@
@
@ |
@
@
অক্সিজেন ও দেহঘড়িটা
@
@
@
- ড. এস, এম, আবে কাউছার
@
@
দেহঘড়ির এ কাঁটা থেমে যাবে, থেমে যাবে দেহের
সেকেন্ড, মিনিট ও ঘন্টার সবকটি কাঁটা যদি না থাকে অক্সিজেনের দমটা। এই
অক্সিজেনই প্রতি নিঃশ্বাসে সচল রেখেছে এই দেহঘড়িটা। জন্ম থেকে আমৃত্যু
পর্যন্ত নিখুঁতভাবে আপনা-আপনিই চলতে থাকে এই শ্বাস-প্রশ্বাসের খেলা।
ভাবুন তো যদি সজ্ঞানে শ্বাস-প্রশ্বাসের কাজ করতে হতো, তবে কি আপনি অন্য কোনো
কাজ করতে পারতেন? না, এমনকি ঘুমাতেও পারতেন না। চিন্তা করে দেখুন, আল্লাহ
আপনার মস্তিস্কে এমন একটি ব্যবস্থা করে দিয়েছেন, যার ফলে স্বয়ংক্রিয়ভাবেই
শ্বাস-প্রশ্বাসের কাজটি করতে পারছেন। জানেন কেন এত ঘন ঘন শ্বাস-প্রশ্বাস
নিতে হয়? হাঁ আমাদের হজম প্রক্রিয়ায় এটা কাজে লাগে বলে। এ জন্য মিনিটে
প্রায় ২৫০ এমএল অক্সিজেন প্রয়োজন হয়। আর এ বিপুল অক্সিজেন রাখার জন্য দুfটি
ফুসফুসের থলে তৈরি আছে। এ ফুসফুস দুfটিতে প্রায় ৩০০ মিলিয়ন অতিক্ষুদ্র বায়ু
কোষ আছে। দেহে এ অক্সিজেন জোগান দিতে এসব কোষে ৭০-১০০ বর্গমিটার জায়গা রয়েছে
যা একটি ছোট ফ্ল্যাটের সমান।
আমরা শ্বাস গ্রহণকালে বায়ুর সাথে অক্সিজেন ফুসফুসে প্রবেশ করে যা কোষের
অভ্যন্তরস্থ রক্তের সংস্পর্শে এসে রক্তের হিমোগ্লেোবিনের সাথে বিক্রিয়া করে
অক্সি-হিমোগ্লোবিন উৎপন্ন করে। শরীরের জৈব-কোষের সংস্পর্শে এসে জারণ
ক্রিয়ায় তাপ উৎপন্ন হয় আর তাতে প্রাণীদেহের উষ্ণতা বজায় রাখে। এর ফলে
শরীরের শক্তি উৎপন্ন হয়। জীবদেহের যাবতীয় বিপাক ক্রিয়া, যেমন: শ্বসন,
রেচন, পুষ্টি ইত্যাদি এবং শারীরবৃত্তীয় ক্রিয়াকলাপ সবকিছুতেই অক্সিজেনের
দরকার হয়। অতীব প্রয়োজনীয় শর্করা বা কার্বোহাইড্রেট কিংবা স্নেহপদার্থ বা
ফ্যাট গঠনেও অক্সিজেনের মুখ্য ভূমিকা রয়েছে।
আল্লাহ তায়ালার সৃষ্টির অপূর্ব সৌন্দর্য জীবের মধ্যে গাছও একটি জীব। গাছ
এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ জীব, যা ছাড়া বেঁচে থাকার কোন উপায় নেই। বায়ুমণ্ডলে
ছড়িয়ে পড়া কার্বন ডাই-অক্সাইড (CO2) শুষে নেয় এবং প্রয়োজনীয় অক্সিজেন (O2)
জোগান দিয়ে আমাদের প্রাণের স্পন্দন সচল রাখে। এক সমীক্ষায় জানা যায় এক
হেক্টর বন ১ বৎসরে প্রায় ৪ মেঃ টন কার্বন-ডাই অক্সাইড গ্যাস টেনে নেয় আর
২ টন অক্সিজেন গ্যাস ছেড়ে দেয়। যা প্রাণীকুল গ্রহন করছে প্রতি মুহূর্তেই।
অমূল্য এ অক্সিজেন যদি মানুষ ও প্রাণীর জন্য কেনার প্রয়োজন হতো তখন জনাব?
