সুতোর টানে-৪
সুলতান সালাহ্উদ্দীন আহমেদ
স্বপ্নের গোল্লাছুট
স্বপ্ন ছুঁয়ে দেখার সাধ জাগার বয়সটিতে আমি অসাধারণ কিছু মানুষের
সান্নিধ্য পেয়েছিলাম। আমার কাছে মনে হতো মানুষগুলোর কাছে যেতে পারা
স্বপ্নকে স্পর্শ করার মতো ঘটনা ঘটিয়ে ফেলা!
আমি ম্যাট্রিক পরীক্ষায় স্টার মার্কসসহ মোট পাঁচটি লেটার পেয়েছিলাম।
এক নাম্বারের জন্য আর একটি লেটার মিস করেছিলাম। সেটা হলো সোশাল
স্টাডিজ। আমি সায়েন্স গ্রুপ থেকে পাশ করি। ভালো রেজাল্টেন কারণে
কলেজে ভর্তির জন্য আমার কোনো ইন্টারভিউ লাগেনি। এছাড়া তখন মজা করে
বলা হতো, ল্যাবরেটরি স্কুল থেকে পাশ করা মানে দেয়ালটা টপকানো! কারণ
ল্যাবরেটরি স্কুল এবং ঢাকা কলেজ পাশাপাশি অবস্থিত।
ঢাকা কলেজে ঢোকার পর যেটা হয়, কিছু ছাত্র পড়াশোনায় অত্যন্ত ভালো
ছিল। আমার মনে হতো পড়াশোনার গতিটা কিছুটা কমে গিয়েছে। কারণ স্কুলে
থাকতে একটা ক্লাসরুমের মধ্যে ক্লাস হতো। ঢাকা কলেজে দেখলাম আমার
কাসটা ওমুক রুমে হচ্ছে তো আরেক জনের ক্লাসটা তমুক জায়গায় হচ্ছে। আগে
আমরা এক কাসেই বসতাম। শিক্ষকরা সব ঐ ক্লাসে আসতেন। ঢাকা কলেজে আমরা
বিভিন্ন ক্লাসে যাচ্ছি এবং শিক্ষকরা সেই ক্লাসে যাচ্ছেন। এটা আমার
জন্য একটু অসুবিধা হয়। মাঝে মাঝে এমন অবস্থা হতো, দেখতাম বন্ধুরা
কোন কাসে যাচ্ছে। তারা যে ক্লাসে যেত সেখানে আমার ক্লাস না থাকলেও
অনেক সময় যেতাম।
প্রিয় শিকদের মধ্যে ছিলেন প্রফেসর আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ। ক্লাসের
পরও তার পেছন পেছন আমরা থাকতাম। স্যারের বাড়ি পর্যন্ত চলে যেতাম।
ভাবীকে বিরক্ত করতাম। তখনও কিন্তু স্যারের অতো নাম হয়নি। টেলিভিশনে
অনুষ্ঠানও শুরু করেননি।
একদিন আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ স্যারকে দেখলাম কিছুটা মন খারাপ করে বসে
আছেন। তার মুখে তখন আনন্দের ছাপ ছিল না। স্যারের এই মন খারাপের
কারণ জানতে চাইলে স্যার জানান, আমাদের বাংলা ডিপার্টমেন্টের হেড
কথাসাহিত্যিক শওকত ওসমান স্যারের জায়গায় তাকে বসানো হয়েছে। কিন্তু
আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ স্যার সেখানে বসতে রাজি ছিলেন না। স্যার
আমাদের বলেছিলেন শওকত ওসমান স্যারের যে মেধা, জ্ঞান, যোগ্যতা আছে
শওকত ওসমানের উপস্থিতিতে সে চেয়ারে বসার যোগ্যতা বা ইচ্ছে তার নেই।
তখন আমি ভাবলাম আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ স্যার তো ভালো, তাহলে শওকত
