|
বাহির বলে দূরে থাকুক ভিতর বলে আসুক
না
লুৎফর রহমান রিটন
ঢাকা থেকে আমরা লেখক-শিল্পী-সাংবাদিকদের
বড়সড় একটা গ্রুপ বিরোধীদলের নেত্রী শেখ হাসিনার সফরসঙ্গী হয়ে গোপালগঞ্জ
টুঙ্গিপাড়া গিয়েছি। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মদিন
উদযাপনের অনুষ্ঠানে অংশ নিতে। সাল ১৯৯৪। উঠেছি গোপালগঞ্জ সার্কিট হাউজে।
কবি ফারুক মাহমুদ আর আমি একটি কক্ষে উঠেছি। কবি রফিক আজাদ, রশীদ হায়দার
পাশের কক্ষে।পরে আমাদের কক্ষে অতিথি হিশেবে এসে উঠলেন মোহন রায়হান আর
মুহম্মদ সামাদ। তাঁরা দেরিতে পৌঁছার কারণে সার্কিট হাউসে রুম পাচ্ছিলেন
না। আমি আর ফারুক মাহমুদ স্বাগত জানালাম তাঁদের, আমাদের কক্ষেই।
দু'রাতেরই তো ব্যাপার। সমস্যা একটাই, আমাদের কক্ষে দুটো সিঙ্গেল বেড।
এক বেডে দু'জনে ঠাঁসাঠাঁসি পরিস্থিতি হয়। তাই মোহন রায়হানের জন্যে বেডটা
ছেড়ে দিয়ে তোষকটা মাটিতে পেতে আমি ঘুমুলাম। আমি এই টুঙ্গিপাড়ায় আগেও
এসেছি নেত্রীর সঙ্গে। কিন্তু মোহন রায়হান এই প্রথম। মোহন ভাইকে সম্মান
জানাতেই এই ব্যবস্থা। বঙ্গবন্ধুর বিরোধীতাকারী অনেকেই তখন গোপালগঞ্জে
আসছেন। বঙ্গবন্ধুর সমাধি জেয়ারত করছেন।(অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী
অর্থাৎ সিক স্যার এবং অভিনেতা মামুনুর রশীদের নাম এই মুহূর্তে মনে পড়ছে।)
বিকেলে অনুষ্ঠান মঞ্চের অদূরে টং দোকানে চা খাচ্ছি। টিংটিঙে
স্বাস্থ্যের লম্বা একটা ছেলে আমার সামনে এসে দাঁড়ালো। চায়ের কাপ হাতে
আমি বসেছিলাম বেঞ্চিতে। ছেলেটা রুল টানা একটা খাতা আমার দিকে বাড়িয়ে
দিলো--একটা অটোগ্রাফ প্লিজ! কাপটা বেঞ্চিতে রেখে খাতাটা হাতে নিয়ে
লেখার আগে জিজ্ঞেস করলাম--নাম কী তোমার। খুব স্পষ্ট উচ্চারণে ছেলেটা
বললো--মার্জুক রাসেল। আমি বললাম--বাহ্ বঙ্গবন্ধুর টুঙ্গিপাড়ায় আরেকটা
রাসেল আছে?
ছেলেটা বিনয়ের হাসি হাসলো। আমি বললাম--রাসেল তো বুঝলাম কিন্তু তার আগের
শব্দটা আরেকবার বলো মিয়া। পারলে বানানটা বইলা দেও।
ছেলেটা হাসলো। তারপর বললো-- ম এ আকার, ব-এ শুন্য র, বর্গিয় জ-এ
হৃস্যুকার ক। মারজুক।
গোপালগঞ্জের দ্বিতীয় রাসেলকে শুভেচ্ছা বা এই জাতীয় কিছু একটা লিখে আমি
খাতাটা ওকে ফেরত দিয়েছিলাম। এরপর ছেলেটা রফিক আজাদ এবং রশীদ হায়দারের
অটোগ্রাফ নিলো। লক্ষ্য করলাম অটোগ্রাফ নেয়া শেষ হলেও ছেলেটা চলে গেলো
না। বরং আমার কাছাকাছি অবস্থান করলো। ওকে চা খেতে বললে রাজি হলো সহজেই।ওর
চোখে মুগ্ধতা মেশানো কৌতূহল। আমার দিকে একটু ঝুঁকে ছেলেটা বললো--'...ইদানিং
সিনেমায় গান লিখে গীতিকার/হয়েছে সে, তাতে কী?/এই নিয়ে ভীতি কার?
