|
রাহমান মনি
একজন প্রবাসীর সুখ
দুঃখ
আমি একজন প্রবাসী । জাপান প্রবাসী । তা
প্রায় তিন যুগ হতে চলল । এর মধ্যে অনেক পরিবর্তন হয়েছে। দুই পা থেকে চার পা
হয়ে বর্তমানে তা আট পা । দেশে টিনের চালা থেকে কংক্রিটের ছাদ। একান্নবতী
থেকে ফ্লাটের মালিক । মাটির ব্যাংক থেকে দেশ-বিদেশে ব্যাংক ব্যালেন্স সব ই
হয়েছে। কিন্তু , আমি প্রবাসী প্রবাসী-ই রয়ে গেছি । না বাংলাদেশী না হতে
পেরেছি জাপানী। কেবলি একজন প্রবাসী।
প্রবাসীদের নিয়ে বিভিন্ন জনের বিভিন্ন ধারনা। নানান মুনীর নানান মত। কারোর
কাছে প্রবাসীরা হচ্ছে টাকার গাছ, ঝাকি দিলেই পড়ার কথা। অথবা প্রবাসে টাকা
উড়ে বেড়ায়,আর প্রবাসীরা তা বস্তায় ভরে। তাই, কারী কারী টাকার মালিক। হাওলাত
চাইলেই দিতে বাধ্য, হাওলাত চাওয়ার পরিমাণ কম হলেও লাখ লাখ, না পেলে সম্পর্ক
নষ্ট। কারোও কাছে আবার সোনার ডিম পাড়া হাঁস,আত্মীয়স্বজন বা পরিবারের
সদস্যদের কাছে এমনটি প্রযোজ্য।
আবার কেউবা মনে করেন প্রবাস জীবন মানেই অড জব করা এক জীবন। হোটেলে পিঁয়াজ
রসুন কাটা, আলু ছোলা কিংবা পরিচ্ছন্ন কর্মী। আড়ালে আবডালে তারা নাক সিটকান।
নাক সিটকালেও দেশের অর্থনীতির চাকা ঘুরাতে প্রবাসীদের অবদানের কথা স্বীকার
করে নেন অকপটে । অন্তত মুখে ।
সুখ দুঃখ নিয়েই মানুষের জীবন। কারোর বা সুখানুভুতির পাল্লাভারী, আবার কারোর
বা কষ্টের টা। প্রবাসীরাও যেহেতু মানুষ,তাই তাদেরও সুখ দুঃখের অনুভুতি আছে,
থাকে মনঃকষ্ট। মনঃকষ্ট থাকলেও প্রবাসীরা তাই নিয়ে সকাল-সন্ধ্যা পরিশ্রম করে
যান কেবলমাত্র সংসারে একটু সচ্ছলতা এনে সুখ শান্তি ফিরিয়ে দিতে ।
মানুষ যেহেতু আশাজাগনিয়া, তাই একজন প্রবাসী হিসেবে প্রথমেই আমার সুখ বা ভালো
লাগা দিক গুলি নিয়ে পাঠকদের সাথে ভাগ করে নিতে চাই। হয়তো বা কাঁকতলিয় ভাবে
কারোর সাথে মিলেও যেতে পারে। আবার কেহবা দ্বিমত পোষণ করতেও পারেন । উভয়
মতের প্রতি আমি শ্রদ্ধা জানিয়ে বলতে চাই , এটা একান্ত-ই আমার ব্যক্তিগত
অভিমত ।
অনেক কষ্টের মাঝেও প্রবাস জীবন মানেই নিরাপত্তাবলয়ে আবদ্ধ এক জীবন। এখানে
স্বাভাবিক মৃত্যুর গ্যারান্টি আছে। গুম বা বেওয়ারিশ লাশ হয়ে পড়ে থাকার
সম্ভাবনা ক্ষীন। দু'একটি ব্যাতিক্রম ছাড়া। অযথা শ্রম ঘণ্টা নষ্ট হয়ে যায়না
যানজটের কবলে পড়ে। এখানে পরিশ্রম করতে পারলে আয় রুজিও খারাপ না । সৎভাবে
নিজে চলে সংসারেও কিছুটা দেয়া যায় । ভবিষতের জন্য কিছুটা জমানোও যায় বৈ কি
!
