|
(মতামতের জন্যে সম্পাদক দায়ী নয়।}
রাহমান মনি
জাপানে অব্যাহত
জন্মহ্রাসের ভয়াবহ চিত্র
সন্দেহ নেই বিশ্বের অন্যতম অর্থনৈতিক
পরাশক্তি ছিল জাপান। যদিও বর্তমানে আর সেই অবস্থান ধরে রাখতে পারেনি জাপান।
তারপরও জাপান তো জাপান-ই। সার্বিক ভাবেই বিশ্বের অন্যতম একটি ব্রান্ড-এর
নাম।
আর এই জাপান সেই জাপান, দুই দুইটি বিশ্বযুদ্ধ করে হেরে যাওয়া এবং ভয়াবহ
ধ্বংসাযজ্ঞের পরও যাদের কল্যাণে জাপান অর্থনৈতিক পরাশক্তি হয়ে উন্নতির চরম
শিখরে পৌছুতে সক্ষম হয়েছিল সেই দক্ষ, সৎ, পরিশ্রমী, দেশপ্রেমিক আর
আত্মবিশ্বাসী জনশক্তি ক্রমবর্ধমান হ্রাসের কারনে জাপান আজ অনেকটাই দিশেহারা
।
জাপানের জনসংখ্যা হ্রাস পাওয়া নতুন কোনো সংবাদ নয়। ১৯২০ সাল থেকেই জাপানের
জন্মহার আনুপাতিকভাবে কমতির দিকে শুরু করে। তারপরও ২০১০ সালে জাপানের
জনসংখ্যা ছিল সর্বোচ্চ ১২ কোটি ৮৫ লাখ ৫১ হাজার ( প্রায় ) হয়ে জনসংখ্যার
দিক থেকে বিশ্বে ১০ স্থান দখল করে নেয়।
এর পর থেকে ক্রমেই জনসংখ্যা কমে আসতে থাকে জাপানে। সর্বশেষ ২০১৮ সালে
জাপানের জনসংখ্যা এসে দাঁড়িয়েছিল ১২৪ মিলিয়নে। এভাবে জন্মহার কমতে থাকলে
জাপানের জনসংখ্যা কমে ২০৬৫ সালে ৮৮ মিলিয়ন এবং ২১০০ সালে ৫০ মিলিয়নে নেমে
আসতে পারে বলে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে।
অতি সম্প্রতি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় কর্তৃক প্রকাশিত প্রতিবেদনের হিসেব মতে
দেশের জনসংখ্যা কমে যাওয়ার যে খতিয়ান তুলে ধরা হয়, জাপানের সংবাদ মাধ্যম
সেটাকে বিপদ সংকেত হিসেবে দেখছেন বিশেষজ্ঞগণ।
চলমান এই ধারা অব্যাহত থাকলে একদিকে যেমন দেশটিতে চরম শ্রম সংকট দেখা দিবে,
তেমনি দেশটিতে বয়োবৃদ্ধদের সংখ্যা বেড়ে গিয়ে একদিন থমকে পড়বে দেশটির
অর্থনৈতিক অগ্রগতি ও উন্নয়ন। যার প্রভাব ইতোমধ্যে পড়তে শুরু করে দিয়েছে।
জাপান তখন আর ব্রান্ড হিসেবে তার অবস্থান ধরে রাখতে সক্ষম থাকবে না।
পরিসংখ্যান অনুসারে ২০০৮ সালে জাপানের ইতিহাসে দেশে সর্বোচ্চ জনসংখ্যা ছিল।
সংখ্যায় তা ১২ কোটি ৯৬ লাখ ৯২ হাজার ১ জন ( প্রায় )। তার মধ্যে পুরুষ ৬ কোটি
৩২ লাখ ৫১ হাজার জন এবং নারী ৬ কোটি ৬৪ লাখ ৪১ হাজার ১ জন।
জাপানে বাড়ছে শতায়ু মানুষের সংখ্যা। ২০১৯ সালে এই সংখ্যা প্রথমবারের মতো ৭০
হাজার ছাড়িয়ে যায়। গত বছর জাপানে শতায়ু মানুষ ছিলেন ৭১ হাজার ২৩৮ জন। এখন
থেকে ৩০ বছর আগে ১৯৮৯ সালে এঁদের সংখ্যা ছিল ৩ হাজার ৭৮ জন। ফলে ৩০ বছরে
শতায়ু মানুষের সংখ্যা বৃদ্ধির হার জাপানে হচ্ছে প্রায় ২৩ গুণ। সন্দেহ নেই
দেশের আর্থিক ব্যবস্থার ওপর মারাত্মক চাপ ফেলছে এটা।
শতায়ুদের মধ্যে নারীর সংখ্যা পুরুষের চেয়ে অনেক বেশি। এর অন্যতম কারন হচ্ছে
প্রকৃতিগত কারনে আনুপাতিকহারে জাপানে পুরুষের তুলনায় নারীর সংখ্যা
স্বাভাবিক এর চেয়ে বেশী। জাপানে গড় আয়ুর দিক থেকেও নারীরা পুরুষদের চেয়ে
