|
আমার পাখি উড়াল দিয়া চইল্যা যায়
লুৎফর রহমান রিটন
জসিম মল্লিক একজন কথাশিল্পী। ২০০৩ থেকে কানাডায় স্থায়ীভাবে বসবাস করছেন
সপরিবারে। গল্প-উপন্যাস ছাড়াও আত্মজীবনী এবং রিপোর্টাজধর্মী টুকরো টুকরো
স্মৃতিগদ্যও লেখেন জসিম। ফেসবুকে এবং প্রবাস থেকে প্রকাশিত বিভিন্ন
সাপ্তাহিক পত্রিকা এবং স্মরণিকায় সেইসব লেখা নিয়মিত প্রকাশিত হয়। সেই
লেখাগুলো নিয়ে নক্ষত্রের আগুন ভরা রাতে, পৃথিবীর মানুষের ভিড়, এবং
এইভাবে বেঁচে থাকো এইভাবে নামে এ পর্যন্ত তিনটি স্মৃতিগদ্য সঙ্কলন
প্রকাশিত হয়েছে জসিমের। প্রকাশিত তিনটি সঙ্কলনকে একত্রে দুই মলাটে
অখণ্ড সংস্করণে রূপ দিতে মনস্থির করেছেন জসিম। নাম রেখেছেন 'এখানে
প্রাণের স্রোত'। এবং জসিম মল্লিকের আন্তরিক দাবি—বইটির একটি ভূমিকা লিখে
দিতে হবে আমাকে। জসিম মল্লিক আমার কাছের মানুষ। আপনজন। জসিমের ইচ্ছেটাকে
অগ্রাহ্য করার বা তাঁকে ফেরানোর কোনো পথ খোলা নেই আমার সামনে। সুতরাং
ভূমিকার নামে আমার অল্প স্বল্প গল্প, জসিমকে নিয়ে।
সত্তরের শেষান্তে এবং আশির সূচনায় পত্রিকার চিঠিপত্র বিভাগে নিয়মিত
লেখালেখি করে কয়েকজন তরুণ ব্যাপক পরিচিতি অর্জন করেছিলেন। তাঁদেরই একজন
হিশেবে জসিম মল্লিককে শনাক্ত করা গিয়েছিলো। জসিম লিখতেন বরিশাল থেকে।
এলাকার ছোটখাটো সমস্যা নিয়ে কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণ মূলক চিঠিগুলো
অধিকাংশ সময়ই পড়া হতো না, কিন্তু শিরোনাম আর পত্রলেখকের নামগুলো এক নজর
দেখে নিতাম। জসিম তখনকার বিখ্যাত পত্রিকা বিচিত্রায় 'ব্যক্তিগত
বিজ্ঞাপন' বিভাগে নিয়মিত বিজ্ঞাপনদাতা হিশেবেও সুপরিচিত। পরবর্তীতে,
সাপ্তাহিক বিচিত্রা কার্যালয়ে জসিম মল্লিক নামের যুবকটির সঙ্গে একদিন
দেখা হলো। বরাবরই আমি ছটফটে স্বভাবের চটপটে ধরণের মানুষ। পরিচয়ের সময়ই
লক্ষ্য করলাম, বরিশাল থেকে আগত জসীম নামের যুবকটি আমার ঠিক উলটো
স্বভাবের। তাঁর চেহারা পোশাক আর আচরণে এক ধরণের মফস্বল মফস্বল গন্ধ
বিরাজমান। ঠিক গন্ধ না বলে এটাকে মফস্বলী সৌরভও বলা চলে। শহুরে
ওপরচালাকির জায়গায় ওর মধ্যে একধরণের সারল্য প্রবলভাবে প্রস্ফুটিত।
কণ্ঠস্বরে আলাদা সতর্কতা। কথাবার্তায় এতোটাই নিম্নকণ্ঠ যে মনে হয় কথাটা
তৃতীয় কেউ শুনে ফেললে মহা কেলেংকারী হয়ে যাবে! আমার সঙ্গে কথা বললেন এক