দেশে কিছু পাঠাতে পারলে মনে প্রশান্তি লাগে। কিছু দিনের জন্য নিজ দেশে
বেড়াতে গেলে জামাই আদর পাওয়া যায় সবখানেই। বন্ধু-বান্ধব , পাড়াপড়শি্ ,
আত্মীয় স্বজন এমনকি নিজ পরিবারেও।
আর সবচেয়ে বড় কষ্টের হল, একজন প্রবাসী উভয় দেশেই পরবাসী। বসবাসরত দেশে
পরদেশীতো বটেই (নাগরিকত্ব পেলেও),এমনকি নিজ দেশেও পরবাসী (নাগরিকত্ব থাকা
সত্ত্বেও)। অনেক সময় নামের আগে বসবাসরত দেশের নামটিও জুড়ে যায় বিশেষণ হিসেবে।
এই যেমন আমাদের দ্বিতীয় প্রজন্মে অনেকেই আমাকে জাপানি আংকেল বলে ডাকে।
একজন প্রবাসী দেশে কিছু পাঠাতে পারলে সবচেয়ে বেশী খুশী হয়। কষ্টার্জিত অর্থ
সাধারণত বাবা বা ভাইদের নামেই পাঠানো হয়ে থাকে। অনেক ক্ষেত্রেই তা
অপব্যবহার বা অনুৎপাদনশীল খাতে খরচ হয়ে থাকে। কোন কোন পিতা বা ভাই নিজ নামে
স্থাবর সম্পত্তি করে থাকেন। পরবর্তীতে সে সম্পত্তিতে প্রবাসীর কোন কতৃর্ত্ব
থাকেনা। অংশ চাইতে গেলে বরং জীবন হুমকীর সম্মুখীন হতে হয়। কোন কোন ক্ষেত্রে
বেঘোরে প্রান হারাতে হয় স্বজনদের হাতে। কেহবা কোন মতে পালিয়ে আবার প্রবাস
জীবনকেই বেছে নেন। প্রবাসে ফিরে ধুকে ধুকে যন্ত্রনাময় জীবন যাপন করেন। কেহবা
অভিমান করে ভুলে থাকার চেষ্টায় বিপথে পা বাড়ান অথবা যোগাযোগ ছিন্ন করেন ।
কোন কোন সময় স্থাবর সম্পত্তি কিনতে গেলে, প্রবাসে থাকা হয় তাই কাগজপত্র (
যদিও বর্তমানে স্মার্ট কার্ড , ভোটার আইডি কার্ড সহ বিভিন্ন পরিচয় পত্রের
ব্যাবস্থা রয়েছে তথাপি বাংলাদেশ বলে কথা , যেখানে সব কিছুই সম্ভব )
বিড়ম্বনার কথা চিন্তা করে বাবা কিংবা বড় ভাই-এর নামে তা ক্রয় করা হয় দেশে
যাওয়া মাত্র বুঝিয়ে দেওয়ার আশ্বাস দিয়ে। দেশে গেলে বুঝিয়ে দেওয়া হয় ঠিকই তবে
সম্পত্তি নয়, বোকামীর খেসারত। এনিয়ে বিচার চাইতে গেলে তা প্রবাসীর বিপরীতেই
যায়। আইনজীবী থেকে শুরু করে থানা-পুলিশ কিছুতেই সবাই কামানোর ধান্ধায় থাকে।
আর আত্মীয় স্বজন পাড়াপড়শীরা বলেন, আল্লাহ্ তো তোমাকে অনেক দিয়েছেন। তাদের
তো কিছু নেই । তাছাড়া নিজের লোকেরাই তো ভোগ করবে , অসুবিধা কি ।
দেশে কিছু পাঠানো পর প্রবাসীকেই খোঁজ নিয়ে জানতে হয় ঠিকমত পৌছালো কিনা।
কারণ, সে যেহেতু পাঠিয়েছে তাই তার দায়িত্বটাই বেশী। পাওয়ার পর নিজ উদ্যোগে
জানানো গরজ তাদের নেই। তবে দেরী হলে তাগাদা আসা এক পর্যায়ে বিরক্তির কারন
হয়ে দাঁড়ায়।
দেশ থেকে কিছু চেয়ে পাঠালে বিভিন্ন অজুহাতে বিলম্ব হয়। হরতাল যানজট,
ব্যাস্ততা তার অন্যতম প্রধান কারণ। তাই সময় মতো পাওয়া ভিসা পাওয়ার চেয়েও
কঠিন হয়ে যায়। কিন্তু যদি কারোর মাধ্যমে অর্থ পাঠানো যায়, তাহলে হরতাল
যানজট, ব্যস্ততা কোন কিছুই তখন আর বাধা হয়ে দাঁড়ায় না দ্রুত সংগ্রহে।
আর বাংলাদেশী সরকারী অফিসের কর্ম কাণ্ড তো সবারই জানা । ইতোমধ্যে বিদেশী
বন্ধু রাষ্ট্রগুলোও তা অবহিত । তাই , জাপান থেকে দেশে কিছু পাঠাতে গেলে
জাপান পোস্ট অফিস থেকে বলা হয় , এখান থেকে যথা সময়ে পাঠানো হবে ঠিক ই তবে ,
বাংলাদেশে যাবার পর কবে নাগাদ প্রাপকের হাতে তা পৌঁছবে তা বলতে পারবো না ।
আর বাংলাদেশ থেকে একটি ইএমএস জাপান আসতে প্রায় এক মাস লেগে যায় । যদিও
জাপান আসার পরের দিনই তা প্রাপকের হাতে পৌঁছানো'র ব্যবস্থা নেয়া হয়ে থাকে ।
