নিষ্ঠুর স্বদেশ জার্নি:প্রবাসের
আত্মীয়রা
কাজী ইনসানুল হক
মায়ের মৃত্যুর খবর পাওয়া, অফিস থেকে ঘড়ে ফেরা, অনলাইনে সেইমডে-র টিকেট না
পেয়ে চড়া মূল্যে বিজনেস ক্লাশের টিকিট কেনা, এয়ারপোর্টে অপেক্ষপান
বন্ধু-প্রিয়জনের সান্নিধ্য, অবশেষে জাপানকে আপাতত সাইয়োনারা(বিদায়) জানিয়ে
ঢাকা ও সৈয়দপুর হয়ে সদ্য প্রয়াত মায়ের কবরে যেয়ে নির্মম জার্নির সমাপ্তি।
৩০ জুন, ২০১৬ সকাল দশটা, ফোনে বারবার ফোন কল ও ম্যাসেজ। মা আর নেই, ডেস্ক
ছেড়ে এডমিনে যেয়ে দেশে যেতে হবে বলে নিজের রুমে যাই। ইতিমধ্যেই অফিসের সবাই
আমার মাতৃবিয়োগের কথা জেনে গেছে। আমি বেরুচ্ছি, লক্ষ করি সবাই কাজ বন্ধ করে
দাড়িয়ে আমাকে বিদায় জানাচ্ছে। সহকর্মীর প্রতি শোক জানানোর এই জাপানী রীতিটি
মাকে হারানোর শোক কিছুটা হলেও লাঘব করে।
কজন প্রবাসী বন্ধু, সুহৃদকে খবরটা জানানো দরকার। যা হবার তাই হলো, বিরামহীন
ফোন কল, ম্যাসেজ, সোশাল মিডিয়ায় পোষ্ট আর কমেন্টস। দিনভর পরিচিত অপরিচিত
লোকজন থেকে শোকবানী। আমি দেশের পথে, অথচ মসজিদে মসজিদে দোয়া পড়ানো, জাপানের
নিউজ পোর্টাল গুলোতে মৃত্যুর খবর জানানো এমনকি দেশের জনপ্রিয় পত্রিকায় শোক
সংবাদ প্রকাশ। কেউ ছুটে এলো, সুটকেস গুছিয়ে এয়ারপোর্টে পৌঁছে দিল। কোন
সহযোগিতা লাগবে কিনা, টাকা পয়সা হাতে আছে কিনা। এয়ারপের্টে যেয়ে দেখি কাজ
ছুটি নিয়ে আমার আগেই ওরা সমবেদনা জানাতে ওখানে। আমি কিভাবে ওদের কাছে
কৃতজ্ঞতা জানাবো, কার নাম বলবো? চেনা-অচেনা শত শত জনের নাম বলতে হবে।
বাংলাদেশে যাওয়ার পরও প্রতিদিন ফোনে যোগাযোগ। জানিনা, চিনিনা এমন অনেকেই
তাদের সমবেদনা জানিয়েছেন। এই হচ্ছে আমার প্রবাসী বন্ধুরা, আমার প্রিয়জনেরা।
স্বজন ছেড়ে এই প্রবাসে আমরা দীর্ঘদীন।
রক্তের সম্পর্কহীন প্রবাসীদের সাথেই তো সখ্যতা। আপদে-বিপদে তারাই পাশে
দাড়ায়।সম্পূর্ন অপরিচিতরাই হয়ে ওঠে প্রিয়জন। এই সম্পর্ককে কোন অভিধায়ে
সিক্ত করা যায় তা চিরকালই অজানা।
টানা জার্নি শেষে মায়ের কবরের সামনে !!