ধরণের ভীতি নিয়ে। যেনো বা ঢাকা শহরটা আমার পৈত্রিক সম্পত্তি। ওখানে
বসবাসের জন্যে এসে মহা অপরাধ করে ফেলেছেন তিনি! আমি কৈফিয়ত তলব করলে
চোখ মুছতে মুছতে এক্ষুণি বরিশালের লঞ্চে উঠবেন। ওঁর ভয়-ভীতি-শঙ্কা এবং
দ্বিধাসমূহকে দূর করতে সচেষ্ট হলাম। এবং লক্ষ্য করলাম বেশ সাফল্যের
সঙ্গেই ব্যর্থ হচ্ছি। মুখচোরা জসিম মল্লিক আমাকে সহজে আস্থায় নিচ্ছেন
না। তরুণ বয়েসেই আমার খ্যাতি কিংবা আমার বেপরোয়া স্বভাবের কারণে আমাকে
হয়তো বা দুর্বিনীত ভেবেছিলেন জসিম। ওর ভাবনার পুরোটাই অমূলক ছিলো না।
কিন্তু সমবয়েসী কিংবা অনুজপ্রতীমতরুণদের সঙ্গে আমার মিশবার ক্ষমতা
সম্পর্কে ওর জানা থাকার কথা নয়। সুতরাং আমি হতাশ হইনি। জানতাম একদিন
জসিমের ভুল ভাঙবেই।
বরিশালের চিরচেনাজানা বান্ধবপূর্ণ পরিবেশ থেকে ছিটকে এসে রাজধানী ঢাকার
বান্ধবহীন পরিবেশে নিজেকে খাপখাওয়াতে কিছুটা সময়তো লাগবেই। জসিমেরও
লেগেছিলো। এক পর্যায়ে সাপ্তাহিক বিচিত্রায় চাকরিও জুটে গেলো তাঁর।
বিচিত্রার বিভাগীয় সম্পাদক সুদর্শনা কবি শামীম আজাদের স্নেহ-ভালোবাসা
মমতা আর প্রশ্রয়ে মফস্বলী যুবক জসিম মল্লিক শহুরে কেতাদুরস্ত হওয়ার
ট্রেনিং পেতে থাকলেন। এবং লক্ষ্য করলাম ধীরে ধীরে ওর মধ্যেকার মফস্বলী
গন্ধটা নিষ্ঠুর ঢাকার সিসাযুক্ত বাতাসে কী রকম মিলিয়ে যাচ্ছে। ওর
জামাকাপড়ে যুক্ত হতে থাকলো চলতি হাওয়ার নকশা। ফ্যাশনেবল পুলওভার কিংবা
জ্যাকেটে ঢাকা পড়ে গেলো ওর মফস্বলী চেহারাটা। কিন্তু দুটো বিষয় ওর
পরিবর্তিত হলো না। এক--ওর সারল্যভরা হাসি আর দুই—স্বল্পভাষী ওর অনুচ্চ
কণ্ঠ।
লেখক হবার স্বপ্ন বুকে ধারণ করে রাজধানী ঢাকায় মাইগ্রেট করা যুবক জসিম
মল্লিক ঢাকাই প্রতিকূলতাসমূহকে খুব সহজেই পরাভূত করে ফেলেন তাঁর অমায়িক
দক্ষতার কল্যাণে। জীবন সংগ্রামে লড়াইরত জসিমকে বাঁচিয়ে রাখে তার লেখক
হবার স্বপ্ন-বিভোরতা।
এক পর্যায়ে মুখচোরা-লাজুক-অন্তর্মূখী জসিম কেমন কেমন করে একটা বান্ধবীও
জুটিয়ে ফেললেন!আশির দশকের শুরুর দিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা
বিভাগের ছাত্র হবার সুবাদে কলা ভবন চষে বেড়াই আমি। হাকিম চত্বর,
লাইব্রেরীর বারান্দা, পিলার এবং সিঁড়ির কোণায়, টিএসসির মাঠ কিংবা
ক্যাফেটেরিয়ার কোণাকাঞ্চিতে জসিমকে আবিস্কার করি ঝকঝকে এক তরুণীর সঙ্গে।
