প্রথমপাতা  

সাম্প্রতিক সংবাদ 

 স্বদেশ

আন্তর্জাতিক

বাংলাদেশ কমিউনিটি

লাইফ স্টাইল

এক্সক্লুসিভ

বিনোদন

স্বাস্থ্য

বর্তমানের কথামালা

 শিল্প-সাহিত্য

 প্রবাসপঞ্জী 

আর্কাইভ

যোগাযোগ

 

 

 

 

 

সবুজ ঘর : আহ্ কি প্রভাব
 

 

 

- ড. এস, এম, আবে কাউছার

 

 

স্বপ্ন দেখি, স্বপ্ন সাজাই একটা সুন্দর ঘরের জন্য । সবুজ মনে, সবুজ ভালোবাসা নিয়ে সবুজ ঘরে বসবাস করবো এটাই তো সবার প্রত্যাশা । কিন্তু এ কেমন ঘর যে ঘরের রয়েছে অনেক প্রভাব যাতে বাস করা কঠিণ ! ঘরের আবার প্রভাব ? বিষয়টা অবাক করার মতো হলেও সত্যি এ ঘরের আছে অদ্ভুতরকম হরেক প্রভাব । আহ্ কি প্রভাব ! হ্যাঁ, এটি হলো "দি ইফেক্ট অব গ্রীন হাউজ" বা "সবুজ ঘরের প্রভাব" । - আর তা নিয়েই আজকের অতি ছোট্ট একটি লেখা ।

"সবুজ ঘর" বা গ্রীন হাউস হচ্ছে এমন একটি বদ্ধ জায়গা যেখানে তাপমাত্রা আটকা পরে থাকে আর বের হতে পারেনা । সাধারণত: শীতপ্রধান উন্নত দেশ সমূহে শাক-সবজি উৎপাদনের জন্য তৈরী একধরনের কাঁচের ঘরকে "সবুজ ঘর" বা গ্রীন হাউস বলা হয়ে থাকে । যেখানে সূর্যের আলো যথেষ্ট পরিমান নয় এবং তাপও তীব্র নয় ফলে উন্মুক্ত স্থানে গাছপালা জন্মায় না । গাছপালা জন্মানোর জন্য যে পরিমাণ সূর্যের তাপ প্রয়োজন তা কৃত্রিমভাবে তৈরী করা হয় । কাঁচের দেয়াল বিশিষ্ট ছাদ দিয়ে বড় বড় ঘর তৈরী করে সে ঘরের মধ্যে মাটি ফেলে সবুজ শাক-সবজি উৎপাদন করা হয় । এ কাঁচের ভিতর দিয়ে তাপ প্রবেশ করতে পারে কিন্তু আর বের হতে পারে না । ফলে ভিতরের তাপমাত্রা ধীরে ধীরে বেশ গরম হয়ে উঠে এবং শাক-সবজি/গাছপালা জন্মানোর জন্য উপযুক্ত হয়ে উঠে । এভাবে তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ করে কাঁচে ঘেরা এ সবুজ ঘরটি শাক-সবজিতে ভরে ওঠে ।

এখন প্রশ্ন - তাহলে কি করে এ মস্ত বড় পৃথিবীটা গ্রীন হাউস বা "সবুজ ঘর" হলো ? বিস্ময় ! তবে তা খুব সহজ - সূর্য থেকে দিনে যে তাপমাত্রা নির্গত হযে আমাদের পৃথিবীতে আসে এবং যা আমাদের মাটি পানি সবকিছুই সে তাপমাত্রা শোষণ করে নেয় এবং রাতের বেলা তা আবার নির্গত করে, আর এ নির্গত তাপমাত্রা যদি কোনোভাবে পৃথিবীর মাঝে আটকা পরে যায় তাহলেই গ্রীন হাউস বা "সবুজ ঘর" তৈরি হয়ে গেল । - আর এ কাজটি মূলত: করে থাকে কিছু 'গ্রীন হাউস গ্যাস' সদস্যরা আর অনেকাংশে দায়ী কার্বন-ডাই অক্সাইড (CO2) মহাশয় !! এ কার্বন-ডাই অক্সাইড (CO2) গ্যাস বায়ু অপেক্ষা ভারী হওয়ায় ভুপৃষ্ঠের কাছাকাছি একটা স্তর তৈরী করে ফেলে যা সূর্যের তাপকে আটকে ধরে রাখতে পারে । ফলে পৃথিবীর তাপমাত্রা বৃদ্ধি পেয়ে ক্রমেই গরম হয়ে উঠে । শুধু পদ্ধতিগত মিল বুঝাতে পৃথিবীর উষ্ণতা বৃদ্ধির ব্যাপারটিকে "সবুজ ঘর" বা গ্রীন হাউসের সাথে তুলনা করা হয়েছে ।