ওসমান স্যার না জানি কতো ভালো! যদিও শওকত ওসমান স্যারের কোনো ক্লাস
আমাদের ছিল না। সায়ীদ স্যার কিন্তু সত্যিই তখন সেই চেয়ারে বসেন নি।
আমাদের আদর্শ গঠনে এগুলো খুব সহায়ক ছিল। কলেজ জীবনের শিক্ষকদের
মধ্যে আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ স্যারের কথা সব সময়ই মনে পড়ে। তার
প্রভাব আমাদের ওপর ছিল অনেক বেশি। শিক্ষকদের সাথে ছাত্রদের সম্পর্ক
ছিল খুব চমৎকার। অবশ্য তাদের খুব ভয়ও পেতাম। শিক্ষক ছাত্রের
সম্পর্ক ছিল পুরোপুরি বন্ধুত্বপূর্ণ।
আমি কলেজে এমনকি ল্যাবরেটরি স্কুলেও দেয়াল পত্রিকা করতাম, ওখানে
বিভিন্ন বিষয় নিয়ে লিখতাম। বিশেষত কবিতা লিখতাম। তখন সবুজ পাতা,
সবুজ সাথী পত্রিকা বের হতো। গুলিস্তানের এক জায়গায় আমরা জড়ো হয়ে
কবিতা পড়তাম এবং ওখানে একজন মডারেটর থাকতেন। আমরা কবিতা পড়তাম সেটা
নিয়ে আলোচনা হতো। অনেকটা পাঠচক্রের মতো। আনিস পড়তো, আমি পড়তাম।
মোটামুটি সবাই পড়তাম।
ঢাকা কলেজে পড়ার সময় দৈনিক বাংলায় আমি একটি কবিতা পাঠিয়েছিলাম। ঐ
পত্রিকার সাহিত্য সম্পাদক ছিলেন কবি আহসান হাবীব। তিনি আমাদের
পাশের বাসায় থাকতেন। ছোটবেলা থেকেই তিনি আমাকে দেখছেন। আমি কবিতাটা
তার হাতে দেইনি, পোস্ট করে দিয়েছিলাম। একদিন তিনি বাসায় এসে আমাকে
বললেন, তুমি কবিতা লিখতে পারো।
কবি আহসান হাবীবের মুখ থেকে কথাটা শুনে আমি এতো খুশি হয়েছিলাম যে
ভাষায় প্রকাশ করতে পারব না। কবিতাটি তার সাহিত্য বিভাগের প্রথম
পাতায় ছাপানো হয়েছিল। কবিতাটির শিরোনাম ছিল, এখনো ইচ্ছে হয় তোমাকে
সরাসরি প্রশ্ন করি।
পুরো কবিতাটির মধ্যে কোনো প্রশ্ন ছিল না; কিন্তু পুরোটা পড়ার পরে
প্রশ্নটা যেন অনিবার্য হয়ে দাঁড়ায়। একটা বিষয় আমি বর্ণনা দিচ্ছি
কিন্তু বর্ণনাটা না জানিয়ে অনুভবের মধ্য দিয়ে পাঠককে জানাচ্ছি।
রেডিও বা টিভির প্রতি আকর্ষণ আমার ঢাকা কলেজ থেকেই। কেমন করে মনে
নেই, রেডিও স্টেশনে নাটকের ভয়েস দিতে আমি যেতাম। আমি রেডিও নাটক
করতাম, তারপর যুদ্ধের পর টিভিতে যাই।
কলেজে কোনো ইউনিফরম ছিল না। পায়জামা-পাঞ্জাবি পরতাম, অনেক সময়
শার্ট-প্যান্ট পরতাম। ঢাকা কলেজে তখন চোষ প্যান্টের একটা প্রচলন
শুরু হয়।
কলেজে তখন শুধুই দেয়াল পত্রিকাই নয় স্মরণিকাও বের হতো। কোনো সময় আমি
সম্পাদক থাকতাম, কোনো সময় আনিস বা আলী ইমাম থাকতো। সেই সময় সবুজ
পাতা বা সবুজ সাথী এরকম একটা পত্রিকা অফিসে যেতাম সেখান থেকে অনেক