এগিয়ে। ২০১৮ সালের হিসাবে নারীর গড় আয়ু ছিল ৮৭ দশমিক ৩২ বছর এবং পুরুষের ৮১
দশমিক ২৫ বছর। ৭১ হাজার ২৩৮ জন শতায়ু ব্যক্তির ৮৮ দশমিক ১ শতাংশ হলেন নারী।
২০২০ সালের ১ এপ্রিল সর্বশেষ পরিসংখ্যান অনুযায়ী জাপানের জনসংখ্যা
১২,৭০,৭২,৭২০ জন। তার মধ্যে পুরুষ ৬ কোটি ২১ লাখ ২৭ হাজার ৬৪১ জন এবং নারী
৬ কোটি ৪৯ লাখ ৪৫ হাজার ৭৯ জন। অর্থাৎ মাত্র ১২ বছরে জাপানের জনসংখ্যা কমে
গেছে ২৬ লাখ ১০ হাজারের মতো । আর একই বছর সর্বশেষ অক্টোবর ১ তারিখ সর্বশেষ
পরিসংখ্যান অনুযায়ী ১২ কোটি ৬১ লাখ ৭০ হাজার ৭১০ জন অর্থাৎ মাত্র ৬ মাসে ৯
লাখের উপর জনসংখ্যা হ্রাস পায়।
এই ধারা অব্যাহত থাকলে আগামী ৫০০ বছর পর বিশ্বে জাপানিদের আর কোন অস্তিত্ব
খুঁজে পাওয়া যাবে না। যদিও বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন এখন থেকেই পদক্ষেপ না নিলে
৫০০ বছর অপেক্ষা করতে হবে না, আগামী ৩০০ বছর পরই জাপানিদের অস্তিত্বের কথা
মানুষ ইতিহাস পড়ে জানতে পারবে ।
একটি এলাকার চিত্র থেকে এর ভয়াবহতা সহজেই অনুমান করা যাবে। যদিও চিত্র পুরো
জাপানের সার্বিক চিত্র না তথাপি প্রতিনিধিত্ব করে মাত্র।
প্রশাসনিক কাজের সুবিধার্থে রাজধানী টোকিওকে আবার ৫০টি সিটি বা ওয়ার্ড (২৩
কু এবং ২৭ শি )-এ ভাগ করা হয়েছে। আমি টোকিওর যে শহরটিতে বসবাস করি তার নাম
‘কিতা সিটি’বা ওয়ার্ড। এই ওয়ার্ডে ১ লাখ ৬১ হাজার ৯৬৫টি পরিবারে মোট ৩ লাখ
৫৪ হাজার ৮৩ জনের বসবাস ( ২০২০ সালের ১ অক্টোবর সর্বশেষ পরিসংখ্যান অনুযায়ী
)। তার মধ্যে ১ লাখ ৬৬ হাজার ৬০৭ জন পুরুষ এবং ১ লাখ ৮৭ হাজার ৪৭৬ জন নারী।
এর বাহিরে ১৮ হাজার ৩৭ জন বিদেশী নাগরিকের বসবাস রয়েছে। ঘনবসতিপূর্ণ
রাজধানীর একটি শহরে এতো লোক সংখ্যার বসবাস খুব একটা অস্বাভাবিক নয়।
যদিও এইটি কোন কূটনৈতিক এলাকা বা টোকিওর প্রসিদ্ধ তেমন কোন এলাকাও নয়।
টোকিওর সর্ব উত্তরে এর অবস্থান বলে এর নাম কিতা সিটি ( উত্তরের শহর ) ।
তারপরও এখানে ১১০টি দেশের মোট ১৮,০৩৭ জন বিদেশি নাগরিকের বসবাস।
এই বিপুল পরিমাণ জন সংখ্যার ( ৩,৫৪,০৮৩ ) মধ্যে শিশুকিশোরদের সংখ্যা (
যাদের বয়স ১৪ বছরের মধ্যে ) খুবই শিউরে ওঠার মতো । এদের মোট সংখ্যা মাত্র
৩০ হাজার ২৭৩ জন। যা, মোট জনসংখ্যার মাত্র ৯.৬% মাত্র। অপরদিকে ৬৫ বছরের
উপরে যাদের বয়স তাদের সংখ্যা ৭২ হাজার ৫২৪ জন। অর্থাৎ ২২.৯%। বাকী ৬৭.৫%
জনসংখ্যা যাদের বয়স ১৫ থেকে ৬৪ বছরের মধ্যে। এই সংখ্যা থেকে থেকে বুঝতে
অসুবিধা হয়না যে, জাপানে ৬৫ বছরের ঊর্ধ্বে যাদের বয়স তাদের সংখ্যা বৃদ্ধি
আশংকা জনক। যদিও এইটি একটি শহর অর্থাৎ পুরো জাপানের আংশিক চিত্র মাত্র।
জাপানের ৪৭টি জেলার ( প্রিফেকচার) মধ্যে ৪০টিতে জনসংখ্যা হ্রাস পেলেও বড়
আকারের শহর রয়েছে সে রকম ৭টি জেলায় জনসংখ্যা বেড়েছে। এই ধারা মফস্বল এলাকা
থেকে তরুণ প্রজন্মের লোকজনের শহরে চলে আসার ইঙ্গিত দেয়। তরুণ সমাজ আর গ্রামে