আমি সত্যি সত্যি চমকালাম খানিকটা-- আরে মিয়া এইটা তো আমার ছড়ার লাইন!
--জ্বি, ইত্তেফাকে আপনি নিজেকে নিয়ে ছড়া লিখছিলেন।
আলাপে আলাপে জানলাম ছেলেটা একজন কবি।এবং,গীতিকার হবার স্বপ্ন তার
বহুদিনের। আমি সিনেমার জন্যে তখন কয়েকটা গান লিখেছিলাম। আমার ছড়ায় সেই
কথাটাই এসেছিলো। নিজের স্বপ্ন ও আগ্রহের বিষয়টা ওখানে আছে বলে আমার
ছড়াটা তার মুখস্ত হয়ে গেছে। ছেলেটা আমাদের কাছাকাছিই থাকলো পুরোটা
বিকেল এবং সন্ধ্যা। রাতে খাওয়ার পালা শেষ করে রুমে ফিরে আসার সময় দেখি
ছেলেটা দাঁড়িয়ে আছে সার্কিট হাউসের লবিতে। আমাকে দেখে সামনে এলো। আমি
ওকে সঙ্গে নিয়ে আমার কক্ষে এলাম। কিছুক্ষণের মধ্যেই ফারুক মাহমুদ এলেন
রফিক আজাদকে সঙ্গে নিয়ে। পাশের কক্ষটি রফিক ভাইয়ের হলেও তিনি আমাদের
কক্ষে চলে এসেছেন আড্ডা দিতে। আমাদের জম্পেশ আড্ডায় শামিল হয়ে মারজুককে
খুব আনন্দিত মনে হলো। রাত বাড়তেই রফিক ভাইয়ের পানাকাঙ্খা জাগ্রত হলো।
তিনি ফারুক ভাইকে তাগাদা দিলেন--ও ফারুক ব্যবস্থা করো। ফারুক ভাই
বললেন--রফিক ভাই টাকা আমি দিতে রাজি কিন্তু আমি এই এলাকার কিছুই চিনি
না জানি না। জিনিস কোথায় পাবো? আমাদের এতোক্ষণের আড্ডায় রফিক আজাদের
জানা হয়ে গেছে যে আমাদের আড্ডায় শামিল হওয়া ছেলেটা স্থানীয় তরুণ কবি।
রফিক ভাই খুব সুমিষ্ট ভঙ্গি ও উচ্চারণে ছেলেটাকে বললেন--বেটা তুমি কবি
হতে চাও?
ছেলেটা মাথা নাড়ালো--জ্বি রফিক ভাই।
--তাহলে যাও, সিনিয়র কবির সেবা করো। কবি হতে হলে সিনিয়র কবির সেবা করতে
হয়। আমি তাহলে তোমার মাথায় হাত বুলিয়ে দোয়া করে দেবো বেটা, তুমি একদিন
কবি হবেই হবে।
অসাধ্য সাধন করলো ছেলেটা। গভীর রাতে কবিসেবার নিমিত্তে কেমন করে যেনো
জিনিস যোগাড় করে ফেললো! আনন্দে আপ্লুত রফিক ভাই সত্যি সত্যি ছেলেটার
মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন--যা বেটা তুই কবি হবিই। তোকে ঠ্যাকায় এমন সাধ্য
কারো নেই।
সেই রাতে দারূণ আড্ডা হলো। জিনিসের খাদক রফিক আজাদ আর ফারুক মাহমুদ। আমি
আর ছেলেটা পান ও ফান সঙ্গী। এক ফাঁকে, ঢাকায় আমাকে কোথায় পাওয়া যাবে
জানতে চেয়েছিলো ছেলেটা। আমি বলেছিলাম--বাংলা মোটরে বিশ্বসাহিত্য
কেন্দ্রে এলেই আমাকে পাবে।
এরপর আমরা ঢাকায় ফিরে এলাম। এবং যথারীতি ভুলে গেলাম ছেলেটাকে।
ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহে বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠা বার্ষিকীর
