প্রথমপাতা  

সাম্প্রতিক সংবাদ 

 স্বদেশ

আন্তর্জাতিক

বাংলাদেশ কমিউনিটি

লাইফ স্টাইল

এক্সক্লুসিভ

বিনোদন

স্বাস্থ্য

বর্তমানের কথামালা

 শিল্প-সাহিত্য

 প্রবাসপঞ্জী 

আর্কাইভ

যোগাযোগ

 

 

 

 

 

একি, ডুবে আছি স্যাকারাইডে!
 

 

 

- ড. এস, এম, আবে কাউছার

 

 

দৈনন্দিন জীবনে কত কিছুর মাঝেই না আমরা ডুবে আছি ! তবে কেউ কি মস্তিস্কের নিউরণে হিসেব কষে দেখেছি যে আসলে আমরা স্যাকারাইডের অতল গভীরে ডুবে আছি প্রতিনিয়ত: । মানুষের বেঁচে থাকার মৌলিক অধিকার খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা, চিকিৎসা সর্বক্ষেত্রেই অক্টোপাসের মত নানাভাবে জড়িয়ে আছে এই স্যাকারাইড । এর ব্যতিরেকে এক মুহুর্ত বেঁচে থাকা কষ্টসাধ্য । স্যাকারাইডবিহীন মানব সত্তা প্রাণহীন ।

স্যাকারাইড মূলত: কার্বোহাইড্রেট বা শর্করা বা শ্বেতসার। এ কার্বোহাইড্রেট বা শর্করা হল একটি জৈব রাসায়নিক পদার্থ যার অণুতে কার্বন (C), হাইড্রোজেন (H) ও অক্সিজেন (O) থাকে । পানির অণুর মতই ২:১ অনুপাতে হাইড্রোজেন পরমাণুর সাথে অক্সিজেন পরমাণু যুক্ত থাকে । রসায়নের ভাষায় শর্করা হল আসলে 'Hydrates of Carbon' কিংবা 'Polyhydroxyaldehyde' বা 'Polyhydroxyketone' ।

খাদ্যের মুখ্য উপাদানই হচ্ছে শর্করা বা শ্বেতসার যা মলটেজ, অ্যামাইলেজ অথবা ল্যাকটেজ এনজাইম দ্বারা পরিপাককৃত হয়ে দেহে তাপ ও শক্তি উৎপন্ন করে, আর তাই দেহপিঞ্জরের কর্মক্ষমতা বৃদ্ধি পায় । অতিরিক্ত শর্করা গ্লাইকোজেন হিসেবে যকৃত ও পেশীতে সঞ্চিত থাকে যা প্রয়োজনের সময় গ্লুকোজে রূপান্তরিত হয়ে দেহে তাপ শক্তি সরবরাহ করে থাকে এবং রক্তে গ্লুকোজের পরিমাণও স্বাভাবিক বজায় রাখে । আসলে শর্করা বা স্যাকারাইডকে শরীরের 'জ্বালানি' বলা হয়ে থাকে । শর্করার প্রধান উৎস হল: চাল, গম, ভুট্টা, চিড়া, মুড়ি, চিনি, গুড়, আলু ও মূল জাতীয় অন্যান্য খাদ্য । দৈনিক ক্যালারির চাহিদার অন্তত ৫০-৬০% শর্করা জাতিয় খাদ্য গ্রহন করা চাই । শর্করাজাতীয় খাদ্য যেহেতু শক্তির প্রধান উৎস হিসেবে বিবেচিত, তাই এ শর্করা বা স্যাকারাইড ছাড়া পঞ্চইন্দ্রিয়ের এ ইন্দ্রিয়তনকে কি সচল রাখতে পারবেন জনাব ?

