|
(মতামতের জন্যে সম্পাদক দায়ী নয়।)
রাহমান মনি
জাপানের ওকিনাওয়ার
মাটিতে বাংলাদেশের মুখ উজ্জ্বল করা মুন্সিগঞ্জ এর জাকির খান
নাম তার জাকির খান। জাপানে এই নামেই তিনি
পরিচিত। তার চেয়েও বেশী পরিচিত খান সান অর্থাৎ মিস্টার খান নামে। যদিও বন্ধু
মহল এবং মুন্সিগঞ্জবাসীর কাছে তিনি খোকন নামেই পরিচিত। মা-বাবার সবচেয়ে ছোট
সন্তান হিসেবে হয়তোবা খোকন নামটি হয়ে থাকতে পারে।
নাম যা-ই হউক না কেন তিনি জাপানের দ্বীপরাজ্য ওকিনাওয়াতে বয়ে বেড়াচ্ছেন
বাংলাদেশের ঝান্ডা। উজ্জ্বল করছেন বাংলাদেশের ভাবমূর্তি।
আর বাংলাদেশের ঝান্ডা বয়ে বেড়াবেননা না-ই কেন, এই পতাকার জন্যই যে তার
অগ্রজ দু’দুইটি ভাই সম্মুখ যোদ্ধা হিসেবে জীবন বাজী রেখে মহান মুক্তিযুদ্ধে
অংশ নিয়ে পাক হানাদার বাহিনীকে পরাস্ত করে যে পতাকা ছিনিয়ে এনে বীরদের
তালিকায় স্থান করে নিয়েছেন, সেই পতাকা বয়ে বেড়াবার, সন্মান রক্ষা করার
দায়িত্ব যে তারই উপর।
১৯৯০ সালে ভাগ্যের অন্বেষণে জাপান এসেছিলেন জাকির খান খোকন।
ভাগ্যের অন্বেষণে জাপানে আসলেও জাকির খান ভর্তি হন জাপানী ভাষা শিক্ষা
ইন্সটিটিউট-এ। এসময় তিনি একটি ইটালিয়ান রেস্টুরেন্ট এ খন্ডকালীন চাকুরী করতে
থাকেন।
JAFLY নামক প্রতিষ্ঠান থেকে জাপানী ভাষা শিক্ষা কোর্স শেষ করে ১৯৯১ সালের
শেষের দিকে জাপানের বিখ্যাত ডিউটি ফ্রি শপ LAOX-এ (Akihabara ) যোগ দেন।
সেখানে তিনি প্রায় সাড়ে তিন বছর কাজ করেন। তিনি বিদেশী ক্রেতা বিশেষ করে
বিভিন্ন দেশের দুতাবাস সংশ্লিষ্টদের সামাল দিতেন। LAOX -এ কাজ করার সময় তিনি
উপলব্দি করেন ইংরেজী ভাষার উপর তার দক্ষতা পর্যাপ্ত নয়। প্রয়োজন ইংরেজী ভাষা
এবং কম্পিউটার-এর উপর দক্ষতা উন্নয়ন। নতুবা আধুনিক সমাজের সাথে তাল মিলিয়ে
চলা কষ্টকর।
সেই উপলব্দি থেকে ঠিক করেন ইংরেজী ভাষায় দক্ষতার উন্নতি করার। মনঃস্থির
করেন কানাডা কিংবা নিউজিল্যান্ড গিয়ে ইংরেজী ভাষায় একাডেমিক ডিগ্রি নেয়ার
পাশাপাশি CBA (Certificate in Business Administration) ডিগ্রিটা অর্জন করা।
যেই কথা সেই কাজ থেকে যোগাযোগ করেন কানাডার ক্যালগারি ও নিউজিল্যান্ড এর
শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সাথে। কিন্তু প্রথম পছন্দ নিউজিল্যান্ড এর ক্রাইস্ট
চার্চ (Old name: CPIT. New name: Ara Institute of Canterbury. ) এর।
