|
শরীরে কি রসায়ন মাখছি?
- ড. এস, এম, আবে কাউছার
কি অবাক কান্ড ! শরীরে রসায়ন মাখছি ?
নিত্যদিন ব্যবহারের আগে কখনো কি কিছুক্ষণের জন্যও ভেবেছি যে শরীরে আমরা কি
মাখছি ? যে সাবান শরীরে লাগাচ্ছি তা কি সত্যি সাবান নাকি জলজ্যান্ত রসায়ন ?
এ - যে রসায়নের রসনার রসালো রোম্যান্স ! পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার জন্য সাবান
ব্যবহার করেননি এমন মানুষ হয়তো এ নীলগ্রহে খুঁজে পাওয়া ভার । আর শরীর ও
মনের পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতাই যে সৌন্দর্যের প্রথম কথা - তা কিন্তু এনে দিয়েছে
রসায়নের এ মমতাময় মাখামাখি –ই ।
সাবান (Soap) আমাদের দৈনন্দিন জীবনের একটি অপরিহার্য পন্য । ছাই ও মসলার
সঙ্গে চর্বি ও কাদার মিশ্রণ ঘটিয়ে প্রথমবারের মতো তৈরি হয় সাবান ।
খ্রিষ্টপূর্ব ২৩ শতকে মেসোপটেমিয়ায় উদ্ভাবিত সাবানের কাঁচামাল ছিল ছাই ও
বিভিন্ন ধরনের মসলা । এও জানা যায়, বিশাল দেহাবশৈলী ষাঁড়ের চামড়ার নিচের
চর্বিকে বিশেষ প্রক্রিয়ায় সাবান হিসেবে ব্যবহার করতো রোমানরা । কালের
পরিবর্তনে পরিবর্তন এসেছে সাবানের আঙ্গিকেও - হয়েছে আধুনিকায়ন, এসেছে
নতুনত্ব । আজ সময়ের পথপরিক্রমায় রঙে-বর্ণে-গন্ধে সাবান পরিণত হয়েছে মনুষ্য
সভ্যতার এক অন্যতম অনুষঙ্গ প্রসাধনে ।
সাবান মাখামাখিতে রসায়নের রাসায়নিক আলিঙ্গনটা কি ? রঙ্গিন প্যাকেটে মোড়া
সাবানগুলো তৈরির প্রক্রিয়ায় কি আছে রসায়নের কলকাঠির নড়াচড়া ? আর কিছু নয়
সাবান হচ্ছে উচ্চ আণবিক ওজন বিশিষ্ট জৈব ফ্যাটি অ্যাসিড (যেমন- ওলিক
অ্যাসিড (C17H33COOH), স্টিয়ারিক অ্যাসিড (C17H35COOH), পামিটিক অ্যাসিড
(C15H31COOH) - এর সোডিয়াম বা পটাশিয়াম লবণ । সোজা কথা তাহলে সাবান হল
সোডিয়াম ওলিয়েট (C17H33COONa) বা সোডিয়াম স্টিয়ারেট (C17H35COONa) বা
সোডিয়াম পল্মিটেট (C15H31COONa) । অন্যভাবে বলা যায়, সাবান হল তেল/চর্বি ও
ক্ষার মিশ্রিত এক ধরণের কঠিন পদার্থ । সাবান তৈরির জন্য নারিকেল, সয়াবিন,
পাম, ইত্যাদি তেল এবং প্রাণীজ/উদ্ভিজ চর্বি ব্যবহার করা হয় । আমরা জানি তেল/চর্বি
হচ্ছে ট্রাইগ্লিসারলের এস্টার, একে সাধারনত "ট্রাইগ্লিসারাইড" বলা হয় । এ
ট্রাইগ্লিসারাইড সমূহকে সোডিয়াম বা পটাসিয়াম হাইড্রক্সাইডের সাথে বিক্রিয়া
করলে গ্লিসারল এবং এক প্রকার ফ্যাটি এসিড তৈরি হয় । এই ফ্যাটি এসিড
লবণটিকেই আমরা সাবান বলে জানি । আর সাবান তৈরীর এই প্রক্রিয়াকে 'স্যাপোনিফিকেশন'
(Saponification) বা 'সাবানায়ন' বলা হয় ।
অর্থাৎ, ট্রাইগ্লিসারাইড + সোডিয়াম হাইড্রক্সাইড (NaOH) / পটাসিয়াম