যা-হোক, অক্সিজেন চক্রের মাধ্যমে জীবজগৎ ও পরিবেশের মধ্যে বাতাসে
অক্সিজেনের স্বাভাবিক মাত্রা বজায় থাকে।
এই গ্যাস মৌলিক ও যৌগিক উভয় রূপেই বায়ুমণ্ডলে পাওয়া যায়। সাধারণভাবে
বায়ুমণ্ডলে ৪ ভাগ নাইট্রোজেনের সাথে ১ ভাগ মৌলিক অক্সিজেন মিশ্রিত অবস্থায়
থাকে যার পরিমাণ প্রায় ২১ ভাগ। অক্সিজেন পানিতে সামান্য পরিমাণ দ্রবীভূত
থাকে বলেই জলজ উদ্ভিদ ও প্রাণীরা শ্বাস-প্রশ্বাস ক্রিয়া চালিয়ে বাঁচতে পারে।
যা কিনা মাছ চাষের জন্যও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আরেক প্রাণ বাঁচানো পানি
(H2O)- এর গঠনেও অক্সিজেন হাইড্রোজেন পরমানুর সাথে (১ : ২ অনুপাতে) বন্ধনে
আবদ্দ থাকে। প্রাণরক্ষাকারী এ অক্সিজেন বিভিন্নভাবে প্রস্তুত করা যায় যেমন-
প্রকৃতিতে সালোক-সংশ্লেষণ পদ্ধতিতে বা পরীক্ষাগারে (বিয়োজনের সাহায্যে,
পানির বিশ্লেষণ করে অথবা বায়ু থেকে পৃথকীকরণের মাধ্যমে)।
জীবন রক্ষায় অতি প্রয়োজনীয় অক্সিজেনকে eঅম্লজানf, eঅক্ষজনf, eদহনবায়ুf বা
eপ্রাণবায়ুf বলে থাকে। প্রতীক eOf এবং পারমাণবিক সংখ্যা ৮ আর পারমাণবিক ওজন
১৫.৯৯৯৪। এই গ্যাসটির 16O (বেশি পরিমাণে পাওয়া যায়), 17O এবং 18O -এ ৩টি
আইসোটোপ পাওয়া যায়। ১৭৭৩ সালে সর্বপ্রথম সুইডিশ বিজ্ঞানী C. W. শেলী
অক্সিজেন আবিস্কার করেন কিন্তু ইংল্যান্ড বিজ্ঞানী J. প্রিস্টলে ১৭৭৪ সালে
অক্সিজেনের উপর পেপার প্রকাশ হওয়ায় তাকেই অক্সিজেন আবিস্কারের জনক বলা হয়।
কিন্তু ১৭৭৭ সালে A. ল্যাভয়সিয়ে অক্সিজেনের নামকরন করেন। অক্সিজেন শব্দটি
এসেছে গ্রিক (oxys) যার অর্থ Sour বা অম্ল এবং (gƒÍnos) অর্থ I produce (আমি
উৎপন্ন করি)। বিজ্ঞানী ল্যাভয়সিয়ে মনে করেছিলেন, অক্সিজেন সকল এ্যাসিডের
একটি সাধারণ উপাদান। পরবর্তীকালে এই ধারণা মিথ্যা প্রমাণিত হলেও, অক্সিজেন
নামটি আজও রয়ে গছে। সাধারণ তাপমাত্রায় দ্বিপরমানুক (O২) এই অনুটি বর্ণহীন,
অদাহ্য, গন্ধহীন ও স্বাদহীন। অক্সিজেন নিজে জ্বলে না, কিন্তু অন্যকে জ্বলতে
সাহায্য করে। অক্সিজেন ছাড়া আগুন জ্বলে না আর আগুনের সাহায্যে আমরা খাবার
রান্না- বান্না করি। তবে একটি ব্যপাার, অক্সিজেনের দহন মানে আগুন না। দহন
মানে অক্সিজেনের সাথে বিক্রিয়া। জ্বলন্ত দ্রব্যের সংস্পর্শে এসে
অক্সিজেনের রাসায়নিক পরিবর্তন ঘটে। শুধু জলে-স্থলে অন্তরীক্ষে নয় জৈব-অজৈব
প্রায় সকল যৌগেই এর অস্তিত্ব বিদ্যমান। কোথায় নেই এই অক্সিজেন।
প্রাণরক্ষাকারী প্রোটিন, নিউক্লিক এসিড সব জায়গায়ই রয়েছে এই অক্সিজেন। এমনকি
