প্রথমপাতা  

সাম্প্রতিক সংবাদ 

 স্বদেশ

আন্তর্জাতিক

বাংলাদেশ কমিউনিটি

লাইফ স্টাইল

এক্সক্লুসিভ

বিনোদন

স্বাস্থ্য

বর্তমানের কথামালা

 শিল্প-সাহিত্য

 প্রবাসপঞ্জী 

আর্কাইভ

যোগাযোগ

 

 

 

 

 

ভেজাইল্যা ফরমালিন
 

 

 

- ড. এস, এম, আবে কাউছার

 

 

প্রেমের মরা জলে ডোবে না, আর অহন এই ভেজাইল্যা জামানায় প্রেমের মরা জলে ডুবে হাবুডুবু খায় । ফরমালিনযুক্ত ভালোবাসার কারনে এর আসল স্বাদটুকু ও কেমন যেন "আধা রোমান্টিক আধা মর্মান্তিক" হয়ে গেছে । আগেকার দিনে সবকিছুতে এত ভেজাইল্যা আছিলো না । ভেজালের অতল গহীনে যেন তলিয়ে যাচ্ছি ! কোথায় নেই এ মরনব্যধি ভেজাল- খাদ্যে ভেজাল, ওষুধে ভেজাল, ফলমূলে ভেজাল, তেলে ভেজাল, দুধে ভেজাল, বীজে ভেজাল, রক্তে ভেজাল, কথায় ভেজাল, কর্তৃপক্ষের নজরদারিতে ভেজাল, রাজনীতিতে ভেজাল, ইতিহাসে ভেজাল, প্রেমে ভেজাল (!) -অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে যে "সর্বাঙ্গেই ব্যথা ওষুধ দিব কোথা" ?

এই ভেজাইল্যা অবস্থা প্রসারের ক্ষেত্রে 'ফরমালিন' (Formalin) শব্দটি যেন এখন কথায় কথারই অংশ হয়ে গেছে । এই নাম এখন সবাই জানেন । আর জানবেন নাই বা কেন ? অধূনা ফরমালিন "ফরমাল-ইন" বা "সহজে প্রবেশ" এর মত বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে । চারদিকে ছড়িয়ে পড়েছে এই ক্যাচাইল্যা ফরমালিন- আর নিরবে-নিঃশব্দে সুস্বাদু খাবারে মিশিয়ে দেয়া হচ্ছে । খাইতে খাইতে আমাগো লিভার যেন এখন অভ্যস্ত হয়া গেছে -সয়ে গেছে পেটে-পিঠে- অক্ষন যদি ফরমালিন মুক্ত খাবার খাই তাইলে মনে হয় পেটটাই খারাপ করবো ! রাসায়নিক নাম ফরমালিন উত্তরোত্তর যেন একটা খারাপ রূপক অর্থে ব্যবহৃত হচ্ছে ।

ফরমালিন হচ্ছে ফরমালডিহাইড বা মিথানল (H-CHO)- এর ৪০% জলীয় দ্রবণ । ১৮৫৯ সালে রুশ রসায়নবিদ আলেকজান্ডার বুতলারভ ফরমালিনের অস্তিত্ব সম্পর্কে প্রথম ধারণা দেন এবং পরবর্তীতে ১৮৬৯ সালে অগাস্ট উইলহেম ভন হফমেন স্বার্থকভাবে তা চিহ্নিত করেন । যা বর্ণহীন ও ঝাঁঝালো গন্ধযুক্ত । ফরমালিন পানিতে অতি দ্রবণীয় এবং উদ্বায়ী । এটি একটি কার্যকরী জীবাণুনাশক এবং পচনরোধক যা মৃতদেহ সংরক্ষণেও ব্যবহৃত হয় । ফরমালিন ব্যাকটেরিয়া বা ছত্রাককে সংক্রমিত হতে দেয় না । পরীক্ষাগারে সাধারণত ক্যালসিয়াম ফরমেটকে পাতন প্রক্রিয়ায় তৈরি করা হয় ।