আসলে মূল ম্যাকানিজমটা এ রকম - আমাদের শক্তির প্রধান উৎস হল সূর্যিমামা । আলোর তরঙ্গদৈর্ঘ্য কম (= ফ্রিকুয়েন্সি বেশী = শক্তি বেশী) হওয়ায় সূর্যের আলো সহজেই বায়ুমন্ডলের স্তর ভেদ করে পৃথিবীতে চলে আসতে পারে । এই আলোকশক্তি ভূপৃষ্ঠ কর্তৃক তাপশক্তি আকারে গ্রহণের পর বাকী শক্তিটুকু যখন ভূপৃষ্ঠ থেকে তাপশক্তি আকারে নির্গত হয় তখন তাপের তরঙ্গদৈর্ঘ্য বেশি (= ফ্রিকুয়েন্সি কম = শক্তি কম) থাকায় তা আর এই স্তর ভেদ করে যেতে পারে না । এই তাপশক্তি আবার পৃথিবীতেই ফিরে আসতে বাধ্য হয় । এর ফলে বৃদ্ধি পাচ্ছে পৃথিবীর তাপমাত্রা, যা বৈশ্বিক উষ্ণায়ন (Global Warming) নামে পরিচিত । তবে এটা ও মনে রাখা দরকার - তাপমাত্রা যত বাড়বে পানির বাষ্পীভবনের হারও তত বাড়বে । ফলে গ্রীনহাউস ইফেক্টে জলীয় বাষ্পের প্রভাবও বেড়ে যাবে । তাছাড়া পৃথিবীর তাপমাত্রা যত বাড়তে থাকবে পৃথিবী থেকে বিকিরিত রশ্মির তরঙ্গদৈর্ঘ্যও তত কমতে থাকবে । আর জলীয়বাষ্প অপেক্ষাকৃত কম তরঙ্গদৈর্য্যের বিকিরন বেশী শোষণ করে নেয় ।

'গ্রীন হাউস গ্যাস' সমূহ বায়ুমন্ডলের চারপাশ ঘিরে গ্রীন হাউসের কাঁচের মত একটি আবরণ তৈরী করে সমস্ত পৃথিবীটাকে যেন একটা "সবুজ ঘর" বা গ্রীন হাউস বানিয়ে ফেলেছে । আর এ গ্যাসীয় স্তরটি পৃথিবীপৃষ্ঠের তাপমাত্রা বৃদ্ধির ক্ষেত্রে গ্রীন হাউসের মত 'ইফেক্ট' বা প্রভাব তৈরী করছে বলে একে গ্রীন হাউস ইফেক্ট বলা হয় ।

গ্রীন হাউস ইফেক্টের জন্য দায়ী 'গ্রীন হাউস গ্যাস' এবং এর সদস্যবৃন্দ হচ্ছে - কার্বন-ডাই অক্সইড (CO2), মিথেন (CH4), সিএফসি (Chlorofluorocarbon, CFC) বা ফ্রেয়ন, নাইট্রাস অক্সাইড (N2O), কার্বন মনোক্সাইড (CO), ওজোন (O3) বা জ্বলীয় বাস্প ইত্যাদি । বিভিন্ন কল-কারখানা থেকে ক্রিয়া-বিক্রিয়ার মাধ্যমে প্রতিনিয়ত কার্বন-ডাই অক্সইড বায়ুমন্ডলে ছেড়ে দেয়া হচ্ছে কিংবা গাছপালা নিধনের ফলেও কার্বন-ডাই অক্সইড বৃদ্ধি পাচ্ছে । প্রত্যেহ রান্না-বান্নার কাজে মিথেন গ্যাস তো ব্যবহার করেই থাকি, এমনকি প্রতিবছর গরুর গোবর থেকে বায়োগ্যাস উৎপাদনে বিপুল পরিমান মিথেন গ্যাস বায়ুমন্ডলে নিঃসৃত হয়ে গ্রীন হাউস ইফেক্টের পরিমানও বাড়িয়ে দিচ্ছে । এরোসল এবং রেফ্রিজারেটরে শীতলকারক হিসেবে CFC অহরহ ব্যবহার করা হচ্ছে যা কিনা গ্রীন হাউস ইফেক্ট ছাড়া ওজন স্তরকেও ধ্বংস করে দিচ্ছে । বজ্রপাতের সময় বাতাসের অক্সিজেন ও নাইট্রোজেনের সমন্বয়ে নাইট্রাস অক্সাইড তৈরি হয় এবং তা বায়ুমন্ডলেই থেকে যাচ্ছে । এছাড়া বিভিন্ন কারখানা, ইটের ভাটা, গাড়ীর ধোঁয়া থেকে কার্বন মনোক্সাইড গ্যাস তৈরি হচ্ছে যা গ্রীন হাউস ইফেক্টের জন্য অভিযোগে অভিযুক্ত এবং দন্ডিত ।