ভালো লেখক বেরিয়ে এসেছে। আনিসের পুরো নাম আহমদ আনিসুর রহমান,
বিচিত্রার তুখোড় লেখক, ইন্টারন্যাশনাল পুল নিয়ে লিখত। ও যে এখন
কোথায় জানি না।
ঢাকা কলেজে পড়ার সময় আড্ডার জায়গা ছিল নিউ মার্কেট। কলেজের এক্সট্রা
কারিকুলামের মধ্যে খুব বেশি ক্রিকেট খেলতাম। বন্ধুদের মধ্যে
প্যাথিওলজির মামুন ঢাকা মেডিকাল কলেজে আছে। সালাহউদ্দীন নামে আর
একজন ছিল আমাদের সঙ্গে। ও প্রথম হয়েছিল। ওর সাথে বিয়ে হয়েছিল
ফিজিক্সের ছাত্রী মিনুর। পাশ করার পর ওরা প্যারিসে চলে যায়। আমরা
দুই সালাহউদ্দীন এবং মিনু কবিতা লিখতাম। সালাহউদ্দীনের এক
বৈশিষ্ট্য ছিল। সে কবিতার প্রথম লাইনের প্রথম অক্ষর দিয়ে পুরো কবিতা
লিখতো। যেমন- ‘অ’ দিয়ে শুরু হলে সব লাইনের শুরুতেই ‘অ’ থাকত।
ব্যাপারটা ছিল খুবই মজার।
পরবর্তী সময় এই সালাহউদ্দীনই আমার হারানো চাচাকে প্রায় ২৫ বছর পর
কানাডা থেকে খুঁজে বের করেছিল। এই চাচা বহুদিন ধরে আছেন কানাডাতে।
পেশায় ডাক্তার, বিয়ে করেননি। ডাক্তার হিসেবে তিনি খুব ভালো ছিলেন।
কিন্তু কানাডা যাওয়ার পর কোনো এক অভিমানে আর বাড়ির সঙ্গে যোগাযোগ
রাখেননি। তাকে পাবার পর তার কাছে যতোই জানতে চাওয়া হোক না কেন, তিনি
কী কারণে যোগাযোগ বন্ধ করে দিয়েছিলেন, তিনি কোনো উত্তর দেন না, চুপ
করে থাকেন।
[লেখক পরিচিতি
আমেরিকার নোভা সাউথইস্টার্ন ইউনিভার্সিটি, ইউনিভার্সিটি অফ মায়ামিসহ বেশ
কিছু ইউনিভার্সিটির শিক্ষক ডা. সুলতান সালাহ্উদ্দীন আহমেদ মানব সেবার ব্রত
নিয়ে চিকিৎসা পেশাকে বেছে নেন। দেশে এবং প্রবাসে তিনি তার পেশায় আন্তরিকতা
এবং সততার জন্য প্রশংসিত হয়েছেন।
তিনি কলেজ ছাত্র অবস্থায় মুক্তিযুদ্ধে জড়িয়ে পড়েন। মুক্তিযুদ্ধের সময় বন্দী
শিবিরে অমানুষিক নির্যাতনের শিকার হন। মুক্তিযুদ্ধে তার উদ্ভাবিত হাতে তৈরি
সাইক্লোস্টাইল মেশিনে মুক্তিযুদ্ধের অনেক জরুরি এবং গোপন তথ্য নিয়মিত
প্রকাশিত হয়। এই মেশিন পরবর্তী সময়ে তাকে আন্তর্জাতিক খ্যাতি এনে দেয়।
গবেষক ও আবিষ্কারক হিসেবেও দেশে-বিদেশে স্বীকৃতি পেয়েছেন তিনি। একজন
মানুষের জীবন কতোটা বৈচিত্র্যময় হতে পারে তার একটি চমৎকার উদাহরণ হতে পারে
এই বইটি। জীবনের দুঃসময়ে ভেঙে না পড়ে তা কাটিয়ে ওঠার প্রেরণা হিসাবে বইটি
কাজ করবে। জীবনকে নিয়ে নতুন করে ভাবার অনেক উপকরণ ছড়িয়ে আছে সীমিত কলেবরের
এই বইটির পাতায় পাতায়। ব্যক্তিজীবনে সুলতান সালাহ্উদ্দীন আহমেদ একমাত্র মেয়ে
ও স্ত্রীকে নিয়ে মায়ামিতে বসবাস করেন।]
|