ইতোমধ্যে কানাডার ক্যালগারি থেকে প্রয়োজনীয় কাগজপত্র চলেও আসে। অপেক্ষা করতে
থাকেন নিউজিল্যান্ড এর (Old name: CPIT.) আসার। একসময় তা এসেও যায়।
কানাডার ক্যালগারি প্রচন্ড শীত বিধায় তিনি নিউজিল্যান্ডকে-ই বেছে নেন এবং
একসময় দুই বছরের জন্য চলেও যান। সময়টা ছিল ১৯৯৫ সাল।
এ সময় বন্ধু বান্ধব, পরিচিত মহল থেকে অনেক বাধা এবং বাক্যবানে জর্জরিত হতে
হয়েছে। তা সত্বেও নিজ ভবিষ্যতের কথা ভেবে তিনি দুই বছরের জন্য পাড়ি জমান
নিউজিল্যান্ড-এ।
১৯৯৭ সালে নিউজিল্যান্ড থেকে জাপানে ফিরে যোগ দেন H,I,S ( এইচ,আই,এস বা
হিদেও ইন্টারন্যাশনাল সার্ভিস ) নামক জাপানের প্রথম সারির একটি ট্রাভেল
এজেন্সি’র ‘নাম্বার ওয়ান ট্রাভেল’ বিভাগে।
সেখানে ৩ বছর কাজ করার পর সেখানে ইস্তফা দিয়ে একই ধারার ‘হিট ট্রাভেল’ এর
ব্রাঞ্চ ম্যানেজার হিসেবে যোগ দেন। একই বছর রাজধানী টোকিও ছেড়ে ওকিনাওয়া
প্রিফেকচারের এরিয়া ম্যানেজার হিসেবে যোগ দেন। বছরটি ছিল ২০০০ সাল।
বড় কোম্পানি ছেড়ে ছোট কোম্পানিতে যোগ দেয়ার সুবিধা সম্পর্কে জনাব খান বলেন,
বড় কোম্পানিতে দীর্ঘদিন কাজ করলে কাজ শিখা হয়, কাজে দক্ষতা আসে, অভিজ্ঞতা
অর্জন করা যায়, এর বেশী কিছু নয়। কারন, ওখানে কাজ করতে হয় কোম্পানির বেধে
দেয়া নিয়মে। নিজের প্রতিভা বিকাশের সুযোগ থাকে না, নীতি নির্ধারণে কোন
ভুমিকা রাখা যায় না।
কিন্তু ছোট কোম্পানিতে কাজ করতে করতে একসময় নিজের প্রতিভা বিকাশের সুযোগ এসে
যায়। অর্জিত অভিজ্ঞতা নীতি নির্ধারণে প্রভাব ফেলা যায়।
এক পর্যায়ে কোম্পানি সম্প্রসারণ এবং ব্যবসা প্রসারে জাকির খানের কাছে
ওকিনাওয়া থেকে আমেরিকায় বদলীর অনুরোধ আসলে তা প্রত্যাখ্যান করে ওকিনাওয়াতেই
থেকে যান।
ওকিনাওয়াতে থেকে যাওয়ার কারন হিসেবে খান বলেন, বলতে পারেন ওকিনাওয়ার প্রতি
প্রেম থেকেই ওকিনাওয়াতে থেকে যাওয়া। কারন, ওকিনাওয়াতে আমি আমার দেশ
বাংলাদেশের মাটি ও মানুষের গন্ধ খুঁজে পাই। ওকিনাওয়ার আবহাওয়া, মানুষের
জীবন যাপন সব কিছুতেই আমি আমার নিজ জন্মভূমির সাদৃশ্য খুঁজে পাই। বলতে
পারেন ওকিনাওয়া হ’লো আমার দ্বিতীয় জন্মভূমি ।
তবে ওকিনাওয়াতে এতোকিছু থাকার পরও খাবার গ্রহনে একটা সমস্যায় ভুগতে ছিলাম।
