অতঃপর আবার দেখা
সোহেল মাহরুফ
ইদানিং এ ধরণের ইন্টারভিউ তাকে প্রায়ই নিতে হচ্ছে। নাম এক্সিট ইন্টারভিউ।
যেসব এমপ্লয়ি এই অফিস থেকে চাকুরী ছেড়ে চলে যেতে চায় তাদের এ ধরণের
ইন্টারভিউ নেয়া হয়। তারা কেন চাকুরী ছাড়ছে? তারা এখানে কি ধরণের ডিসকমফোর্ট
ফেইস করেছে? তারা আর কি কি এডিশনাল বেনিফিট আশা করে? এডিশনাল কোন বেনেফিট
পেলে তারা এখানে রিটেইন করবে কিনা? এই কোম্পানির ওয়ার্ক এনভায়রনমেন্ট কেমন?
জব এনভায়রনমেন্ট ইমপ্রুভ করার জন্য তাদের কোন সাজেশনস আছে কিনা? মোটামুটি
এইসব প্রশ্ন দিয়েই এরকম প্রতিটি ইন্টারভিউ সাজানো হয়। কনসেপ্টটা বিদেশী
কোম্পানীর কাছে থেকে ধার করা। এতে করে নাকি কর্পোরেট কালচার ডেভেলপ হয়।
ইদানিং এই কোম্পানিতে এই ধরণের ইন্টারভিউ বেশি বেশি হচ্ছে। আসলে এটা রায়হান
সাহেবই এই কোম্পানিতে প্রচলণ করেছেন। রায়হান সাহেব এই কোম্পানির সিইও। বয়স
চল্লিশ এর মত। খুবই উচ্চাকাঙ্খী মানুষ। তিনি যখন অন্য কোম্পানি থেকে অনেক
বেশি সুবিধা আর হাইয়ার পজিশন নিয়ে এই কোম্পানিতে জয়েন করেছেন তখন
স্বাভাবিকভাবেই ডিরেক্টরদের এক্সপেকটেশন ও অনেক বেড়ে যায়। আর তাকে নিজের
অবস্থানের যৌক্তিকতা প্রমাণ করার জন্যই হোক অথবা ডিরেক্টরদের এক্সপেকটেশন
মিট আপ করার জন্যই হোক নিজের সামর্থ্যরে বাইরে অনেক কিছু চেষ্টা করতে হয়।
অনেক নতুন কিছু দিয়ে ডিরেক্টরদের চমকে দেয়ার একটা সচেতন প্রচেষ্টা তিনি
চালাচ্ছেন। শুরুতেই তিনি সিষ্টেমের ইফেক্টিভনেস এ্যানালাইসিস দিয়ে শুরু
করেন। আগের সিস্টেমের লুপহোল গুলো ডিরেক্টরদের চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে
বাহবা কুড়ানোর চেষ্টা করেন। পাশাপাশি কস্ট কাটিং, প্রোডাক্টিভিটি
এনহেন্সমেন্ট প্রভূতি পুরানো মেথড নিয়ে ও কাজ করেন। কিন্তু ইকনোমিক্সে
ডেমিনিশিং মার্জিনাল ইউটিলিটি বলে একটা ব্যাপার আছে। তাই রায়হান সাহেব যত
বেশি ইনপুটই দেন না কেন আউটপুট সেরকম ভাবে বাড়ে না। তারপরও তিনি তার
অবজেক্টিভ ওরিয়েন্টেড ম্যানেজমেন্ট নিয়ে আলোর মুখ দেখার চেষ্টা করছেন। আর
তার এ প্রচেষ্টায় অধঃস্তনরা মোটামুটি পালিয়ে বাঁচার চেষ্টা করছে। আর
সেটাকেই তিনি সুযোগ হিসেবে নিলেন। এত কিছুর পরেও যখন কাঙ্খিত ফল পাচ্ছিলেন
না তখন মনে হচ্ছিল সেটআপটা তার মন মত হয়নি। তারা তার নুতন সিষ্টেমের সাথে
তাল মেলাতে পারছে না। তাই তারা নিজের থেকে সরে যাওয়াতে তার জন্য ভালই
হয়েছে। এখন তিনি নিজের মত লোক নিয়ে সেটআপ তার মত করে করে নিতে পারবেন।
মাঝখান থেকে এই গণ রিজাইন থেকে ফায়দা লোটার জন্য চালু করলেন এক্সিট
ইন্টারভিউ নামের নুতন নাটক। ডিরেক্টরদের বোঝালেন এতে করে কোম্পানির
কর্পোরেট কালচার, কর্পোরেট গভর্নেন্স ডেভেলপ হবে। প্রাথমিক ভাবে এ রকম