ভেজাল থেরাপি বেশি চোখে পড়ে যখন মাসের প্রথমে লম্বা ফর্দ নিয়ে বাজারে যাওয়া হয়, তখন সবার মুখে শুধু বলতে শুনা যায় - এটা ভালতো, ওটা ভালতো, ভেজাল নেইতো ? সর্বময় জড়িয়ে-ছড়িয়ে আছে ভেজাল- মাছে, ফলে ও দুধে ফরমালিন, ফলমূলে কার্বাইড, শাক-সবজি ও শুঁটকিতে কীটনাশক (ডিডিটি), মাছকে তর-তাজা দেখাতে রেড অক্সাইড, অপরিপক্ক টমেটোকে পাকাতে হরমোন, মুড়িকে সাদা ও টসটসে করতে ইউরিয়া-হাইড্রোজ, জিলাপি-চানাচুর মচমচে রাখতে মবিল, শিশু খাদ্যে মেলামিন, এছাড়া বিস্কুট, আইসক্রিম, কোল্ডড্রিংক্স, জুস, সেমাই, আচার, নুডুলস এবং মিষ্টিতে থাকছে টেক্সটাইল ও লেদার রং । এমনকি কৃত্রিম রং মিশিয়ে নকল ঘি, ইট বা কাঠের গুঁড়োর সাথে ঘাসের গুঁড়া মিশিয়ে মসলা তৈরি, লবণে সাদা বালি, চা -এ করাতকলের গুঁড়ো, ফার্মের স্বাস্থ্যবান মুরগীকে প্রোটিন জেল খাইয়ে বাড়ানো (বিষাক্ত মাংস পিন্ড ছাড়া আর কি) ? আর গরু-ছাগলকে নিষিদ্ধ ঔষধ গলাধকরণ করে মোটা-তাজাকরন হচ্ছে অহরহ আমাদের চোখের সামনেই । এখন বাজারে কৃত্রিম দুধের উৎপাদন ও সরবরাহ ক্রমে বেড়েই চলছে । নিম্নমানের গুঁড়া দুধ, আটা, ময়দা, অ্যারারুট, সালফিউরিক অ্যাসিড, সরিষার তেল ও মবিল মিশিয়ে এই দুধ তৈরি করা হচ্ছে ৷ বীজ থেকে ফল, ধান থেকে পান এমন একটি ভোগ্যপণ্য নেই যাতে ফরমালিন, কার্বাইড বা বিষাক্ত রাসায়নিক পদার্থের ব্যবহার হচ্ছে না । লোভী ব্যবসায়ীরা অধিক মুনাফা লাভের আশায় বিভিন্ন রকমের ক্ষতিকারক রাসায়নিক দ্রব্যের ব্যবহার দিন কি দিন ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি করেই চলেছে- যেন দেখার কেউ নেই ।

বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে কমন টপিক "ফরমালিন" চায়ের দোকানেও আলোচনা হয় । দেখুন একটা কমনসেন্স যে, যেসব খাবার বেশি দিন ফ্লেভারড, মচমচে, কালারফুল রাখতে হবে সেখানে প্রিজারভেটিভও বেশিই ব্যবহার করার কথা । ৯০% প্যাকেটজাত খাবারেই কোন না কোনভাবে প্রিজারভেটিভ ব্যবহার করা হয়, নাহলে এগুলো পঁচে যাবে । ইন্সট্যান্ট নুডলসে ২ ধরণের প্রিজারভেটিভ, ফরমালিন ও TBHQ (Tertiary-butyl hydroquinone) ব্যবহার করা হচ্ছে যা অতন্ত্য ক্ষতিকর । এতে ডিএনএ ড্যামেজ, পাকস্থলীর ক্যানসার বা টিউমার হতে পারে । অথচ বাসা-বাড়ীতে আমরা সকাল-সন্ধ্যা এ নুডলস খেয়ে তৃপ্তির ঢেকুর তুলে থাকি ।

