|
গল্পের শুরু এখানেই
সোহেল মাহরুফ
গল্প লেখার এই এক সমস্যা। চাইলেই যখন তখন গল্প লেখা যায় না। কবিতার বেলায়
যেমন হঠাৎ করে একটা সুন্দর ভাব আসে, কিছু অপূর্ব শব্দগুচ্ছ কিংবা অসাধারণ
দুয়েকটি পংক্তি। ব্যাস। একটু ঘষামাজা করলেই টেনেটুনে মোটামুটি মানের
পাঠযোগ্য একটি কবিতা দাঁড় করানো যায়। কিন্তু সাধারণ মানের একটি পাঠযোগ্য
গল্প লেখাও অনেক কঠিন। প্রথমত গল্পের একটি ভালো প্লট খুঁজে বের করতে হয়।
তারপর কিছু আনুষঙ্গিক কাহিনি এবং বিশ্বাসযোগ্য চরিত্র। এ তো গেলো গল্পের
শুরুর আগের ব্যাপার। তারপর একটি যুৎসই গতিময় ভাষাশৈলী যা পাঠককে ধরে রাখবে
এবং সবশেষে সামঞ্জস্যপূর্ণ একটা শিরোনাম। যা সকলকে আকর্ষন করবে।
অনেকক্ষেত্রে দেখা যায় একটি ভালো প্লটের গল্পও ভাষার কারণে মার খায়। আবার
অনেক সময় সুন্দর ভাষা তরতর গতিতে এগিয়ে চলে কিন্তু ভালো কাহিনির অভাবে
কিছুদূর গিয়ে কলম মুখ থুবড়ে পড়ে। এ সমস্যাকেই তাত্ত্বিক ভাষায় বলে-
রাইটার্স ব্লক। ব্যাপারটা মোর্শেদ প্রথম জেনেছে শামছুর রাহমানের একটি
প্রবন্ধ থেকে। পরবর্তীতে ক্রিয়েটিভ রাইটিংস এর ওপর ঘাটাঘাটি করতে গিয়ে
বিস্তারিত জেনেছে। মোর্শেদ- পুরো নাম মানজুর মোর্শেদ। নিভৃতচারী
কবি-গল্পকার। তার লেখা আদৌ মানুষ পড়ে কি না সে জানে না। তবে বিভিন্ন
পত্রিকার সম্পাদকেরা তার কাছে নিয়মিত ধর্না দেন লেখার জন্য। এটাতেই সে মাঝে
মাঝে আত্মতৃপ্তিতে ভোগে। তবে ইদানিং চাহিদা একটু বেড়ে গেছে। বিশেষ করে
গল্পের জন্য সবাই চাপ দিচ্ছেন। তাদের মতে গল্পের লেখক এবং লেখার সংখ্যা নাকি
সংাঘাতিকভাবে কমে গেছে। মোর্শেদ এটির কোনো কারণ খুঁজে পায় না। কারণ সে জানতো
গল্প লেখা সহজ এবং এর পাঠক বেশি। তাই সবাইই গল্প লিখে। এবং তার শুরুটা কবিতা
দিয়ে হলেও সে ধীরে ধীরে গল্প লেখা শুরু করে। এবং সাহিত্য সম্পাদকদের বাড়তি
খাতির তার ধারণাকে আরও পোক্ত করে দেয়। কিন্তু এখন গল্প লেখকের সংখ্যা কমে
যাওয়ার কারণ কি? পাঠকও কি কমে গেছে? মোর্শেদ এর পেছনে অবশ্য একটি কারণ খুঁজে
পায়। মানুষের দৈনিন্দন জীবনের ব্যস্ততাই এর অন্যতম কারণ। একটি গল্প
সুন্দরভাবে ফুটিয়ে তোলার জন্য একজন লেখককে যে পরিমাণ সময় দেওয়া দরকার-
জীবনকে গভীরভাবে উপলব্দি কিংবা পর্যবেক্ষন করার জন্য- তা কি একজন লেখক দিতে
পারেন? কিংবা সুন্দরভাবে উপস্থাপনের জন্য যে সময় দরকার তা কি একজন লেখক
ব্যয় করেন? আর বইয়ের পাঠক কি আদৌ আছে? সবাইতো এখন সিরিয়ালের দর্শক। আর
লেখকেরাও মনে হয় লেখা বাদ দিয়ে সিরিয়ালের চিত্রনাট্য লেখায় ব্যস্ত। এতে দুই
দিকেই লাভ- সহজ কিছু সংলাপে কাজটা এগিয়ে নেওয়া সহজ এবং বিনিময়ে নগদ পাওনাও
ভালোই। আর মিডিয়ার কল্যানে প্রচার প্রসারের জন্য এখন আর ভাগ্যদেবীর দরকার
হয় না। যাই হোক এ কারণেই তাদের মতো কিছু লেখকের ওপর বাড়তি চাহিদার সৃষ্টি
হয়েছে। এই সুযোগে এখানেও অনেকে অখাদ্য কুখাদ্য নিয়ে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করতে
