অনুভূতির ক্যানভাস
সোহেল মাহরুফ
বাসির
বুঝতে পারছে না তার এখন কী করা উচিত। তার কি উঠে দাঁড়িয়ে কাল্পনিক
বঙ্কিমচন্দ্রকে উদ্দেশ্য করে স্যালুট করা উচিত? হয়তো রূমের দেয়ালে বঙ্কিমের
কোনো ছবি থাকলে সে সেটাই করতো। হয়তো জীবিত বঙ্কিমকে হাতের কাছে পেলে পা
ছুঁয়ে প্রণাম করতো। কিংবা হয়তো আবেগে জড়িয়ে ধরতো। আসলে সেদিন
বঙ্কিমচন্দ্রের একটি লেখা পড়ার পর থেকে সে বঙ্কিমে শ্রদ্ধাবনত। লেখাটি সে
পড়েছিল একটি দৈনিকের সাময়িকীতে। এর আগে বঙ্কিমের অনেক উপন্যাস পড়লেও এ রকম
লেখা তার চোখে পড়েনি। লেখাটি একটি প্রবন্ধ। এই বঙ্গদেশে ‘বাবু’ নামক এক
কুলাঙ্গার প্রজাতির আবির্ভাবের পূর্বাভাস ছিল সেই প্রবন্ধে। বিষয়টি যেমন
বাসিরকে আকর্ষন করেছে তেমনি ভালো লেগেছে এর শব্দ চয়ন, ভাষার শৃঙ্খলিত
ব্যবহার, বাক্য গঠন, উপমার ব্যবহার প্রভূতি। প্রবন্ধটি পড়তে গিয়ে তার কাছে
প্রবন্ধের মতো নিরস মনে হয়নি বরং কবিতার মতো মনে হয়েছে। সে পুরোপুরি মুগ্ধ।
নিজে তো কয়েকবার পড়েছেই অন্যদেরকেও পড়তে বাধ্য করেছে। এমনকি পত্রিকার
অনলাইন সংস্করন থেকে ডাউনলোড করে অনেক পরিচিতজনকে মেইল করে পাঠিয়েছে।
প্রবন্ধটির নাম তার মনে নেই। তবে আজ লিখতে বসে হঠাৎ প্রবন্ধটির কথা মনে
পড়েছে। সে হঠাৎ সেখান থেকে তার সবচেয়ে ভালো লাগা অংশটুকু কাগজে লিখে ফেলে-
“তাহারা নিজ গৃহে পানি খাইবেন,
বন্ধু গৃহে মদ খাইবেন,
বেশ্যা গৃহে গালি খাইবেন আর
কর্তা গৃহে গলাধাক্কা খাইবেন।”
এটি ছিল ‘বাবু’ প্রজাতির স্বরূপ বোঝাতে বঙ্কিমচন্দ্রের ভাষ্য। যদিও আসল
লেখায় একটু এদিক সেদিক হতে পারে। আসলে লেখাটি এ মুহূর্তে তার হাতের কাছে
নেই। এইটুকুই মোটামুটি বাসিরের মাথায় গেঁথে গেছে। সে এরপর লেখার আর কিছু
খুঁজে পায় না। আসলে সে বসেছে একটি স্বনামধন্য দৈনিকে কলাম লেখার জন্য। যদিও
সে কখনই কলাম লেখেনি। সে টুকিটাকি কবিতা গল্প লিখে। পাঠক পড়ে কি না জানে
না। তবে সাহিত্য সম্পাদকেরা তাকে মোটামুটি সমাদর করেন। কিন্তু এবার এক
প্রভাবশালী পত্রিকার সম্পাদক ধরেছেন তার পত্রিকায় কলাম লেখার জন্য। এ শুনে
সাহিত্য সম্পাদকেরা নাখোশ। তাদের মতে কলাম লিখলে লেখকদের প্রতিভা নষ্ট হয়।
বাসির অবশ্য তার প্রতিভা ক্ষয়ের ব্যাপারে শংকিত নয়। তবে এইসব দৈনিন্দন
মামুলি বিষয় নিয়ে ফরমায়েশী লেখা লিখতে তার মন সায় দিচ্ছে না। তবু সম্পাদক
নাছোড়বান্দা। তার মতে প্রতিভাবান লেখকেরা কলাম না লেখায় পত্রিকার
পৃষ্ঠাভর্তি কলামগুলো অর্থহীন হয়ে পড়ছে। ব্যবসায়ী, রাজনীতিবিদ, পেশাজীবিদের
লেখা তথ্য, তত্ত্ব আর পরিসংখ্যানে ভরপুর নিরস কলামগুলো সাধারণ মানুষ পড়ে
না। আর তাই এগুলো শুধু পত্রিকার কাগজ আর কাগজের পয়সার অপচয়। তাই তিনি