প্রশ্ন হতে পারে ফরমালিনের সহনীয় মাত্রা কত ? ফরমালিনের কোনো সহনীয় মাত্রা নেই । যেকোনো মাত্রাই মানবদেহের জন্য ক্ষতিকর অর্থাৎ কোনো মাত্রাই মানবদেহের জন্য স্বীকৃত নয় ৷ ফরমালিন কোনো খাবার জিনিস নয়, এটি কেমিক্যাল, এটি একটি 'বিষ' । মানবদেহে ঢোকার কোনো প্রশ্নই আসে না । বিষের কোনো সহনীয় মাত্রা হতে পারে না । যদিও বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা (WHO) এর মতে ফরমালিনের সহনীয় মাত্রা ০.১৫ পিপিএম (পার্টস পার মিলিয়ন) । এই পরিমাণ এত অল্প যা ল্যাবরেটরিতেও মাপা দুঃসাধ্য । তাহলে সহনীয় মাত্রার প্রশ্ন আসে কীভাবে ! খাদ্যদ্রব্যে যদি তুল্য (১০০ কোটি ভাগের দু'ভাগ) মাত্রার ফরমালিনও থাকে তবে তাও শরীরে ক্যান্সার সৃষ্টি করতে পারে ।

বিশেষজ্ঞদের মতে লাগামহীনভাবে খাদ্যে ফরমালিনসহ নানা রাসায়নিক ভেজাল দ্রব্য মেশানোর ফলে মানুষের কিডনি নষ্ট হওয়া ছাড়াও লিভার ক্যান্সার, চোখের রেটিনার কোষ ধ্বংস, পেটের পীড়া, হাঁচি, কাশি, বদহজম, ডায়রিয়া, আলসার, চর্মরোগসহ বিভিন্ন রোগ হয়ে থাকে । ধীরে ধীরে এসব রাসায়নিক পদার্থ হার্ট, ব্রেন সবকিছুকে ধ্বংস করে দেয় । এছাড়া মানবদেহে ফরমালডিহাইড ফরমিক অ্যাসিডে রূপান্তরিত হয়ে রক্তের এসিডিটি বৃদ্ধি করে এবং শ্বাস-প্রশ্বাসেও ব্যাঘাত সৃষ্টি করে । প্রতিনিয়ত: কতই না রকমারি রোগের মধ্যে ডুবে আছি আর ধীরে ধীরে জাতিকে ক্রমাগত মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেয়া হচ্ছে ।

সর্বাঙ্গের ব্যথা দূর করতে সামান্য কিছু মেডিসিন (!) নিয়ে হাজির হয় "বিএসটিআই" বা "ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর" । বছরজুড়ে একটা দায়সারা গোছের ভেজালবিরোধী অভিযান চালানো হচ্ছে । এ লক্ষ্যে কত যে দণ্ডবিধি বা অ্যাক্ট আছে তার কোন ইয়াত্তা নেই, কিন্তু নেই কোন যথাযথ প্রয়োগ বা প্রতিকার । এ সংস্থাগুলো সাধারণত ডিজিটাল ফরমালডিহাইড মিটার, ফরমালডিহাইড সোয়াব ডিটেক্টর, ফরমালডিহাইড ডিপ স্টিক, ফরমালডিহাইড ডিটেকশন কিট বা ক্রোমোটিক অ্যাসিডের সঙ্গে সালফিউরিক অ্যাসিডের মিশ্রণ দিয়ে ফলমূল পরীক্ষা করে থাকে । যদিও মান নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যায় । তবে সাইন্স ল্যাবরেটরী কিছু রাসায়নিক কিট বাজারে এনেছে যাতে বিভিন্ন রঙের তলানি দেখে ফরমালিন সনাক্ত করা যায় ।