এক অনু বিশিষ্ট কার্বোহাইড্রেট বা শর্করাকে মনোস্যাকারাইড (গ্লুকোজ, ফ্রুক্টোজ, গ্যালাকটোজ), দুই অনু বিশিষ্টকে ডাই স্যাকারাইড (সুক্রোজ, মল্টোজ, ল্যাকটোজ, সেলোবায়োজ) বা বহু অনু বিশিষ্ট শর্করাকে পলি স্যাকারাইড (স্টার্চ, সেলুলোজ, ডেক্সট্রিন) বলে ।

মনোস্যাকারাইড, গ্লুকোজ জৈবিক ক্রিয়ার একটি মৌলিক উপাদান যা জীবকোষে ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয় । সালোকসংশ্লেষণ বা ফটোসিনথেসিস প্রক্রিয়ার অন্যতম প্রধান উৎপাদ এটি । গ্লুকোজ প্রাণী ও উদ্ভিদের কোষের শ্বাসক্রিয়ায় অন্যতম অপরিহার্য উপাদান । গ্লুকোজ রোগীর খাবার হিসেবে বেশ জনপ্রিয় এবং ভিটামিন সি প্রস্তুতিতেও ব্যবহৃত হয় । দুধের প্রধান উপাদান ল্যাকটোজ একটি গ্লুকোজ-গ্যালাকটোজ ডাইস্যাকারাইড । বিভিন্ন পাকা ফলমূল, মধু ও আধিকাংশ মিষ্ট ফলে গ্লুকোজ থাকে -যা খেয়ে আমরা তৃপ্তির ঢেকুর তুলে থাকি ।

মানব জীবনে টক-ঝাল-মিষ্টি বিভিন্ন স্বাদ বিভিন্ন সময়ে অপূর্ব অনুভূতি দিয়ে থাকে । আর মিষ্টি স্বাদের প্রধান উপাদান চিনি যা কিনা সব মিষ্টি জাত খাবারের জন্য অপরিহার্য । আর চিনি হলো ডাই স্যাকারাইড । মিষ্টি বা মিষ্টান্ন ছাড়া আমাদের আপ্যায়ন-ই যেন পূর্ণতা পায়না । ইক্ষুর রস থেকে সহজেই চিনি পাওয়া যায় । তবে অতিরিক্ত চিনি গ্রহণ না করাই শ্রেয় । আর মিষ্টিকুমড়া খেতে মিষ্টি লাগে কেননা এতেও শর্করা বা কার্বোহাইড্রেট আছে বলে । প্রায় সব ধরনের সবজিতেই কিছু না কিছু শর্করা থাকে ।

প্রাত্যহিক জীবনের প্রত্যেকটি কাজেই জড়িয়ে আছে স্যাকারাইড যেমন- ধরুণ, পলি স্যাকারাইডের অন্তর্ভূক্ত সেলুলোজের কথা । আপনি ঘুমাতে যাবেন খাট, বালিশ-তোষক, বিছানা সবই যে সেলুলোজের তৈরী । আপনার গায়েও লেগে আছে সেলুলোজের পোষাক । আপনি যেখানে বসে প্রত্যেহ পড়াশুনা করছেন বা নিয়মিত খাবার খাচ্ছেন সেই টেবিলটি ও যে সেলুলোজের । আর খাবারের মধ্যে স্যাকারাইড বা শর্করা বিদ্যমান সেটা তো আগেই বলেছি । মনের ভাব প্রকাশ করার জন্য কাগজটিও যে পলি স্যাকারাইডের । দৈনন্দিন ব্যবহৃত হাজারো জিনিস আছে যেমন- কাগজ, বইপত্র, টিস্যু, আসবাবপত্র এমনকি ঘরবাড়ি তৈরীতেও সেলুলোজ বা পলি স্যাকারাইড বিদ্যমান । অবশ্য গ্রামে গেলে এ সেলুলোজের ব্যবহারটা আরো বেশি চোখে পড়বে- ঘরের চালা নির্মাণ করা হয় ছন (সেলুলোজ) দিয়ে । হয়তো: চোখ এড়িয়ে যাবে না বাঁশের বেড়াটিও? সেটাও যে সেলুলোজ বা স্যাকারাইড ।

