|
কবি, গল্পকার, প্রবন্ধকার এবং বাংলা সাহিত্যে চলিতভাষার প্রতিষ্ঠাতা প্রমথ
চৌধুরীর ৬৮তম মৃত্যুবার্ষিকীতে শ্রদ্ধাঞ্জলি
@
@
নূর মোহাম্মদ নূরু
@
আমরা অনেক প্রাতঃস্মরণীয় ব্যক্তিত্বের জন্ম-মৃত্যুকাল স্মরণ রাখি না;
তাঁদেরকে বিশেষ বিশেষ দিনে স্মরণও করি না। বাংলা সাহিত্যে তেমনই একজন
বিস্মৃত প্রায় গুণী ব্যক্তিত্ব চলিত ভাষার প্রবর্তক ও বিদ্রুপাত্মক
প্রাবন্ধিক প্রমথ চৌধুরী। তিনি বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে যে অবদান রেখে গেছেন
তা সত্যিই অতুলনীয়। তিনিবাংলা ভাষা ও সাহিত্যে যে অবদান রেখে গেছেন তা
সত্যিই অতুলনীয়। তাঁরই নেতৃত্বেই বাংলা সাহিত্যে নতুন গদ্যধারা সূচিত হয়।
প্রমথ চৌধুরী ফরাসী ও ইংরেজী ভাষা-সাহিত্যেও সুপণ্ডিত ছিলেন। সমকালীন
পত্র-পত্রিকায় তিনি eবীরবলf ছদ্মনামে সাহিত্য রচনা করতেন। প্রমথ চৌধুরী
রবীন্দ্র যুগে আবির্ভূত হলেও তাঁর সাহিত্য আপন বৈশিষ্ট্যে সমুজ্জ্বল। প্রমথ
চৌধুরী একাধারে কবি, গল্পকার, প্রবন্ধকার এবং বাংলা সাহিত্যে উচ্চাঙ্গের
চলিতভাষার প্রতিষ্ঠাতা। তাঁর সর্বপেক্ষা উল্লেখযোগ্য কীর্তি হলো বাংলা
সাহিত্যে চলিত ভাষার পূর্ণ প্রতিষ্ঠা। তাঁর সম্পাদিত সবুজপত্র বাংলা
সাহিত্যে চলতি ভাষারীতি প্রবর্তনে আগ্রণী ভূমিকা পালন করে। ১৯১৪ সালে তিনি
যখন "সবুজ পত্র" সাহিত্য পত্রটি প্রকাশ করেন তখন থেকেই চলিত ভাষা
সাহিত্যক্ষেত্রে এক বিদ্রোহী এবং আধুনিক মাধ্যম হিসেবে আত্মঘোষণা করে। সেই
কারণেই প্রকৃতপক্ষে আধুনিক বাংলা সাহিত্যের তিনি একজন প্রধান স্থপতি। ১৯৪৬
সালের ২ সেপ্টেম্বর ভারতের শান্তিনিকেতনে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। এই গুণী
ব্যক্তিত্বের ৬৮তম মৃত্যুদিনে আমাদের শ্রদ্ধাঞ্জলি।
প্রমথ চৌধুরী ১৮৬৮ সালের ৭ আগস্ট যশোর জেলায় জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পৈত্রিক
নিবাস ছিল বাংলাদেশের পাবনা জেলার চাটমোহর উপজেলার হরিপুর গ্রামে। পাবনার
বিখ্যাত চৌধুরী বংশের সন্তান প্রমথ চৌধুরী কেবল কুলে-মানে অভিজাত ছিলেন
তা নয়, মনের দিক থেকেও ছিলেন অভিজাত । বাল্যকাল কেটেছে পাবনায়,কৈশোর
কৃষ্ণনগরে, যৌবনে বিলেত আর কলকাতায়, বার্ধক্য কলকাতায় এবং শান্তিনিকেতনে ।
তাঁর শিক্ষাজীবন ছিল অসাধারণ কৃতিত্বপূর্ণ। তিনি ১৮৯০সালে কলকাতা
বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দর্শনে বি.এ. অনার্স এবং ইংরেজি সাহিত্যে এমএ ডিগ্রী
লাভ করেন। উভয় পরীক্ষায় প্রথম শ্রেণিতে প্রথম স্থান অধিকার করেন এবং পরে
ব্যারিস্টারি পড়ার জন্য বিলাত যান। বিলাত থেকে দেশে ফিরে তিনি কিছুদিন
