প্রথমপাতা  

সাম্প্রতিক সংবাদ 

 স্বদেশ

আন্তর্জাতিক

বাংলাদেশ কমিউনিটি

লাইফ স্টাইল

এক্সক্লুসিভ

বিনোদন

স্বাস্থ্য

বর্তমানের কথামালা

 শিল্প-সাহিত্য

 প্রবাসপঞ্জী 

আর্কাইভ

যোগাযোগ

 

 

 

 

 

তেল ও তেলীয় কথা
 

 

 

- ড. এস, এম, আবে কাউছার

 

 

তেল (Oil) মারতে পারিনি বলে এ তেলীয় যুগে অনেক কিছুই পাইনি । তবে আমি কাউকে তেল মর্দণ করতে যাইনি কখনও । যাদের এ বিশেষ মহামূল্যবান গুনটি আছে তাদের জীবনে হয়তো যা পাওয়ার কথা নয় তাও দু'পায়ের পদতলে এসে কুর্ণিশ করবে । তেল বহুগুনে গুণান্বিত । যাক, ওদিকটায় আমি যাবো না । আমার লেখা হবে তেলের রসায়ণ ও তৎসম্পর্কীয় তেলীয় কথা নিয়ে ।

তেল: স্বাভাবিক তাপমাত্রায় তরল অবস্থায় থাকে এমন একটি তরল পদার্থ যা কখনো পানির সাথে মিশে না কিন্তু জৈব দ্রাবকের সাথে মিশে যায় । তাইতো প্রচলিত কথায় আছে "তেলে-জলে কখনো মিশে না" । তেল হল ট্রাইগ্লিসারলের এস্টার (যাতে তিনটি এস্টার গ্রুপ থাকে), একে সাধারনত "ট্রাইগ্লিসারাইড" বলা হয় । এ ট্রাইগ্লিসারাইডকে আর্দ্রবিশ্লেষিত করলে গ্লিসারল ও ফ্যাটি এসিড পাওয়া যায় । তেলে উচ্চমাত্রার কার্বন ও হাইড্রোজেন থাকে তবে অক্সিজেনের পরিমাণ অন্যান্য জৈব যৌগ হতে কম । মানবজাতির উদ্ভবেরও বহু আগে এক ধরনের তেল সূষ্টি হয়েছে যাকে আমরা খনিজ তেল হিসাবে শ্রেনীভুক্ত করি এবং এগুলো আদিকাল থেকে সমুদ্রের তলদেশে জমে থাকা মৃত প্লাংকটন বা ভূগর্ভের বিভিন্ন স্থান যেমন: পাথরের স্তর, বালুর স্তর বা ফাপা স্থান থেকে আহরিত করা হয় । এসব বস্তু বিভিন্ন জৈব-রাসায়নিক প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে খনিজ তেল বা পেট্রোলিয়ামে রূপান্তরিত করা হয় । আর উদ্ভিদ, প্রাণী এবং অন্যান্য জীব থেকে জৈবিক প্রক্রিয়ায় যেসব তেল উৎপন্ন হয় তাকে জৈব তেল বলে । এছাড়া রসায়নবিদরা কৃত্রিমভাবে গবেষণাগারে রাসায়নিক যৌগ থেকে প্রস্তুত কৃত তেলকে সিনথেটিক তেল বলা হয় ।

তেলীয় কথা: তেল ছাড়া কি চলা যায় ? উত্তর না ! উহা বড়ই জরুরি জিনিস ! একেবারে ছোটবেলা থেকেই শুনে এসেছি, "অয়েল ইওর ওন মেশিন" বা "নিজের চরকায় তেল দাও" । -দিচ্ছি ? সাধ্যমতো চেষ্টা করছি । যদিও সবসময় সাধ আর সাধ্যের মধ্যে সেতুবন্ধন তৈরি করা যায় না । আমরা উচ্চবিত্ত থেকে নিম্নবিত্ত সবাই তেল দিতে চাই । তেল দিয়ে তৈলাক্ত হতেও চাই। তেলেই যে শান্তি । আবার অশান্তির মূলেও ওই তেল । সময়মতো তেল ঢেলে দিতে না পারলে যে কেউ তেলে-বেগুনে জ্বলে উঠতে পারে ।

