|
লবঙ্গের অঙ্গে রসায়ন দোলে ঢঙ্গে
- ড. এস, এম, আবে কাউছার
প্রেয়সীর চুলে হৃদয় দোলে! ঢাকের তালে কোমর দোলে! গানের তালে অঙ্গ দোলে!
হাওয়ায় হাওয়ায় দোলনা দোলে! আমার ভাবনায় লবঙ্গ দোলে আর লবঙ্গের অঙ্গে রসায়ন
দোলে! দোলে দোলে তাও আবার ঢঙ্গে দোলে! দোলে মন দোলে অকারণ হরষে! লবঙ্গের
মাঝে রসায়নের অণুতে মনটা দোলে! দখিনা বাতাসে আমার কলমটি দোলে! নীচের লেখায়
আমার পাঠক-পাঠিকা দোলে!!
লবঙ্গের অঙ্গে- ইউজেনল [Eugenol = 2-Methoxy-4-(prop-2-en-1-yl)phenol,
৭১%], অ্যাসিটাইল ইউজেনল (acetyl eugenol, ৯%), মিথাইল স্যালিসাইলেট
(methyl salicylate), ২-হেপ্টানোন (2-heptanone), বেটা-ক্যারোফাইলিন (beta-caryophyllene),
ভ্যানিলিন (vanillin), ক্র্যাটেগলিক এসিড (crategolic acid), ট্যানিন
(tannins), গ্যালোট্যানিক এসিড (gallotannic acid), ট্রাই-টারপিনয়েড: যেমন-
ওলিয়ানোলিক এসিড (oleanolic acid), স্টিগ্মাস্টেরল (stigmasterol), বিভিন্ন
সেস্কুইটার্পিন (sesquiterpenes) এবং কিছু ফ্ল্যাভানয়েড: যেমন- ইউজেনিন (eugenin),
কেম্পফেরোল (kaempferol), র্যাম্নেটিন (rhamnetin), ইউজেনটিন (eugenitin),
ইত্যাদি নামক যৌগ দোলে। লবঙ্গের সুগন্ধের জন্য দায়ী 'ইউজেনল'। এ যৌগের
জীবাণুনাশক এবং বেদনানাশক গুণও রয়েছে।
এছাড়া "ইউজেনল" এর রয়েছে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ অ্যান্টি-ব্যাকটেরিয়াল গুণ।
এ গুণের জন্য ইউজেনল যেমন হজমে উপকার আসে, তেমনই মাড়ি ব্যাথার উপশমেও
ব্যবহার হয়। রুট ক্যানাল থেরাপিতে অনেকে ব্যবহার করেন লবঙ্গের নির্যাস।
মুখের দুর্গন্ধ দূর করতে উপকার দেয় লবঙ্গ। গলা খুশখুশ হোক বা দাঁতে ব্যাথা-
মুখে লবঙ্গ পুড়ে উপকার পায়নি এমনটা কেউ বলতে পারবে না। সর্দি-কাশি-কফ সারাতে
লবঙ্গ একাই একশো। তাই চা করার সময় একটু লবঙ্গ ছেড়ে দিন গরম জলে।
ইউজেনলের অন্য একটা গুণ হল এটি জ্বালা বা ফোলা ভাব কমাতেও সাহায্য করে।
ফুসফুসের ক্যানসারের ওষধি হিসাবে লবঙ্গ তেল ব্যবহার হয় আয়ুর্বেদে।
অ্যান্টি-অক্সিড্যান্ট গুণের জন্য লিভারের স্বাস্থ্যরক্ষায় উপকারী লবঙ্গ।
এমনকি লবঙ্গকে নিয়ে বেশ কিছু প্রাচীন টোটকা রয়েছে। যেমন, লবঙ্গ ও তিলের তেল
মিশিয়ে কপালে মাখলে অনিদ্রা রোগ সারে। লবঙ্গ বাটার সঙ্গে একটু মধু আর লেবু
মিশিয়ে মুখে মাখলে ব্রণ-ফুসকুড়ি কমে, দাগ মোছে, মুখ উজ্জ্বল হয়। বিভিন্ন
সাবান-প্রসাধনীতেও এ কারণেই লবঙ্গ-তেল ব্যবহার করা হয়। অনেকে আবার
জামাকাপড়ের আলমারিতে এক কোণে একটু লবঙ্গ রেখে দেন।
আজকের কথা নয়। হাজার-হাজার বছর আগে থেকে মশলা হিসাবে ব্যবহার হয়ে আসছে
লবঙ্গ। এটি মশলা হিসেবে প্রায় সব রান্নায় ব্যবহৃত হয়ে থাকে। মূলত রান্নার
স্বাদ বৃদ্ধির জন্য লবঙ্গ ব্যবহার করা হয়। গোটা ফোড়ন হিসাবে দেওয়া যায়
রান্নায়, আবার শুকনো কড়ায় ভেজে গুঁড়ো করে ছড়িয়ে দেওয়া যায় রান্নার একদম
শেষে।
কিন্তু আপনি জানেন কি রান্নায় ব্যবহার ছাড়াও এই লবঙ্গের আছে আরো নানা
