প্রথমপাতা  

সাম্প্রতিক সংবাদ 

 স্বদেশ

আন্তর্জাতিক

বাংলাদেশ কমিউনিটি

লাইফ স্টাইল

এক্সক্লুসিভ

বিনোদন

স্বাস্থ্য

বর্তমানের কথামালা

 শিল্প-সাহিত্য

 প্রবাসপঞ্জী 

আর্কাইভ

যোগাযোগ

 

 

 

 

 

ঝাল, ঝাল, উফফ কি ঝাল: মরীচিয় কথন
 

 

 

- ড. এস, এম, আবে কাউছার

 

 

যদি বউয়ের সাথে রাগ করে বউকে দেখিয়ে দেখিয়েই ১০-১২টা মরিচ চিবিয়ে চিবিয়ে খেয়ে ফেলেন!! তখন হবে টা কি শুনি?? জিহবা জ্বলে-পুড়ে ছারখার হয়ে যাবে না? - হু-হা ঝাল, ঝাল, উফফ কি ঝাল!! মুখে লালা আসে, নাকে পানি আসে, চোখেও পানি আসে, মুখ ঘামতে থাকে এমনকি হার্ট বিট বাড়তে থাকে। সম্ভবত: দুনিয়াতে মরিচই এক মাত্র ফল যা কামড়ালে পাল্টা কামড় দেয়। হায়রে মরিচের কেরামতি!!

মূলত: মরিচের এ ঝালের জন্য দায়ী হচ্ছে ক্যাপসাইসিন (capsaicin বা 8-methyl-N-vanillyl-6-nonenamide) (C18H27NO3) আর তার বিজারিত ভাই (যাতে দুটো হাইড্রোজেন বেশি আছে) ডাইহাইড্রোক্যাপসাইসিন (dihydrocapsaicin বা 8-Methyl-N-vanillylnonanamide) (C18H29NO3)। এরা গন্ধবিহীন এক ধরনের এলকালয়েড (Alkaloid)। এই পদার্থগুলোর কারনেই মরিচে ঝালের পার্থক্য হয়ে থাকে। অর্থাৎ যে মরিচে এ পদার্থের পরিমান বেশি, সে মরিচে ঝালের পরিমানও বেশি হয়ে থাকে। আবার যে মরিচে ঐ পদার্থের পরিমান কম, সে মরিচে ঝালের পরিমানও কম হয়ে থাকে। এক্ষেত্রে বড় মরিচও ছোট মরিচের মাঝে কোন তারতম্য নেই।

মরিচে কামড় পড়ার পর পর ক্যাপসাইসিন বা ডাইহাইড্রোক্যাপসাইসিন উপাদান আমাদের জিহবায় চলে আসে এবং এটা আমাদের জিহবায় স্নায়ুবিষ কিংবা নিউরোটক্সিনের মত কাজ করে। নিউরোটক্সিন জিনিসটা এমন যেটা কোনো বিষাক্ত অনুভূতির জন্য আমাদের স্নায়ু অনুভূতি পায়, যদিও সেই অনুভূতিটা কোনো ক্ষতি করে না। ক্যাপসাইসিন বা ডাইহাইড্রোক্যাপসাইসিন কিন্তু আমাদের জিহবার টিস্যুকে জ্বালায় না, পোড়ায়ও না আবার ক্ষতও তৈরি করে না। এটা শুধুমাত্র জিহবায় লেগে থাকা স্নায়ুতন্তুকে আঘাতে আঘাতে ক্ষত-বিক্ষত করে এবং সেখান থেকে আমাদের মগজে একটা ভুল সিগন্যাল পাঠায় যেটা আমাদের বুঝায় আমাদের জিহবা জ্বলে পুড়ে যাচ্ছে।