থাকতে পছন্দ করছে না। শহরের চাকচিক্যকেই তারা বেছে নিচ্ছে।
গত ৭ দশকের ইতিহাস থেকে জানা যায় জাপানের জনসংখ্যার হ্রাসের ক্রমবর্ধমান
চিত্র। এক বছরের মধ্যে জনসংখ্যা হ্রাসের এই সংখ্যা হচ্ছে, ১৯৫০ সালে হিসাব
রাখা শুরু হওয়ার পর থেকে সবচেয়ে বড় পতন। নতুন পরিসংখ্যানে ২০২০ সালের ১
অক্টোবর জাপানের মোট জনসংখ্যা দেখানো হয়েছে ১২ কোটি ৬১ লাখ ৭০ হাজার। এর
মধ্যে জাপানিদের সংখ্যা হচ্ছে ১২ কোটি ৩৭ লাখ ৩০ হাজার। জাপানে ভূমিপুত্র
জাপানিদের সংখ্যা কমলেও বিদেশিদের সংখ্যা বাড়ছে। একই হিসাবে বলা হয়েছে,
জাপানে এখন বিদেশি লোকজনের সংখ্যা হচ্ছে ২৪ লাখ ৪০ হাজার, যা হচ্ছে এক বছর
আগের চেয়ে ২ লাখ ১১ হাজার বেশি। এই বৃদ্ধির পেছনে আছে গত বছর চালু হওয়া
নতুন ভিসা ব্যবস্থার অধীনে বিদেশ থেকে শ্রমজীবী মানুষের জাপানে আগমন সহজ করে
দেওয়া। বৃদ্ধ হয়ে আসা সমাজে শ্রমিকের ঘাটতি পুষিয়ে নিতে এই পথে জাপান এখন
এগিয়ে যাচ্ছে।
আর ধন্যবাদ ।
আর এই বিদেশী শ্রমিকদের আগমন এবং শতায়ুদের সংখ্যা বৃদ্ধি নতুন প্রজন্মকে
ভাবিয়ে তুলেছে ভবিষ্যতে তাদের পেনশন প্রাপ্তিতে। এক পরিসংখ্যান থেকে জানা
যায় ১৯৭১ সালের পরে জন্ম নেয়াদের আদৌ পেনশন এর দেয়া যাবে কিনা তা নিয়ে
যথেষ্ট সংশয় রয়েছে।
কোভিড-১৯ কে অনেকেই জাপানে জন্মহ্রাসের উপর আশীর্বাদ হিসেবে আশার আলো
দেখেছিলেন অনেকেই। তার কারন, কাজ পাগল জাপানিরা কর্মব্যস্ততার জন্য একে
অপরকে সময় দিতে না পারার কারনে যারা জাপানে জন্মহার হ্রাসের কারন হিসেবে
দেখে আসছিলেন তারা মনে করেছিলেন করোনার কারনে পরিবার কে সময় দেয়ার কারনে
পরস্পর পরস্পরের সান্নিধ্যে আসার সুযোগ ঘটবে। স্বামী-স্ত্রী একে অন্যকে সময়
দিতে পারবেন। কিছুটা হলেও জনসংখ্যা বৃদ্ধিতে ভুমিকা রাখবে।
কিন্তু তাদের সেই আশায় গুড়েবালি হয়ে দেখা দিয়েছে জাপান স্বাস্থ্য বিভাগ
প্রদত্ত এক পরিসংখ্যানে। পরিসংখ্যান অনুযায়ী গতবছর এসময়ের তুলনায় এবছর
গর্ভবতী নারীর সংখ্যা কম। নিন্দুকেরা অবশ্য এজন্য জাপান সরকারের বেধে দেয়া
স্বাস্থ্যবিধি অর্থাৎ সামাজিক দূরত্ব কে দায়ী করেছেন। তাদের মতে সামাজিক
দূরত্ব মানতে গিয়ে স্বামী – স্ত্রী পরস্পরের সান্নিধ্যে যেতে পারেনি , যার
পরিনাম জাপানে ক্রমবর্ধমান জন্মহ্রাস অব্যাহত।
বিষয়টি নিয়ে বর্ষীয়ান নেতা প্রাক্তন প্রধান মন্ত্রী , অতি সম্প্রতি
পদত্যাগকারী এবং বর্তমান উভয় সরকারের উপ-প্রধানমন্ত্রী আসো তারো-ও অনেকটা
উষ্মা প্রকাশ করেছেন।
আর এই ধারা অব্যাহত থাকলে সত্যি সত্যিই একদিন জাপানী নামের একটি জাতীর
অস্তিত্বের কথা কেবলি ইতিহাস থেকে মানুষ জানতে পারবে।
rahmanmoni@gmail.com
ARNING:
Any unauthorized use or reproduction of 'Community' content
is strictly prohibited and constitutes copyright infringement liable to
legal action.
[প্রথমপাতা] |
|