দিনটি আমরা মহা আনন্দ ও ব্যস্ততায় কাটাই। সায়ীদ স্যারের আমন্ত্রণে
দিনব্যাপি দেশের বিশিষ্টজনদের আগমনে কেন্দ্রের মাঠ লবি ছাদ থাকে উৎসব
মুখর। দিনভর চলতে থাকে খানাখাদ্যি। আইটেম হিশেবে থাকে মোয়া, মুড়ি,
নারকেলের নাড়ু, সন্দেশ, নকশি পিঠা, ভাঁপা পিঠা আর চায়ের অফুরান যোগান।
'যখন খুশি, যতোক্ষণ খুশি এবং যতোবার খুশি' খাওয়ার কথাটা বিশেষ ভাবে
মুদ্রিত থাকে নিমন্ত্রণপত্রে। মানুষ 'আসছে যাচ্ছে খাচ্ছে/আসছে খাচ্ছে
যাচ্ছে' টাইপের একটা হুল্লোড় চলতে থাকে সেদিন সকাল থেকে সন্ধ্যা
পর্যন্ত। অনুষ্ঠান উপস্থাপনার পাশাপাশি অতিথিদের দেখভালের দায়িত্বও
পালন করি কিছুটা, আমীরুল মাযহারদের সঙ্গে। সেদিন, ১৫ তম প্রতিষ্ঠা
বার্ষিকী উৎসব চলছিলো কেন্দ্র প্রাঙ্গনে। শেষ বিকেলের যাই যাই রোদে
দেখলাম কেন্দ্র কম্পাউন্ডে লাজুক ভঙ্গিতে পায়ে পায়ে টুঙ্গীপাড়ায় দেখা
সেই কবি ছেলেটা ঢুকলো। আমি মাঠের ঘাসে ডেকোরেটর থেকে আনা ফোল্ডিং চেয়ারে
বসে আড্ডা দিচ্ছিলাম বন্ধু ও অতিথিদের সঙ্গে। আমাকে দেখে উচ্ছ্বসিত
ছেলেটা এগিয়ে এলো--ভাই আমি মারজুক। টুঙ্গিপাড়ায় আপনার সঙ্গে দেখা
হয়েছিলো। আমি বললাম--কবে আইলা? বসো বসো। ছেলেটা বসলো। আমি উঠে গিয়ে নাড়ু
সন্দেশ মুড়ি মোয়া আর গরম ভাঁপা পিঠার একটা প্লেট ওর জন্যে নিয়ে
এলাম--খাও মিয়া। আমি একটু ব্যস্ত আছি। তুমি খাইতে থাকো।
ছেলেটা খুব আগ্রহ নিয়ে মোয়া-পিঠা-নাড়ু খাচ্ছে। কিছুক্ষণ পরে দেখি ওর
প্লেট সাফা। শুন্য প্লেট হাতে একা একা বসে আছে ছেলেটা। আমি জিজ্ঞেস
করলাম--আরেক প্লেট খাইবা নাকি? ছেলেটা সম্মতিসূচক মাথা নাড়লো। আমি
দ্বিতীয় একটা প্লেট নিয়ে এলাম ওর জন্যে। আমার কঠিন ব্যস্ততার ব্যাপারটা
বুঝতে পেরে ভিড়ের মধ্যেই এক ফাঁকে বিদায় নিলো ছেলেটা। তারপর অনেক দিন
আর দেখি না ছেলেটাকে। ভাবলাম আবারো হয়তো ফিরে গেছে গোপালগঞ্জে তার
চিরচেনা এলাকায়।
এর কিছুদিন পর ছেলেটা এক বিকেলে এসে জানালো--কবি ফারুক মাহমুদ ওর থাকার
ব্যবস্থা করে দিয়েছেন এলিফ্যান্ট রোডের একটা প্রেসে। প্রেসটা চালান
ফারুক মাহমুদ। মারজুক রাতে ঘুমায় ওখানে। আর সারাদিন ঘুরে বেড়ায় ঢাকা
শহরের লেখক-কবিদের আড্ডায়, পত্রিকা অফিসে। আমি বললাম--আমিও তো
এলিফ্যান্ট রোডেই থাকি। ভালোই হলো। তোমার সঙ্গে নিয়মিত দেখা হবে।
সন্ধ্যায় আজিজ মার্কেটে ফারুক মাহমুদ মারজুককে নিয়ে ঘুরে বেড়ান।