অক্সিজেনের আইসোটোপ ছড়িয়ে আছে পৃথিবীর নানা প্রান্তে এবং বিস্তৃত রয়েছে
সূর্য্যে এমনকি চাঁদেও। আর মঙ্গলে অক্সিজেন পাওয়া যায়নি বলে তো কোন বসতি গড়ে
উঠতে পারেনি।
অক্সিজেন জীবনের জন্য অপরিহার্য। প্রতিনিয়ত: চিকিৎসার ক্ষেত্রে শ্বাসকষ্ট
দূরীকরণের জন্য এই অক্সিজেন গ্যাস ব্যবহার করা হয়ে থাকে। এমনকি অক্সিজেনের
ঘাটতি দেখা দিলে মস্তিষ্কের কোষগুলো মারা যেতে শুরু করে যাকে আমরা স্ট্রোক
বলে থাকি। যুক্তরাষ্ট্রের এক গবেষণায় দেখা যায়, অত্যধিক কোমল পানীয় পানের
ফলে শরীরে অক্সিজেনের পরিমাণ কমে আসে, যা মানব দেহের জন্যে ক্যানসারের ঝুঁকি
বাড়ায়! সুতরাং অক্সিজেনের ঘাটতি কোনো ভাবেই কাম্য নয়।
অতি বেগুনি রশ্মির (তরঙ্গ দৈর্ঘ্য ১৯৩ ন্যানো মিটার থেকে কম) আঘাতে
অক্সিজেন অণু ভেঙে 'ওজোন' (O3) নামক একটি বিষাক্ত গ্যাসের সৃষ্টি করে।
বায়ুমণ্ডলের স্ট্র্যাটোস্ফিয়ারে (ভূমি থেকে ১৫ থেকে ৫০ কিলোমিটার উপরে) এই
ওজোন অবস্থান করে বিধায় সূর্যের অতিবেগুনি রশ্মিকে ভূপৃষ্ঠে আসার ক্ষেত্রে
বাধা প্রদান করে, ফলে জীবজগত রক্ষা পায়।
অক্সি-এ্যাসিটিলিন শিখা (৩২০০ ডিগ্রী সেন্টিগ্রেড তাপমাত্রা) দ্বারা কঠিন
ধাতব পদার্থকে কাটা বা ঝালাই কিংবা জোড়া লাগানোর জন্য ব্যবহৃত হয়ে থাকে।
জোড়া লাগানোর এই প্রক্রিয়াকে সোজা ভাষায় ওয়েলডিং বলে থাকি। সাধারণত:
অক্সিজেন ও অ্যাসিটিলিন নামক গ্যাসের মিশ্রণকেই অক্সি-অ্যাসিটিলিন বলা হয়।
এছাড়া আলোর ঝলকানি আতশবাজিতে অক্সিজেন জারক হিসাবে জারণ-বিজারণ বিক্রিয়া
সংঘটিত করে যার ফলে তৈরি হয় মনোমুগ্ধকর দৃশ্য।
শুধু মানবকুল নয় সব প্রানিকুলেই দেহঘড়ির কাঁটা সচল রাখতে এটি জরুরী। মায়ের
শরীরে ভ্রূণ থেকে (অক্সিজেন গ্রহণের জন্য অক্সিসোমে প্রায় ৭০টি এনজাইম ও
১৪টি কো-এনজাইম তৈরী থাকে) শুরু করে মৃত্যু পর্যন্ত অক্সিজেন আমাদের অজান্তে
দেহঘড়িটির জন্য অবিরত কাজ করে চলছে।
-আর যখন অক্সিজেন ফুরিয়ে আসবে তখন দেহঘড়ির এলার্ম বেঁজে উঠবে, সাথে সাথে
কাঁটার টিক টিক শব্দ চিরতরে বন্ধ হয়ে যাবে।
লেখক: পোস্টডক্টরাল গবেষক, ইয়োকোহামা সিটি বিশ্ববিদ্যালয়, জাপান এবং
অধ্যাপক, রসায়ন বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় । অক্টোবর ১১, ২০১৫ ।
@
WARNING:
Any unauthorized use
or reproduction of
'Community' content is
strictly prohibited
and constitutes
copyright infringement
liable to legal
action.
[প্রথমপাতা] |
@ @
|