আমাকে এড়াতেই কী না জানি না ওরা জায়গা বদল করে নিয়মিত। কিন্তু নিয়তির
নিষ্ঠুর পরিহাস, ওরা যেখানেই ঘাপটি মেরে বসে আমি কেমন কেমন করে সেখানেই
গিয়ে হাজির হই! আমাকে দেখলেই দূর থেকে হাসতে থাকে জসিমের বান্ধবী,
সুন্দরী মেয়েটা। ওদের অতিক্রম করে যাবার সময় আমি কোনো একটা ডায়ালগ
ডেলিভারি দিই। আমার কথায় হেসে গুঁড়ো গুঁড়ো হয় মেয়েটা। আর বোকার মতো
হাসতে থাকা জসিমের চেহারায় ফুটে ওঠে আবীর মাখা হাসি। পরে জেনেছি
স্নিগ্ধসুন্দর হাস্যোজ্জ্বল ওই মেয়েটাই জসিমের সঙ্গে একটা জীবন কাটিয়ে
দেবার অঙ্গীকারে বিবাহের বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছে। জেসমিন নামের
হাস্যোজ্জ্বল লাভিং এন্ড কেয়ারিং একজনকে জীবনসঙ্গী হিশেবে পাওয়া
ভাগ্যের ব্যাপার। জসিম ভাগ্যবান। লেখক জসিমকে মমতা আর ভালোবাসার ছায়া
দিয়ে আগলে রেখেছে মেয়েটা। জেসমিন অর্থাৎ বেলী ফুলের সুবাসে সুরভিত
জসিমের জীবনটা।
আমাকে বরাবরই সমঝে চলে জসিম। ২০০১ সালের মাঝামাঝি সময়ে আমার প্রবাস
জীবন শুরুর আগে আগে, এক দুপুরে আমি (ইস্কাটনে সাপ্তাহিক ২০০০ কার্যালয়ে)
বিচিত্রাবাহিনির সঙ্গে আড্ডা দিতে গেলাম। আর কিছুদিন পরেই আমি টোকিও
পাড়ি দেবো। ওখানকার বাংলাদেশ দূতাবাসে ফার্স্ট সেক্রেটারি(প্রেস) পদে
যোগ দিতে। জসিম বসেছিলেন ওর টেবিলে। হঠাৎ আমাকে অবাক করে দিয়ে জসিম
জিজ্ঞেস করলেন--আমার সঙ্গে লাঞ্চ করবেন রিটন ভাই? আমাদের এখানে একটা
ছোট্ট ক্যান্টিন আছে। ওখানে আমি দুপুরে ভাত খাই। খাবেন আমার সঙ্গে?(এর
আগে জসিমের সঙ্গে আমার খাওয়া হয়নি কোনো দিন কোনো উপলক্ষ্যে।) জসিমকে
অবাক করে দিয়ে আমিও সঙ্গে সঙ্গেই রাজি হয়ে গেলাম। কী যে খুশি হলেন জসিম!
জসিম ভেবেছিলেন আমি তাঁর আমন্ত্রণ হয়তো গ্রহণ করবো না। ওকে অবাক করে
দিতেই আমি রাজি হয়ে গেলাম। জসিমের সঙ্গে ২০০০-এর সিঁড়ির তলায় ছোট্ট একটি
কক্ষে ইলিশ-বেগুন-আলুর ঝোলসমৃদ্ধ ঘরোয়া রান্নার অপূর্ব স্বাদের সেই
লাঞ্চের স্মৃতি আজও আমাকে উদাস করে।
এরপর আমি টোকিও চলে গেলাম চাকরিসূত্রে। কিছুকাল পর বিএনপি-জামাত
চারদলীয় জোটের ধাওয়া খেয়ে টোকিও-নিউইয়র্ক দৌড়াদৌড়ির এক পর্যায়ে কানাডার
অটোয়ায় এসে থিতু হলাম। কয়েক বছর পর কেমন কেমন করে জসিমও চলে এলেন
কানাডায়, সপরিবারে, এবং অটোয়াতেই। অতঃপর আমরা কানাডায় একই শহরে মিলেমিশে
বসবাস করিতে লাগিলাম!