মারজুকের মাথায় চে গুয়েবাড়ার লাল ক্যাপ। ফারুক ভাই ঠাট্টা করে মারজুককে
'বাংলা কবিতার নাইট গার্ড' বলেন। মারজুক সেটা হাসিমুখেই মেনে নেয়।
ফারুক ভাইয়ের ঠাট্টায় কিছুটা তাচ্ছিল্য থাকলেও মারজুক প্রতিবাদ করে না।
আফটার অল বড় ভাই তিনি। মারজুকের আশ্রয়দাতা।
আমাদের এলিফ্যান্ট রোডের বাসায় মারজুকের আগমন মোটামুটি নিয়মিতই বলা
চলে। ছুটির দিন সকালে মারজুক চলে আসে আমার কাছে। কুশনে মাথা রেখে
ড্রয়িং রুমের কার্পেটে শুয়ে শুয়ে আমি গান শুনি ফুল ভল্যুমে। আমার মাথার
পাশে বসে থাকে মারজুক। 'দিল তো পাগল হ্যায়' তখন হিট গান। এই গানের সুর
ছন্দ আমার পছন্দের। মারজুকও দেখলাম গানটার ফ্যান। গান শুনি আর চোখ বন্ধ
রেখেই ওর কথা শুনি। ওর জীবনের অনেক গল্প করে সে আমার সঙ্গে। জেরিন
নামের একটা মেয়ের গল্প বলে সে আমাকে। মেয়েটাকে সে ভালোবাসতো। এইসবের
পাশাপাশি মারজুক তার বিশ্বষ স্বপ্নের কথাটাও প্রায়ই বলে। গান লিখতে চায়
সে। গীতিকার হতে চায় সে। বিখ্যাত গীতিকার। এক পর্যায়ে মারজুক আমার
'ছোটদের কাগজ'-এর প্রুফ দেখার দায়িত্ব নিলো। এতে সামান্য কিছু বাড়তি
উপার্জন হবে। ঢাকায় ওর চলাচল কিছুটা ছন্দ পাবে।
আমার সঙ্গে ওর খাতিরটা মোটামুটি জমজমাট।
এক সকালে ওকে নিয়ে বাংলা বাজার গেলাম আমার প্রকাশকদের কাছ থেকে
রয়্যালিটির টাকা আনতে। স্টুডেন্ট ওয়েজের লিয়াকত উল্লাহ হিশাব নিকাশ করে
আমার সমুদয় প্রাপ্য নগদে তুলে দিলেন। টাকার অংকটা খুব ছোট ছিলো না।
স্টুডেন্ট ওয়েজ থেকে বেড়িয়ে বিস্মিত মারজুকের মহাবিস্মিত
উচ্চারণ--'ভাই, ছড়া লেইখ্যা আপ্নে এতো ট্যাকা পান!' আমি হাসলাম। চলো
তাইলে আরো কিছু যোগাড় করি। আরো দুজনের কাছ থেকে নগদ টাকা নিলাম।
বিদ্যাপ্রকাশের মজিবর রহমান খোকা টাকা দিতে গড়িমসি করছিলেন। কিন্তু আমি
কিছুটা অনমনীয় থাকলাম। আগে থেকে বলা থাকলেও তিনি বললেন পরশু আসেন রিটন
ভাই। আমি বললাম--পরশু না। আজকে আসার কথা ছিলো, আজকেই নেবো। পরশু আসার
টাইম নাই। কিছুটা মন খারাপ করে খোকা ভাই আমাকে একটা চেক লিখে দিলেন এক
সপ্তাহ পরের তারিখ দিয়ে। চেকটা মানিব্যাগে ঢুকিয়ে খোকা ভাইয়ের কাছ থেকে
বিদায় নিয়ে বাংলা বাজারের রাস্তায় যখন হাঁটছি মারজুক তখন বিস্ময়ের
মহাসাগরে নিমজ্জিত--'ভাই, আপ্নে দেখি মারাত্মক জিনিস! ক্যাশ না থাকলে
চেক-এ ধরেন! আহা কী দিলেন!' আমি বললাম--হ মিয়া। মারজুক বললো--ট্যাকা তো
ভালোই পাইলেন।
--হ। চলো তোমারে খাওয়াই। বিউটি বোর্ডিং এ খাইছো কুনুদিন?