হাইড্রক্সাইড (KOH) → গ্লিসারল + সাবান (Soap)
সাধারণত তুলনামূলক শক্ত ধরনের সাবান তৈরীর জন্যে সোডিয়াম হাইড্রক্সাইড (NaOH)
এবং কোমল ধরনের সাবানের জন্যে পটাশিয়াম হাইড্রক্সাইড (KOH) ব্যবহার করা হয়
। সাবান পানিতে মেশালে আর্দ্র-বিশ্লেষণ ঘটে ক্ষার উৎপন্ন করে আর সেজন্যই
সাবান পানি পিচ্ছিল বোধ হয় । তবে চর্বি দিয়ে তৈরি সাবানে ফেনা একটু কম হয়,
অন্যদিকে তেল ব্যবহার করলে সাবান ভালো হয় । সাবানকে শক্ত ও ভারী করার জন্য
সোডিয়াম সিলিকেট (Na2SiO3) ব্যবহার করা হয় (পরিমাণমত যেন বেশি শক্ত হয়ে না
যায়) । এছাড়া পরিমাণমত সুগন্ধি মেশানো হয় । সর্বোপরি এমন রঙ ব্যবহার করা
উচিত যাতে ত্বকের ক্ষতি না করে এবং দ্রবণীয় হয় । সাবান তৈরির ক্ষেত্রে
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে তেল/চর্বির সঙ্গে কষ্টিক সোডার সঠিক অনুপাত
মেশানো । এটা ঠিক না হলে সাবানে বাড়তি তেল বা ক্ষার থেকে যাবে । সাধারণত
১০০ গ্রাম ওজনের তেল/চর্বির সাথে ১৪-১৯ ভাগ ওজনের কষ্টিক সোডা মেশানো হয় ।
জীবাণুনাশকের জন্য Triclosan (C12H7Cl3O2) নামক রাসায়নিক উপাদানটি
এন্টি-ব্যাকটেরিয়াল ও এন্টি-ফাংগাল এজেন্ট হিসেবে সাবানে দেয়া হয়ে থাকে ।
সাবানে গ্লিসারিনের উপস্থিতি ভালো কেননা এটা রুক্ষতা দূর করে ত্বকে আদ্রতা
বজায় রাখতে সাহায্য করে । চাইলে আপনিও ঘরে বসে অতি সহজে সাবান তৈরি করতে
পারেন ।
সাবান তৈরী করা যতটা-ই না সহজ, তার চেয়ে ততটাই কঠিন এর গুনগত মান যাচাই করা
। দেখা যায় প্রায় সব ধরনের সাবানের প্যাকেটের গায়ে TFM (Total Fatty
Matter) দেয়া থাকে । এ TFM সাবানে উপস্থিত ফ্যাটি এসিডের পরিমাণকে নির্দেশ
করে । সাধারণত ৬০% TFM এর নিচের সাবানগুলো ত্বকের জন্যে ক্ষতিকর । আর সবচেয়ে
ভালো হয় ৭০% এর বেশি TFM সমৃদ্ধ সাবান ব্যবহার করলে। তাই, সাবান কেনার আগে
অবশ্যই TFM এর পরিমাণ দেখে কেনাই ভালো । কেননা গোসলের জন্য সাবানে উপস্থিত
TFM এর মান যত বেশি হবে, সাবানটি তত বেশি ব্যবহারের উপযোগী হবে ।
ময়লা ও জীবাণুমুক্ত রাখতে আমরা গোসলের সময় নিয়মিত শরীরে সাবান ব্যবহার করে
থাকি । - এ যেন আমাগো গা এ সাবান নয় আস্ত রসায়ণের লেজ মাখছি ।
____________________________________________
লেখক: পোস্টডক্টরাল গবেষক, ইয়োকোহামা সিটি বিশ্ববিদ্যালয়, জাপান এবং
অধ্যাপক, রসায়ন বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ।
WARNING:
Any unauthorized use
or reproduction of
'Community' content is
strictly prohibited
and constitutes
copyright infringement
liable to legal
action.
[প্রথমপাতা] |
|