ইতোমধ্যে পত্রলেখক এবং ব্যক্তিগত বিজ্ঞাপনদাতা পরিচয়ের নাগপাশ থেকে
বেরিয়ে কথাশিল্পী হিশেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করার সংগ্রামে জয়ী হয়েছেন
জসীম মল্লিক। প্রতিবছর বইমেলায় জসীমের বই প্রকাশিত হয়। আর আমি আবেগে
টইটুম্বুর জসীম মল্লিকের আহাউহু দেখি। আমার খুব ভালো লাগে জসীমের এই
চেহারাটা। আমার সঙ্গে আলাপচারিতায় জসীম নিজেই আমাকে জানান যে ওর প্রচুর
পাঠক আছে যারা ওর বই নিয়মিত কেনে। প্রচুর মেয়ে ওর লেখার ভক্ত। জসিমের
কাছেই জানতে পারি, ওর নারীভক্তরা ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে পৃথিবীর নানান দেশে।
যে দেশেই যান জসীম, একাধিক নারীভক্তের সঙ্গে ওর যোগাযোগ হয়, দেখা হয়।
নারীভক্তদের ব্যাপারে জসীমের কোনো লুকোছাপা নেই এবং এটা ওর অর্ধাঙ্গিনী
জেসমিন কর্তৃকও নাকি অনুমোদিত!
২০০৩-এ অটোয়ায় জসিমের সঙ্গে আমার প্রথম দেখা হবার দিনটি ছিলো
রৌদ্রকরোজ্জ্বল। টেলিফোনে কথা বলে জানলাম জসিম ওর আত্মীয়ের যে বাড়িতে
এসে উঠেছেন সেই বাড়িটা আমার বাসা থেকে মাত্র দুই ব্লক দূরে। আমার ছুটির
দিন বিধায় সকালেই জসিমকে স্বাগত জানাতে ছুটে গেলাম। ওকে বাড়ি থেকে বের
করে সাইড ওয়াক দিয়ে হাঁটছি। সরল হাসিতে উদ্ভাসিত জসিম আমার কাছে বিবরণ
পেশ করতে থাকলেন পৃথিবীর কোন দেশে তাঁর কোন নারীভক্ত তাঁকে কী কী বলেছে।
মজা পেয়ে আমিও বললাম, আরে এই কানাডায়, এই অটোয়াতেও তো মিয়া আপনার
নারীভক্ত আছে! এক ভদ্রমহিলাকে চিনি যিনি আপনার মহাভক্ত।
আমার কথা শুনে চিকচিক করে ওঠে জসিমের দুই চোখ--তাই নাকি রিটন ভাই!
বললাম, হ্যাঁ। এই তো কাছেই থাকেন তিনি। আপনি চাইলে নিয়ে যেতে পারি আমি
আপনাকে, সেই মহিলার বাড়িতে। যাবেন?
--চলেন ভাই! এখনই নিয়ে যাবেন না পরে?
--আপনি চাইলে এখনই যেতে পারি কারণ ওই মহিলা ওই যে সামনের বিশাল
এপার্টম্যান্টেই থাকেন। চলেন যাই তাহলে।
জসিমের মাথায় কেশের বিস্তার খুবই স্বল্প। সেই স্বল্পকেশেই ব্যাক পকেট
থেকে ক্ষুদ্র একটা চিরুনি বের করে কেশবিন্যাশে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন জসিম।
আমি সেই এপার্টমেন্টের মূল ফটকের প্রাথমিক দরোজা ঠেলে জসিমকে নিয়ে
প্রবেশ করলাম। দ্বিতীয় দরোজা অর্থাৎ মূল দরোজা খুলতে ওখানে স্থাপিত
টেলিফোন বক্সে নির্দিষ্ট নাম্বারে ডায়াল করলাম। একটি নারীকণ্ঠ হ্যাঁলো
বলতেই পরিচয় দিলাম--ভাবী আমি নদীর বাবা। দরোজাটা একটু খুলে দেবেন প্লিজ!