আসুন দেখি কিভাবে এই ফরমালিনকে দূর করা যায়- ফরমালিনের মাত্রা প্রায় অর্ধেক কমে যায় যদি নরমাল পানিতে ১ ঘণ্টা মাছ ভিজিয়ে রাখা হয়, ফরমালিনের মাত্রা প্রায় ৭০-৮০% কমে যায় যদি লবনাক্ত পানিতে ১ ঘন্টা ভিজিয়ে রাখা হয়, ভিনেগার ও পানির মিশ্রনে (পানিতে ১০% আয়তন অনুযায়ী) ১৫ মিনিট মাছ ভিজিয়ে রাখা হয় তাহলে প্রায় পুরোটাই ফরমালিন দূর হয় । আর ফল ও সবজি খাওয়ার আগে ১০ মিনিট হালকা গরম লবন মিশ্রিত পানিতে ভিজিয়ে রাখলে অনেকটাই ফরমালিন দূর হয় ।

মানুষ মানুষকে ঠকিয়ে অধিক মুনাফা লাভের জন্য যেসব পন্থা অবলম্বন করে সেগুলোর অন্যতম হলো ধোঁকা বা প্রতারণা । এটি একটি গুরুতর ও জঘন্য অপরাধ । অধিক মুনাফা লাভের নেশায় ফরমালিন বা ক্ষতিকর কোনো দ্রব্য খাদ্য বা পণ্যে মিশিয়ে কিংবা মন্দ লুকিয়ে রেখে বিক্রয়ের জন্য উপস্থাপন করা যে কোন ধর্মের দৃষ্টিতেই অপরাধ । পণ্যদ্রব্যে ফরমালিনসহ যে কোনো ভেজাল মেশানোর ফলে বিভিন্ন রোগের নিয়ামক শক্তিরূপে আবির্ভূত হয় এবং তা থেকেই রোগের উৎপত্তি ঘটে । ফলে এর বিষাক্ত ছোবলে অসংখ্য মানুষ মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে । -এ প্রসঙ্গে পবিত্র কুরআন মাজিদে বলা হয়েছে- "কেউ যদি কাউকে (অন্যায়ভাবে) হত্যা করে তাহলে সে যেন সব মানুষকেই হত্যা করল" (-সূরা মায়িদা) । ভেজালযুক্ত খাবার বিক্রি নিষেধ করে মহানবী (সা.) বলেছেন, "একজন মুসলমান অন্য মুসলমানের ভাই, দোষযুক্ত কোনো মাল তার কাছে বিক্রি হালাল নয় যতক্ষণ সে দোষ বলে না দেয়" (-বুখারি, মুসলিম) ।

জনস্বাস্থ্যের জন্য হুমকিস্বরূপ ফরমালিন ব্যবহার বা ভেজাল বিরোধী অভিযানে সরকারকে শূন্য টলারেন্সে দেখাতে হবে এবং অসাধু ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে । সাথে সাথে ফরমালিন এবং ভেজাল বিরোধী সামাজিক আন্দোলনও গড়ে তুলতে হবে । আমরা আর ফরমালিনের কাছে জিম্মি হয়ে পড়তে চাই না । একটি সুস্থ্য এবং সুন্দর জাতি গঠনে আসুন সবাই কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে ভেজাইল্যা প্রতিরোধে কাজ করি । আর নিশ্চিন্তে ভেজালমুক্ত খাবার খেয়ে ফোকলা দাঁতে তৃপ্তির হাসিতে হাসি ! -পরিশেষ সমস্বরে ছোটকালে পড়া ছড়াটি আউরাই: ফরমালিনমুক্ত হতে নাকি জানে না কেউ কে বলেছে ভাই/ এই শোনো না কত ভেজালমুক্তির খবর বলে যাই ।।


____________________________________________
লেখক: পোস্টডক্টরাল গবেষক, ইয়োকোহামা সিটি বিশ্ববিদ্যালয়, জাপান এবং অধ্যাপক, রসায়ন বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ।

 
 

WARNING: Any unauthorized use or reproduction of 'Community' content is strictly prohibited and constitutes copyright infringement liable to legal action.

[প্রথমপাতা]