কলকাতা হাইকোর্টে আইন ব্যবসা করেন। এর পর কিছুকাল ইংরেজি সাহিত্যে অধ্যাপনা
করেন এবং পরে সাহিত্যচর্চায় মনোনিবেশ করেন। তাঁর প্রথম প্রবন্ধ "জয়দেব"
প্রকাশিত হয় "সাধনা" (১৮৯৩) পত্রিকায়। ১৮৯০-৯৯ এর মধ্যে তিনি সাধুভাষায়
কয়েকটি গল্প লেখেন।
তাঁর প্রবর্তিত গদ্যরীতিতে gসবুজপত্রh নামে বিখ্যাত সাহিত্যপত্র ইতিহাসে
প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। স্বল্পায়ু সত্বেও সবুজপত্র প্রথম বিশ্বযুদ্ধোত্তর
প্রজন্মের বাংলা ভাষা এবং সাহিত্য রীতি গঠনে একটি প্রধান শক্তি হিসেবে কাজ
করে। এ সাময়িকীতে শুধু সবুজ রং-ই ব্যবহার করা হতো। নন্দনাল বসু অঙ্কিত একটি
সবুজ তালপাতা এর প্রচ্ছদে ব্যবহার করা হতো। সবুজপত্রে কখনো কোনো বিজ্ঞাপন
এবং ছবি প্রকাশিত হয় নি।প্রমথ চৌধুরী সাময়িকীটিকে বাণিজ্যিকভাবে আকর্ষনীয়
রূপ প্রদানের জন্যে কোনো চেষ্টা করেননি। বরং তিনি এর মান এবং আদর্শ সমুন্নত
রাখার প্রতি অত্যন্ত সতর্ক ছিলেন। তাই সবুজপত্র সাধারণ পাঠক ও লেখকদের কাছে
জনপ্রিয় হতে পারেনি। প্রথম পর্যায়ে এটি ১৩২৯ বঙ্গাব্দ(১৯২২ সাল)পর্যন্ত
প্রকাশিত হয়।দ্বিদীয় পর্যায়ে সবুজপত্রের প্রকাশনা শুরু হয় ১৩৩২
বঙ্গাব্দ থেকে।সাময়িকীটি শেষে পর্যন্ত ১৩৩৪ বঙ্গাব্দে (১৯২৭)সালে বন্ধ হয়ে
যায়। এই gসবুজপত্রh কেন্দ্রিক ভাষা ও সাহিত্যাদর্শ আন্দোলনে তিনি
রবীন্দ্রনাথের বলিষ্ঠ সমর্থন পান। রবীন্দ্রনাথের কথ্য ভাষায় লেখা উপন্যাস
gশেষের কবিতাh সবুজপত্রে প্রকাশিত হলে প্রমথ চৌধুরীর এই আন্দোলন ব্যাপক
সফলতা লাভ করে। প্রমথ চৌধুরী বিশ্বভারতী পত্রিকার সম্পাদনাও করেছেন ।
বীরবল ছিলো প্রমথ চৌধুরীর ছদ্মনাম। দিল্লীপতি সম্রাট আকবরের সভাসদ বীরবলের
ছিল প্রখর পরিহাসপ্রবণতা এবং যুক্তিধর্মিতা । যা প্রমথ চৌধুরীকে আকৃষ্ট
করেছিল। ' সাহিত্যে হাস্যরসের বিশেষ প্রয়োজন । এ বিষয়ে তাঁর অভিমত 'করুণরসে
ভারতবর্ষ স্যাঁতসেঁতে হয়ে উঠেছে ।' তাই 'বাংলা সাহিত্যের স্বাস্থ্যরক্ষার
জন্যই হাসির চর্চা প্রয়োজন' । তিনি 'হাসি ও কান্না' সনেটে বলেছেন,
সত্য কথা বলি, আমি ভাল নাহি বাসি,
দিবানিশি যে নয়ন করে ছলছল,
কথায় কথায় যাহে ভরে আসে জল,
আমি খুঁজি চোখে চোখে আনন্দের হাসি।'
সদালাপী মানুষটি সবাইকে আপনার করে নিতে পারতেন । নানা শ্রেণির মানুষের সাথে
অনায়াসে মিশে যেতে পারতেন তিনি। সহাস্য রসিকতা তাঁর চারিত্রিক বৈশিষ্ট । এক
অনুষ্ঠানে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সাথে উপস্থিত ছিলেন তাঁর ভ্রাতুষ্পুত্রী
সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুরের কন্যা ইন্দিরা দেবী । প্রমথ চৌধুরীর বন্ধু সে
