|
রাহমান মনি
উৎসব মুখর পরিবেশে
জাপানে শিক্ষা জীবন শুরু হয়
'হাড্ডি আমার, মাংস আপনা্র'এই ছিল আমার
শিক্ষাজীবন শুরুর দিনটিতে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকের উদ্দেশ্যে
আমার শ্রদ্ধেয় মরহুম পিতার উক্তি। আপনার কাছে দিয়ে গেলাম। মানুষ করে অর্থাৎ,
আপনি যেভাবেই পারেন পড়া আদায় করে নিবেন। এইজন্য আমার কাছে কোন কৈফিয়ত দিতে
হবে না। আমাদের সময়ে সিংহভাগ শিক্ষার্থীরই প্রায় একই অবস্থা যে ছিল তা
নির্দ্বিধায় বলা যায়।
আর এই মৌখিক চুক্তির বদৌলতে বাংলাদেশে শিক্ষক মহোদয়গন যে দিগুন উৎসাহে কঞ্চি,
বেত, ডাস্টার, হাত এমন কি হাতের কাছে যা থাকতো তার ব্যবহার করতে দ্বিধা বোধ
করতেন না।
আর, জাপানে প্রতিটি শিক্ষার্থীর শিক্ষা জীবন শুরু হয় আনন্দঘন ও উৎসবমুখর
পরিবেশে। শুধু শিক্ষার্থী ই নয়, পরিবার,আত্মীয় স্বজন, পাড়াপড়শি এমন কি
পরিবেশও যেনো উৎসবমুখর হয়ে উঠে। প্রকৃতি ও তাদের আনন্দের উৎসের যোগান দেয়।
চেরী ফুল (যা জাপানে সাকুরা নামে পরিচিত) সহ বসন্তকালীন নানান রঙের ফুল ফুটে
কচি প্রাণদের স্বাগত শিক্ষা জীবন শুরুর অভিনন্দন জানানোয় প্রস্তুত থাকে।
জাপানে প্রতিটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সাকুরার অবস্থান যেন বাধ্যতামুলক।
জাপানে ৬ বছর বয়স থেকে শিক্ষা জীবন শুরু হয়। এপ্রিল ১ থেকে পরবর্তী বছরের
মার্চ ৩১ এর মধ্যে যাদের জন্ম তাদের সবাই একই শিক্ষাবর্ষে শিক্ষা জীবনের
যাত্রা শুরু করে। এপ্রিল থেকে জাপানে শিক্ষাবর্ষ শুরু হয়ে থাকে।
প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ৬ বছর, নিন্ম মাধ্যমিক ৩ বছর, উচ্চ মাধ্যমিক ৩ বছর এবং
বিশ্ববিদ্যালয়ে ৪ বছর, মোট ১৬ বছর শিক্ষাজীবন চালিয়ে যেতে হয়।
তার আগে ৩ বছর বয়স থেকে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রবেশ পূর্ব পর্যন্ত কিন্ডার
গার্টেন কিংবা 'ডে-কেয়ার'এ যেতে হয়। অনেকে আবার কয়েকমাস বয়স থেকে ডে-কেয়ার
এ যাতায়াত শুরু করে। আর এই ডে-কেয়ার কিংবা কিন্ডার গার্টেন থেকেই বিদ্যালয়ে
জীবনে প্রবেশের প্রাথমিক শিক্ষা দিয়ে গড়ে তোলা হয়। সেই সাথে জাপানী ম্যানার।
আর জাপানী ম্যানার যে বিশ্ব সেরা সে কথা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। সেই
শিক্ষাটি শিশু বয়সেই ভীত গেড়ে দেয়া হয়। আর শিশু বয়সে একবার যা রপ্ত করা যায়,
বাকী জীবন তা ধরে রাখা হয়। এছাড়া শিশুরা শিক্ষকদের কথা যে বেদ বাক্যের মতো
বিশ্বাস করে একথা সবার ই জানা।
বিদ্যালয়ে যাবার বয়স হলেই স্থানীয় প্রশাসন থেকে অভিভাবকদের কাছে চিঠি দিয়ে
জানান দেয়া হয়। সকলকেই জানান দেয়া হয়ে থাকে। কারন, এখানে নিন্ম মাধ্যমিক
পর্যন্ত শিক্ষা বাধ্যতামূলক। শারীরীক অসুস্থ কিংবা মানুষিক অপরিপক্কদেরও
নিন্ম মাধ্যমিক শিক্ষা সমাপ্ত করতে হয়। সেক্ষেত্রে কিছুটা ভিন্ন পন্থা
অবলম্বনে। জাপানে বসবাসরত বিদেশী নাগরিকদের বেলায়ও একই নিয়ম প্রযোজ্য। সাথে
থাকে দিক নির্দেশনা ও আশপাশের কয়েকটি বিদ্যালয়ের যোগাযোগ এর জন্য বিস্তারিত
তথ্যাবলী।
শিশুটি যখন বিদ্যালয়ে যাবার প্রস্তুতি নিতে থাকে তখন তাকে উৎসাহিত করার
জন্য শুরু হয় বিভিন্ন উপহার। এসব উপহারের প্রায় সবই তার প্রাথমিক
বিদ্যালয়ের শিক্ষা জীবনের সাথে সংশ্লিষ্ট। যেমন প্রথমেই প্রয়োজন হয় একটি
