|
ধারাবাহিক উপন্যাসঃ
কাক জ্যোৎস্নায় কাক ভোর-শেষ পর্ব
শাশ্বত
স্বপন
আর লিখতে ইচ্ছে করছে না, মাথা ঘুরছে। পাশার কথা মনে পরছে। বৈষম্য আছে বলেই
পৃথিবী এত বৈচিত্র্যময় । যে যার ব্যক্তিগত স্বার্থ নিয়েই বৈষম্যকে ভাঙ্গতে
চায় । স্রষ্টা সত্য, পৃথিবী সত্য,বৈষম্যও সত্য। তবুও চলছে নারীর দ্রোহ--চলবে
দ্রোহ। স্বার্থান্বেসী মানুষের সৃষ্টি বৈষম্য ভাঙ্গতে 'দ্রোহ'। দ্রোহের মাথা
নেই, আছে বক্ষ ও লেজ । তাই তো দ্রোহ দ্রোহ-ই থাকে, বিদ্র্রোহ আর জমাট বাঁধে
না পাথরের মত। মাথা নেই--নেই নেতা-নেত্রী, নেই রাজা রামমোহন, নেই
ঈশ্বরচন্দ্র, নেই রোকেয়া, নেই সুফিয়া কামাল, নেই ...। তাইতো দ্রোহ জমাট
বাঁধে বরফের মত--যা রোদের তাপে গলে পানি হয়ে যায়। এখন এ সমাজে একটা 'বি'চাই
-- চাই একটা বি আকৃতির মাথা—দ্রোহের সাথে মিলে সৃষ্টি করবে কালবৈশাখির মত
বিদ্রোহ।
কালী তার এই অবস্থায় জন্য আজ থেকে আর কাউকে দায়ী করবে না। সে জানে, এ সমাজ
তার এই আজকের মানসিক অবস্থার মত নয়। সমাজ অন্যায়র বিরুদ্ধে লড়বেই, সে
অন্যায় যেভাবেই হোক , অন্যায় অন্যায়ই। কিন্তু কালির কাছে সব পরিষ্কার মনে
হচ্ছে । আর একটা নরক পার হতে পারলেই স্বাপ্নিক নরক অথরা স্বর্গ সে দেখতে
পাবে। সে এখন পৃথিবীর কথা ভাবে না। পৃথিবীর বুকে বাস করেও সে নিজেকে অন্য
জগতের ভাবছে।
কালী কেমন যেন হয়ে গেল ? তাকে কিছুই খাওয়ানো যায় না। এ পৃথিবীতে মা-বাবা,
ভাই-বোন কাউকে সে চিনে না- চিনতে চায় না । সে কথা বলে না। কারো প্রশ্নর কোন
উত্তরও দেয় না। এ পৃথিবীতে যেন সে নতুন আসছে। হরিণী দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে
শিশুর মত। সে আজো পা দু'টি সোজা করলে ব্যথা পায়। পা ফাঁক করে তাকে হাঁটতে
হয়। তুলসী তাকে প্রতিবার ধরে ধরে বাথরুম নিয়ে যায়। সারাক্ষণ সে চুপচাপ বসে
থাকে। জোড় করে তাকে খাওয়াতে হয়।শেফালী তাকে গীতা, মহাভারত, রামায়ন পড়তে দেয়।
সে ছুঁয়েও দেখে না। শুধু তাকিয়ে বইগুলিকে দেখে। ভাবে, এই বইগুলির কত ক্ষমতা
! নারীদের পক্ষ নিয়ে যদি এ রকম একটা বই হত। শেফালী ওকে বিভিন্ন দেব-দেবীর
ছবির সামনে বসায়। কালী তাকিয়ে দেখে, কথা বলে না, প্রণামও করে না। নিরবে
কান্নার অশ্রু ঝরে, সবাই অশ্রু দেখে কিন্তু তার অন্তরের কান্নার পাহাড়
ভাঙ্গার শব্দ কেউ শুনতে পায় না।
আজ রবিবার। রাত ১০ টার দিকে কালী বেশ স্বাভাবিক হয়ে যায় । তুলসী অবাক হয়ে
যায় তার এই হঠাৎ পরিবর্তন দেখে। উত্তর ঘরে তুলসী আর কালী শুয়ে আছে। মুলির
বেড়া কাঁটা হয়েছিল সে বেড়া পরিবর্তন করে টিনের বেড়া লাগানো হয়েছে। কালী ভাত
খায়নি। সারাদিন শুধু এক টুকরো পাউরুটি আর দুধ খেয়েছে। খেয়েছে বললে ভূল হবে-
খাওয়ানো হয়েছে। সে তুলসীর সাথে দুষ্টামী করছে-
আমার আঠারটা ছেলে হবে। ঠাকুমা, তুমি আমাকে পাশার সাথে ..এখন আমার আঠারটা
ছেলে হবে। ছেলেগুলি কুকুরের মত হবে। ওরা আমাকে কুকুরের মত দুইবার দুইবার করে...
থাম্ ,পাগল হলি ?