চাচ্ছেন তার পত্রিকায় সৃজনশীল লেখকদের দিয়ে মননশীল কলাম লেখাবেন। সেই
প্রচেষ্টার প্রথম গিনিপিগ- বাসির মবিন। নিভৃতচারী গল্পকার ও কবি। বাসির
অনিচ্ছাস্বত্ত্বেও লিখতে বসে। কিন্তু বঙ্কিমচন্দ্রের লেখার উদ্ধৃতির পর আর
কিছু আসে না। সে অবশ্য বুঝতে পারে না এই কয় লাইনই বা সে কেন লিখেছে। লেখাটা
কোন বিষয়ে হবে? শিরোনাম কি হবে? কিংবা একটি কলাম এভাবে শুরু করা যায় কি না
সে বিষয়ে তার যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে। সে লেখাটি কেটে দিতে চায়। কিন্তু ইচ্ছে
করে না। আবার পড়ে। তার কাছে ভালোই লাগে। অনেকগুলো পরিচিত মুখ তার চোখের
সামনে ভেসে উঠে। ভাবে বঙ্কিমচন্দ্র হয়তো সমাজের একটি ক্ষুদ্র অংশকে নির্দেশ
করেছিলেন। কিন্তু এখন পুরো সমাজই এসব বাবুতে ভরে গেছে। বাসিরের হাসি পায়।
কেননা তার চোখের সামনে ছবির মতো ভাসে এরকম অনেক পরিচিত বাবুদের মুখ। সে
হঠাৎই অবাক হয়ে যায় মানুষের জীবন যাপনের স্বরূপ দেখে। হঠাৎ পুরো জীবনটাই
তার কাছে নাটকের মঞ্চ মনে হয়। মনে হয় একই মানুষ বিভিন্ন দৃশ্যে বিভিন্ন
চরিত্রে নিখুঁত অভিনয় করে যাচ্ছে। এই যেমন তার কথাই ধরা যাক। লেখালেখির
মানুষগুলো তাকে চিনে প্রতিভাবান কিন্তু ভীষণ আত্মঅহংকারী মানুষ হিসেবে।
অফিসের ক্লায়েন্টরা চিনে বিনয়ী, মিশুক, সকলের শুভাকাঙ্খী একজন হিসেবে। বসের
চেম্বারে সে ভীষণ ওবেডিয়েন্ট, পাংচুয়াল একজন। আর বাপের কাছে চিরকালের
ঘাড়ত্যাড়া। এসব কিছুর সমন্বয় করতে গিয়ে তার নিজেকেও মাঝে মাঝে
বঙ্কিমচন্দ্রের বাবুদের মতো মনে হয়। সেদিন এক ডাক্তারের চেম্বারের একটি ঘটনা
তার মনে গভীর দাগ কেটে গেছে। কি একটি সামান্য সমস্যার কারণে সেদিন সে এক
মেডিসিন কনসালটেন্ট এর শরনাপন্ন হয়। সিরিয়াল নিয়ে বসে আছে। অনেক রোগীর
বিষণœ মুখ তার বিরক্ত লাগে। তার লেখক মনের অনিসন্ধিৎসু চোখ কিছু একটা খোঁজে।
দেখে তরুণী ফ্রন্টডেস্ক অফিসার আর তরুণ অ্যাটেনডেন্ট এর কথা বলা, হাঁটা চলা
কিংবা রোগীনীর সাথে আসা কোনো তরুণীর কাছে বারবার খোঁজ নিতে যাওয়া তরুণ
অ্যাটেনডেন্টকে। এর মাঝে দেখে কিছু এমপিওদের আসা যাওয়া। হাতে ব্যাগ ঝুলিয়ে
কেউ হাসিমুখে, কেউ বিষণœ মুখে, কেউ তাড়াহুড়ো করে আর কেউ চিন্তামগ্ন হয়ে
সেখানে প্রবেশ করে। বাসির লম্বা সিরিয়ালে বসে কর্মহীন অলস সময় পার করার আর
কোনো উপায় না পেয়ে এসব কিছু পর্যবেক্ষন করে। হঠাৎ এসব ভাবতে ভাবতে একজন
এমপিও তার দৃষ্টি আকর্ষন করে। ছেলেটির ভেষভুষা খুবই পরিপাটি। অন্যদের থেকে
স্বতন্ত্র। আসার পর থেকেই সে মোটামুটি ভীষণ ব্যস্ততা দেখাচ্ছে। একবার এই
চেম্বারে উঁকি দিচ্ছে তো আরেকবার ঐ চেম্বারে উঁকি মারে। ডাক্তারদের পিকটাইম
হওয়াতে কোথাও সুযোগ পায় না। কিছু অ্যাটেনডেন্ট তো দরজার কাছেই ঘেঁষতে দেয়