বাঙালী বলে কথা। জন্মের পর থেকেই মসল্লাযুক্ত অর্থাৎ স্পাইসি খাবার খেয়ে
অভ্যস্ত। কিন্তু এখানে কেবলি মসল্লামুক্ত খাবার খেতে হয়। স্পাইসি খাবার
যা-ও বা পাওয়া তা আবার ধর্মীয় বিবেচনায় গ্রহনীয় নয়।
রেস্টুরেন্ট এ খন্ডকালীন চাকুরী করার পূর্ব অভিজ্ঞতা এবং নিউজিল্যান্ড এ
বি,বি,এ (ব্যাচেলর অফ বিজন্যাস এডমিনেস্ট্রেশন) করার সুবাদে ম্যানেজমেন্ট
করার আত্মবিশ্বাস সব সময়ই ছিল।
খান বলেন, HIT ট্রাভেল এর কর্নাধার সাওয়াদা Mr. Hadi পরামর্শে ওকিনাওয়াতে
রেস্টুরেন্ট ব্যবসা শুরু করি। উদ্দেশ্য ছিল দুইটি। প্রথমত, এখানে আমি সহ
আমার মতো যারা স্পাইসি খাবারের সমস্যায় ভুগতে ছিলেন তাদের সেই সমস্যা লাঘব
করা। বিশেষ করে হালাল খাবারের। এবং দ্বিতীয়ত ওকিনাওয়াতে আমাদের খাদ্য
সংস্কৃতিকে পরিচিতি করানো। যদিও রেস্টুরেন্ট এর নাম দেয়া হয়েছে ইন্ডিয়ান
ফুড “কাবাব রেস্টুরেন্ট” ।
কারন, ব্রিটিশ শাসনামলে বাংলাদেশ, ভারত এবং পাকিস্তান একই কলোনির
অন্তর্ভুক্ত ছিল বিধায় এই তিনটি দেশের খাদ্য সংস্কৃতির কিছুটা মিল রয়েছে বৈ
কি। আর মূল শব্দটি ‘কেবাব’ হলেও আমাদের এই অঞ্চলে তা কাবাব নামেই সমধিক
পরিচিত। আর পরিচিত সবকিছুর প্রতি সবার আলাদা একটা দুর্বলতা থেকেই থাকে।
সেই থেকেই ট্রাভেল এজেন্সির চাকুরী ছেড়ে জনাব খানের ব্যবসায়ী হিসেবে পথ চলা
শুরু।
না, নিয়মিত আয়ের চাকুরী ছেড়ে অনিয়মিত আয়ের পথ বেছে নেয়াটা খানের জন্য ভুল
ছিল না।
হয়তো কোটি কোটি টাকার মালিক বনে এখনো পৌঁছতে পারেননি, তবে তার চেয়েও অনেক
উপরে পৌঁছেছেন যেমন নিজে, তেমনি সন্মানিত করেছেন নিজ দেশের। তার মাধ্যমে
ওকিনাওয়াতে পরিচিতি পেয়েছে প্রিয় বাংলাদেশ।
খান জানান, ওকিনাওয়া পর্যটকদের জন্য আকর্ষণীয় এবং দর্শনীয় স্থান।
আভ্যন্তরীণ এবং আন্তর্জাতিক অনেক সভা সেমিনার এই ওকিনাওয়াতে হয়ে থাকে।
বিভিন্ন দেশের কূটনীতিক বিশেষ করে মুসলিম দেশগুলির কূটনীতিক এবং পর্যটকরা
হালাল খাবারের সন্ধানে ছুটে আসেন কাবাব রেস্টুরেন্ট-এ। কেহ সরবে জানান দিয়ে
আবার কেহবা নীরবে নিভৃতে। এইতো গত এপ্রিল মাসে আধুনিক মালয়েশিয়ার রূপকার ডঃ
মাহথির মাহমুদ ব্যক্তিগত সফরে ওকিনাওয়া এলে উল্লেখিত বাংলাদেশী রেস্টুরেন্টে
আসেন এবং মধ্যাহ্ন ভোজ সারেন। যদিও সে সময় আমি ব্যবসায়িক কাজে বাংলাদেশে
অবস্থান করছিলাম বলে খান যোগ করেন।