মাটি স্পর্শ করতেই ভেতরটা ডুকরে উঠলো। আর কখনই দেখা হবেনা, তাঁর গলায় 'বাবা'
ডাকটি শোনা যাবেনা। ফোন করলেই "আর কতদিন থাকবি, চলে আয় বাবা" শোনানোর কেউ
রইলোনা। যখন ছিলেন তখন বুঝতে পারিনি, মা। মা থাকাটা যে কতটা থাকা, কতটা
পরিপূর্ন, ভরপুর করে রাখে সন্তানদের। প্রযুক্তি এখন হাতের মুঠোয়, আঙ্গুলের
স্পর্শে দেখা যায়, কথা বলা যায়। অথচ আজ নয় আরেকদিন করে কতদিন, কতমাস ফোন করা
হয়নি। আফসোস আজ আমার সময় আছে, মায়ের সময় নেই।
কবর থেকে ঘড়ে ফিরেছি, পরিবারের সবচেয়ে বড় মুরুব্বি চলে গেলেন, কান্না,
আহাজারী। তারমধ্যেই জানা গেল গুলশানে সন্ত্রাশী হাঙ্গামা শুরু হয়েছে।
পারিবারিক শোক ছাপিয়ে এখন রাষ্ট্রীয় শোক। সকাল হতে হতেই জানা গেল
উগ্রবাদীদের হাতে নিহত হয়েছেন ১৭ জন বিদেশী সহ সর্বমোট ২০ জন, তন্মধ্যে ৭
জন জাপানীও ৷ গূরুতর আহত ১ জন জাপানী।
চোখের সামনে আমার ২৫ বছরের জাপান প্রবাসী জীবনের জাপানীদের চেহারা মনে পড়লো,
বিশেষ করে আমার অফিস বন্ধুদের, যারা কাজ ছেড়ে দাড়িয়ে আমাকে মাতৃবিয়োগে শোক
জানিয়েছিলেন গতকাল।
পড়দিনই ভাইবারে সহকর্মী জাপানী ওৎসুকা সানের ম্যাসেজ "হক সান, দাইজবু দেসকা
(হক সাহেব ঠিক আছতো) ? সিনসেকি ওয়া দাইজবু দেসকা (আত্মিয়-স্বজন সবাই ঠিকঠাক
আছেতো) ? কিওৎসুকেতে নে (সাবধানে থেক কিন্তু)" ৷ এই হচ্ছে জাপানী স্টাইল।জাপানীদের
এত বড় ক্ষতি সাধন হওয়া সত্বেও, আমার প্রতি এবং আমার পরিবার পরিজনের প্রতি
ধিক্কার এর পরিবর্তে চিন্তায় ব্যাকুল ৷
দু' সপ্তাহ পর জাপান ফিরছি। ঢাকা - কুয়ালালামপুর, মালোয়েশিয়ান এয়ারলাইন্সে
কোন জাপানী যাত্রী পেলামনা। আতংকিত বিদেশীরা হয়তো ইতিমধ্যেই ঢাকা ছেড়েছেন।
কুয়ালালামপুর - নারিতার ফ্লাইটটা ছিল জাপান এয়ারলাইন্সের।লজ্জাবোধ দাপিয়ে
উঠলো, প্লেনে নব্বুই ভাগ জাপানী। জাপানী কায়দায় মাথা নীচু করে বাংলাদেশী
পাসপোর্টটি এগিয়ে দিলাম। জাপানী ডেস্ক এটেন্ডেন্ট হাঁসিমুখে তাকালেন, আমার
মনে হলো উনি বুঝি দু' সপ্তাহ আগে নিহত ৭ জন জাপানীর হত্যাকারী দেশের একজনকে
দেখলেন। অপ্রয়োজনীয়, তবুও বললাম 'কোনো আইদা নো কতদে মৌশিওয়াকে আরিমাছেন (কিছু
দিন পূর্বের ঘটনার জন্য লজ্জিত এবং অত্যন্ত দূঃখিত) ৷ রোবোটিক হাঁসি দিয়ে
তিনি এয়ারক্রাপ্টে ঢুকবার অনুমতি দিলেন। নারিতা এয়ারপোর্টের ইমিগ্রশনেও একই
অবস্থা। ৩০ তারিখ রাতে জাপান ছেড়েছি, ১ তারিখ এই হত্যাযজ্ঞ.. যেন আমি যেয়ে
ঘটনা ঘটিয়ে ফিরছি। জাপানীদের মুখ থেকে আমার দূঃখ প্রকাশের একই উত্তর.....
না না, দুঃখ প্রকাশের কিছু নেই, সারা বিশ্বে এরকম ঘটছে....।পরদিন অফিস
যেয়েও একই জবাব। হ্যাঁ, এটাই হচ্ছে জাপানী সদাচার, সৌজন্যবোধ। মনে হলো
জীবনের ২৫ বছর ভুল দেশে ঠিকানা গড়িনি।
দীর্ঘদিন প্রবাসে অবস্থান ও অভিজ্ঞতা থেকে সকল প্রবাসীদের একটা 'টিপস' দিতে
চাই। প্রবাসীরা বিদেশে বসেই প্রিয়জনদের মৃত্যু সংবাদ পান, নানান
প্রতিকুলতায় শেষ সময় প্রিয়জনের কাছে যাওয়া হয়না। যদি সম্ভব হয় আর্থিক ক্ষতি
হলেও একটা ওয়ান ওয়ে ওপেন টিকেট কিনে রাখুন। শেষ সময়ে বিমানবন্দরে যেয়ে অন্য
যাত্রীকে অনুরোধ করেও দেশে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। প্রবাসী প্রিয়জনরা,কখন কে
চলে যাবে আমরা কেউ জানিনা তাই প্রিয়জনের সাথে ,বাবা-মায়ের সাথে নিয়মিত
যোগাযোগ রাখুন।
kaziensan@gmail.com
|