একটা মেজর চেইঞ্জ দেখে ডিরেক্টররা বেশ খুশি। তবে ইদানিং তাকে প্রায়
প্রতিদিনই এইরকম ইন্টারভিউ নিতে হচ্ছে। পাশাপাশি শূণ্যস্থান পূরণ করার জন্য
রিক্রুটমেন্ট ইন্টারভিউ নিতে হচ্ছে নিয়ম করে। প্রতিদিনই সকাল বিকাল তাকে
ইন্টারভিউ বোর্ডে বসতে হয়। আজকেও সেরকম একটা এক্সিট ইন্টারভিউ বোর্ডে তিনি
বসে আছেন। আজকে মাত্র একজন কেন্ডিডেট। তাই তিনি দ্রুত ইন্টারভিউ শেষ করে
তার পরবর্তী এপয়েন্টমেন্টে মনোনিবেশ করার কথা ভাবছেন। তার সাথে আছেন মিস
সিমলা- তার পার্সোনাল সেক্রেটারি। ফাইল পত্র দিয়ে তাকে সাহায্য করার জন্য।
আর আছেন এইচ আর অফিসার মিস তানজিনা। এইচ আর ম্যাটারে তাকে হেল্প করার জন্য।
তারা দুজনেই তার খুব পছন্দের। দু’জনকেই তিনি হাইয়ার স্যালারী, হাইয়ার পজিশন
দিয়ে তার আগের কোম্পানি থেকে নিয়ে এসেছেন। রায়হান সাহেব ইন্টারভিউ শুরুর
আগেই ক্যান্ডিডেটের ফাইলে একবার চোখ বুলান। প্রথমেই ছবিতে তার চোখ আটকে
যায়। খুব শার্প লুকের ইয়াং পার্সোনালিটিসম্পন্ন একজন। এডুকেশন
ব্যাকগ্রাউন্ড খুবই ভাল। ক্যারিয়ার প্রগ্রেস ও ভাল। ডিপার্টমেন্ট থেকে তার
যে রিজাইন লেটার ফরোয়ার্ড করা হয়েছে তাতে ডিপার্টমেন্টের হেড তাকে প্রমোশন
অথবা আদার বেনিফিট দিয়ে তাকে অর্গানাইজেশনে রিটেইন করার জন্য রিকমেন্ড
করেছেন। রায়হান সাহেব ইনফরমেশনগুলো মাথার ভেতরে গুছিয়ে নেন। তারপর একটু
ভাবেন। আজকের ক্যান্ডিডেটের নাম রিয়াজ রহমান। বয়স বত্রিশ/তেত্রিশ হবে। সে
খুব সাবলীল ভাবে রুমে ঢুকে। তাকে দেখে মোটামুটি রায়হান সাহেবের ফার্ষ্ট
সাইট ইম্প্রেশন হয়। তিনি মনে মনে ঠিক করে ফেলেন যে করেই হোক একে এই
কোম্পানিতে রাখতে হবে। তিনি ডিরেক্টরদের যে প্রতিশ্র“তি দিয়েছেন তা অর্জন
করতে হলে এই ছেলে তার ভাল কাজে আসবে। কিন্তু ইন্টারভিউ শুরু হতেই তার
ভাবনায় বিঘœ ঘটে। রিয়াজ সাহেবের সরাসরি উত্তরগুলো তাকে ভীষণভাবে বিদ্ধ করে।
তবু তিনি তাকে মোটিভেট করতে চেষ্টা করেন। কিন্তু সে এ কোম্পানিতে আর
কোনমতেই কন্টিনিউ করতে চায় না। এমনকি সে কোন বিষয়ে কোন কমপ্লেইন ও করতে চায়
না। তার সরাসরি উত্তরগুলো রায়হান সাহেবকে বিরক্ত করে। বিশেষ করে দুইজন লেডি
অফিসারের মাঝে বসে তিনি কিছুটা বিব্রতও বোধ করেন। তাই ইন্টারভিউ বেশিদুর
আগায় না। রিয়াজ সাহেব হাসিমুখেই বিদায় নেন। কিন্তু রায়হান সাহেবের ভেতরে
একটা বিভ্রম সৃষ্টি হয়। তার কাছে মনে হয় রিয়াজ সাহেবের ঠোঁটগুলো নড়ছে।
তিনি স্পষ্ট শুনতে পান রিয়াজ সাহেব তাকে উদ্দেশ্য করে বলছেন- রায়হান সাহেব
আবার দেখা হবে। খানিকক্ষনের জন্য রায়হান সাহেব বিভ্রান্ত। বলেন- সরি! রিয়াজ
সাহেব কি বলছেন? রিয়াজ সাহেব অবাক হয়ে যান। বলেন-কই স্যার! কিছু বলিনি। বলে
