|
বাংলাদেশের অগ্রগণ্য আধুনিক কবি, সাহিত্যিক, গবেষক ও সাহিত্য-সম্পাদক
আব্দুল মান্নান সৈয়দের ৪র্থ মৃত্যুবার্ষিকীতে শ্রদ্ধাঞ্জলি
নূর মোহাম্মদ নূরু
ঊনিশ শতকের ষাট দশকে আবির্ভূত অন্যতম কবি আব্দুল মান্নান সৈয়দ, একাধারে কবি,
গল্পকার, প্রাবন্ধিক, উপন্যাসিক, অনুবাদক, নাট্যকার ও গবেষক। পঞ্চাশ বছরেরও
অধিক সময় ধ'রে বাংলা সাহিত্যকে নানান দিকে দিয়ে ঋদ্ধ করেছেন। একসময় তিনি
বাংলা গদ্যে প্রচুর নিরীক্ষা করেছেন, ঠিক তেমনি কবিতায় নিজস্ব একটি ধারা ও
স্বাতন্ত্র বজায় রেখেছিলেন। অনুবাদেও ছিলেন তিনি সহজ ও সরল। পরিশ্রমী এই
লেখক সাহিত্যের সব শাখায় ছিলেন সমান পারদর্শী। প্রায় ৩০০টিরও বেশী গ্রন্থ
তিনি লিখেছেন। কবিতা ছাড়াও তিনি গল্প, উপন্যাস, সমালোচনা, নাটক ইত্যাদি
সাহিত্যের বিভিন্ন শাখায় সুপ্রসার ও সুগভীর অবদান রেখেছেন। তিনি বহুমুখী
প্রতিভার অনন্যসাধারণ শিল্পী। বাংলা একাডেমী পুরস্কার, আলাওল পুরস্কারসহ
অসংখ্য পুরস্কারে তিনি সম্মানতি হয়েছেন। ২০১০ সালের ৫ই সেপ্টেম্বর তিনি
মৃত্যুবরণ করেন। ৪র্থ মৃত্যুবার্ষিকীতে আব্দুল মান্নান সৈয়দকে স্মরন করছি
গভীর শ্রদ্ধায়।
আব্দুল মান্নান সৈয়দের জন্ম হয়েছিল ১৯৪৩ সালের ৩রা আগস্ট অবিভক্ত ভারত
উপমহাদেশের পশ্চিমবঙ্গের চব্বিশ পরগনার ইছামতি নদী থেকে অনতিদূরে জালালপুর
নামক গ্রামে। পিতা সৈয়দ এ. এম. বদরুদ্দোজা ছিলেন সরকারী চাকুরে ;
সাহিত্যের বিশেষ অনুরাগী এবং মাতা কাজী আনোয়ারা মজিদও সাহিত্যের অনুরাগী
ছিলেন। জন্মের কয়েক বছরের মধ্যে, ১৯৪৬-এ, কলকাতায় হিন্দু ও মুসলমানদের
মধ্যে ভয়াবহ দাঙ্গা হয় এবং পরের বছর ১৯৪৭-এ বৃটিশ শাসিত ঔপনিবেশিক ভারত
উপমহাদেশ বিভক্ত হয়ে পাকিস্তান ও ভারত রাষ্ট্র সৃষ্টি হয়। ১৯৫০-এ ভয়াবহ
আরেকটি দাঙ্গা হয় পশ্চিম বঙ্গে। তখন তার পিতা নৌকোয় করে পালিয়ে সপরিবার
পূর্ব পাকিস্তানের (বর্তমান বাংলাদেশ) ঢাকা শহরে চলে আসেন। ঢাকায় এসে তারা
গোপীবাগে বসবাস করতে শুরু করেন। পরবর্তীতে গ্রীন রোডে জমি কিনে তাঁর পিতা
স্থায়ী নিবাস গড়ে তোলেন। সে সময় গ্রীন রোডের নাম ছিল "কুলি রোড"। ৫১
গ্রীন রোডই ছিল তাঁর আমৃত্যু ঠিকানা। তার পিতা মান্নান সৈয়দের লেখালেখির
জন্য গ্রীন রোডের বাসায় উঠানের একপাশে আলাদা দোচালা ঘর তুলে দিয়েছিলেন।
১৯৫৮ খৃস্টাব্দে ঢাকার নবাবপুর সরকারী উচ্চ বিদ্যালয় থেকে তিনি প্রবেশিকা
পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। কলা বিভাগে উচ্চ মাধ্যমিক উত্তীর্ণ হন তিনি ঢাকা
কলেজ থেকে ১৯৬০ খৃস্টাব্দে। অত:পর তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বাংলা ভাষা ও