ব্যস্ত। মোর্শেদ এই বাড়তি চাহিদার কারণে একটি চাপ অনুভব করে। আর সেই চাপের
মুখেই সে হঠাৎ রাইটার্স ব্লকের ব্যাপারটি তার নিজের ভেতরে আবিস্কার করে। আজ
অনেকদিন পরে একটু অবসর পেয়ে নূতন গল্পের প্লট নিয়ে ভাবছে। কিন্তু কিছু তো
আসছেই না বরং এই গল্প লেখা বিষয়ক গুরু গম্ভীর তত্ত্ব মাথায় কিলবিল করছে।
মোর্শেদ যাচ্ছে তার গ্রামের বাড়ি বরিশালে। ঢাকা থেকে লঞ্চে করে। লঞ্চ ছাড়ার
পূর্বে কেবিনের সামনে বসে অলস সময় পার করছে। কর্মমুখর মানুষদের যা হয় আর
কি- অলস সময়কে অস্বস্তিকর মনে হয়। মোর্শেদের বেলায়ও এর ব্যতিক্রম নেই।
কোথায় সে এই অবসরের অলসতাটুকু প্রাণভরে উপভোগ করবে তা না। সে বসে গেছে
গল্পের প্লট খুঁজতে।
সে বসে আছে কেবিনের সামনের করিডোরে- প্লাস্টিকের চেয়ারে। আশেপাশে তাকিয়ে
অনিস্বন্ধিৎসু চোখে খুঁজছে তার গল্পের প্লট। এর আগেও এরকম বাড়ি যাওয়ার পথে
দু’একটি গল্প লিখেছে। যেগুলো ব্যাপক প্রশংসা কুড়িয়েছে। মোর্শেদ তাকিয়ে আছে
পাশের আরেকটি লঞ্চের দিকে। তার মতোই কেবিনের করিডোরে বসে আছে দু’তিনটি রংচঙে
মেয়ে। আসলে আজকাল স্টার প্লাস, জিটিভি দেখতে দেখতে কি মহিলারা আর কি মেয়েরা-
সবাই নিজেদেরকে হিন্দি সিরিয়ালের নায়িকা ভাবতে শুরু করেছে। মেয়েগুলোর পোশাক
দেখে মোর্শেদের এমনটি মনে হচ্ছে। প্রত্যেকের পড়নে স্লীভলেস কামিজ, থ্রী
কোয়ার্টার পায়জামা। এগুলোর আবার কি কি সব নাম আছে। মোর্শেদ এদেরকে নিয়েই
গল্পের প্লট চিন্তা করছে। ভাবছে হয়তো মেয়েগুলো কাজিন হবে। কোনো অনুষ্ঠানে
অ্যাটেন করতে অথবা ছুটিতে সবাই একসাথে দাদাবাড়ি অথবা নানাবাড়িতে বেড়াতে
যাচ্ছে। এমন একটি ব্যাপার মাথায় নিয়ে সে যখন কাহিনি সাজাচ্ছে হঠাৎ তাদের
একটি কথায় মোর্শেদ খুব বিরক্ত বোধ করে। আসলে ইভটিজিং নিয়ে ইদানিং খুব
শোরগোল হচ্ছে। কিন্তু অ্যাডাম টিজিং বলেও একটি ব্যাপার আছে। মোর্শেদ এর
আগেও দুই একবার এরকম অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হয়েছে। যাই হোক সে যখন গল্পের প্লট
নিয়ে ভাবছে তখন হঠাৎ খেয়াল করলো মেয়েগুলো তাকে লক্ষ্য করে অদ্ভুত উচ্চারনে
বলছে হট্! হট্! বলেই একজন আরেকজনের গায়ে গড়িয়ে পড়ছে। ব্যাপারটা মোর্শেদের
কাছে উপভোগ্য লাগলো না। সে সেখান থেকে উঠে লঞ্চের সামনে গিয়ে দাঁড়ালো।
হঠাৎ পাশের লঞ্চে এক দেবশিশুতুল্য মুখ তার দৃষ্টি আকর্ষন করলো। কতই বা বয়স
হবে মেয়েটির- সাত কি নয়? অদ্ভুত নিস্পাপ মুখ। সে লঞ্চের রেলিং এ হাত রেখে
দাঁড়িয়ে আছে। সারাক্ষনই মুখ নড়ছে। হাতে হয় ঝাল মুড়ির ঠোঙা নয় চিড়ার মোয়া নয়
আমড়া ইত্যাদি ইত্যাদি কিছু না কিছু আছে। মোর্শেদ অবাক হয়ে মেয়েটিকে দেখে।
পাশেই ডেকের উপর বসে আছেন একজন মহিলা। কালো বোরকায় পুরো শরীর ঢাকা। শুধু
চোখ দেখা যায়। পাশেই বয়স্ক এক পুরুষ বসে আছেন। তার হাত পাগুলো শুধু দেখা
যাচ্ছে। আর হাত পায়ের গঠন দেখেই মোর্শেদ তার বয়স অনুমান করে নেয়। ছোট মেয়েটি