হেসে বিদায় নেন। আবার ও রায়হান সাহেবের মনে হয় রিয়াজ সাহেবের ঠোঁট নড়ছে।
তিনি বলছেন- রায়হান সাহেব আবার দেখা হবে। এমনকি রিয়াজ সাহেব যখন দরজা খুলে
বের হয়ে যাচ্ছেন তখনও মনে হলো তিনি যেন ঘুরে দাঁড়িয়ে বলছেন- রায়হান সাহেব
আবার দেখা হবে। রায়হান সাহেব ঘামতে শুরু করেন। এ দেখে মিস তানজিনা আর মিস্
সিমলা অবাক হয়ে যান। মিস্ সিমলা অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করেন- স্যার এ্যানি
প্রোবলেম?
-না। তেমন কিছু না। আপনারা এখন আসেন। পরে আলাপ হবে। মিস্ তানজিনা আর মিস্
সিমলা আর কথা না বাড়িয়ে রুম থেকে বের হয়ে যায়। তারা রুম থেকে বের হতেই
রায়হান সাহেব টাই এর নট আলগা করে দিয়ে এসিটা আরেকটু বাড়িয়ে দেন। তবু তার
অস্বস্তি ভাবটা যায় না। তার ভীষণ ক্লান্তি লাগে। তিনি ক্লান্ত শরীরটা
চেয়ারের সাথে এলিয়ে দেন। ভেতরে ভেতরে ভীষণ ঘামতে থাকেন। কিছুক্ষন পরে উঠে
ফ্রেশরুমে যান। মুখে পানির ঝাপটা দেয়ার জন্য যেই বেসিনের আয়নার দিকে
তাকিয়েছেন অমনি তিনি আবার আঁতকে উঠেন। দেখেন তার পেছনেই রিয়াজ সাহেব
দাঁড়িয়ে আছেন। তার ইস্ত্রি করা শার্ট কাঁধের কাছে হাত দিয়ে সমান করে দেয়ার
ভঙ্গিতে বলেন-রায়হান সাহেব আবার দেখা হবে। রায়হান সাহেবের অস্বস্তি চূড়ান্ত
মাত্রায় পৌছে। ইংলিশ ছবিতে ছোটবেলায় তিনি এরকম দৃশ্য অনেক দেখেছেন। কিন্তু
বাস্তবে ও যে এরকম হতে পারে তা তার চিন্তার বাইরে। একবার তার মনে হলো তিনি
বোধ হয় মাথা ঘুরে পড়ে যাবেন। কোনমতে নিজেকে সামলে নিয়ে তিনি ফ্রেশরুম থেকে
বেরিয়ে আসেন। চেয়ারে বসতেই দেখেন সেল ফোন বেজে উঠে। তিনি সেলফোনের শব্দে
আতঙ্কগ্রস্থ হয়ে পড়েন। মনে হয় যেন সেলফোনের রিং টোন ও বলছে-রায়হান সাহেব
আবার দেখা হবে। দু’তিনবার কল আসার পরে তিনি সেলফোনটা হাতে তুলে নেন। দেখেন
বাসার নম্বর। নিশ্চয়ই মেয়ে তুলতুলি ফোন করেছে। রায়হান সাহেবের একমাত্র মেয়ে
তুলতুলি। তার মা এবং মামারা মিলে অনেক লম্বা নাম রেখেছে। কিন্তু রায়হান
সাহেবের সেটা পছন্দ না। তাই তিনি তাকে তুলতুলি নামেই ডাকেন। এ সময়ে সে একাই
বাসায় থাকে। প্রতিদিনই সে এ সময়ে বাবাকে ফোন দেবে। ঘড়ি ধরে দশ মিনিট কথা
বলবে। তারপর মায়ের সাথে দশ মিনিট কথা বলে গানের স্কুলে যাবে। কলটা দেখার
পরেও রায়হান সাহেবের ধরতে ইচ্ছে করছে না। তিনি রিংটোন সাইলেন্ট করে রাখেন।
দরজা খুলে মেসেঞ্জার আবু মিয়া উঁকি দেয়- স্যার লাঞ্চ রেডি করবো।
-না। লাঞ্চ করবো না। বলেই তিনি আবার চেয়ারে তার শরীর এলিয়ে দেন। মুহূর্তেই
ফোনটা বেজে উঠে। রায়হান সাহেব অনিচ্ছাস্বত্ত্বেও ফোনটা ধরেন। পিএস মিস্
সিমলা-স্যার আধঘন্টা পরে ফ্রেশ রিক্রুটমেন্টের ইন্টারভিউ। ফাইলগুলো কি নিয়ে
আসবো?