খুলছি ভাই--বলতে না বলতেই ক্র্যাক শব্দযোগে শক্তপোক্ত কাচের দরোজাটি
স্বয়ংক্রিয়ভাবে খুলে গেলো। এলিভেটরে ঢুকে আমি আপার্টমেন্ট ৯বাটনে পুষ
করলাম। জসিম আরেকপ্রস্থ কেশবিন্যাস সেরে নিলেন। কারণ একটু পরেই তার
সঙ্গে দেখা হবে অদেখা নারীভক্তের। জসিম বেশ এক্সাইটেড। এতোটাই
এক্সাইটেড যে আমি পকেট থেকে দ্রুত গতিতে চাবির রিঙ বের করে দরোজাটা
খুললাম সেটা খেয়ালই করলেন না। আমার পেছনে পেছনে অতি সন্তর্পণে ঘরে
প্রবেশ করলেন তিনি। তারপর জুতো-টুতো খুলে আমার পেছন পেছন সোফায় এসে
বসলেন। একটু টয়লেট থেকে আসি আপনি বসুন বলে আমি উঠে গেলাম। জসিম সোফায়
বসে ডানে বাঁয়ে চোখ ঘোরাচ্ছেন আর অপেক্ষা করছেন অদেখা সুন্দরী ভক্তের।
আমি আড়াল থেকে ওকে দেখি। এক পর্যায়ে ওর চোখ পড়ে দেয়ালে ঝোলানো আমাদের
পারিবারিক ছবির ফ্রেমের ওপর এবং চোখ পড়তেই বিস্মিত নেত্রে ইতিউতি তাকাতে
থাকেন জসিম। আমিও ওই সময়েই হাজির জসিমের সামনে। খানিকটা লজ্জা পেয়ে
ভুবন ভোলানো সারল্যে বোকার মতো হাসতে থাকেন জসিম--ধুরৃটন ভাই এইটা একটা
কাম করলেন! আপ্নে পারেনও! বিশ্বাস করেন ভাবী আর নদীর সঙ্গে আপনার ছবিটা
না দেখলে আমি বুঝতেই পারতাম না যে আপ্নে আমারে নিয়া খেলতাসেন! হাহ্
হাহ্ হাহ্।
সাপ্তাহিক ২০০০-এর ঈদ সংখ্যায় বড়দের উপযোগী একটা উপন্যাস লিখলাম। কাহিনি
মন্ত্রীকে নিয়ে। মন্ত্রীর এপিএস মোখলেস। উপন্যাসটা পড়ে গদগদ কণ্ঠে জসিম
আমাকে বলেছিলেন--রিটন ভাই আমি মোখলেস বলছি। আপনার এই চরিত্রটা দারুণ!
মিলে যায় জীবনের সঙ্গে।
আমি বুঝতে পারি জসিম কী ভাবে ওই চরিত্রের সঙ্গে নিজেকে মেলালেন। ঢাকার
একজন ধনকুবের শিল্পপতি এবং পরবর্তীতে এম্পির জনসংযোগ কর্মকর্তার
দায়িত্ব পালন করেছেন জসিম দীর্ঘদিন। সুতরাং জসিমতো একটি মোখলেসই!
আমেরিকায় মুক্তধারার বইমেলা হয়। জসিম সেখানে চলে যান আর আমাকে জানান
উৎফুল্ল কণ্ঠে--জানেন রিটন ভাই আমার কুড়িটা বই বিক্রি হয়েছে!