মারজুক খুশি হয়ে ওঠে--বিউটি বোর্ডিং? শামসুর রাহমান শহীদ কাদরীদের
আড্ডার জন্যে বিখ্যাত সেই বিউটি বোর্ডিং?
আমি বললাম--হ মিয়া। বিউটি বোর্ডিং-এর খাওন-দাওনও হেবি টেস্টি।
বিউটি বোর্ডিং-এ আমরা দুজন মন ভরে দ্বিপ্রাহরিক আহার সমাপন করলাম। ওদের
সর্ষে ইলিশটা মারজুককে বিমোহিত করলো দেখলাম। রিকশায় ফিরতে ফিরতে মারজুক
কতো যে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করলো। বললো--আজকের দিনের কথা ভুলুমনা ভাই। কী
দিলেন! আহা।
ছোটদের কাগজের সুবাদে মারজুকের সঙ্গে আমার সকাল-বিকেল-সন্ধ্যা-রাত্রি
যোগাযোগ থাকতো। ওর অন্য কোনো কাজ না থাকলে আমার সঙ্গে ছায়ার মতো লেপ্টে
থাকতো সে। এক সন্ধ্যায় হাতিরপুল বাজারে গেছি স্ত্রীর লেখা লিস্টি হাতে।
মারজুক আমার সঙ্গী যথারীতি। সবজি অঞ্চলে গিয়ে মারজুক কার যেনো একটা
কবিতার পঙ্ক্তি আওড়ায়--কাহিনিটা এরকম, সবজি বাজারে গেলে কবির মনে হয়
যেনো বা সে কোনো গ্রামে চলে এসেছে। গ্রোসারির দোকান থেকে
ডাল-চিনি-লবণ-গরম মসল্লা ইত্যাদি নিতে নিতে লক্ষ্য করলাম মারজুক খুব
আগ্রহ নিয়ে দোকানের জিনিসপত্রের দিকে ওর কৌতূহলী দৃষ্টির ক্যামেরাটা
প্যান করছে। বললাম--কিনবা কিছু? লাগবো কিছু তোমার?
--ন্নাহ্ কিছু লাগবো না ভাই।
আমি দোকানিকে দাম মেটাচ্ছি এমন সময় মারজুক বললো--তাইলে রিটন ভাই আমারে
একটা শ্যাম্পু কিন্না দ্যান। বিজ্ঞাপনের সুবাদে তখনকার একটা বিখ্যাত
ব্রান্ডের শ্যাম্পু নিলো সে। ওর রুচি আমাকে মুগ্ধ করলো।
এইরকম দিনযাপনের এক সন্ধ্যায় বন্ধু কবি আবু হাসান শাহরিয়ার এবং মারজুক
রাসেলকে সঙ্গে নিয়ে এলিফ্যান্ট রোডের বাসায় এলাম আমি। আমার স্ত্রী
শার্লি চা পরিবেশনের ফাঁকে আমাকে বললো আমি যেনো ওদের রাতের খাবার খেয়ে
যেতে বলি। আমরা গল্প করতে করতে শার্লি খাবার সার্ভ করে ফেললো। ডায়নিং
টেবিলে আমরা খেতে বসেছি। অন্যান্য আইটেমকে পরাভূত করে বিশাল একটা
সিরামিক বাটিতে গরুর ভুনা মাংশ তার সম্মোহনী সুবাস ছড়াচ্ছে। মারজুক
দেখলাম খুশিতে টইটম্বুর--আহা গরুর মাংশ! ফাটাফাটি! এইরকম দুর্দান্ত
গরুর মাংশ তো পুরা বাটি আমি একলাই মাইরা দিতে পারুম ওস্তাদ!
শাহরিয়ার বললো--তাই নাকি? এর পুরোটা তুমি একাই খেতে পারবে?