-নাহ। এইচ আর কে বলেন ইন্টারভিউটা সেড়ে ফেলতে। আর সর্টলিষ্টেড
ক্যান্ডিডেটদের জন্য আরেকটা ইন্টারভিউর ব্যবস্থা করতে বলেন। সেখানে আমি
থাকবো। বলেই রায়হান সাহেব ফোনটা রেখে দেন।
তিনি চেয়ারে হেলান দিয়ে একটু ঘুমিয়ে পড়েছিলেন। আবার ফোনটা বেজে উঠে। তিনি
লাফিয়ে উঠেন। স্পষ্ট দেখতে পান রিয়াজ সাহেব বলছেন- রায়হান সাহেব আবার দেখা
হবে। তিনি ধাতস্থ হতে কিছুটা সময় নেন। দেখেন ফোনটা একটানা বেজে চলছে। তিনি
দ্রুত ফোনটা রিসিভ করেন- স্যার। ম্যাডাম। আপনাকে সেলফোনে না পেয়ে কল
করেছেন। মিস্ সিমলা একটানা বলেন।
রায়হান সাহেব বিরক্ত হয়ে বলেন-আচ্ছা দেন। রায়হান সাহেবের স্ত্রী রেবেকা।
তিনি ও একটা প্রতিষ্ঠানের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা। এমনিতে ভালই। তবে ক্ষেপে
গেলে সামলানো কঠিন। সাধারণত অফিস আওয়ারে বড় ধরণের কোন ঝামেলা না হলে তিনি
কখনও রায়হান সাহেবকে তেমন একটা ফোন করেন না। তাই তার ফোন শুনে তিনি ভাবতে
শুরু করেন কোন ঝামেলা হলো কিনা। তার ভাবনার ছেদ ঘটাতেই ওপাশ থেকে তপ্ত
কন্ঠ- কি ব্যাপার সমস্যা কি?
রায়হান সাহেব কিছু বুঝে উঠতে পারেন না। বলেন- কই কি হইছে?
-মেয়ে ফোন দিছে ধরো নাই কেন?
-মুড অফ ছিল।
-মুড অফ কি মেয়ের সাথেও। তোমাকে বলছি না অফিসের ঝামেলা কখনও বাসায় টানবে
না। তুমি ফোন ধরো নাই দেখে মেয়ে কেঁদে কেটে একশেষ। এখনই ফোন দিয়ে কথা বলো।
-আচ্ছা ঠিক আছে।
-আর তোমার পিএস বললো তুমি নাকি দুপুরে লাঞ্চ করো নাই। কি কোন সিরিয়াস
প্রোবলেম হইছে?