সাহিত্য অধ্যয়ন করেন এবং ১৯৬৩-তে স্নাতক সম্মান এবং ১৯৬৪-তে স্নাতকোত্তর
ডিগ্রী লাভ করেন।শিক্ষা-জীবন শেষে তিনি সিলেটের মুরারীচাঁদ কলেজে শিক্ষকতা
শুরু করেন। সারা জীবন প্রধানত: অধ্যাপনা ক'রে তিনি জীবিকা নির্বাহ করেন।
কর্মজীবনে তিনি ফরিদপুর শেখ বোরহানুদ্দীন কলেজ, সিলেটের এম. সি. কলেজে, এবং
ঢাকায় জগন্নাথ কলেজে অধ্যাপনা করেছেন। দায়িত্ব পালন করেছেন ডিসট্রিক্ট
গেজেটিয়ারে। ঢাকার জগন্নাথ কলেজে দীর্ঘ কাল অধ্যাপনা করার পর ২০০২ থেকে
২০০৪ পর্যন্ত মেয়াদের জন্য তিনি নজরুল ইন্সটিটিউটের নির্বাহী পরিচালকের পদে
অধিষ্ঠিত হন।
সব্যসাচী লেখক আব্দুল মান্নান সৈয়দে বাংলা সাহিত্যের যে শাখাতেই চর্চা
করেছেন সেখানে সাফল্য ও কীর্তি ধরা দিয়েছে অবলীলায়। বলা হয় এদেশে তাঁর
মতো পরিশ্রমী লেখক নেই। সমসাময়িককালে তাঁর মতো বড় মাপের লেখক দেখা যায়
না। দুই বাংলাতেই তাঁর মতো সাহিত্যসমালোচক খুঁজে পাওয়া যায় দুষ্কর।
বিশ্বসাহিত্য সম্পর্কে ছিল তাঁর অগাধ ধারণা। কবিতা, গল্প, উপন্যাস ও কবিতায়
তাঁর সৃজনশীলতা অসাধারণ। প্রচণ্ড তোলপাড় করা শক্তি নিয়ে বাংলা সাহিত্যে
আবির্ভূত হয়েছিলেন তিনি। যে কোন লেখার মধ্যেই পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতেন।
বাংলা কবিতায় কবিতায় তিনি যুক্ত করেছিলেন পরাবাস্তববাদী দিগন্ত। তাঁর
উদ্ভাবনী শক্তি ও ব্যঞ্জনা সৃষ্টি তাঁর ভাষাকে করে তুলেছে ব্যতিক্রমী।
সাহিত্যের বিভিন্ন শাখায় প্রচৃর কাজ করলেও ভগ্নস্বাস্থ্য উপেক্ষা করে তিনি
আরো কাজ করার পরিকল্পনা করেছিলেন।
সব্যসাচী লেখক মান্নান সৈয়দ কথাসাহিত্যেও উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রেখে গেছেন।
জন্মান্ধ কবিতাগুচ্ছ, জোৎস্না রৌদ্রের চিকিৎসা, সংবেদন ও জলতরঙ্গ,
পরাবাস্তব কবিতা, মাছ সিরিজ, সকল প্রশংসা তাঁর, আমার সনেট, সত্যের মতো
বদমাশ, মৃত্যুর অধিক ক্ষুধা লাল, কলকাতা, পোড়া মাটির সংসার, শুদ্ধতম কবি,
জীবনানন্দ দাশের কবিতা, করতলে মহাদেশ, চেতনায় জলপড়ে শিল্পের পাতা নড়ে, দশ
দিগন্তের স্রস্টা ,মাতাল মানচিত্র, বুদ্ধদেব বসুর সুনির্বাচিত কবিতা, আমার
বিশ্বাস প্রভৃতি তাঁর উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ। প্রতীকী এবং পরাবাস্তবতাবাদী
পরিচর্যা আবদুল মান্নান সৈয়দের ছোটগল্পের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। প্রথম পর্বের
গল্পের ভাষারীতিতে আরোপিত আধুনিকতা দ্বিতীয় পর্বে পরিত্যক্ত হয়েছে; ফলে,
গল্পস্রোত হয়েছে অনেক বেশি সাবলীল ও স্বচ্ছন্দ। সত্যের মত বদমাস, চল যাই
পরোক্ষে এবং মৃত্যুর অধিক লাল ক্ষুধা ইত্যাদি তার উল্লেখযোগ্য গল্পগ্রন্থ।
