|
বাংলা সাহিত্যের দিকপাল, পুঁথি সম্রাট মুন্সি আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদের
৬১তম মৃত্যুবার্ষিকীতে শ্রদ্ধাঞ্জলি
@
@
@
নূর মোহাম্মদ নূরু
মেধা, শ্রম, ঐকান্তিকতা, অনুসন্ধান ও আবিষ্কারে যিনি মধ্যযুগের বাংলা
সাহিত্যের অজানা অথচ অপরিহার্য ইতিহাস পুনরুজ্জীবিত করেছিলেন, তিনি মনীষী
মুন্সি আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ। বাঙালি মুসলিম সমাজের আত্মচেতনা বৃদ্ধি,
মাতৃভাষার প্রতি অনুরাগসৃজন, দেশের প্রতি ভালোবাসা বৃদ্ধিতে, আত্মপ্রত্যয় ও
আত্মমর্যাদা জাগানোর ক্ষেত্রে আব্দুল করিম সাহিত্যবিশারদের অবদান
চিরস্মরণীয়। প্রাচীন পুঁথি আবিষ্কার, সংগ্রহ, সংরক্ষণ, সম্পাদনা ও গবেষণায়
অসাধারণ নিষ্ঠা, দক্ষতা ও প্রজ্ঞার পরিচয় প্রদান করেন তিনি। তাঁর সংগৃহীত
পুঁথির সংখ্যা প্রায় দুই হাজার। eইসলামাবাদf ও eআরাকান রাজ সভায় বাঙ্গালা
সাহিত্যf তাঁর দুইখানি মৌলিক গদ্যগ্রন্থ। তাঁর সংগৃহীত বিপুল পুঁথি সম্পদের
মুসলিম পুঁথিগুলো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে এবং হিন্দু পুঁথিগুলো রাজশাহী
বরেন্দ্র রিসার্চ মিউজিয়ামে দান করে গেছেন। আজ ৩০ সেপ্টেম্বর মহান মনীষী
মুন্সি আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদের ৬১তম মৃত্যু বার্ষিকী। ১৯৫৩-সালের ৩০
সেপ্টেম্বর মৃত্যুবরণ করেন। মৃত্যুদিনে তাঁর প্রতি আমাদের গভীর শ্রদ্ধা।
সাহিত্য বিশারদ মুন্সি আবদুল করিম ১৮৬৯, মতান্তরে ১৮৭১ সালের ১১ অক্টোবর
পটিয়া মহকুমার সুচক্রদন্ডী গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা মুনশী
নুরউদ্দীন। তার মাতা মিস্রীজান প্রখ্যাত পাঠান তরফদার দৌলত হামজা বংশের মেয়ে
ছিলেন। জন্মের কয়েক মাস আগে পিতার মৃত্যু এবং ১৭ বছর বয়সে মাতৃহীন আবদুল
করিম দাদা-দাদি ও চাচা-চাচির স্নেহছায়ায় এন্ট্রান্স পাস করেন এবং সচেষ্টায়
বাংলা, সংস্কৃত, আরবি ও ফারসি ভাষায় ব্যুৎপত্তি লাভ করেন। তার পড়াশোনা শুরু
হয়েছিল বাড়ির দহলিজেই। সেখানেই তিনি আরবি-ফারসি ও বাংলায় পড়া শুরু করেন।
অতঃপর তিনি সুচক্রদণ্ডী মধ্যবঙ্গ বিদ্যালয়ে ভর্তি হন। এক বছর পড়াশোনা করে
তিনি পটিয়া উচ্চ ইংরেজি বিদ্যালয়ে ভর্তি হন। সেখান থেকে ১৮৯৩ সালে প্রবেশিকা
পরীক্ষায় দ্বিতীয় বিভাগে উত্তীর্ণ হন। উল্লেখ্য যে, এন্ট্রান্স পরীক্ষায়
তার দ্বিতীয় ভাষা ছিল সংস্কৃত এবং সঙ্গত কারণেই উনিশ শতকে এন্ট্রান্স পাস
করতে ইংরেজি ভাষাজ্ঞানেও পারদর্শী হতে হতো। চট্টগ্রাম কলেজে দুfবছর এফএ
পড়ার পর ১৮৯৭ সালের ভয়াবহ প্রাকৃতিক দুর্যোগে চট্টগ্রাম অঞ্চলের অনেক
সম্পন্ন পরিবারের মতো তাদের পরিবারেও অর্থনৈতিক অসচ্ছলতা অনিবার্য করে তোলে।