অনুষ্ঠানে যেতে অনুরোধ করলেন এবং রসিকতা করে ইন্দিরা দেবীর প্রসঙ্গটি তুলে
ধরলেন । উত্তরে প্রমথ চৌধুরী বলেছিলেন—'পরের বাড়ির খুকি দেখবার লোভ আমার
নেই। ভাগ্যক্রমে ইন্দিরা দেবীই হন তাঁর সহধর্মিনী (১৮৯৯) ।
পিতৃপুরুষের বাসভূমি পাবনা জেলার হরিপুর গ্রামের প্রতি আজীবন আকর্ষণ অনুভব
করেছেন । তিনি 'আত্মকথায়' বলেছেন—'আমি ছেলেবেলায় কৃষ্ণনগরেই বাস করতুম সাড়ে
এগারো মাস ও হরিপুরে পনেরো দিন । কিন্তু হরিপুর আমরা সঙ্গেই এনেছিলুম,
তার মানসিক আবহাওয়াও ।'
'সবুজপত্রের' সম্পাদক প্রমথ চৌধুরী বাংলা সাহিত্যে চলিত ভাষার প্রবর্তক এবং
বাকচাতুর্য সমৃদ্ধ প্রাবন্ধিক। কবিতা রবীন্দ্রানুরাগী হয়েও তিনি ছিলেন
স্বতন্ত্র। তাঁর বাকরীতিতে আছে লঘুপক্ষ, ভারহীন দ্রুতগতি, ভাবালুতাশূণ্য
বুদ্ধির দীপ্তি, বাঙালী জীবনের জড়ত্ব ও স্থবীরতার বিরুদ্ধে তীব্র আঘাত।
তাঁর প্রতিভার চরম প্রকাশ প্রবন্ধ রচনায় । তাঁর ভাষা শাণিত ও দীপ্ত, তাঁর
রচনাশৈলীর প্রধান ধর্ম বাক্চাতুর্য । বিরোধাভাসপূর্ণ বাক্যরচনায় তিনি সিদ্ধ।
অনেকে মনে করেন তাঁর ফরাসি সাহিত্যে অধিকার তাঁর ভাষার এক বিচিত্র
ক্ষিপ্রগতি ও তীক্ষ্ণতার সঞ্চার করেছিল।
প্রমথ চৌধুরী রচিত উল্লেখযোগ্য গ্রন্থাবলির মধ্যে তেল-নুন-লাকড়ি (১৯০৬),
বীরবলের হালখাতা (১৯১৭) , রায়তের কথা (১৯১৯), নানা চর্চা (১৯২৩), চার-ইয়ারী
কথা, আমাদের শিক্ষা, প্রাচীন বঙ্গ সাহিত্যে হিন্দু ও মুসলমান (১৯৫৩),
প্রবন্ধ সংগ্রহ ইত্যাদি গদ্যগ্রন্থ বাংলা সাহিত্যের অমূল্য সম্পদ। চার ইয়ারী
কথা, আহুতি, নীল লোহিত ও গল্প সংগ্রহ তাঁর গল্পগ্রন্থ। বাংলা কবিতা ও ছোট
গল্পের রচয়িতা হিসেবেও তিনি বিখ্যাত। বাংলা কাব্য সাহিত্যে তিনিই ইতালীয়
সনেটের প্রবর্তক। eসনেট পঞ্চাশৎf ও পদ্য রচনা তাঁর কাব্যগ্রন্থ।
প্রমথ চৌধুরী তাঁর কর্ম ও কীর্তির জন্য বেশকিছু পুরস্কার লাভ করেছিলেন। তার
মধ্যে ১৯৩৮ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় হতে eজগত্তারিণী স্বর্ণপদকf অন্যতম।
১৯৪৬ সালের ২ সেপ্টেম্বর ভারতের শান্তিনিকেতনে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। প্রমথ
চৌধুরী তাঁর অবদান ও সৃষ্টিকর্মের জন্য বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে চিরস্মরণীয়
হয়ে থাকবেন। বাংলা সাহিত্যে চলিতভাষার প্রতিষ্ঠাতা প্রমথ চৌধুরীর ৬৮তম
মৃত্যুদিনে আমাদের শ্রদ্ধাঞ্জলি।
@
WARNING:
Any unauthorized use
or reproduction of
'Community' content is
strictly prohibited
and constitutes
copyright infringement
liable to legal
action.
[প্রথমপাতা] |
@
লেখকের আগের লেখাঃ
|