আছে নানা রকমের তেল, যেমন- সরিষার তেল, সয়াবিন তেল, নারিকেল তেল, অলিভ অয়েল বা জলপাই তেল, সূর্যমুখী তেল, রাইস ব্রেন তেল, পাম অয়েল, কালোজিরা তেল, কাঠবাদাম তেল, তিলের তেল, তিসির তেল, মাছের তেল ইত্যাদি । প্রায় সবধরণের তেলেই বিভিন্ন মাত্রার সম্পৃক্ত বা স্যাচুরেটেড (দ্বি-বন্ধন নেই) এবং একক-অসম্পৃক্ত বা আনস্যাচুরেটেড (দ্বি-বন্ধন আছে) ফ্যাটি এসিড বিদ্যমান। এছাড়া পলি বা বহু-অসম্পৃক্ত ফ্যাটি এসিড ও রয়েছে । এতে লিনোলেনিক এসিড (C18H30O2, ওমেগা-৩), লিনোলিক এসিড (C18H32O2, ওমেগা-৬) এবং অলিক এসিড (C18H34O2, ওমেগা-৯) আছে । যা মানবদেহের জন্য অত্যন্ত উপকারী । মানুষের রক্তের কোলেস্টেরল ও উচ্চ রক্তচাপ কমাতে সাহায্য করে যাতে হৃদরোগের ঝুঁকি কমায় । সম্প্রতি জাপানি বিজ্ঞানীরা গবেষণা করে দেখেন, যারা দৈনন্দিন খাদ্যে শতকরা পাঁচ ভাগ লিনোলিক এসিড ব্যবহার করেন তাদের স্ট্রোকের ঝুঁকি শতকরা ২৮ ভাগ হ্রাস পায় ।

আমাদের দেশে সবচেয়ে জনপ্রিয় তেল হল সরিষার তেল । এ তেলে একক-অসম্পৃক্ত ফ্যাটি এসিডের পরিমাণ (৬৫-৭০%) বেশি থাকায় পুষ্টিমানের বিচারে তেলটি উৎকৃষ্ট। মজার ব্যাপার হল- এতে এ্যালাইল আইসোথায়োসায়ানেট এবং ইরোসিক এসিড থাকার কারণে তীব্র ঝাঁঝালো গন্ধ বের হয় । অন্যদিকে সূর্যমুখী তেলে ক্ষতিকারক ইরোসিক এসিডটিই নেই । আর সয়াবিন তেলে পলি বা বহু-অসম্পৃক্ত ফ্যাটি এসিডের পরিমাণ বেশি (প্রায় ৬৪%) থাকায় অনেকেই সয়াবিন তেল পছন্দ করেন ।

জলপাইয়ের তেল বা অলিভ ওয়েল যাকে আরবিতে 'জয়তুন' বলে । এ তেল প্রসঙ্গে আল্লাহর রসূল (স.) বলেছেন, "তোমরা এই তেলটি খাও এবং তা শরীরে মাখাও" । বুঝতেই পারছেন এর গুরুত্ব ! যদিও বাংলাদেশে জলপাই তেলের ব্যাবহার তেমন নেই । শুধুমাত্র শীতকালে শরীরে মাখার কাজে জলপাই তেল ব্যবহৃত হয়, তাও খুবই কম । গবেষকরা দেখিয়েছেন, খাবারে জলপাইয়ের তেল ব্যাবহারে শরীরের ব্যাড ক্লোষ্টোরেল (LDL) কমায় এবং গুড ক্লোষ্টোরেল (HDL) বৃদ্ধি করে ।