-নাহ। তেমন কিছু না।
-তাহলে তাড়াতাড়ি খেয়ে নাও। নইলে শরীর খারাপ করবে।
-আচ্ছা ঠিক আছে। রায়হান সাহেবের আর বেশি কথা বলতে ইচ্ছে করছে না। তবু ও কথা
দীর্ঘায়িত হচ্ছে।
-আজকে আমাদের নতুন ফ্লাটের ফিটিংসগুলো কিনতে যাওয়ার কথা না? কখন বের হবে।
-আমি আজকে পারবো না। আরেকদিন।
-না। তাহলে বেশি দেরী হয়ে যাবে। পরে আবার টাইমলি শিফট করতে পারবো না।
-আচ্ছা তাহলে তুমি যাও।
-এইটা কি রকম কথা? ঘরের কাজ ও আমি করবো বাইরের কাজও আমি করবো! তুমি দেখছি
ইদানিং সবকিছু এভয়েড করার চেষ্টা করছো।
-আমি আজকে পারবো না। রায়হান সাহেব কথা যত সংক্ষিপ্ত করতে চায় কথা আরো
দীর্ঘায়িত হয়।
এক পর্যায়ে রেবেকা বলে-শোন আমি সন্ধ্যা শার্প ছয়টায় আসবো। তুমি আমার সাথে
যাবে। আর কিছু শুনতে চাই না। বলেই রেবেকা ফোনটা রেখে দেয়। রায়হান সাহেবের
আতঙ্কের সাথে এখন মেজাজটা ও বিগড়ে গেছে। তিনি ফোনটা তুলে মিস্ সিমলাকে
আচ্ছা মতো একটা ঝাড়ি লাগান। মিস্ সিমলা অনেকদিন ধরেই রায়হান সাহেবের সাথে
কাজ করছেন। বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন অবস্থায়ই তিনি রায়হান সাহেবকে দেখেছেন।
কিন্তু আজকের অভিজ্ঞতা তার জন্য নুতন। সে প্রথমে কিছুটা ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে
যায়। পরে নিজেকে গুছিয়ে নিয়ে জ্বি স্যার জ্বি স্যার বলে পরিস্থিতি সামলে
নেয়। ফোন রাখার পরে সে কিছুক্ষন ভাবে। ভালই বুঝতে পারে যে আজ বসের মন
খারাপ। তবে তার চাকুরীর অভিজ্ঞতায় বস্কে কিভাবে বশ করা যায় তা সে ভাল করেই
শিখে নিয়েছে। আর এর আগে রায়হানসাহেবের ক্ষেত্রে সে শতভাগ সফল। তাই সে বসের
এই মেজাজ গরম যাতে দ্রুত পুরো অফিসে ছড়িয়ে না পড়ে তার ব্যবস্থা নেয়ার কথা
ভাবে। কিছুক্ষন সে মন খারাপ করে ডেস্কে বসে থাকে। তারপর সে তার পরিকল্পনা
করে। মিস সিমলা- বয়স চৌত্রিশ/পঁয়ত্রিশ হবে। তবে তার অতিরিক্ত সচেতনতার
কারণে আর স্লিম ফিগারের কারণে বয়স পঁচিশ কি আটাশ বলে দিব্যি চালিয়ে দেয়া
যায়। আর তার এমন আকর্ষণীয় স্লিম ফিগারে পুরুষের চোখ আটকে রাখার জন্য যা যা
করণীয় তা করতে সে মোটেও কৃপণতা করে না। তার পাতলা শাড়ি কোমড়ের নিচে নামতে
নামতে মোটামুটি বারমুডা ট্রায়াঙেলের বিপদসীমার কাছাকাছি পৌছে যায়। আর কাজল
আকাঁ চোখের মত মায়াবী ইশারায় তাকিয়ে থাকে নিকানো আঙ্গিনার মত মেদহীন পেট,
নাভী। আর ব্লাউজের কাপড়ের সংযম না চাইলেও চোখে পড়ার মত। পাতলা শাড়ির আঁচল
অনেক সময়ই যেটা সামলাতে ব্যর্থ হয়। আর তার এমন গেটআপ সচেতন না অবচেতন ভাবে
করা তা মেলাতেই অনেকেই হিমশিম খায়। সে বেশ মজাই পায় যখন দেখে তার কোন
অসতর্ক মুহূর্তে তার বাবার বয়সী কোন কলিগ কাজ ভুলে চশমার ফাঁকে দিয়ে অপলক