মারজুক বললো--পারুম মানে! এইটা ধরেন আমার জন্যে ব্যাপার না।
আমি বললাম--এইখানে মিনিমাম চারজনের খাওয়ার উপযোগী মাংশ আছে মিয়া। তুমি
একলা যদি সাঁটাইতে পারো তো সাঁটাও। আমি আমার ভাগটা তোমার লাইগা উৎসর্গ
করলাম।
শাহরিয়ারও তাই করলো। এবং আমাদের অবাক করে দিয়ে বাটির পুরো মাংশ হাপিশ
করে দিলো মারজুক! ভরপেট গোমাংশ খাওয়া শেষে তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলে মারজুক
ওর গরুপ্রিয়তার কাহিনি বলতে শুরু করলো। ওর একটা গল্প ছিলো
এরকম--এলিফ্যান্ট রোডে গাউসিয়ার কাছাকাছি ফারুক ভাইয়ের প্রেস থিকা বস
সকাল এগারোটা সাড়ে এগারোটায় বাইরাইছি। রাস্তার ধারের একটা হোটেলের
সামনে দিয়া যাইতাছি। বাবুর্চি হালায় বিরাট ডেকচিতে রানতাছে গরুর মাংশ।
গন্ধটা নাকে আইসা ইমুন একটা কিক দিলো যে আমার সবকিছু গেলো আউলা হইয়া।
আমি গিয়া বইয়া পড়লাম। দুইটা পরোটা আর এক প্লেট গরু সাঁটাইলাম। এমুন
টেস্টি যে কী কমু বস দিলাম আরেক প্লেটের অর্ডার। লগে আরো কিছু পরোটা।
দুই প্লেট মাইরা বিল দিতে গিয়া দেখি সত্তুর ট্যাকার মামলা। আমার
একদিনের বাজেট ওস্তাদ এক বেলাতেই ফিনিস হইয়া গেলো গা। ইমুন হারামি
শালার এই গরুর মাংশ। আর আমি বস এই জিনিস হেভি টানতে পারি।
ঘটনা শুনে এবং মারজুকের গরুর মাংশ খাওয়া দেখে শার্লি একই সঙ্গে মুগ্ধ
এবং বেদনার্ত হয়ে উঠলো। ওরা চলে যাবার পর শার্লি আমাকে বললো--এখন থেকে
বাড়িতে গরুর মাংশ রান্না হলে আমি তোকে ফোনে জানিয়ে দেবো। তুই ফেরার সময়
মারজুককে নিয়ে আসবি। আহারে ছেলেটা বাবা মাকে ছেড়ে একলা একা এই শহরে
থাকে। গরুর মাংশ এতোটা প্রিয় ওর!
এরপর, বেশ কয়েকবারই মারজুককে নিয়ে আসতে হয়েছে আমার। উপলক্ষ্য সেই গরুর
মাংশ।
দিন যায়। মারজুকের চেহারা পোশাক আর চুলের স্টাইলে পরিবর্তন আসতে থাকে।
মারজুক দিন দিন কী রকম দুষ্প্রাপ্য হয়ে উঠলো। ওকে আর যখন তখন পাওয়া যায়
না। কোথায় গেলো ছেলেটা!
একদিন সকালে আমার বাসায় এলো মারজুক। ওর চোখে মুখে উচ্ছ্বাস। মকসুদে
মঞ্জিলে পৌঁছে গেছে সে। এখন, ওর দিবানিশির অধিকাংশ সময় সে থাকে জনপ্রিয়
ব্যান্ড শিল্পী জেমসের সঙ্গে। বেশ ক'টা গানও নাকি লিখেছে সে জেমসের
জন্যে। তার মধ্যে 'মীরাবাঈ' নাকি খুবই পপুলারিটি পেয়েছে। আপ্নে শোনেন
নাই বস? আমি বললাম--এখনো শুনি নাই তবে শুনবো অবশ্যই। জেমসের আগে তুমিই
একটু শোনাইয়া যাও, দেখি শোনোন যায় কী না। কোনো রকম সংকোচ না করেই
কার্পেটে বসে ঝাঁকড়া চুল দুলিয়ে মারজুক গাইলো--'ঝাঁকা নাকা ঝাঁকা নাকা
ঝাঁকা নাকা দেহ দোলা না/ মীরা বাঈ...।' জেমসের গান এবং পানসঙ্গী মারজুক
আমাদের কাছ থেকে খানিকটা দূরে সরে গেলো। বলা চলে নগর বাউল জেমস কেড়ে