না। সে নিরাশ হয়ে একটি চেয়ারে বসে পড়ে। অস্থিরভাবে পা নাচায়। তারপর আবার উঠে
পড়ে। অ্যাটেনডেন্টকে দিয়ে কিছু গিফট ভেতরে পাঠাতে সক্ষম হয়। অ্যাটেনডেন্ট
ভেতর থেকে বাইরে এসে আস্বস্ত করে। সে সুস্থির হয়ে বসে। কিছুক্ষন পর ভেতর
থেকে ডাক পড়ে। সে শিস্ বাজাতে বাজাতে ভেতরে ঢোকে। অল্প কিছুক্ষনের মধ্যে
আবার শিস্ বাজাতে বাজাতে বের হয়। বাসির অবাক হয়ে যায় ছেলেটির প্রাণচাঞ্চল্য
দেখে। সারাদিনের অফিসের পর সন্ধ্যার পরের এই বাড়তি খাটুনির পরও ছেলেটির
ক্লান্তি নেই। সে আনন্দে শিস্ বাজাচ্ছে। এত প্রাণশক্তি কোত্থেকে আসে! ছেলেটি
চলে যায়। কিন্তু বাসিরের মনে গভীর দাগ কেটে যায়। সে ভাবে এই ছেলেটিই হয়তো
এই পরিশ্রম, এই তরুণ অ্যাটেনডেন্ট কিংবা ডাক্তারের ব্যবহার সবই ভুলে যাবে
কাল ছুটির দিনে। হয়তো অফিসের বাইক কিংবা বন্ধুর কাছে থেকে ধার করা পালসার
নিয়ে গার্লফ্রেন্ডের সাথে দেখা করবে। বলবে ভাই কিনে দিয়েছে। হয়তো মাসের
বেতনের একটি বড় অংশ ব্যয় করে গার্লফ্রেন্ডকে গিফট করবে দামী কোনো মোবাইল
সেট। তারপর হয়তো মেসে ফিরে গ্রামে থাকা মা বাবাকে চিঠি লিখবে- এই মাসে বেতন
একটু কম হয়েছে। ওদিকে কষ্ট করে সামলে নিও। আগামী মাসে বেশি পাঠাবো। চিঠি
লেখার সময়কার ছেলেটির মুখ মনে করে বাসিরের মনটা খারাপ হয়ে যায়। আসলে কবি
লেখকদের এই এক সমস্যা। তাদের নিজেদের হাজার কষ্টের মাঝেও অন্যের কষ্ট
মুহূর্তে হৃদয় ছুঁয়ে যায়। এই সেদিন- সে গাড়িতে বসে ছিল। বাদামতলী মোড়ের
অফিস আওয়ারের দূর্বিষহ জ্যাম। হঠাৎ ফুটপাতের উপরে একটি মেয়ের উপর বাসিরের
চোখ পড়লো। মেয়েটির বাঁ চোখে সমস্যা, পায়েও বোধ হয় সমস্যা আছে। কিছুটা
হাঁটার পর বসে বিশ্রাম নিচ্ছে। মেয়েটির দূর্বিষহ জীবনের কথা ভেবে তার চোখে
জল আসে। সে মনে মনে বলে- আল্লাহ এ তোমার কেমন খেলা? তাকে জীবন যখন দিলেই
এমন দূর্বিষহ জীবন কেন দিলে? তার চোখ দিয়ে টপাটপ করে পানি পড়ে। সে মনে মনে
ভাবে- আমার নিখাঁদ প্রার্থনা কি তাকে ভালো করে দিতে পারে না? হঠাৎ জ্যাম
ছুটে যায়। তারপর নৈমিত্তিক ব্যস্ততায় সব ভুলে যায়। আজ আবার মেয়েটির মুখ মনে
পড়তেই তার চোখ জলে ভরে উঠে। আসলে কর্পোরেট নিয়মে বাঁধা জীবনে যখন মাঝে মাঝে
সে কাগজ কলম নিয়ে বসে- নিজেক যখন বিবেকের আয়নায় ব্যবচ্ছেদ করে তখন তার
পরাজয় হলেও কোনো দুঃখ নেই। কেননা সত্যের মুখোমুখি দাঁড়ানোর সাহসটুকুই তার
কাছে বেঁচে থাকার অনন্ত অনুপ্রেরণা। বাসিরের আর কলাম লেখা হয়ে উঠে না। বরং
বঙ্কিমের লেখার মধ্য দিয়ে আশেপাশের নৈমিত্তিক ঘটনার মধ্যে দিয়ে নিজেকে
আবিস্কার করাটাই তার কাছে বড় ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়।
|