প্রথমপাতা  

সাম্প্রতিক সংবাদ 

 স্বদেশ

আন্তর্জাতিক

বাংলাদেশ কমিউনিটি

লাইফ স্টাইল

এক্সক্লুসিভ

বিনোদন

স্বাস্থ্য

বর্তমানের কথামালা

 শিল্প-সাহিত্য

 প্রবাসপঞ্জী 

আর্কাইভ

যোগাযোগ

 

 

 

 

 

সুখ টান নিকোটিনে
 

 

 

- ড. এস, এম, আবে কাউছার

 

 

সুখ টানেই যে হেব্বি শান্তি ! ধুৎ, আয়েশি ভংগিতে চোখ বুজে এক টান নয়, দু'টান নয়, তিন টান নয়, সুখ টান না দিলে কি আর স্বর্গীয় শান্তি মেলে ? দে, দে টান - সিগারেটে উন্মুখ লেহন করে জিরিয়ে জিরিয়ে দে ক'টি সুখ টান । আর পরক্ষনেই দম নিয়ে সুখ টানের প্রতি মোলের ফুঁক মিশে যায় আর্দ্র বায়ুমণ্ডলের স্তরে স্তরে । একি সারাদিনের ক্লান্তি থেকে মুক্তি পেতে সিগারেটে সুখ টান ? আসলেই কি স্বস্তির সুখ টান, না নিকোটিন পান ?

নিউরনে নিকোটিনের ঘাটতি পড়লেই সিগারেটে (নিকোটিনে !) সুখটান ? নিকোটিনের তৃষ্ণা ভর করেছে গলায় এবং মস্তিস্কে ? তাই সিগারেটে শেষ টানটা দিয়েই ফেলি ? তর্জনী এবং বৃদ্ধা আঙ্গুলের যৌথ প্রচেষ্টায় সিগারেটের অন্তষ্টিক্রিয়া সম্পন্ন করে খাড়া সূর্য্যের দিকে আকাশের বুকে ধোঁয়া ছেড়ে ইহজীবনের শান্তি !

আজাইরা একটা সুখ টান দিয়ে ধোঁয়া ছাড়ছেন আর সিগারেট ক্রন্দনে বলে উঠছে - "জন্ম থেকে জ্বলছি মাগো, আর কতদিন বল সইবো..." । যার জন্ম হয়েছে জ্বলে মরবার জন্য সে কিনা জ্বলতে চাচ্ছে না ? তা কি হয় ! প্রতি টান সুখ টান, মাঝে বিচ্ছিরি ঘ্রাণ । খুব কম লোকই খুঁজে পাওয়া যাবে যে জীবনে কেহ সুখ টান দেয়নি । হ্যাঁ, আমিও যখন ক্লাস এইটে পড়ি তখন আমার বাবার সিগারেট প্যাকেট থেকে চুরি করে বাড়ির পিছনে একটা পরিত্যক্ত ঘরে বসে জীবনে প্রথম সুখটান দিয়েছিলাম । আর পাশের কোথা থেকে যেন টেপ-রেকর্ডে বেজে ওঠেছিল ডলি সায়ন্তনীর সেই বিখ্যাত গান, "রংচটা জিন্সের প্যান্ট পরা, জ্বলন্ত সিগারেট ঠোঁটে ধরা" - এখনো সেই সুখ টানের প্রথম স্মৃতি মনে পড়ে । তবে চুরুটের হুক্কায় ও দু'চারটি সুখ টান দিয়েছিলাম ।

নিকোটিন (C10H14N2) একটি এলকালোয়েড ও দ্বি-চক্র বিশিষ্ট যৌগ যাতে পিরিডিন (Pyridine) এবং পাইরোলিডিন (Pyrrolidine)- রিং যুক্ত থাকে । একে 3-(1-methyl-2-pyrrolidinyl)pyridine ও বলা হয় । বর্ণহীন, তেলীয় প্রকৃতির, পানিতে দ্রবণীয় ও বিষাক্ত । তামাক জাতীয় উদ্ভিদে (Nicotiana tabacum) ও Nicotiana rustica পাতায় প্রচুর পরিমাণে নিকোটিন পাওয়া যায় । এছাড়া তামাকজাত বিভিন্ন দ্রব্য যেমন সিগারেট, জর্দা, গুল, সাদাপাতায় ও পাওয়া যায় । নিকোটিন গবেষণাগারেও সংশ্লেষন প্রণালীতে প্রস্তুত করা যায় । তামাক গাছ হতে সর্বপ্রথম নিকোটিন পৃথক করেন জার্মান পদার্থবিদ উইলেম হেনরিখ এবং রসায়নবিদ লুইডউইক উইম্যান ।

আসলে নিকোটিন একটি স্নায়ু বিষ বা নিউরোটক্সিন (Neurotoxin), যা একধরণের অ্যাসিটাইলকোলিন (Acetylcholine) রিসেপ্টরের কোলিনার্গিক (Cholinergic) অ্যাসিটাইলকোলিন রিসেপ্টর উপর কাজ করে । অ্যাসিটাইলকোলিন হচ্ছে একটি নিওরোট্রান্সমিটার (Neurotransmitter) যার কাজ হচ্ছে মস্তিষ্ক এবং শরীরকে উত্তেজিত করা । নিকোটিন মস্তিষ্কের রক্তনালীগুলোকে ধীরে ধীরে সঙ্কুচিত করে দেয় ফলে ব্রেইন স্ট্রোক হয়ে থাকে । এমনকি যে নিকোটিন আমাদের শরীর গ্রহণ করে, তা আমাদের হৃৎপিণ্ডের রক্তনালীকে সঙ্কোচিত করে ফেলে, যার কারণে বুকব্যথা, হার্ট অ্যাটাক ও হতে পারে । তাই এটি মানবদেহের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর ।