নিলো আমাদের মারজুককে।
দিন যায়। মারজুকের চেহারা পোশাক আর চুলের স্টাইলে আরো ব্যাপক পরিবর্তন
আসতে থাকে। নিয়তির খপ্পরে পড়ে দেশ থেকে ছিটকে পড়ি আমি। থিতু হই
কানাডায়। বাংলাদেশে আমার প্রিয় মানুষগুলোর সঙ্গে আর দেখা হয় না আমার।
দেখা হয় না মারজুকের সঙ্গেও। ইতোমধ্যে মোস্তফা সরয়ার ফারুকীর 'বেচেলর'
নামের ছবিতে অভিনয়ের মাধ্যমে বিখ্যাত হয়ে ওঠে মারজুক। এই ছবিতে ওর লেখা
গানও জনপ্রিয়তা পায়। ওর কারণে ছবিটা যোগাড় করে দেখি। গোপালগঞ্জের সহজ
সরল শাদাসিধে মারজুকের পনিটেল দেখে আমি অভিভূত হই। আমি খবর
পাই--স্যাটেলাইট টিভিগুলোর নাটকেও মারজুক অভিনয় করে। পরিচালনা করে। এক
কথায় স্টার হয়ে ওঠে আমাদের মারজুক। ঢাকা থেকে মারজুকের পরিচিত আমার এক
বন্ধু কানাডায় আসেন স্থায়ীভাবে বসবাসের সন্ধানে। আমি মারজুকের কথা
জানতে চাই। বন্ধুটি বলে--সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারে না যেই ছেলে, শুদ্ধ
উচ্চারণে কথা বলতে পারে না যেই ছেলে, সেই ছেলের বিরাট ছবি ঢাকার
বিলবোর্ডে ঝুলতাছে!
বুঝতে অসুবিধে হলো না মারজুকের উত্থান বা প্রতিষ্ঠায় আমার বন্ধুটি
কিঞ্চিৎ ঈর্ষান্বিত।
২০০৮ সালে বাংলাদেশে গিয়ে মারজুকের সঙ্গে দেখা হলো। ততোদিনে টিশার্ট
জিন্স হুডি আর ক্যাপ ওর নৈমিত্তিক ব্রান্ডেড পোশাক হয়ে উঠেছে। মারজুক
আমার সঙ্গে দেখা করতে চ্যানেল আইয়ের সিদ্ধেশ্বরী কার্যালয়ে এলো। তখন
দুপুর। নামাজের আজান হলো। পুরো বিল্ডিং-এ আজানের সম্প্রচার হয় লাউড
স্পিকারে। মারজুক কিছুটা হতচকিত--'রিটন ভাই মসজিদে আইয়া পড়লাম নাকি!'
বইমেলায় মারজুকের নতুন বই বেরিয়েছে। বাংলা একাডেমিতে চ্যানেল আইয়ের
লাইভ অনুষ্ঠানে এলো মারজুক বইটা নিয়ে। আমি ওর সাক্ষাৎকার নিচ্ছি। ওকে
আপনি সম্বোধন করে আমি প্রশ্ন করতেই অসম্মতিসূচক মাথা নেড়ে প্রতিবাদ করে
উঠলো মারজুক--আরে এইটা কিছু হইলো? আমারে আপনি কইরা বলেন কেনো? আমি
বললাম--একজন কবিকে সম্মান জানিয়ে আমি আপনি সম্বোধন করছি। মারজুক তাতেও
রাজি হয় না--না রিটন ভাই আপ্নে আমারে আপনি করে বলতেই পারেন না। এইটা
যায় না। অতঃপর আমাকে ফিরে আসতেই হলো তুমিতে। এই হলো মারজুক। আমাদের
মারজুক।
মারজুকের লেখা একটা গান আমার খুবই পছন্দের। ফারুকীর 'থার্ড পারসন
সিঙ্গুলার নাম্বার' ছবির 'বাহির বলে দূরে থাকুক ভিতর বলে আসুক না'
গানটির গীতিকার মারজুক। মারজুক গীতিকার হতে চেয়েছিলো। হয়েছে। সেই
হিশেবে মারজুক একজন সফল প্রতিষ্ঠিত তরুণ এখন। সাংস্কৃতিক অঙ্গণে
প্রতিষ্ঠা পাবার জন্যে কী অমানুষিক সংগ্রাম আর কষ্টের মধ্যেই না যেতে
হয়েছে ছেলেটাকে!