একুশের বইমেলার সময় প্রতিবছর অটোয়া থেকে উড়ে যাই আমি ঢাকায়। বাংলা
একাডেমি প্রাঙ্গণ থেকে সরাসরি সম্প্রচারিত 'বইমেলা প্রতিদিন' অনুষ্ঠানটি
উপস্থাপনা করি। অনুষ্ঠানে প্রবীন লেখক নবীন লেখক পাঠক প্রকাশক শিল্পী
এবং বরেণ্য সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বদের সাক্ষাৎকার নিই। জসিমও ওই সময়টায়
চলে যান বাংলাদেশে। প্রতিবছর ফেব্রুয়ারি মাসে একাধিকবার আমি জসিমের
সাক্ষাৎকার নিই। এক বিকেলে সদ্য প্রকাশিত নতুন বই নিয়ে হাজির হলন জসিম
অনুষ্ঠান শুরু হবার খানিকক্ষণ পরে। অনুষ্ঠান চলছে। আমি খেয়াল করলাম
ত্রস্ত এবং লাজুক পায়ে জসিম এসে দাঁড়িয়েছেন অপেক্ষমাণ লেখকদের সঙ্গে।
কিছুক্ষণের মধ্যেই আমি মাইক্রোফোন হাতে তাঁর কাছে চলে গেলাম। অনুষ্ঠান
সরাসরি সম্প্রচারিত হচ্ছে। অন ক্যামেরা আমি দর্শকদের উদ্দেশে
বললাম--এখন আমি যাঁর সঙ্গে কথা বলবো তিনি কথাশিল্পী জসিম মল্লিক। থাকেন
কানাডায়। জসিম বললেন--রিটন ভাই এয়ারপোর্ট থেকে সরাসরি চলে এসেছি
বইমেলায়, এই অনুষ্ঠানে। আমি বললাম--বাহ্ বাংলাদেশ থেকে বারো হাজার
তিনশ কিলোমিটার দূরের দেশ কানাডা থেকে বইমেলার টানে বাংলা একাডেমি
প্রাঙ্গণে চলে এসেছেন! জসিম বললেন--কানাডায় বসে আমি আর আমার স্ত্রী ভোর
বেলায় এই অনুষ্ঠানটা দেখেছি গত কয়েকদিন। আজকে আমি এই অনুষ্ঠানে চলে
থাকবো এটা আমার স্ত্রী জানে এবং টরন্টো শহরে এই ভোর রাতে সে টিভির সামনে
বসে আছে! আমি টিভি পর্দায় জসিমের স্ত্রীকে স্বাগত জানালাম। জসিমকে
বললাম--আপনি টিভিস্ক্রিণে আপনার স্ত্রীকে কিছু বলুন। লজ্জায় রাঙা হয়ে
জসিম তাঁর স্ত্রীকে নিরাপদে বাংলাদেশে পৌঁছানোর খবরটি দিলেন এবং
স্ত্রীকে শুভেচ্ছা জানালেন। অনুষ্ঠানের পর জসিম আমাকে বললেন--রিটন ভাই
আপনি পারেনও! কী যে লজ্জায় ফেলে দিলেন! জীবনেও ভাবিনি আপনি এরকম
অভাবনীয় একটা কাণ্ড করবেন। অবশ্য আপনাকে দিয়েই এরকম ঘটনা ঘটানো সম্ভব।
কানাডায় বইমেলা হয়। একই রকম উৎফুল্ল জসিম--রিটন ভাই আমার চল্লিশটা বই
বিক্রি হইছে একদিনে!
তারপর ফেসবুকে ছবি আপলোড করেন জসিম। বইয়ের ক্রেতার সঙ্গে লেখক দাঁড়িয়ে
আছেন হাসিমুখে। এবং ক্রেতা অতি অবশ্যই একজন নারী! লেখক জসিমের সারল্যভরা
এই বোকাবোকা ছেলেমানুষী আমাকে আনন্দিত করে।
ধান ভানতে শিবের গীত গাইছি। লেখার কথা জসিম মল্লিকের প্রকাশিতব্য বই 'এখানে
প্রাণের স্রোত'--এর ভূমিকা আর আমি লিখছি জসিমের সাতকাহন!