বউয়ের কথামত মরিচের ঝাল লাগার পর পানি খাই, কোনো লাভ হয় শুনি? কোনো লাভ হবে না। কারন ক্যাপসাইসিন বা ডাইহাইড্রোক্যাপসাইসিন হচ্ছে হাইড্রোফোবিক (যারা পানি পছন্দ করে না) টাইপের রাসায়নিক যৌগ। এদের সরাতে হলে পানি দিয়ে সরানো যাবে না। কি দিতে হবে তাহলে? হাইড্রোফোবিক পদার্থই লাগবে। আর সেটা কোথায় পাব? সেটা পাওয়া যাবে দুধের মধ্যে। দুধের কেসিন (casein) নামক প্রোটিন যৌগটা একটা হাইড্রোফোবিক পদার্থ যা পানির সঙ্গে মেশে না। ঝাল লাগার পর দুধ খেলে দুধের কেসিন মরিচের ক্যাপসাইসিন বা ডাইহাইড্রোক্যাপসাইসিনকে ধুয়ে মুছে নিয়ে যাবে। দুধের পাশাপাশি ঘি, মাখন, দই এসবও খাওয়া যাবে, তাহলে ঝাল চলে যাবে- আহ্ শান্তি!

এবার মায়ের কথামত ঝাল লাগার পর চিনি খাই, কোনো লাভ হয়? আসলে চিনি মিষ্টি বলে জিভে একটু শান্তি হয়, এর বেশি কিছুই না। আপনি নিজেই একটা পরীক্ষা করে দেখুন না? কটা মরিচ টপাটপ চিবিয়ে নিন, তারপর চিনি খান। দেখুন ঝাল কমে কিনা। চিনির অণু পানিতে ভালো গুলে যায় কিন্তু সেই দ্রবণ ক্যাপসাইসিন বা ডাইহাইড্রোক্যাপসাইসিনকে খুব একটা দ্রবীভূত করতে পারে না, ফলে মরিচের ঝাল সারে না।

মরিচ যদিও আমাদের কাছে ঝাল ঝাল লাগে তবুও পাখি/মুরগি প্রজাতিদের কাছে মরিচ ঝাল লাগে না কেন? কারন আমাদের জন্য ক্যাপসাইসিন বা ডাইহাইড্রোক্যাপসাইসিন যেমন নিউরোটক্সিন, ওদের জন্য নিউরোটক্সিন না জিনিসটা। ওদের জিহবা যখন ক্যাপসাইসিনের স্পর্শ পায় তখন তাদের জিহবার স্নায়ুগ্রন্থগুলোকে সেটা আক্রমন করে না, ফলে তাদের ঝাল লাগে না মরিচটায়।

মরিচের সবচেয়ে ঝাল অংশ কোনটা? আগা, গোড়া, নাকি মাথা? আসলে কোনোটাই সবচেয়ে ঝাল অংশ নয়। সবচেয়ে ঝালের অংশ হচ্ছে এর বীজবাহী গর্ভপত্র। মরিচের ভেতর যে অংশে বীজগুলো ঝুলে থাকে, সেটাই গর্ভপত্র। এখানে ক্যাপসাইসিন বা ডাইহাইড্রোক্যাপসাইসিন এর একটা থলিকোষ থাকে। উইলবার স্কভিল নামে এক মার্কিন বিজ্ঞানী ১৯১২ সালে এক পরীক্ষা করেন যার মাধ্যমে মরিচের ঝাল মাপা যায়। সেটাই এখন স্কভিল স্কেল (Scoville scale) যা ঝাল মাপার যন্ত্র বলে পরিচিত । 'ক্যারোলিনা রিপার' এখনো পর্যন্ত সবচেয়ে বেশি ঝাল মরিচ বলে গিনেস বুক অফ ওয়ার্ল্ড রেকর্ডসে জায়গা করে নিয়েছে আর 'ক্যাপসিকাম' বা মিষ্টি মরিচ সবচেয়ে কম ঝাল মরিচ।