শুধু কবিতা-কথাসাহিত্য নয়, তিনি লিখেছেন, কাব্যনাট্যপ্রহসন, একাঙ্ক,
শ্রুতিনাট্য, পূর্ণাঙ্গ নাটক, অনুবাদ নাটক, ইত্যাদি। ১৯৯২ খৃস্টাব্দে বাংলা
একাডেমী কর্তৃক প্রকাশিত হয় তাঁর নাট্যগুচ্ছ। ২০০৯-এ প্রকাশিত হয়
নাট্যধর্মী সকল লেখার সঙ্কলন নাট্যসমগ্র। তিনি ছোটগল্পের নাট্যরূপ দিয়েছেন।
তাঁর কয়েকটি কাব্য নাট্যের নাম বিশ্বাসের তরু, জ্যোৎস্না-রৌদ্রের চিকিৎসা,
ঈশ্বরপ্রাপ্তির ছোট্ট গাঁথা, চাকা, কবি ও অন্যেরা এবং আটতলার ওপরে।
আব্দুল মান্নান সৈয়দ দীর্ঘদিন ডায়াবেটিস ও হৃদরোগে ভুগছিলেন। ২৭ আগষ্ট
২০১০ চ্যানেল আই নামক টেলিভিশনে আয়োজিত একটি আলোচনা অনুষ্ঠানে অংশ নিতে
গিয়ে হঠাৎ করে অসুস্থ হয়ে পড়েন তিনি। নিকটস্থ ঢাকা মেট্রোপলিটন হাসপাতালে
চিকিৎসা লাভ করেন তিনি। সেই থেকে বাসায়ই অবস্থান করছিলেন কবি। ৫
সেপ্টেম্বর ২০১০ ইফতারীর কিছু আগে ঘুমের ভিতর হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে তিনি
শেষ নি:শ্বাস ত্যাগ করেন। বাসার অদূরে ল্যাবএইড হাসপাতালে নেয়া হলে সেখানে
ডাক্তাররা তাঁর মৃত্যু নিশ্চিত করে। পরদিন ৬ আগস্ট জনাজা শেষে তাঁর লাশ
আজিমপুর গোরস্থানে সমাধিস্থ করা হয়। তাঁর মৃত্যুতে সমকালীন বাংলা সাহিত্য
এক অপূরণীয় শূন্যতায় নিমজ্জিত হলো এবং এমন একটি সংকট তৈরী হলো যা
দীর্ঘকাল ধ'রে অনুভূত হবে। তাকে মূল্যায়ণ করতে হলে পূর্ণাঙ্গ মান্নান
সৈয়দকেই সামনে রাখতে হবে। এই পরিপূর্ণ আবদুল মান্নান সৈয়দ সৃষ্টির প্লাবনে
যে ভূখণ্ডের অধিশ্বর তা থেকে তার বিলয় নেই। তার সৃষ্টির গুনেই আজ তিনি
আমাদের সাহিত্যের এক অনন্য পুরুষ।
আব্দুল মান্নান সৈয়দ ছিলে বাংলাদেশের কোন বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথম "পোয়েট
ইন রেসিডেন্স"। তাঁকে স্কলার-ইন-রেসিডেন্স পদমর্যাদায় নিয়োগ করে জাতীয়
কবি কাজী নজরুল ইসলামের সংগ্রামী জীবনকে গ্রোথিত করে পূর্ণাঙ্গ নজরুলজীবনী
রচনার দায়িত্ব দেয়া হয়। তবে সাহিত্য কর্মে যে তুলনারহিত সৃজনশক্তির
স্বাক্ষর তিনি রেখে গেছেন তার মূল্য জীবদ্দশায় যথাযথভাবে স্বীকৃত হয় নি।
স্বীয় বিশ্বাসে রাজনৈতিক ঔদার্য়ের কারণে তাঁকে প্রায়শঃ রাষ্ট্রীয়
উপেক্ষার শিকার হতে হয়েছে।
সব্যসাচী লেখক মান্নান সৈয়েদের আজ ৪র্থ মৃত্যুবার্ষিকী। মুত্যুদিনে কবিকে
স্মরণ করছি গভীর শ্রদ্ধা ও ভালোবাসায়।
WARNING:
Any unauthorized use
or reproduction of
'Community' content is
strictly prohibited
and constitutes
copyright infringement
liable to legal
action.
[প্রথমপাতা] |
লেখকের আগের লেখাঃ
|