|
কোরবানি
-আকাশ মামুন-
কোরবানির ঈদ চলে এলো। স্কুল বন্ধ হয়ে গেছে। যারা চাকরি নিয়ে শহরে থাকে;
এমনকি রোজার ঈদেও গ্রামে আসেনি; তারাও কোরবানীর ঈদ করতে নিজ গ্রাম জালিচিরা,
কাঁকড়াগণি, জয়নাগাছা, বেদুরিয়া, বেরিবাইদ, থানারবাইদ, চাপাইদ, ঘুঘুর বাজার
আসতে শুরু করেছে। হই-হুল্লুড চলছে গ্রামে-গ্রামে। ধুন্দুমার তালে চলছে
ক্রিকেট খেলা। এ গ্রামের সাথে ও গ্রামের ক্রিকেট ম্যাচ। জালিচিরা জুনিয়র
ক্রিকেট টিমের অন্যতম ব্যটসম্যান নবাব কদিন হল খেলতে যাচ্ছে না। তার বন্ধু
রাজ গাগরা, পিরেন জাম্বিল ও আবেল মানখিন এসেছিল। আজ তাদের টিমের সাথে কেজাই
প্রাইমারি স্কুল মাঠে খেলা আছে কাঁকড়াগণি টিমের। কাঁকড়াগণি ভাল ক্রিকেট খেলে,
বেশ শক্তিশালী দল। তার উপর নাকি তাদের টিমে ঢাকা থেকে একজন ব্যাটসম্যান
এসেছে। নবাব না খেললে তাদের ব্যাটিং লাইন দুর্বল হয়ে পড়ে। কিন্তু নবাব যাবে
না বলে দিয়েছে। নবাবের এখন যাবার সময় নেই। এখন বিল্টুকে তার সময় দিতে হয়।
তাদের আদরের পোষা গরু বিল্টু। দুদিন বাদেই তাকে কোরবানি করা হবে। সেবার
নবাবের ভীষন অসুখ করেছিল। নবাবের অসুখ ভাল হলে বিল্টুকে কোরবানি করবেন বলে
বাবা মানত করেছিলেন। বাবাকে নবাব বলেছিল, বিল্টুকে কোরবানি না করলে কী হয়?
বাবা বলেছিলেন, কোরবানী করতেই হবে। নয়তো আল্লাহ বেজার হবে, গুণাহ লিখবে।
নবাব বলেছিল, আল্লাহ এতো খারাপ কেন? অন্যের গরুর প্রতি তার লোভ কেন? সে নিজে
গরু পালতে পারে না? বাবা তাকে ধমক দিয়েছিল। বলেছিল, আল্লাহকে নিয়ে ওসব বলতে
হয় না। আল্লাহ গরুর মাংস খায় না। সে শুধু মানুষের ঈমান দেখে, মাংসতো তোরাই
খাবি। ধমক খেয়ে নবাব চুপ হয়ে গেলেও মনে মনে আল্লাহ কে অনেক বকাই দিয়েছে।
সত্যিতো লোকটা খারাপ, অনেক লোভী এবাং বদমাস। টেলিভিশনে খারাপ লোকরা যেমন হয়
তেমন। তেমন না তো কী? মাংস খাবে না তো অত বড় একটা গরু তার জন্য কেন কোরবানি
করতে হবে। কোরবানি করতে হলে নিজের গরু কোরবানি করুকগে। অন্যের গরুর গলা দিয়ে
রক্ত বের হবে আর সে বসে বসে হাসব? চোর কোথাকার। সে কিছুতেই বিল্টুকে কোরবানি
হতে দিবে না। যে কোন একটা উপায় সে বের করবেই। বাইদে ঘাস খাওয়াতে খাওয়াতে
বিল্টুর মুখে একটা চুমু দিয়ে নবাব বলল, চিন্তা করিসনে বিল্টু যে ভাবেই হোক
তোকে আমি বাঁচাবই। কিন্তু কি ভাবে বাঁচানো যায় তা ঠিক ভেবে পেল না নবাব। মা