এ অত্যাবশকীয় ভোজ্য তেলে যেন ভেজাল না মিশাই কিন্তু অসাধু ব্যবসায়ীরা কি শুনে এই কথা ? ভোজ্য তেলে ফ্যাটি এসিডের মাত্রা যেন সহনীয় পর্যায়ে থাকে । সঠিক ভালো মানের তেল নির্ণয় করতে এর রং, এসিড ভ্যালু, আয়োডিন ভ্যালু, ইনডেক্স ভ্যালু ও মেল্টিং পয়েন্ট পরীক্ষা করতে হয়। যেসব তেল সঠিক পরীক্ষার মধ্য দিয়ে পরিশোধন করা হয়, সেগুলোয় এসিড ভ্যালু কম থাকে । যেগুলোয় এসিড ভ্যালু বেশি থাকে সেগুলো পরিশোধন ছাড়াই বা স্বল্প পরিশোধনে বাজারজাত করা হয় । ভোজ্য তেলে এ ধরনের এসিডের মাত্রা বেশি থাকার কারণে মানবদেহে শক্তির জোগান ও টিস্যু গঠন বাধাগ্রস্ত হতে পারে । এসিডের অতিরিক্ত এ মাত্রা হার্টের জন্য ক্ষতির কারণ হতে পারে। এমনকি ক্যানসারের মতো রোগও হতে পারে ।
এই পরম উপাদান তেলের যে কত ব্যবহার তার কোন হিসেব নেই । কোথায় নেই তেলের ব্যবহার ? জ্বালানি হিসাবে, বিদ্যুত উৎপাদনে, পিচ্ছিলকারক পদার্থ রূপে, চিত্রকর্ম অঙ্কনে, ভোজনে, সৌন্দর্য ও স্বাস্থ্য রক্ষাকল্পে- এতো তেলের গুণাগুণ যে বলে শেষ করা যাবে না । তেল হল মোটরযানের কাছে রক্তের মত একটা বস্তু । মানুষ যেমন রক্ত ছাড়া বাঁচতে বা চলতে পারে না, তেমনই ইঞ্জিনও অয়েল ছাড়া চলতে পারে না । -যুগ যুগ ধরে তেল দিয়ে আলু ভর্তা, বেগুন ভর্তা, ডিম ভাজি আর ঝালমুড়ি খাওয়া কি ভূলার মত ? তবে পুষ্টিবিজ্ঞানীদের মতে, রোজ মাথাপিছু ৩-৪ চা চামচ (১৫-২০ মিলি) তেলই যথেষ্ট আর নিরাপদ। এর বেশি তেল না খাওয়াই ভালো ।

লেখার শেষাংশে বাঁশের সঙ্গে তেলের নিবিড় সম্পর্ক দিয়েই শেষ করছি । গণিতবিদরা কেমন করে যেন বাঁশের সঙ্গে তেলের সেই নিবিড় সম্পর্কটা আবিষ্কার করেছিলেন । আবিষ্কার করেছিলেন বলেই অধিকাংশ ছাত্রকেই তৈলাক্ত বাঁশে বানরের ওঠা-নামার পাটিগণিতের অঙ্ক কষে পরীক্ষায় পাস করতে হয়েছে । -আসুন আমরা তেল দিয়ে তেলীয় কথার তেলেসমাতিতে সব পরীক্ষায় পাস করি । আর ত্যাগে, ভোগে সর্বময় তেলতেলে ও তেলময় থাকি ।


____________________________________________
লেখক: পোস্টডক্টরাল গবেষক, ইয়োকোহামা সিটি বিশ্ববিদ্যালয়, জাপান এবং অধ্যাপক, রসায়ন বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ।

 
 

WARNING: Any unauthorized use or reproduction of 'Community' content is strictly prohibited and constitutes copyright infringement liable to legal action.

[প্রথমপাতা]