সর্বকালের সেরা বিজ্ঞানী আইজ্যাক নিউটনও আলকেমির চর্চা করেছেন ! প্রাচীন আলকেমির চর্চাকে কিছু ধারায় ভাগ করা যায়- এগুলো হচ্ছে চায়নীজ আলকেমি, ভারতীয় আলকেমি, এবং পশ্চিমা আলকেমি । পশ্চিমা আলকেমি ভূমধ্যসাগরীয় এলাকায় উদ্ভুত হয়ে ধীরে ধীরে মিশরের দিকে ছড়িয়ে পড়ে, অতঃপর তা আরব বিশ্বে গমন করে এবং একেবারে শেষের দিকে ইউরোপে বিস্তার লাভ করে ।

যা হোক কালের পথপরিক্রমায় অষ্টম শতাব্দীর শেষভাগে এসে আরব আলকেমিষ্ট 'যাবির ইবনে হাইয়ান' প্রথম আলকেমির জন্য বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি এবং গবেষণাগার নির্ভর এবং নিয়ন্ত্রিত পরীক্ষা-নীরিক্ষার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করতে থাকেন । যা তাঁর সমসাময়িক অন্যান্য রূপক আধ্যাত্মবাদ ও অধিভৌতিক ও ধর্মীয় তত্ত্বনির্ভর চর্চার সম্পূর্ণ বিপরীত ছিল । আর এ দৃষ্টিভঙ্গীর কারনে ইতিহাসবিদগণ যাবিরকে 'রসায়নের জনক' অভিধা বা উপাধি দিয়ে থাকেন । ঐতিহাসিক দলিলপত্র থেকে তাঁর পরীক্ষা-নিরীক্ষাধর্মী গবেষনা চর্চা এবং যন্ত্রপাতির ব্যবহার বিষয়ক অনেক তথ্য পাওয়া যায় । যাবির ইবনে হাইয়ান এর আত্মিক আলকেমি, দর্শন এবং ব্যালেন্স অব ন্যাচারের উপর প্রায় ৫০০-এর মত বই রয়েছে । যাবির এর বিভিন্ন আবিষ্কারই আলকেমি থেকে কেমিস্ট্রির পথে উত্তরন ছিল একটি মাইলস্টোন । তিনি এক্সপেরিমেন্টের উপর গুরুত্ব দেন এবং আলকেমিকে সাইন্স রূপ দিয়ে কেমিস্ট্রি হিসেবে দাড় করান ।

আলকেমি চর্চা থেকেই বিজ্ঞানী যাবির একসময় আবিষ্কার করে ফেললেন অনেক কিছু । আবিষ্কার করলেন কি করে তরলের মিশ্রন থেকে অন্য একটি তরলকে আলাদা করা যায়- যা 'ডিস্টিলেশন' নামে পরিচিত, আর ডিস্টিলেশন হচ্ছে দুটি দ্রবনকে তাদের ভিন্ন স্ফুটনাংকের মাধ্যমে আলাদা করা । যাবির কিন্তু আরো আবিষ্কার করে ফেললেন হাইড্রোক্লোরিক এসিড এবং নাইট্রিক এসিড এবং তাদের মিশ্রন থেকে আবার "একুয়া রেজিয়া" (HNO3:HCl = 1:3) যা সোনাকে দ্রবীভূত করে । ফলে সোনার বিশুদ্ধিকরন এবং আহরন সহজ হয়ে যায় । এছাড়া আলকেমি নিয়ে নাড়াচাড়া করতে করতে আলকেমিস্টরা সালফিউরিক এসিড, সাইট্রিক এসিড, এসিটিক এসিড এবং টারটারিক এসিডও আবিষ্কার করেন । তাদের এ আবিস্কার সেই সময় আলকেমিদের সন্মানের চূড়ায় নিয়ে যায় । অবশ্য যাবির ক্রিস্টালাইজেশন, লিকুইফ্যাকশন, অক্সিডাইজেশন, ইভাপোরেশন, ফিলট্রেশন সহ বেশকিছু প্রসেস ব্যখা করে যান, যা কেমিস্ট্রির মূলভিত্তি । আর অন্যদিকে তখন ইবনে সিনা ছিলেন সর্বকালের সেরা বিজ্ঞানীদের একজন । তাঁর চিকিত্সাশাস্ত্রে অবদান এতটাই গুরুত্বপূর্ণ ছিল যে, আঠারো শতকের শেষ পর্যন্ত প্রায় ৭০০ বছর ধরে তাঁর লিখিত বইগুলো অক্সফোর্ড, কেমব্রিজসহ ইউরোপের নামীদামী বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে গুরুত্বসহকারে পড়ানো হত । এসব গবেষণা/আবিষ্কার আজকের কেমিস্ট্রি, কেমিক্যাল ইন্জিনিয়ারিং কিংবা চিকিত্সাশাস্ত্রেরই মূল সোপান ।