মরিচ এর ইংরেজি নাম Chili ও বৈজ্ঞানিক নাম Capsicun annuum। মরিচকে সাধারণভাবে লংকা বলা হয় যা সোলানেসি (solaneceae) পরিবারের উদ্ভিদ। এর আদি নিবাস আমেরিকা মহাদেশে। প্রায় ৭৫০০ বছর আগে থেকেই আমেরিকার আদিবাসীরা মরিচ ব্যবহার করে আসছে। আজ বাংলাদেশে মরিচকে বিভিন্ন নামে ডাকা হয়ে থাকে- যেমনঃ নাগা মরিচ, ধানি মরিচ, লাল মরিচ, কামরাঙ্গা মরিচ, সিমলা মরিচ, উল্টা মরিচ, বেলুন মরিচ, লঙ্কা মরিচ ও বোম্বাই মরিচ ইত্যাদি।

পাতে কাঁচা মরিচ ছাড়া অনেক বাঙালির ভোজই হয় না। কিন্তু কাঁচা মরিচের ব্যবহার কি কেবল রান্নায় ঝাল আর সুগন্ধ বাড়ানোর জন্য? তা নয়। এই কাঁচা মরিচ ভিটামিনের এক চমৎকার উৎস। রয়েছে নানা পুষ্টিগুণও। এর মধ্যে রয়েছে ভিটামিন সি, ভিটামিন ই, ভিটামিন এ, ভিটামিন কে। এছাড়া ভিটামিন বি৬, ভিটামিন বি২, ভিটামিন বি৩- এগুলোর ভালো উৎস। এতে আছে কপার আয়রন, পটাসিয়াম ম্যাংগানিজ, ম্যাগনেসিয়াম এবং সামান্য পরিমাণে প্রোটিন ও কার্বোহাইড্রেট। তবে গবেষকেরা বলছেন, কাঁচা মরিচের ভিটামিন সি তাপ, অতিরিক্ত আলো ও বাতাসের কারণে একটু একটু করে হারায়। তাই তাজা কাঁচা মরিচ না খেতে পারলে তা ঠান্ডা ও অন্ধকার জায়গায় সংরক্ষণ করুন।

আমেরিকার ইনস্টিটিউট অব ক্যানসার রিসার্চ বলছে, তাজা সবুজ কাঁচা মরিচে যে ক্যাপসাইসিন আছে ক্যানসার কোষের বৃদ্ধি রোধ করতে পারে। অন্যদিকে- ম্যানচেস্টার মেট্রোপলিটন ইউনিভার্সিটির খাদ্যবিজ্ঞানী স্টিফেন হোয়েটিংয়ের গবেষণায় প্রমাণ হয়, মরিচের ভেতর যে উপাদান রয়েছে তা দেহে চর্বি রোধে বিশেষ ভূমিকা রাখে। ঝাল লাল মরিচের রাসায়নিক উপাদান দেহে তীব্র তাপপ্রবাহ সৃষ্টি করে এবং অ্যাড্রেনালিন হরমোন রোধে সহায়তা করে। ফলে শরীরে চর্বির পরিমাণ কমে যায়। আর প্রতিদিনের খাদ্য তালিকায় যদি মরিচ থাকে তাহলে ওজন কমাতে তা সাহায্য করবে।

ছোট্ট একটি কাঁচা মরিচই হতে পারে আপনার সুস্বাস্থ্যের সঙ্গী। মরিচের এত্তো কত্তো গুন, অথচ এই মরিচই আমরা খাই না, তা হতেই পারে না। তাই এখন থেকে প্রতিদিন খাদ্য তালিকায় অন্তত ১টি কাঁচা বা লাল মরিচ রাখুন এবং শরীরের জন্য অতি প্রয়োজনীয় এন্টি-অক্সিডেন্ট সমৃদ্ধ ভিটামিনের অভাব পূরণ করুন। প্রতিদিন কমলা না খেতে পারি কাঁচা মরিচ তো খেতে পারব।

লেখক: প্রফেসর, রসায়ন বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় । জুলাই ১৪, ২০১৬ ।

 
 

WARNING: Any unauthorized use or reproduction of 'Community' content is strictly prohibited and constitutes copyright infringement liable to legal action.

[প্রথমপাতা]