টেবিল সেট বা জাপানী ভাষায় সুকুয়ে ( টেবিল,চেয়ার ও অন্যান্য) ও পাঠ্যপুস্তক
বহন করার জন্য একটি ব্যাগ। আর এই ব্যাগটিকে নিয়ে প্রতিটি শিশুর থাকে
বিভিন্ন স্বপ্ন। জাপানী ভাষায় বলা হয়ে থাকে রানদোসেরু। টেবিল এবং ব্যাগ উভয়
ই শিশু বান্ধব। ৬ বছর ব্যবহারের নিশ্চয়তা সহ।
সাধারনত দাদা দাদি কিংবা নানা নানি সুকুয়ে এবং রানদোসেরু উপহার দিয়ে থাকেন।
এছাড়াও অন্যান্য প্রয়োজনীয় ( পেন্সিল, রাবার, ডাইরি, স্কুল জুতা, পোশাক,
টুপী ) সব কিছুই বিদ্যালয়ে প্রবেশের প্রথম দিনটির পূর্বেই প্রস্তুত রাখতে
হয়। আর এই সবগুলি বিভিন্ন উৎস থেকে উপহার হিসেবে পেয়ে থাকে।
বিদ্যালয়ের প্রথমটিতে সাঁজ সাঁজ রব পড়ে যায়। সেজে উঠে পুরো বিদ্যালয়। বিশেষ
করে প্রধান ফটক। জাতীয় পতাকা সম্বলিত ফুলেল শুভেচ্ছা স্বাগতম।
অত্যন্ত পরিপাটি পোষাকে, অভিভাবক সমেত বিদ্যালয়ে গমন যে কারোর মনে ধরার মত।
স্যুটটি হয়তো ওই একদিন ই পড়ে থাকে। কারন শিশুরা দ্রুত বর্ধমান।
বিদ্যালয়ের প্রধান কর্তা ব্যাক্তি ( প্রধান শিক্ষক) , এলাকার গন্যমান্য
ব্যক্তিবর্গ, অভিভাবক সংগঠন-এর কর্তা ব্যক্তিবর্গ, স্থানীয় প্রশাসন,
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মকর্তাগণ উপস্থিত থেকে শিশুদের স্বাগত জানান।
অভিভাবকসহ বিদ্যালয়ে প্রবেশ শেষে নিজ শ্রেণীকক্ষে সাজানো গুছানো ঝকঝকে
পরিবেশ এবং নিজ আসনে নতুন পাঠ্য বই সমেত বিভিন্ন সরঞ্জাম দেখলে যে কোন
শিশুর-ই বিদ্যালয়ের প্রতি আগ্রহ যে বাড়ে তা নির্দ্বিধায় বলা যায়।
শ্রেনী শিক্ষকের সাথে বিপুল করতালির মধ্য দিয়ে সারিবদ্ধভাবে বিদ্যালয়ের
অডিটোরিয়ামে প্রবেশ এক অন্যরকম অনুভুতি। সিনিয়র শিক্ষার্থী, অভিভাবক,
অতিথিরা দাঁড়িয়ে সবাইকে অভ্যর্থনা জানান সবাইকে। সেখানে আনুষ্ঠানিক ভাবে
বরণ করে নেয়া হয় শিশুদের।
অডিটোরিয়াম সাজানো হল ফুল এবং লাল-সাদা কাপড়ের – । জাপানে লাল-সাদা হলো
অভিনন্দনের প্রতীক। থাকে বিদ্যালয়ের নিজস্ব ঐতিহ্য।
আর পুরো আয়োজনটি সম্পন্ন হয়ে শেষ বর্ষের শিক্ষার্থীদের টিম ওয়ার্ক এর
মাধ্যমে।
একজন নবীন কিভাবে বিদ্যালয়ের জীবন যাপনে অভ্যস্ত হবে তা সিনিয়ররা বেশ যত্ন
সহকারে শিখিয়ে দেয়। তাদের সব কিছুই সবাই ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখে থাকে।
শিশুর জবাবদিহিতা না থাকলেও প্রতিষ্ঠানের জবাবদিহিতা বাধ্যতামুলক। প্রতিটি
কাজের জবাবদিহিতা করতে হয় প্রতিষ্ঠানকে। এমন কি শিশুটি বাড়িতে কিভাবে জীবন
যাপন করে তারও খোজ নিতে হয় শ্রেনী শিক্ষক কে। এইজন্য অভিভাবকদের যেমন
বিদ্যালয়ে যেতে হয় নিয়ম অনুযায়ী তেমনি শ্রেনী শিক্ষককেও বাসায় আসতে হয়। নোট
নিতে হয় তার জীবনযাপনের উপর।
এছাড়া রয়েছে, বছরে একাধিকবার অভিভাবকদের উপস্থিতিতে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলিতে
ক্লাশ নেয়া নিয়মিত একটি কাজ।
ক্লাশে কোন পরীক্ষায় অংশ নিতে হয়না। খেলাধুলার ছলে হেসে খেলা তাদের
শিক্ষাজীবনের প্রথম বর্ষটি পার হয়।
rahmanmoni@kym.biglobe.ne.jp
সৌজন্যে – সাপ্তাহিক
ARNING:
Any unauthorized use or reproduction of 'Community' content
is strictly prohibited and constitutes copyright infringement liable to
legal action.
[প্রথমপাতা] |
|