অ্যান্তনীয় ল্যাভয়সিয়ে আর চার্লস বয়েলের মত জগত সেরা নামকরা রসায়নবিদরাও নাকি গোপনে আলকেমি চর্চা করতেন । ল্যাভয়সিয়েই সর্বপ্রথম অক্সিজেন এবং হাইড্রোজেন সনাক্ত করেন এবং নামকরণ করেন । তাঁর গবেষণা হতে প্রমাণিত হয় বস্তুর দহনের কারন অক্সিজেন । ল্যাভয়সিয়েই অক্সিজেন এবং হাইড্রোজেনের বিক্রিয়ায় পানি তৈরি করেন এবং প্রমাণ করেন যে পানি কোনো মৌলিক পদার্থ নয় । তিনি বিক্রিয়ারত বিভিন্ন পদার্থের ভর সূক্ষভাবে নির্নয় করেন এবং ভরের নিত্যতা সূত্রও আবিষ্কার করেন । ল্যাভয়সিয়ে অন্য গবেষকদের সাথে নিয়ে বিভিন্ন পরীক্ষার মাধ্যমে চার মৌলিক পদার্থের ধারনা ভেঙ্গে দেন এমনকি তাঁর জীবদ্দশায় ৫৫ টি মৌলিক পদার্থও সনাক্ত করেন । তাঁর এ গবেষণার মাধ্যমে দীর্ঘদিনের অনুমান নির্ভর রসায়নের আমূল পরিবর্তন তৈরি করে দেন ।

ল্যাভয়সিয়ের গবেষণার হাত ধরে আজ আমরা কত কিছুই না জানি, একটি মৌলিক পদার্থের সাথে অপর মৌলিক পদার্থের পার্থক্যটি কোথায় এবং এও জানি, রাসায়নিক বিক্রিয়ার মাধ্যমে এক মৌলিক পদার্থকে অন্য মৌলিক পদার্থে রূপান্তর করা সম্ভব নয় । এর অর্থ হচ্ছে রাসায়নিক প্রক্রিয়ায় লোহা/ধাতুকে সোনায় পরিণত করা কখনই সম্ভব নয় । এছাড়া রবার্ট বয়েল, গ্যাসের চাপের সাথে আয়তনের সম্পর্ক স্থাপনকারী গুরুত্বপূর্ণ সূত্রটি তাঁরই পরীক্ষালব্ধ আবিষ্কার । তবে বিংশ শতাব্দীর শুরুতে সত্যি সত্যিই একজন আলকেমিস্টের আবির্ভাব ঘটেছিলো, যিনি কৃত্রিম পদ্ধতিতে এক মৌলিক পদার্থকে অন্য মৌলিক পদার্থে রূপান্তর করে দেখিয়েছেন । তাঁর নাম আর্নেষ্ট রাদারফোর্ড । যাকে মানব ইতিহাসের প্রথম প্রকৃত আলকেমিষ্ট হিসেবে আখ্যায়িত করা হয় । তিনি পরমানুর নিউক্লিয়াসের উপস্থিতি প্রথম সনাক্ত করেন এবং এর ফলে আমরা জানতে পারি পরমানুর নিউক্লিয়াসে অবস্থানরত প্রোটনের সংখ্যার তারতম্যের কারনেই মৌলিক পদার্থগুলোর রসায়নিক ধর্ম ভিন্ন হয় । তিনি এ ঘটনা উপলব্ধি করে নাইট্রোজেনের পরমানুর মধ্য দিয়ে তেজষ্ক্রিয় আলফা কণিকার বিচ্ছুরণ ঘটিয়ে নাইট্রোজেনের নিউক্লিয়াসে অবস্থিত প্রোটনের সংখ্যাকে বদলে দিয়ে তাকে অক্সিজেনে রূপান্তর করেন । তাহলে, আলফা কণিকাকেই প্রথম প্রকৃত পরশ পাথর (Philosopher's stone) বলা যায় যা আলকেমিরা ধারণা করতেন !

যদিও মধ্যযুগে লোহা বা ধাতুকে সোনায় পরিনত করতে পারার পদ্ধতি আবিষ্কারের প্রচেষ্টায় শুরু হয় আলকেমিবিদ্যা । কিন্তু দুঃখের বিষয়, লোহা বা অন্য কোন ধাতুকে তারা কখনোই সোনায় পরিণত করতে সক্ষম হননি, খুঁজে পাননি অমৃত সুধা বা এলিক্সর অব লাইফ যা পান করলে অনেক দীর্ঘায়ু লাভ করা যায় । তবে তাতে কি, আলকেমি চর্চা করতে গিয়ে আলকেমিস্ট যাবির, ইবনে সিনা অনেক কিছুই আবিষ্কার করে রেখে গেছেন- যা পরবর্তীতে ল্যাভয়সিয়ে, বয়েল, রাদারফোর্ডদের হাত ধরে পূর্ণতা পেয়েছে । আসলে আলকেমিই নির্মাণের কারিগর এবং তাদের দেখানো আলোকবর্তিকাই আজ জ্ঞান-বিজ্ঞান-প্রযুক্তির বিভিন্ন শাখায় অগ্রসরমান ছুটে চলা, আর দিন কি দিন উজ্জ্বল থেকে উজ্জ্বলতর হচ্ছে ।
 

_________________________________
লেখক: পোস্টডক্টরাল গবেষক, ইয়োকোহামা সিটি বিশ্ববিদ্যালয়, জাপান এবং প্রফেসর, রসায়ন বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় । মার্চ ৪, ২০১৬

 
 

WARNING: Any unauthorized use or reproduction of 'Community' content is strictly prohibited and constitutes copyright infringement liable to legal action.

[প্রথমপাতা]