জসিম আমাকে পুরো বইয়ের পান্ডুলিপিই পাঠিয়েছে। অধিকাংশ রচনাই আমার পড়া
ছিলো। কিছু বাকি ছিলো সেগুলো পড়া হলো। এরকম স্মৃতিগদ্যের বই আমার খুবই
পছন্দের। আমি নিজেও বিস্তর লিখেছি স্মৃতিগদ্য। সুতরাং জসিমের বইটাও
আমার পছন্দ হয়েছে। স্মৃতি যেহেতু একটি যৌথ ব্যাপার, স্মৃতিকথায় নিজের
কথা বলতে শুরু করলেও সেখানে অন্যেরা চলে আসেন। প্রচুর চেনাজানা এবং
অচেনা মানুষের প্রাণবন্ত উপস্থিতি রয়েছে এই বইতে। বিচিত্রসব মানুষ।
বিচিত্র তাঁদের চরিত্র ও চারিত্র্য। জসিমের গদ্যভঙ্গি সরল ও সাবলিল।
জসিমের চিন্তা-চেতনা ও স্বীকারোক্তিসমূহ রাখঢাকহীন এবং সত্যাশ্রয়ী।
কাল্পনিক বা আরোপিত কিছু নয় বরং জীবনের বহমান বাস্তবতাকেই তুলে এনেছেন
জসিম। জসিমের আবেগ ও অনুভূতি পাঠককেও আলোড়িত করবে। কখনো আনন্দিত করবে।
কখনো আর্দ্র করবে। জসিমের বেশকিছু রচনার বিষয় তার মা। যিনি লেখাপড়া না
জানা গ্রামের অতি সরল শাদাসিধে একজন মানুষ। পুত্র তার লেখক এটা তিনি
শুনেছেন। কিন্তু পুত্র কী লেখে সেটা তাঁর জানা নেই। তিনি জিজ্ঞেস
করেন--'তুমি নাকি লেখো? কী লেখো তুমি?' বিদেশে চলে আসার আগে মা জসিমকে
প্রশ্ন করেন--'বিদেশে কেনো যাও?'
একটা অংশ উদ্ধার করি--''মা আর ফিরবেন না! কখনই না! যে যায় সে আর ফেরে
না! এ বছর ২০ মার্চ মায়ের সাথে আমার শেষ দেখা হয়। কখনও চেতন কখনও
অবচেতনে ছিলেন মা তখন। তাতে কী! মাতো আছেন! আসার সময় আমার হাত শক্ত করে
ধরে বলেছিলেন, ’বাবা তোমার সাথে আর আমার দেখা হবে না! আর না! আমি চলে
যাব। সবাই আমার পাশে থাকবে কিন্তু তুমি থাকবা না। দুঃখ করবা না। আমার
দোয়া সবসময় তোমার সঙ্গে থাকবে’। মায়ের এসব কথা মেনে নেয়ার লোক আমি
না। আমি বল্লাম, আপনার সাথে আবার আমার দেখা হবে। আমিতো প্রতিবছর আসি
আপনাকে দেখতে। মা বলেন, ’তুমি ওদেশে কেনো থাকো! কী আছে ওদেশে! নিজের
দেশ ছেড়ে কেউ যায়’! আবার নিজে নিজেই বলেন, ’তোমাকে তো যেতে হবে।
তোমার ছেলেমেয়েরা আছে না! আমার যেমন তোমার জন্য খারাপ লাগে তোমারও
তো ওদের জন্য খারাপ লাগে’! তারপর আমার মাথায় পিঠে হাত বুলিয়ে দিয়ে
মিষ্টি করে বলেন, ’যদি শোনো আমি মারা গেছি তোমাকে আসতে হবে না। তুমি
আমার জন্য দোয়া করো তাহলেই হবে।''
মাকে নিয়ে জসিমের লেখাগুলো আমার হৃদয় ছুঁয়ে গেছে। একবার, কানাডা থেকে
জসিম বরিশালে গেছেন তাঁর মায়ের সান্নিধ্য পেতে। মা তাঁকে জড়িয়ে ধরে
বলেছেন--''তুমি একটা পাখি এই দেখি আছে আবার দেখি নাই। আমার পাখি উড়াল
দিয়া চইল্যা যায়''...
হায়রে প্রবাস জীবন! স্বপ্ন এখানে উড়াল দিয়াই চইল্যা যায়!
WARNING:
Any unauthorized use or reproduction of 'Community' content
is strictly prohibited and constitutes copyright infringement liable to
legal action.
[প্রথমপাতা] |
লেখকের আগের লেখাঃ
|