কে ধরেছিল, মা বলেছে কোরবানি করতেই হবে। নয়তো গ্রামের মানুষ তাদের খারাপ
বলবে। একঘরে করে রাখবে।
কাল ঈদ। দিন পেরিয়ে রাত চলে এলো। বিল্টুকে বাঁচানোর কোন পথই নবাব পেলো না।
ভাবতে ভাবতে কখন যেন ঘুমিয়ে গেল নবাব। মাঝ রাতে ঘুমের মধ্যে দেখতে পেল,
মসজিদের ঈমাম তরবারি হাতে দাঁড়িয়ে আছে। বাবা একটা গর্তের কাছে দড়ি ধরে
বিল্টুকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে। বিল্টু তেড়ে-তুড়ে পালাতে চাচ্ছে। নবাবের দিকেও
একবার এসেছিল। কিন্তু নবাব কিছুই করতে পারলো না। শেষে শাহামত, আলাল কাকা,
ছমির জ্যাঠা, খলিল ভাই, বাদশা দাদা ও বাবা মিলে বিল্টুকে পা বেঁধে গর্তে
কাছে শুইয়ে দিল। বিল্টু অপলক দৃষ্টিতে নবাবের দিকে তাকিয়ে আছে। চোখের কোন
দিয়ে পানি ঝড়ছে। ঈমাম সাহেব আজ সকালে বালুতে ঘঁষা চকচকে তরবারি দিয়ে
বিল্টুর গলাটা কেঁটে ফেলল। বিল্টু পা ছোঁড়ে ছমির জ্যাঠার গালে একটা লাত্থি
মেরে দিল। ছমির জ্যাঠা ছেড়ে চলে গেলেও বাকিরা শক্তি দিয়ে বিল্টুকে চেপে
ধরল। হামেসাই বিল্টু ফিনকি দিয়ে রক্ত ঝরিয়ে নিস্তেস হয়ে পড়ে রইল। অপলক
পাথরের মত চোখে সে নবাবের দিকে তাকিয়ে রইল। নবাব চিৎকার দিয়ে ঘুম থেকে জেগে
উঠল। মা বললেন, কি হয়েছে নবাব স্বপ্ন দেখেসিস? পানি খা। নবাব পানি খেলো,
কিন্তু তার ঘুম আর এলো না। মা-বাব ঘুমিয়ে গেলে চুপিচুপি নবাব বিছানা ছেড়ে
বাইরে বেরিয়ে এলো। গোয়াল ঘরের দরজা খুলে নবাবকে নিয়ে বেরিয়ে গেল। হাঁটতে
হাঁটতে মৃদু জ্যোৎসনায় দোখলা ফরেস্ট রেঞ্জের দিকে গেল। এদিকটায় খুব বেশি
লোক আসে না। গহীন বনে ভিতর গিয়ে একটা বাইদের মধ্যে বিল্টুকে বেঁধে বাড়ি
ফিরে এলো। চুপিচুপি ঘরে ঢুকে শুয়ে পড়ল। এবার নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে পড়লো। সকালে
বাবার আর্তচিৎকারে ঘুম ভাংল নবাবের। তাদের বিল্টু চুরি হয়ে গেছে। শোরগোল
উঠল চারদিকে। চাউর হয়ে গেল জামাল মিয়ার কোরবানির গরু চুরি হয়েছে। ঈদগাহ
থেকে এসে একটু বাদেই কুরবানি শুরু হয়ে যাবে। কিন্তু পাঁচ গ্রামের কোথাও
জামাল মিয়ার গুরু খোঁজে পাওয়া গেল না। ঈমাম সাহেব এসে বললেন, যেহেতু নিয়াত
করেছে তাই জামাল মিয়াকে কোরবানি করতেই হবে। শেষে পোষা ছাগল কোরবানি করা হল।