স্যাকারাইড বা শর্করা রক্তে কমে গেলে চিকিৎসাবিজ্ঞানের ভাষায় একে বলে হাইপোগ্লাইসেমিয়া । আর আমরা সোজা ভাষায় বলি 'হাইপো' হওয়া বা 'সুগার নিল হয়ে যাওয়া' । উভয় টাইপ (-১ ও -২) ডায়াবেটিক রোগীর জীবনেই কোনো না কোনো সময় এমন অভিজ্ঞতা হতে পারে । শর্করা মস্তিষ্কের একমাত্র শক্তি সরবরাহকারী উপাদানও । তাই কয়েক মিনিট এই সরবরাহ বন্ধ থাকলে রোগী অজ্ঞান বা অচেতন হয়ে যেতে পারে ফলে মস্তিষ্কের মারাত্মক ক্ষতি হতে পারে ।

এবার সেলুলোজ থেকে গাড়ি তৈরীর চিন্তাভাবনা করছে জাপান । গাছের সেলুলোজ থেকে 'ন্যানো ফাইবার' তৈরি করে গাড়ির যন্ত্রাংশ বানিয়ে নজর কাড়তে চলেছে । এই ফাইবার লোহার চেয়ে অন্ততপক্ষে পাঁচগুণ শক্ত আর ওজনের দিক থেকে পাঁচ গুণ হালকা বলে এর জ্বালানি ব্যবহারের দক্ষতা বৃদ্ধিতে সহায়তা করবে । দেখুন, যারা হটডগ পছন্দ করেন কিন্তু মোটা হবার ভয়ে বা শরীরে চর্বি জমা হয়ে যাবার ভয়ে খেতে পারেন না তাদের জন্যে সুখবর, গাছের সেলুলোজ থেকে এবার হটডগের উপকরণ তৈরি করবে নরওয়ের একটি কোম্পানি । একে চর্বির বিকল্প হিসেবেই ভাবছে ।

ঘরের ভিতর থেকে বাহির, টেস্টটিউব থেকে কারখানা সবক্ষেত্রেই স্যাকারাইড শুধু স্যাকারাইড । বিভিন্ন শিল্প-কারখানায় উৎপাদ বা বিক্রিয়ক হিসেবে এমনকি জীবন বাঁচানো নানা প্রকারের ঔষধ তৈরীতে বিপুল পরিমানে স্যাকারাইড ব্যবহার হয়ে থাকে । আমরা যে গরু, ছাগল, মহিষ, ভেড়া, হরিনের মাংশ ভক্ষণ করে থাকি এরাও কিন্তু সেলুলোজ বা পলি স্যাকারাইড প্রধান খাদ্য হিসেবে খেয়েই বেঁচে থাকে । পাঁচটি মৌলিক অধিকারের সবকয়টিতেই বিভিন্ন স্যাকারাইডের উপস্থিতি বিদ্যমান ।

লেখার টাইটেল পড়ে একটু-আধটু অদ্ভুত মনে হলেও কিন্তু এতক্ষণ যা লিখলাম তার অন্তত ৮০-৯০ ভাগ সবার জীবনে প্রতিদিনের জন্যই স্যাকারাইডের ব্যবহারটি সত্যি । তবে স্বল্প পরিসরে স্যাকারাইডের এত বিশালতা বর্ননা করা সম্ভব নয় । হ্যাঁ, চারপাশে স্যাকারাইড গ্রহণ/পরিধান/অবলোকন/ না করে আমি-আপনি একটা দিনও পার করতে পারবো না । আর তাইতো আমরা ডুবে আছি স্যাকারাইডের মাঝেই ।

____________________________________________
লেখক: পোস্টডক্টরাল গবেষক, ইয়োকোহামা সিটি বিশ্ববিদ্যালয়, জাপান এবং অধ্যাপক, রসায়ন বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ।

 
 

WARNING: Any unauthorized use or reproduction of 'Community' content is strictly prohibited and constitutes copyright infringement liable to legal action.

[প্রথমপাতা]