যখনই যা আব্দার করছে লোকটি সাথে সাথে তা ই মেটাচ্ছে। মোর্শেদ ভাবতে থাকে।
ভাবে মহিলা আর পুরুষটি হয়তো ঢাকায় গার্মেন্টসে চাকুরী করে। ছুটিতে দেশের
বাড়িতে বেড়াতে যাচ্ছে। কিছুক্ষন পরে মহিলা তার বোরকা খুলে ফেলে। মোর্শেদ
দেখে মহিলার বয়স যতটা অনুমান করেছিল ততটা নয়। তখন তাকে ছোট বাচ্চাটির মা নয়-
বোন বলেই মনে হচ্ছে। মহিলা বোরকা রাখার জন্য যখন তার ব্যাগটা খুললেন তখন তো
বিস্ময়ে মোর্শেদের চোখ ছানাবড়া। দেখে তাকে ভড়কে দিতেই যেন তার দিকে বড় বড়
চোখ করে তাকিয়ে আছে একটি বই। নাম- সিলেক্টেড প্রোজ ফরম ভিক্টোরিয়ান এইজ।
মোর্শেদের ভাবনা পরিবর্তিত হয়। ভাবে মেয়েটি হয়তো ঢাকায় কোনো কলেজে বা
ইউনিভার্সিটিতে পড়ে। বাবা আর বোন হয়তো তাকে ছুটিতে বাড়িতে নিয়ে যেতে এসেছে।
মোর্শেদ আবার নূতন করে গল্পের প্লট ভাবতে থাকে। ভাবে তার পরিবার কেমন।
তাদের আর্থিক অবস্থা কেমন। হয়তো বা তার বিয়ের প্রস্তাব এসেছে। সেজন্যই বাবা
তাকে নিতে এসেছেন। হয়তো তার কোনো গোপন প্রণয় আছে কারো সাথে। কিন্তু বাবা
মায়ের আর্থিক অবস্থা কিংবা সম্মানের কথা ভেবে মেয়েটি হয়তো কোনোদিনই তা
প্রকাশ করতে পারবে না। তারপর চিরতরে হারিয়ে যাবে। এভাবে ভাবতে ভাবতেই
মোর্শেদ খুব মানবিক, হৃদয় ছুঁয়ে যাওয়া গল্পের প্লট খুঁজে পায়। ঠিক তখনই
লঞ্চ ছেড়ে যাওয়ার সময় হয়। হঠাৎ লঞ্চটি গর্জন দিয়ে নড়েচড়ে উঠে। মেয়েটি পাশে
বসে থাকা লোকটিকে তাড়া দেয়। ছোট মেয়েটি লোকটির হাত ধরে টানে। এক পর্যায়ে
লোকটি উঠে দাঁড়ায়। এবার মোর্শেদ প্রথমবার লোকটিকে দেখতে পায়। হাত পা দেখে
তাকে যত বয়স্ক মনে হয়েছে ততটা বয়স্ক নয়। মেয়েটির কাছাকাছি বয়সের একটি ছেলে।
হঠাৎ মোর্শেদের চিন্তা পরিবর্তন হয়। মেয়েটি ছেলেটিকে চলে যাওয়ার জন্য তাড়া
দেয়। কিন্তু ছেলেটি অসহায়ের মতো দাাঁড়িয়ে থাকে। মোর্শেদের চিন্তা দ্রুত
পরিবর্তন হয়। লঞ্চটি ধীরে ধীরে পল্টুন ছেড়ে যায়। ছেলেটি হঠাৎ দৌঁড় দেয়।
মুহূর্তেই অদৃশ্য হয়ে যায়। আর ছেলেটি অদৃশ্য হওয়ার সাথে সাথেই মেয়েটি ছোট
মেয়েটিকে নিয়ে শুয়ে পড়ে। লঞ্চটা মাঝ নদীর দিকে যাচ্ছে। মোর্শেদের
ভাবনাগুলোও যেন ধীরে ধীরে স্থিমিত হচ্ছে। হঠাৎ মোর্শেদ খেয়াল করে ছেলেটি
মাঝ নদীতে একটি নৌকা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। হাত নেড়ে বিভিন্নভাবে মেয়েটির দৃষ্টি
আকর্ষন করার চেষ্টা করছে। কিন্তু মেয়েটি কিংবা ছোট মেয়েটি একবার দেখছেও না।
ছেলেটি অনেকবার ব্যর্থ চেষ্টা করে শেষে ক্ষান্ত দিলো। অসহায়ের মতো বসে পড়লো
নৌকার উপর। মোর্শেদের স্থিমিত ভাবনা আবার নড়েচড়ে উঠলো। মেয়েটিকে ভালো মন্দ
ভেবে সে নূতন ভাবনার খোরাক পায়। খুঁজে পায় নূতন গল্পের প্লট।
|
WARNING:
Any unauthorized use or reproduction of 'Community' content
is strictly prohibited and constitutes copyright infringement liable to
legal action।
[প্রথমপাতা] |
লেখকের আগের লেখাঃ
|