নবাব বেশ ফুরফুরে মেজাজে বন্ধুদের সাথে ঘুরে বেড়াচ্ছে। তার বন্ধু, খেলার
সাথি বিল্টু বেঁচে গেলো।
রাতে সবাই যখন ঘুমিয়ে পড়ল_নবাব চুপিচুপি ঘুম থেকে উঠে দোখলা বাইদে গিয়ে
বিল্টুকে বাঁধন মুক্ত করে দিল। মুক্ত হয়ে বিল্টু নবাবের সাথে বাড়ির পথ ধরল।
খড়ের গাদায় কাছে বিল্টুকে রেখে নবাব ঘরে ঢুকে ঘুমিয়ে পড়ল। সকালে ঘুম ভেঙ্গে
জামাল মিয়া তো অবাক। তাদের বিল্টু খড়ের গাদায় খড় খাচ্ছে। পাড়াময় রটে গেল।
জামাল মিয়ার কোরবানির গরু পাওয়া গেছে। কেউ কেউ বলাবলি করছিল_গরু কোরবানি না
দিতেই জামাল মিয়া গরুটা লুকিয়ে রেখেছিল। ঈমাম সাহেব এসে বললেন, জামাল মিয়া
খোঁজে পাওয়া এই গরুটাকেও তোমার কোরবানি দিতে হবে। নয়তো আল্লাহ নারাজ হবেন।
অগত্য বিল্টুকে কোরবানি দিতেই হল। নবাবের আকুতি, কান্না কিছুই বিল্টুর
কোরবানি থামাতে পারল না। মা বিল্টুকে বোঝালেন কাঁদিস নে বাবা। আমরা আর একটা
বিল্টু তোকে কিনে দিব। কাঁদতে কাদঁতে বিল্টু বলল, মা তুমি যদি হারিয়ে যাও
তবে কী আর একটা মা এনে দিলেই তোমাকে আমি পাব মা? নিরুপায় হয়ে মা বললেন,
কাঁদিস নে বাবা। বেহেস্তে গিয়ে বিল্টুর সাথে আল্লাহ তোকে দেখা করিয়ে দিবেন।
দুনিয়াতে যার প্রতি বেশি ভালবাসা থাকে বেহেস্তে তাকে পাওয়া যায়। সেটা কেমন
মা? এই ধর বেহেস্তে আমি, তুই, তোর বাবা এক সাথে থাকব। সেখানে আল্লাহ
বিল্টুকেও দিয়ে দিবেন।
মায়ের সান্তনা পেয়ে বিল্টু ভাবতে থাকল_তবে বেহেস্তেই সে আর বিল্টু থাকবে।
বেহেস্তে বিল্টুর সাথে দেখা হবে বলে ঘরে রাখা কিটনাশক খেয়ে নিল নবাব।
যতক্ষণে টের পাওয়া গেল_ততক্ষণে বেশ দেরি হয় গেছে। পাহাড়ি এবড়ো-থেবড়ো
রাস্তায় দুলতে-দুলতে একটা ভ্যান নবাবকে নিয়ে জলছত্র হাসপাতালের দিকে ছুটে
চললো। ভ্যানে বসে নবাবের মা বিলাপ করছেন। নবাব বলছে কেঁদো না মা। আমি
বেহেস্তে নবাবের সাথে থাকব। তুমি চলে এলে তোমার সাথেও দেখা হবে। আমি
বেহেস্তে যাচ্ছি মা, আমি যাচ্ছি… ।বিড়বিড করতে করতেই নবাবের দেহ নিথর হয়ে
এলো। নবাব কে জড়িয়ে ধরে মা বিলাপ করতে লাগলেন, আল্লাহরে আমি কেন মিথ্যে
সান্তনা দিতে গেলাম। আল্লাহ….।
ARNING:
Any unauthorized use
or reproduction of
'Community' content is
strictly prohibited
and constitutes
copyright infringement
liable to legal
action.
[প্রথমপাতা] |
লেখকের আগের লেখাঃ
|