ওকিনাওয়াতে ইয়ং বিজন্যাস পার্সন হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন খান। একজন
ইয়ং বিজন্যাসম্যান হিসেবে খান এর নাম এখন পুরো ওকিনাওয়া ব্যাপী। নিজ
যোগ্যতায় স্থান করে নিয়েছেন বিভিন্ন চেম্বারস এবং স্থানীয় সামাজিক সংগঠন
সমূহের সাথে। কেবল জড়িতই শুধু নন, কাধে নিয়েছেন নেতৃত্বও । ওকিনাওয়া
প্রিফেকচার ফুড এবং বেভারেজ এসোসিয়েশন এর সভাপতির ভার তার উপর। দীর্ঘদিন ধরে
তিনি এই দায়িত্ব পালন করে আসছেন। যদিও এইটা অবৈতনিক তথাপি অত্যন্ত
সন্মানজনক।
শুধু বাংলাদেশী হিসেবেই নয়, একজন বিদেশী হিসেবে ওকিনাওয়ার খান জাপানের ৪৭টি
প্রশাসনিক জেলার মধ্যে প্রথম এবং একমাত্র বিদেশী হিসেবে ফুড এন্ড বেভারেজ
এসোসিয়েশন অফিস এর সর্বোচ্চ (নির্বাহী প্রধান) পদে আসীন।
রেস্টুরেন্ট ব্যবসা ছাড়াও জাকির খান বর্তমানে বাংলাদেশে ফেব্রিক্স ব্যবসা
করছেন। বাংলাদেশী পণ্যকে জাপানের বিভিন্ন প্রদর্শনীতে পরিচিত করে চলেছেন।
জাপানী উদ্যোক্তাদের বাংলাদেশে বিনিয়োগ করানো এবং বাংলাদেশী পণ্যকে জাপানে
বাজারজাত করার কাজ করে যাচ্ছেন নিরলসভাবে।
জাকির খান বর্তমানে জাপানের নামী দামী ( ব্র্যান্ড মেকার Aeon, Right-On,
Shimura ETC ) কোম্পানি গুলোর পোশাক শিল্পে তাদের চাহিদা মোতাবেক পণ্য
বাংলাদেশ থেকে তৈরি করিয়ে এনে জাপানে বাংলাদেশের তৈরি পোশাক শিল্পকে প্রমোট
করা সহ বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে অনন্য ভূমিকা রেখে
চলেছেন।
তার পরিচালনায় জাপান-বাংলাদেশ যৌথ কোম্পানি বাংলাদেশী পণ্য জাপানের
বাজারজাত করার মান নিয়ে কাজ করে থাকে। তিনি প্রতিষ্ঠানটির ম্যানেজিং
ডাইরেক্টর (এমডি)।
ব্যক্তি জীবনে জাকির খান খোকন জাপানি তরুণীর সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে
এক কন্যা সন্তান এবং দুই পুত্র সন্তানের গর্বিত পিতা। স্ত্রী সন্তানদের নিয়ে
রয়েছে তার সুখের সংসার।
মুন্সিগঞ্জ শহরের ডানপিটে ছেলেটি আজ জাপান জয় করে নিজ দেশের পতাকা জাপানের
মাটিতে সমুজ্জ্বল রেখেছেন।
-জাপান প্রবাসী সাংবাদিক।
rahmanmoni@gmail.com
ARNING:
Any unauthorized use or reproduction of 'Community' content
is strictly prohibited and constitutes copyright infringement liable to
legal action.
[প্রথমপাতা] |
|