তাকিয়ে থাকে। তার এই সচেতনতা দিয়ে তার চাকুরীজীবনে বেশ ভালই উন্নতি করেছে।
বিশেষ করে রায়হান সাহেবের মত স্মার্ট কাজ পাগল মানুষকেও সে কাবু করে
ফেলেছে। তার যে বাসায় সুন্দরী স্মার্ট বউ আছে সেটা সিমলাকে দেখলে প্রায়ই
ভুলে যান। আর মিস্ সিমলা ও এর সদ্ব্যবহার পুরোপুরিই করেছেন। এর আগের
কোম্পানিতেও সে বেশ ভাল অবস্থানে ছিল। বিশেষ করে রায়হান সাহেবের সুনজরের
কারণে। আর এখানে তো সে না চাইতেই রায়হান সাহেব তাকে অনেক বেশি সুযোগ সুবিধা
দিয়ে নিয়ে এসেছেন। তাই আজ আবার সে তার পুরানো অস্ত্র ব্যবহার করে রায়হান
সাহেবের বিগড়ে যাওয়া মেজাজ শান্ত করতে চায়। সে উঠে ফ্রেশ রুমে যায়। চুল
চেহারা ঠিক করে নেয়। তারপর শাড়ি ঠিক করতে গিয়ে শরীরের আকর্ষণীয় স্থানকে
আরেকটু উন্মুক্ত করে যাতে সহজে দৃষ্টি আকর্ষন করে। তারপর সে পরেরদিনের
এ্যাপয়েন্টমেন্ট এর ফাইল নিয়ে রায়হান সাহেবের রুমে প্রবেশ করে। রায়হান
সাহেব তখনও চেয়ারে হেলান দিয়ে আছেন। তাকে দেখে সোজা হয়ে বসেন। সে চেয়ারে
বসতেই রায়হান সাহেব বলেন- ড্রেস ঠিক করে নেন।
রায়হান সাহেবের মুখে এমন কথা শুনে সে কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে যায়। বলে- সরি
স্যার!
রায়হান সাহেব হঠাৎ ভাবেন এভাবে সরাসরি বলাটা অফিস ডেকোরামের ভায়োলেশন হলো
কিনা। তাই তিনি নিজেকে সংযত করে বলেন- না কিছু না। আপনি এখন যান। পড়ে আসেন।
মিস্ সিমলা বের হয়ে যায়। রায়হান সাহেব আবার চেয়ারে শরীরটা এলিয়ে দেন।
কতক্ষন এভাবে ছিলেন খেয়াল নেই। হঠাৎ দেখেন সাইলেন্ট করা মোবাইলের রঙ্গীন
আলো জ্বলা নিভা করছে। তার ফোনটা ধরতে ভয় করছে। মনে হচ্ছে ফোন ধরলেই রিয়াজ
রহমান নামের ছেলেটা আবার বলে উঠবে-রায়হান সাহেব আবার দেখা হবে। তাই তিনি
ফোনটা ধরেন না। কিছুক্ষন পরে ফোনটা বেজে উঠে। ভাবেন নিশ্চয়ই মিস্ সিমলা ফোন
দিয়েছেন। তাকে ঝাড়ি দেয়ার জন্য আবার ফোনটা তুলেন। ওপাশ থেকে রেবেকার
আতঙ্কিত কন্ঠ- এই তুমি ফোন ধরছো না কেন? তুলতুলি হসপিটালে। গানের স্কুল
থেকে ফেরার পথে কার এ্যাকসিডেন্ট করেছে। সিরিয়াস অবস্থা। রেবেকা পাগলের মত
একটানা প্রলাপ বকে যাচ্ছে। রায়হান সাহেব সবকিছু শুনলেন কি শুনেন নাই। শুধু
হসপিটালের নাম শুনেই উঠে ছুটে গেলেন।
হসপিটালে গিয়ে দেখেন রেবেকা অপারেশন থিয়েটারের সামনে অস্থির ভাবে পায়চারি
করছেন। রায়হান সাহেব সেদিকে ছুটে যান। কিন্তু রেবেকাকে কি জিজ্ঞেস করবেন
খুঁজে পান না। হঠাৎ দেখেন দুরে হাত চেপে ধরে দাঁড়িয়ে আছে সেই ছেলেটি।
সকালের ইন্টারভিউ নেয়া সেই ছেলেটি- মানে রিয়াজ রহমান। রায়হান সাহেব আবার
আতঙ্কগ্রস্থ হয়ে পড়েন। হঠাৎ সবকিছু ভুলে রেবেকাকে জিজ্ঞেস করেন-ঐ ছেলেটা
এখানে কেন? সে কি চায়?