এর সঙ্গে যোগ হয় শারীরিক অসুস্থতা। পরীক্ষার আগে তিনি টাইফয়েড এ আক্রান্ত
হন। ফলে তার আর এফএ পরীক্ষা দেয়া হয়নি। এখানেই তার উচ্চ শিক্ষার সমাপ্তি ঘটে।
আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ বাল্যকাল থেকেই পুঁথিপত্রের প্রতি খুবই আগ্রহী
ছিলেন। সারা জীবন তার নেশা ছিল দৈনিক-সাপ্তাহিক-পাক্ষিক-মাসিক ইত্যাদি পত্রিকা
পাঠ করা এবং সংগ্রহ করা। তিনি তাঁর বাড়িতে তাঁর পিতামহ কর্তৃক সংগৃহীত কিছু
পুঁথির সঙ্গে পরিচিত হন। এই পুঁথিগুলো পড়ে তিনি পুঁথি সংগ্রহে ও এ নিয়ে
লিখতে আগ্রহী হন। এ পুঁথিগুলোর মধ্যেই পেয়ে যান eচণ্ডীদাসের পদাবলীf। সেসময়
তিনি ছিলেন এফএ ক্লাসের ছাত্র। এ সময় তিনি আচার্য অক্ষয় সরকার সম্পাদিত
eপূর্ণিমাf পত্রিকায় eপ্রাচীন পদাবলীf নামে একটি প্রবন্ধ লেখেন। এই প্রবন্ধ
পাঠ করেই মহাকবি নবীন চন্দ্রসেন সাহিত্যবিশারদের প্রতি আকৃষ্ট হন। ১৮৯৫ সালে
চট্টগ্রাম মিউনিসিপ্যাল স্কুলের শিক্ষক হিসাবে কর্মজীবনের শুরু করেন।
পরবর্তীকালে তিনি সীতাকুণ্ড মধ্য ইংরেজি স্কুলের অস্থায়ী প্রধান শিক হন।
চট্টগ্রামে প্রথম সাব-জজ আদালতে অ্যাপ্রেন্টিস হিসেবে কাজ করেন। পরে কবি
নবীন সেনের সুপারিশে চট্টগ্রাম কমিশনার অফিসে যোগদান করেন। ১৯৩৪ সালে তিনি
চাকরি থেকে অবসর গ্রহণ করেন।
আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ এমন একজন ব্যক্তি, যিনি আজীবন প্রাচীন ও
মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যের সেবা করে গেছেন। বাঙালি লেখকেরা যখন পাশ্চাত্য
সাহিত্যের প্রভাবে ও অনুরাগে আধুনিক বাংলা সাহিত্য সৃষ্টিতে নিজেদেরকে
নিয়োজিত করেছেন, আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ তখন প্রাচীন ও মধ্যযুগের পুঁথি
সংগ্রহ, পুঁথির রণাবেণ এবং পুঁথি সম্পাদনায় নিজেকে নিয়োজিত রেখেছেন। মূলত
পুঁথি সংগ্রহ, পুঁথির রণাবেণ ও পুঁথি সম্পাদন ছিল তার জীবনের ব্রত।
বর্ণাঢ্য জীবনে তিনি বাংলা সাহিত্যের প্রধান উপাদান পুঁথি পত্র ও এদেশের
প্রাচীন ও মধ্য যুগের লৌকজ-সাহিত্যের ভাণ্ডারকে সমৃদ্ধ করেছেন। তাঁর
সম্পাদিত নরোত্তম ঠাকুরের eরাধিকার মানভঙ্গf, কবিবল্লভের eসত্যনারায়ণের পুথিঁf,
দ্বিজ রতিদেবের eমৃগলুব্ধf রামরাজার eমৃগলুব্ধ সম্বাদf, দ্বিজ মাধবের eগঙ্গামঙ্গলf,
আলী রাজার eজ্ঞানসাগরf, বাসুদেব ঘোষের eশ্রীগৌরাঙ্গ সন্ন্যাসf, মুক্তারাম
সেনের eসারদামঙ্গলf, শেখ ফয়জুল্লাহর eগোরক্ষবিজয়f ও আলাওলের eপদ্মাবতীf (খণ্ডাংশ)
বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষৎ থেকে প্রকাশিত। eইসলামাবাদf (চট্টগ্রামের সচিত্র
ইতিহাস) ও eআরাকান রাজসভায় বাঙ্গলা সাহিত্যf (মুহম্মদ এনামুল হকের সহযোগে