স্বাস্থ্যগুণ? USDA এর রেফারেন্স অনুসারে ১০০ গ্রাম লবঙ্গে ৬৫ গ্রাম
কার্বোহাইড্রেট, ৬ গ্রাম প্রোটিন, ১৩ গ্রাম টোটাল লিপিড, ২ গ্রাম সুগার,
২৭৪ কিলো-ক্যালোরি শক্তি ও ৩৩ গ্রাম ডায়েটারি ফাইবার থাকে। খনিজের মধ্যে
ক্যালসিয়াম, আয়রন, ম্যাগনেশিয়াম, ফসফরাস, পটাশিয়াম, সোডিয়াম, জিঙ্ক -কমবেশি
সবই আছে। আর ভিটামিনের মধ্যে উল্লেখযোগ্য বি-৬, বি-১২, সি, এ, ই, ডি, কে,
থায়ামিন, রাইবোফ্লাভিন, নিয়াসিন, ফোলেট রয়েছে। এইসব যৌগের
অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট বৈশিষ্ট্য আছে। একবার দু'চোঁখ বন্ধ করে ভাবুনতো লবঙ্গ
মশলাটি কত ভিটামিনসমৃদ্ধ ও স্বাস্থ্যসম্মত - এবার চোঁখ খুলুন।
লবঙ্গকে 'লং' এবং ইংরেজীতে 'Clove' বলা হয় আর বৈজ্ঞানিক নাম হচ্ছে:
Syzygium aromaticum। এটি কোন ফল বা বিচি নয় - কেবল লবঙ্গ গাছের ফুলের
কুড়িকে শুকিয়ে লবঙ্গ বা লং তৈরি করা হয়। লবঙ্গ একটি ঝাঁঝালো, উপাদেয় ও
ঘ্রাণময় মসলা। একে আস্ত, গুঁড়া বা তেল এ তিন রকমে ব্যবহার করা হয়। আমরা
বেশির ভাগ সময় রান্নার ক্ষেত্রেই আস্ত লবঙ্গই ব্যবহার করে থাকি। FAO এর
তথ্য মতে শুধুমাত্র ইন্দোনেশিয়াতে ৮০% লবঙ্গ উৎপাদিত হয়। বর্তমানে এটি
পৃথিবীর অনেক দেশেই চাষ করা হয়। এমনকি বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তান ও
শ্রীলংকাতেও লবঙ্গের চাষ হয়ে থাকে। চীন ও জাপানীরা ধুপ হিসাবে লবঙ্গ
ব্যবহার করে থাকে। আমাদের দেশেও লবঙ্গের ব্যবহার বহুবিধ ও প্রাচীন।
এছাড়া- লবঙ্গের আরো কিছু বিশেষ গুণ আছে, যা আমাদের জন্য ক্ষেত্রবিশেষে ভীষণ
উপকারী। যেমন- লবঙ্গ হজমে সহায়তা করে, ক্ষুধা বাড়ায়। যেখানে যেখানে মশার
উৎপাত বেশি সেখানে লেবু টুকরা করে তার মধ্যে কয়েকটি লবঙ্গ রেখে দিন। এতে করে
দূর হবে ঘরের মশা এবং যাপন করুন সুস্থ জীবন। একটি বোতলে পানির মধ্যে
লবঙ্গের তেল মিশিয়ে ভালো করে ঝাঁকিয়ে স্প্রে করুন। এটি প্রাকৃতিক
ফ্রেশনারের কাজ করবে। চিনির কৌটার মধ্যে লবঙ্গ দিয়ে রাখুন। এতে চিনিতে
পিঁপড়া আসবে না। প্রচণ্ড স্ট্রেস ও উৎকণ্ঠা অনুভব করছেন? এক টুকরো লবঙ্গ
মুখে ফেলে চুষে চুষে খেয়ে ফেলুন। পান করতে পারেন লবঙ্গের চাও। মেজাজ ফুরফুরে
ও চাঙ্গা হয়ে উঠবে।
-লবঙ্গের অঙ্গে আগা-গোড়া রসায়নের রসে ঠাসা ও ভরপুর। অঙ্গভারী লবঙ্গের
অঙ্গের পরতে পরতে বিছিয়ে রয়েছে রসায়নের অণু। -এ অণুর মিষ্টি দোলা পেতে
প্রতিদিন অল্প করে হলেও লবঙ্গ হয়ে যাক আমার-আপনার সবার নিত্যদিনের
অপরিহার্য সঙ্গী। =তাইতো বলে উঠি=
"লবঙ্গের অঙ্গে রসায়ন দোলে ঢঙ্গে
স্বর্গের স্বপ্নের মতো হৃদয় দোলে বিহঙ্গে"!!
______________________
লেখক: প্রফেসর, রসায়ন বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ।
WARNING:
Any unauthorized use or reproduction of 'Community' content is strictly
prohibited and constitutes copyright infringement liable to legal
action.
[প্রথমপাতা] |
|