একটা ঘটনা বলি।
নব্বুই-এর দশকের শেষ দিকে এক বিকেলে বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের ছাদে আমার
সঙ্গে নানান প্রসঙ্গে কথা বলতে বলতে আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েছিলো ছেলেটা।
কিছুক্ষণ আগে কষে একটা ধমক দিয়েছিলাম ওকে। সম্ভবত প্রুফ দেখা বিষয়ে ওর
অমনোযোগ এবং দায়িত্বহীনতা আমাকে ক্ষুব্ধ করেছিলো। মারজুক তো আমার
ছোটভাইই। ওকে তো আমি ধমক একটা দিতেই পারি। কিন্তু ধমক পরবর্তী ছেলেটার
জলটলমল আবেগ আমাকেও কাবু করে ফেললো। মারজুক বললো—‘টুঙ্গিপাড়ায় আপনারে
রিটন ভাই আমার এতোই ভালো লাগছিলো যে আমি গোপালগঞ্জ থিকা ফাইনালি ঢাকা
চইলা আসলে বিপদে পড়লে আপনের কাছেই আইসা দাঁড়ামু এইরকম একটা চিন্তা আমার
মাথার মইধ্যে ছিলো। কবি হইতে হইলে ঢাকায় আইতেই হইবো। চান্স
খুঁজতেছিলাম। ফ্যামিলির লগে লাগলো ক্যাঁচাল। আইসা পড়লাম ঢাকায়।
দুইদিনেই পকেটের ট্যাকা শেষ। যাই কই আর খাই কি? দুইদিন আনালে বিনালে
থাইকা ক্ষুধায় তো কাতর হইয়া পড়লাম। বিকালে বিশ্বাস করেন ভাই মাথাটা
ইমুন চক্কর দিলো যে আমি তো মাটিতে বইস্যা পড়লাম। চোখে আন্ধার দেখি।
খাইতে হইবো। কিন্তু কে খাওয়াইবো! আঁতকা বস আপ্নের কথা মনে হইলো। আপ্নে
ঠিকানা কইছিলেন বাংলা মোটর বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র। তো চইলা আসলাম আপ্নের
উদ্দেশ্যে। আইসা দেখি ব্যাপক ঘটনা। বিখ্যাত অখ্যাত মানুষে ভর্তি
বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র। খিদায় মাথাটা আরেকবার চক্কর খাইলো। পৃথিবীটা
দুইল্লা উঠলো। যদি আপ্নেরে না পাই! কিন্তু বস আপ্নেরে পাইয়া গেলাম কয়েক
সেকেন্ডের মইধ্যেই। আপ্নে বন্ধুবান্ধব লইয়া ব্যস্ত আছিলেন। আমারে
চিনবেন কিনা সেইটাও একটা টেনশন ছিলো। কিন্তু আমারে আপনে চিনলেন তো
চিনলেনই কিছু কওনের আগেই আমারে চেয়ারে বসাইয়া নিজের হাতে খাওনের প্লেট
আগাইয়া দিলেন। আপ্নে খেয়াল করেন নাই আমি কী রকম ভুবুক্ষের মতন
খাইতেছিলাম। বিশ্বাস করেন এতোই ক্ষুধার্ত ছিলাম যে এক প্লেটে আমার পেট
ভরে নাই। আমি আপ্নের কাছে আরেক প্লেট চামু ভাবতে ভাবতেই দেখি আপ্নে
আইসা জিগাইলেন--আরেক প্লেট খাইবা নি? আমি হ কইলাম। আপ্নে আরেক প্লেট
আইন্না দিলেন আমার হাতে। তারপর চইল্লা গেলেন। বিশ্বাস করেন ভাই আমার
চোখ ঝাপসা হইয়া যাইতেছিলো। আমি লুকাইয়া কানতেছিলাম। আপ্নে কেম্নে
বুঝলেন যে আমার খিদা লাগছে!’
প্রিয় মারজুক, গত কয়েকদিন ধরে তোমার কথা খুব মনে পড়ছিলো। কেমন আছো
তুমি? দুদিন আগে তোমার জন্যে লিওনার্দ কোহেন-এর ‘লাইভ ইন লন্ডন’
কনসার্টের ডিভিডিটা কিনে এনেছি। আমি তো জানি এটা পেলে আনন্দে একটা
শিশুর মতোই নেচে উঠবে তুমি।
অটোয়া ১৫ অক্টোবর ২০১৪
WARNING:
Any unauthorized use or reproduction of 'Community' content
is strictly prohibited and constitutes copyright infringement liable to
legal action.
[প্রথমপাতা] |
লেখকের আগের লেখাঃ
|