রচিত) তাঁর দুটি মৌলিক গ্রন্থ।
আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদের মতো নিষ্ঠাবান পুঁথি সংগ্রহকারী বাংলা
সাহিত্যের ইতিহাসে আর একজনও নেই। তিনি ছিলেন মুসলমান, কোন হিন্দুর আঙ্গিনায়
তাঁর প্রবেশাধিকার নাই, কিন্তু হিন্দুর ঘরে পুঁথি আছে শুনে তিনি ভিখারীর মত
তার দ্বারে গিয়া পুঁথি দেখতে চাইতেন। পুঁথি সরস্বতী পূজার দিন পূজিত হয়।
অতএব মুসলমানকে ছুঁতে দেয়া হবে না বলে অনেকে তাঁকে দেখতেও দেন নাই। অনেকে
আবার তাঁর কাকুতি মিনতিতে নরম হয়ে নিজে পুঁথি খুলে পাতা উল্টে দেখিয়েছেন,
মুন্সী সাহেব দ্বারের বাইরে দাঁডিয়ে হস্তস্পর্শ না করে কেবল চোখে দেখে নোট
করে সেই সকল পুঁথির বিবরণ লিখে এনেছেন। এত অধ্যবসায়, এত আগ্রহে, এমন করে
কোন হিন্দু অন্ততঃ তার নিজের ঘরের পুঁথিগুলির বিবরণ লিখতে বা অন্য কোন
কার্যে হাত দিয়েছেন কিনা, জানি না। মুন্সী সাহেবের নিকট বাংলা সাহিত্য
সমাজের কৃতজ্ঞতার পরিমাণ যে কত বেশী, তা এই বিবরণ হতে অনুমান করা যায়।
আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ উনিশ-বিশ শতকের রেনেসাঁর মানসপুত্রদের একজন। তার
সময়ে খাঁটি বাঙালির সংখ্যা কমই ছিল। ইচ্ছায় হোক, অনিচ্ছায় হোক, তাঁর সময়ে
উপমহাদেশের রাজনীতি ও সংস্কৃতি সাম্প্রদায়িক চেতনায় কণ্টকিত হয়েছিল। কিন্তু
আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদকে ওই পঙ্কিল স্রোত কলুষিত করতে পারেনি। আবদুল
করিমের এই নিরলস সাহিত্য-সাধনার স্বীকৃতিস্বরূপ ১৯০৯ সালে চট্টল ধর্মমণ্ডলী
কর্তৃক eসাহিত্য বিশারদf উপাধি এবং ১৯২০ সালে নদীয়ার সাহিত্য সভার কাছ থেকে
eসাহিত্য সাগরf উপাধি লাভ করেন। আব্দুল করিমকে আমরা যথাযথভাবে সম্মান
প্রদর্শন করতে পারিনি। তা সত্ত্বেও চট্টগ্রাম পৌরসভা তার স্মৃতির প্রতি
সম্মান প্রদর্শন করে চট্টগ্রামের লাভ লেইন সড়কটির নাম পরিবর্তন করে আব্দুল
করিম সাহিত্যবিশারদ সড়ক নামকরণ করেছে এবং দেরীতে হলেও সাহিত্যে অসাধারণ
অবদানের জন্য বাংলাদেশ সরকার ১৯৯৫ সালে তাকে মরণোত্তর স্বাধীনতা পদক প্রদান
করেন।
বাংলা সাহিত্যের এই অতুলনীয় সাহিত্যকর্মী ১৯৫৩ খ্রিষ্টাব্দের ৩০ সেপ্টেম্বর
চট্টগ্রামের নিজ বাসভবনে 'চট্টগ্রামের অজানা কাহিনীf লিখতে বসে ১০টা ৪৭
মিনিটে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন। আজ এই মহান সাধকের ৬১তম মৃত্যুবার্ষিকী।
মৃত্যুদিনে তাঁর প্রতি আমাদের গভীর শ্রদ্ধা।
লেখকঃ গণমাধ্যম কর্মী
@
WARNING:
Any unauthorized use
or reproduction of
'Community' content is
strictly prohibited
and constitutes
copyright infringement
liable to legal
action.
[প্রথমপাতা] |
@
লেখকের আগের লেখাঃ
|