সংবিধিবদ্ধ সতর্কবার্তাটি মনে করিয়ে দিই । ধূমপান স্বাস্থ্যের পক্ষে একেবারেই ভাল নয় তাই সুখটান না দেয়াই ভালো । সিগারেটে একবার টান দেওয়া মাত্রই প্রচুর পরিমাণ নিকোটিন মুহূর্তের মধ্যেই (মাত্র ছয় সেকন্ড) মস্তিষ্কে ক্রিয়া-বিক্রিয়া শুরু করে । নিকোটিনের অণুগুলো মস্তিষ্কের রিসেপ্টরগুলোকে আঁকড়ে ধরে এবং ডোপামিনের (Dopamine) নিঃসরণ ঘটায় । ফলে ধূমপায়ীরা একটা সূখানুভূতি পেতে শুরু করে । ডোপামিন ছাড়াও এটি এন্ডোজেনাস ওপিওড নামক একটি রাসায়নিক মস্তিষ্কে ছড়িয়ে দেয় । এতে করে সুখ টানকারীরা একটা ইতিবাচক অনুভূতি পেতে পারেন - মিশিগান বিশ্ববিদ্যালয়ের এক গবেষণায় বিজ্ঞানীরা এমন তথ্যই দেন ।

অনেকে মনে করে থাকেন ফিল্টারযুক্ত সিগারেটে ঝুঁকির পরিমাণ অপেক্ষাকৃত কম । আসলে ব্যাপারটা পুরোপুরি সঠিক নয় । কারণ ফিল্টার সিগারেটের বিষাক্ত পদার্থগুলো আটকে রাখতে পারে না । জ্বলন্ত সিগারেট থেকে সরাসরি নির্গত ধোঁয়ার মধ্যে কারসিনোজেন (Carcinogen), অ্যামোনিয়া (NH3), বেনজোপাইরিন (Benzopyrene, C20H12), কার্বন মনোক্সাইড (CO) ইত্যাদি উৎপাদ বিভিন্ন অনুপাতে থাকে । এ রাসায়নিক উপাদানগুলো সিগারেট সেবনকারীর শ্বাসতন্ত্রে ক্যান্সার উৎপাদনে ভূমিকা রাখে । আবার অনেকেই নিকোটিনের হাত থেকে বাঁচার জন্য ইলেকট্রিক সিগারেট বা ই-সিগারেটের আশ্রয় নেন । কিন্তু তাতে কি ই-সিগারেট তৈরির জন্য যেসব রাসায়নিক পদার্থ বা ফ্লেভার ব্যবহৃত হয় তা ফুসফুসকে অকেজো ও ক্যান্সার তৈরি করতে পারে । - তো সাধু, সুখ টান হতে সাবধাণ !

একটি সিগারেটে ৮-১০ মিলিগ্রাম নিকোটিন থাকে, অবশ্য ব্র্যান্ড ভেদে ভিন্ন মাত্রায়ও থাকতে পারে । একটি গবেষনায় দেখা গেছে যে দুটি সিগারেটে যে পরিমান নিকোটিন থাকে তা যদি একটি সুস্থ মানুষের দেহে ইঞ্জেক্ট করে দেয়া হয় তাহলে সে মানুষটি তখনি মারা যাবে । আপনি সিগারেটে টান দিবেন পাশের লোকটিও সমান তালে আক্রান্ত হয়ে যাবে, এ সিগারেটের ধোঁয়া সহজেই শ্বাসতন্ত্রে প্রবেশ করে সমূহ ক্ষতিসাধন করে । বিভিন্ন তথ্যে দেখা যায়, প্রতিটি সিগারেটে একজন ধূমপায়ী গড়ে ৫ সেকেন্ড আয়ু হারায় । আর প্রতিবছর বিশ্বে ৪ মিলিয়ন লোক মৃত্যুবরণ করে থাকে এই নিকোটিনে সুখ টানের ফলে ।

সম্প্রতি ভারতের নরেন্দ্র মোদি সরকার ধূমপানের ক্ষেত্রে ন্যূনতম বয়সসীমা ১৮ থেকে বাড়িয়ে ২৫ বছর করার কথা ভাবছে । ২৫ বছর বয়স হওয়ার আগে সিগারেটে সুখটান নয় ! বাংলাদেশ সরকারও সিগারেট পানের বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ ও প্রকাশ্যে ধূমপান নিষেধ করবেন । ধূমপানমুক্ত দেশ গড়ার মাধ্যমে একটি স্বাস্থ্যবান জাতি সৃষ্টির লক্ষ্যে 'ধূমপান বিষ পান' এই আপ্ত বাক্যটির যথার্থতা উপলব্ধিতে সরকার বাস্তবমুখী পদক্ষেপ নিবেন ।

মাগার সিগারেটে "সুখটান না দিলে জুইত পাই না" কিংবা "না খেলে ঘুম আসে না" - এসব তত্ত্ব কথায় মত্ত না হয়ে সবাই মিলে সিগারেটকে মিউজিয়ামে পাঠাই । - আসুন দেহের পাম্পমেশিনটা সুস্থ্য ও সবল রাখি আর সুখ টান হতে বিরত থাকি যেন খাঁচার অচিন পাখিটা সহসা বেরিয়ে না যায় ।

____________________________________________
লেখক: পোস্টডক্টরাল গবেষক, ইয়োকোহামা সিটি বিশ্ববিদ্যালয়, জাপান এবং অধ্যাপক, রসায়ন বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ।

 
 

WARNING: Any unauthorized use or reproduction of 'Community' content is strictly prohibited and constitutes copyright infringement liable to legal action.

[প্রথমপাতা]