গ্রীন হাউস ইফেক্টের ফলে নানা প্রভাব পরিলক্ষিত হয় প্রথমেই তাপমাত্রার ধীরে ধীরে বৃদ্ধি ঘটে এবং তা স্থায়ী হয় । বিজ্ঞানীদের ধরণা আগামী ৫০ বছরে পুরো পৃথিবীর তাপমাত্রা ৪ ডিগ্রী সেন্টিগ্রেড স্থায়ীভাবে বৃদ্ধি পেতে পারে, আর তখন একটা বিরাট পরিবর্তন আসতে পারে এ স্বাদের ধরণীতে । আমরা জানি, পানির স্বাভাবিক তাপমাত্রা ৪ ডিগ্রী সেন্টিগ্রেড এবং ০ ডিগ্রী সেন্টিগ্রেড তাপমাত্রায় পানি বরফে পরিণত হয় । আগামী ৫০ বছরে যখন সমস্ত বিশ্বের তাপমাত্রা ৪ ডিগ্রী সেন্টিগ্রেড বৃদ্ধি পাবে তখন পৃথিবীপৃষ্ঠের যেখানে ০ ডিগ্রী সেন্টিগ্রেড তাপমাত্রার বরফ আছে তা সবই গলে পানি হয়ে যাবে এবং বিপুল পরিমাণ পানি সমুদ্রে চলে আসবে । এভাবে সমুদ্রের তল বেড়ে গিয়ে নদীগুলিতে উল্টোমুখি স্রোত তৈরী হবে এবং ফলে সমুদ্রের লবণাক্ত পানি নদীর দু'কুল উপচিয়ে জমির মাটি লবণাক্ততা হয়ে উর্বরতা হারাবে । এমনকি সমুদ্রেপৃষ্ঠের পানির উচ্চতা বেড়ে গিয়ে উপকূল অঞ্চলগুলি ডুবে যাবে । বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধিতে বাংলাদেশের জন্য আশংকার কারণ হচ্ছে দেশের দক্ষিণাঞ্চলের নিন্মভূমি ডুবে যেতে পারে । এছাড়া জলবায়ুর পরিবর্তনের (বায়ু প্রবাহের বর্তমান গতির পরিবর্তন, ঋতু পাল্টে যাওয়া, ইত্যাদি) ফলে অনাবৃষ্টি, বন্যা, সাইক্লোন, খরা, অনাবৃষ্টি ইত্যাদি প্রাকৃতিক বিপর্যয় সবই গ্রীন হাউস প্রভাবের ফলে দায়ী বলে মনে করা হচ্ছে ।

উন্নতবিশ্বের লাগামহীন ভোগবিলাসের নিমিত্তে নির্মিত নিত্যনতুন প্রযুক্তি সামগ্রী উৎপাদিত হচ্ছে যা থেকে গ্রীন হাউস গ্যাস সমূহ নিঃসরণ করছে এবং তা বায়ুমন্ডলে যুক্ত হচ্ছে । বিশ্বে কার্বন নিঃসরণের তালিকার প্রথম দেশ হল - যুক্তরাষ্ট্র তারপর চীন, রাশিয়া, জাপান, কানাডা, কোরিয়া, জার্মানিসহ উন্নত বিশ্বের দেশসমূহ । শুধুমাত্র ৮-১০ টি দেশেরই কার্বন নিঃসরণ শতকরা ৬৮.২% যেখানে বাংলাদেশের মাত্র ০.১৫% । বৈশ্বিক উষ্ণায়ন ঠেকাতে এবং পৃথিবীটাকে মানুষের বাসযোগ্য করে রাখতে ১৯২টি দেশের অংশগ্রহণে বিশ্ব ধরিত্রী সম্মেলন বসে ফি বছরই । হয় গলা ফাটা বক্তৃতা, হয় সেমিনার, হয় চুক্তি । কিন্তু দুঃখজনক, এই পর্যন্ত ই- যা ! বরং উল্টো শিল্পোন্নত দেশে বেড়ে গেছে গ্রীণ হাউস গ্যাসের নির্গমনের পরিমাণ - যেন দেখার চোখ নেই ।

এত সংক্ষিপ্ত পরিসরে গ্রীন হাউস প্রভাবের এত বিশালতা যৎ সামান্যই বলা যাবে - যা হোক, কার্বন-ডাই অক্সাইড সহ অন্যান্য গ্রীন হাউস গ্যাস নির্গমণ রোধে কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহন করতে হবে, জ্বালানী শক্তির ব্যবহার কমাতে হবে, দ্রুত গতিতে নতুন বনাঞ্চল গড়ে তুলতে হবে, শিল্পকারখানায় রাসায়নিক প্রযুক্তি হিসেবে পরিবেশ বান্ধব সবুজ রসায়ন (Green Chemistry) নির্ভর রাসায়নিক প্রযুক্তি ব্যবহার করতে হবে,..... তবেই এই নিখিল অবনীর বুকে "সবুজ ঘর" - এর প্রভাব হতে মুক্ত থেকে আমরা হয়তো সুখের ভেলায় বেঁচে থাকতে পারবো ... আহ্ !!

____________________________________________
লেখক: পোস্টডক্টরাল গবেষক, ইয়োকোহামা সিটি বিশ্ববিদ্যালয়, জাপান এবং অধ্যাপক, রসায়ন বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ।

 
 

WARNING: Any unauthorized use or reproduction of 'Community' content is strictly prohibited and constitutes copyright infringement liable to legal action.

[প্রথমপাতা]