দেশের নাগরিকদের নাকি ভোটাধিকার বলতে একটা অধিকার রয়েছে । তা , দেশেই থাকুক
বা প্রবাসেই থাকুক না কেনো । এটা নাগরিক অধিকার । একাদশ জাতীয় সংসদ
নির্বাচন থেকে সে অধিকার ( ? ) দেওয়া ও হয়েছিল । তবে , যে পদ্ধতিতে
ভোটাধিকার দেয়া হয়েছে তা মেনে ভোট দিতে গেলে পরবর্তী জাতীয় নির্বাচন এসে
যাবে । কারন , বাংলাদেশের সরকারী অফিসের চিঠি চালাচালির কথা সবার-ই জানা ।
ইন্টারভিউ হয়ে যাবার পর ইন্টারভিউ কার্ড হাতে পৌঁছানোর ঘটনা খুব একটা কম কি
? তাই , ভোটাধিকার বিষয়টা প্রবাসীদের জন্য অধরা ই রয়ে যায় ।
সুখানুভুতির অভিজ্ঞতায় বলেছিলাম যে, কিছুদিনের জন্য দেশে বেড়াতে গেলে জামাই
আদর পাওয়া যায় সবখানেই, এমনকি নিজ বাড়ীতেও। আবার সেই প্রবাসীই যখন প্রবাস
জীবন পাঠ শেষ করে স্থায়ী ভাবে দেশে ফেরেন তখন হয়ে যান ভিলেন। এমনকি নিজ
পরিবারেও। কারণটা স্পষ্ট, এতোদিন সোনার ডিম পাড়া হাঁস থেকে ডিম পাওয়া তো
দুরের কথা উল্টো সে-ই এখন থেকে সব কিছুতেই ভাগীদার। হিরো থেকে রাতারাতি
ভিলেনে পরিনত হওয়া আর কি !
একজন প্রবাসী যখন দেশে ফিরে যায়, তখন আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব সবাই
সম্ভাবনার দ্বার দেখিয়ে সহযোগিতার হাত সম্প্রসারিত করে এগিয়ে আসে যৌথভাবে
অর্থ লগ্নী'র কাজে । কারণ , দেশে থাকেন বিধায় তারা অভিজ্ঞতা ভারে
ভারাক্রান্ত। আর প্রবাসীরা থাকেন বস্তাভরা অর্থের ভারে ভারাক্রান্ত। কিন্তু
কিছুদিন পর সব খুইয়ে প্রবাসী হন অভিজ্ঞতার ভারে নুহ্যমান আর পরামর্শকারী হন
অর্থভারে উদীয়মান।
যেহেতু জাপানে থাকি, তাই জাপানের অভিজ্ঞতা থেকে বলছি, জাপানী পাশপোর্ট নিতে
গেলে বাংলাদেশী পাসপোর্ট ত্যাগ করতে হয়। কারণ দ্বৈত নাগরিকত্ব বিধান জাপানে
নেই। সবকিছু ত্যাগ করে জাপানী পাশপোর্ট নেওয়ার পর তা গলায় ঝুলিয়ে রাস্তায়
হাঁটলেও সাধারণ জনগণ বিদেশী বলে সম্বোধন করবে , জাপানী হিসেবে নয়,
সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ ছাড়া। এরচেয়ে কষ্ট কিই বা হতে পারে।
জাপানী পাশপোর্ট নেয়া কোন বিদেশী যদি জাপানে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন তখন
তার শবদেহটি নিজ দেশে নেয়ার কোন এখতিয়ার নেই । জাপানেই তার সৎকার করতে হয় ।
কিন্তু মৃত ব্যাক্তিটি যদি মুসলিম হন তাহলে সমস্যাটি হয় প্রকট থেকে প্রকটর
। কারন , জাপানীজ রীতিতে মুসলিমদের সৎকার করা যায়না । এখানে দাফন করতে হলে
কবরস্থান এর দরকার হয় । জাপানে তা খুব ই অপ্রতুল । নেই বললেই চলে ।
আর বাংলাদেশীদের বেলায় এই সমস্যাটি আরো গভীর । কারন , ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে
পারিবারিক বন্ধনটা বাংলাদেশে খুবই সুদৃঢ় । প্রিয়জনটি প্রবাসে মৃত্যুবরণ
করলেও শবদেহটি দেখার এবং নিজেরা সৎকারের ব্যাবস্থা নিতে চায় ।
প্রবাসীদের ও আকাঙ্খ্যা থাকে তার শেষ ঠিকানাটি যেনো নিজ জন্মভূমিতেই হয় ।
সব কিছুর পর আমি একজন প্রবাসী, এইটাই বাস্তবতা, এইটাই চরম সত্যযে ।
rahmanmoni@kym.biglobe.ne.jp
ARNING:
Any unauthorized use or reproduction of 'Community' content
is strictly prohibited and constitutes copyright infringement liable to
legal action.
[প্রথমপাতা] |
|