তুমি, তোমরা আমাকে মাপ কর দিও। এ পৃথিবীর কারো উপর আমার কোন রাগ নেই, ক্ষোভ
নেই। তোমাদের অনেক কষ্ট দিয়েছি ঠাকুমা। আমাকে সবাই ক্ষমা করে দিও। ক্ষমা
চাওয়াও নারীত্বের ধর্ম, তাইনা ঠাকুমা ?
তুই ঘুমা-
হ্যাঁ, ঘুমাব। অবশ্যই ঘুমাব। আমি জেগে থাকলে কারো ঘুম হয় না। সবার শান্তিমত
ঘুম হোক..এই আমি ঘুমাচ্ছি...
না, কালি ঘুমায়নি। তার কাছে এখনও স্বর্গ, নরক, পৃথিবী ইত্যাদি রহস্যময় আর
দ্বিধা লাগছে। স্বাভাবিকে ফিরে এসে সে আবার পূর্ণ বিশ্বাস হারিয়ে ফেলল। ওকে
আর কালী ডাকতে ইচ্ছে করছে না। আমি এখন ওকে উষা ডাকব। কারণ ?
আজীবন নারীত্বের শুভ্রতা আনার জন্য সে সংগ্রাম করেছে। আজ তার শেষ দ্রোহ।
এতদিন বহু লাঞ্ছনা-গঞ্ছনা, ধর্ষণ পর্যন্ত সহ্য করেছে। আজ সব কিছুর প্রান্তে
সে যাবে। এ তার বহু আগের স্থির সংকল্প। এ বিষাক্ত সময়ের এই বিষাক্ত সমাজে
তার এই বিষাক্ত দেহ নিয়ে সে আর সন্মুখে এগোতে চায় না। থুথুতে ভরে যাবে তার
কুৎসিৎ দেহ। সেসব কষ্ট সে আর সহ্য করতে পারবেনা। সে কোনদিন স্বামী পাবে
না--মা হতে পারবে না। তার এ জীবনের মূল্য দূর্বা ঘাসের শিশিরের মত।
অন্তবিহীন জীবনের এ যাত্রা পথে মানুষ ক্রমাগত মৃত্যুর দিকে এগোচ্ছে কেউ ধীরে
ধীরে, কেউ দ্রুত। তবুও মানুষ মৃত্যুকে মৃত্যু হিসাবে না ভেবে শব্দ হিসাবে
ভাবে। মৃত্যুর একেবারে সম্মুখে গেলে অথবা মৃত্যু তাকে ছুঁয়ে গেলে তখন মৃত্যু
বুঝতে পারে। কিন্তু বেঁচে গেলে সে পরক্ষণেই ভূলে যায়।আর ভূলে যায় বলেই এত
অন্যায়-অবিচার, এত পাপে পৃথিবী ভরে গেছে। মানুষ যে কোন মুহুর্তে মরে যেতে
পারে। অথচ সে কথা জেনেও শোষণ-শাসন করে বিরাট সম্পত্তির পাহাড় গড়ে--যা
মৃত্যুর পর তার কোন কাজেই আসবে না। মানুষ কি ভুল করছে ? এত বড় মস্তিষ্কের
শ্রেষ্ঠ জীব মানুষ তা কি সে বুঝে না ? নিশ্চয় সে ভাবে, সে কোন ভুল করে না।
যা করে তা সময়ের জন্য, জীবনের জন্য, বংশধরের জন্য। খাঁটি কথা। তাহলে
ধর্ম-বিভেদ, বর্ণ-বিভেদ, সতীদাহ, চিতা, দুর্ণীতি, অন্যায়-অত্যাচার , বোমা
সবই তো সময়ের জন্য, জীবনের জন্য, বংশধরের জন্য । তাহলে এগুলিও কি খাঁটি কথা?
... তারপরে চলে যাই। তারপর সকাল বেলা। হাঁস-মুরগী আর বিচিত্র পাখিদের কলরব।
এই সকাল বেলা আমাকে আজ গরু মনে হচ্ছে।আমি আজ গরু--কালীর স্বপ্না। মনে হচ্ছে,
গোয়াল ঘরে আমি বাছুরটার মুখে স্তন্য চেপে ধরে ভোর হতে হাম্বা হাম্বা করে
ডাকছি। আমি পরোপকারী মহৎ জীব। আমার দায়িত্ব আছে না ? তাইতো ভাঙ্গা বাঁশের
টুকরাটি যা আমার মুখের সামনে, সেটাকে স্পীকার মনে করে হাম্বা হাম্বা করে
নারী মুক্তির জন্য বক্তিতা দিয়ে যাচ্ছি। আমার কথা আমার মত গরু ছাড়া আর কেউ
বুঝে না।সে গরুরা আমার মত কলম দিয়ে দাগ কাটতে পারে--দৌঁড়াতে পারে না
বেশীক্ষণ।
ARNING:
Any unauthorized use or reproduction of 'Community' content
is strictly prohibited and constitutes copyright infringement liable to
legal action.
[প্রথমপাতা] |
লেখকের আগের লেখাঃ
..........[লেখক
আর্কাইভ]
|