রেবেকা রায়হান সাহেবের এমন আতঙ্কগ্রস্থ চেহারা দেখে বলেন- সে ই তো
তুলতুলিকে স্পট থেকে উদ্ধার করে এনেছে। তারপর এমারজেন্সি ব্লাড দিয়েছে। সে
না থাকলে যে কি হতো! বলেই সে কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে। সেখানে খবর পেয়ে তাদের আর
যারা পরিচিত এসেছেন তারা রেবেকাকে শান্ত করেন। কিন্তু রায়হান সাহেব সেদিকে
খেয়াল না করে রিয়াজ রহমানের দিকে ছুটে যান। তার হাত চেপে ধরেন। বলেন- ভাই
আমার ভুল হয়েছে। আমি আর এমনটি করবো না। তুমি এই কোম্পানিতে থাকো। আমি তোমার
কোন ক্ষতি করবো না।
রিয়াজ কিছু বুঝে উঠতে পারে না। সে বলে- সরি স্যার। আপনি কি বলছেন আমি বুঝতে
পারছি না।
-তুমি না থাকলে আমার তুলতুলির আজ কি যে হতো!
-থ্যাঙ্কস্ গড। সে তুলতুলি! আপনার মেয়ে! যা হোক সময়মতো আমি সেখানে ছিলাম।
স্যার আশা করি সে ভাল হয়ে উঠবে।
-তাই দোয়া করো। কিন্তু তুমি কালকেই আবার আমার কোম্পানিতে জয়েন করো।
-না স্যার। আমি কোন ব্যক্তিগত ক্ষোভ থেকে চাকুরী ছাড়িনি। শুধু খারাপ লেগেছে
যে কিছু নিরীহ লোক চাকুরী হারাচ্ছে তাই দেখে। আমাকে নিয়ে কখনও ভাবি না। আমি
অলরেডী একটা এমএনসিতে ডিপার্টমেন্ট হেড হিসেবে অ্যাপয়েন্টেড হয়েছি।
রায়হান সাহেব আরো জোরে রিয়াজের হাত চেপে ধরে-তুমি আমাকে মাফ করে দাও ভাই।
-স্যার আমার আপনার উপরে কোন ক্ষোভ নাই। শুধু একটা রিকোয়েষ্ট করবো- মানুষের
উপকার করতে না পারেন কাইন্ডলি অপকার করবেন না।
এরমধ্যে তরুণী ডাক্তার ওটি থেকে বেরিয়ে আসে। রেবেকাসহ অন্যরা সেদিকে ছুটে
যায়। ডাক্তার তাদের কি যেন বুঝিয়ে বলেন। তারা আশ্বস্ত বলে মনে হয়। তারপর
ডাক্তার সরাসরি রায়হান সাহেবের দিকে চলে আসে। রায়হান সাহেব আগ বাড়িয়ে বলেন-
তুলতুলি আমার মেয়ে । তার কি অবস্থা?
-ভাল। ভেতরে কিছু গ্লাস ছিল বের করা হয়েছে। এখন আশঙ্কামুক্ত। আর টাইমলি
ব্লাড পাওয়াতে তেমন সমস্যা হয়নি। বলেই সে রিয়াজ রহমানকে উদ্দেশ্য করে বলে-
এই তুমি এখনও এখানে দাঁড়িয়ে কেন? তোমার খারাপ লাগছে না। আমার অফিসে গিয়ে
বসতে।
-না ঠিক আছে। তাদের এমন অন্তরঙ্গ কথায় রায়হান সাহেব জিজ্ঞাসু চোখে তাকান।
তখন রিয়াজ পরিচয় করিয়ে দেন- স্যার এ হচ্ছে জুঁই। আমার হবু স্ত্রী। আগামী ১৭
তারিখে আমাদের বিয়ে। দোয়া করবেন।
-অবশ্যই।তুমি অনেক লাকি। তোমাদের বিয়েতে অবশ্যই আমাকে দাওয়াত করবে।
-অবশ্যই স্যার। বলেই রিয়াজ জুঁইয়ের বাহু বন্দী হয়ে তার অফিসের দিকে পা
বাঁড়ায়।
|