আন্তর্জাতিক নারী দিবস ও নারী অধীকার
-সফিউল্লাহ আনসারী-
গত ৮ মার্চ আন্তর্জাতিক নারী দিবস। বিশ্বের
অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও গুরত্বের সাথে পালিত হবে এ দিবসটি। অবশ্য এর
আগে আন্তর্জাতিক কর্মজীবী নারী দিবস হিসেবে পালিত হতো। আর ১৫ অক্টোবর
আন্তর্জাতিক গ্রামীণ নারী দিবস। নারী দিবসের এবারের প্রতিপাদ্য
বিষয়-‘অধীকার মর্যাদায়,নারী-পুরুষ সমানে সমান'।
নারী দিবস মূলত নারী সমাজের পারিবারিক,সামাজিক ও রাষ্ট্রীয়সহ সর্বক্ষেত্রে
তাদের অধীকার এবং সুযোগ-ক্ষমতায়নে পুরুষের সমান অবস্থানকে সমুন্নত রাখার
আন্দোলন। বিশেষ করে পৃথিবীর নারীদের অধিকার কতটুকু অর্জিত হয়েছে এবং নারীরা
কিভাবে,কী কী বৈষম্য ও বাধার সম্মুখীন হচ্ছে, তা মূল্যায়ন করা ও তুলে ধরে
তা থেকে উত্তরণের চেষ্ঠা করা। ভিন্ন আয়োজনে বিশ্বের কোথাও নারীর অধিকার নিয়ে,
কোথাও নারীর সম্মান-মর্যাদা নিয়ে, কোথাও নারীর কর্মের স্বাধীনতা নিয়ে, আবার
কোথাও নারীর অর্থনৈতিক ও সামাজিক-রাজনৈতিক বিষয়গুলোকে প্রাধান্য দেয়া হয়।
স্বীকৃতি খোঁজা হয় জাতীয় কবির সেই অমর কবিতার মতো-পৃথীবিতে যা কিছু চির
কলাণকর,অর্ধেক তার করিয়াছে নারী অর্ধেক তার নর’। সত্যি তাই হয়,হওয়ারও কথা।
অথচ পুরুষ শাসিত সমাজে মৌখিক অধীকার প্রাপ্ত হলেও দু:খজনক হলেও সত্য, নারী
তার স¤পুর্ণ অধীকার আজো সমভাবে পায়নি।
‘আন্তর্জাতিক নারী দিবসের এই দিনটি শুরু হয় ১৮৫৭ সালের ৮ মার্চ মাস থেকে।
সে সময় যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কে একটি সুঁচ কারখানার নারী শ্রমিকরা
কারখানার মানবেতর পরিবেশ তথা কর্মক্ষেত্রে সুস্থ ও স্বাস্থ্যকর পরিবেশ
নিশ্চিত করে অসম মজুরির প্রতিবাদ, দৈনিক শ্রম ১২ ঘণ্টা থেকে কমিয়ে আট
ঘণ্টায় আনা, ন্যায্য মজুরির দাবিতে সোচ্চার হয়েছিলেন। আন্দোলন করার অপরাধে
গ্রেপ্তার হয়ে কারাগারে নির্যাতিত হন অনেক নারী। ঘটনার তিন
বছর পর ১৮৬০ সালের একইদিনে গঠন করা হয় ‘নারী শ্রমিক ইউনিয়ন’। ১৯০৮ সালে
পোশাক ও বস্ত্রশিল্পের কারখানার প্রায় দেড় হাজার নারী শ্রমিক একই দাবিতে
আন্দোলন করেন। অবশেষে আদায় করে নেন দৈনিক আট ঘণ্টা কাজ করার অধিকার। ১৯১০
সালের এই দিনে ডেনমাকের্র কোপেন হেগেনে অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক সমাজতান্ত্রিক
সম্মেলনে জার্মানির নেত্রী ক্লারা জেটকিন ৮ মার্চকে আন্তর্জাতিক নারী দিবস
হিসেবে ঘোষণা করেন।সেই থেকেই বিশ্বের সকল দেশে পালিত হয়ে আসছে আন্তর্জাতিক
নারী দিবস। আর জাতিসংঘ দিনটির গুরুত্ব অনুধাবন করে-১৯৭৫ সালে আন্তর্জাতিক
নারী বর্ষে ৮ মার্চকে আন্তর্জাতিক নারী দিবস হিসেবে পালন করা করে আসছে,যদিও
১৯৭৭ সালে জাতিসংঘ দিনটিকে আনুষ্ঠানিকভাবে আন্তর্জাতিক নারী দিবস হিসেবে
স্বীকৃতি দেয়। বাংলাদেশে ১৯৭১ সালের আগে থেকেই দিবসটি পালিত হতে শুরু করে।
এরই ধারাবাহিকতায় বর্তমানে আমাদের দেশে শিক্ষা,স্বাস্থ্যসহ প্রায়
সর্বক্ষেত্রে নারীদের অগ্রযাত্রা অব্যহত রয়েছে।নারী সমাজ কর্মক্ষেত্রে
বৈষম্যকে গুডবাই জানিয়েছে। সামাজিক বৈষম্য, শোষণ, ধর্ষণ, অপহরণ, এসিড
নিক্ষেপ, যৌন নির্যাতন, নারী পাচার, হত্যাসহ নানা ধরনের নির্যাতনের কবল থেকে
আজও নারীদের মুক্তি পুরোপুরি সম্ভব না হলেও পুরুষ শাষিত সমাজ ব্যবস্থায়
চিন্তার পরিবর্তন ঘটছে,যার সুফল নারী সমাজ ভোগ করছেন। নারী
আন্দোলন,সংগ্রামের ফলে বিশ্বের নারী সমাজের শিক্ষা, স্বাস্থ্য, রাজনীতি ও
অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ অগ্রগতি সাধন করছে। বিশ্ব মানবাধিকার ঘোষণাতেও বলা
হয়েছে, সব মানুষ সমভাবে জন্মগ্রহণ করে এবং জাতি, ধর্ম, বর্ণ, নারী-পুরুষ
নির্বিশেষে রাজনৈতিক অধিকার, ভোট প্রদানের অধিকার ও দফতরে কাজ করার অধিকার
রয়েছে।
আমাদের দেশে রাষ্ট্রীয়ভাবে নারীর সুরক্ষায় রয়েছে আইন। নারী শিশু বিষয়ক
মন্ত্রনালয় সারাবছর নারীদের উন্নয়নে বিভিন্ন কর্মসুচি বাস্তবায়ন ও নারী
নির্যাতন রোধে কাজ করে যাচ্ছে। তারপরও সীমাহীন দুর্ভোগ কেবল নারী ও শিশুর
ভাগ্যেই।পত্রিকার পাতা খুললেই চোখে পড়ে নারী ও শিশু নির্যাতনের মতো জঘন্য
ঘঁনা। যৌতুক প্রথা থেকে আমাদের সমাজ আজো বের হয়ে আসতে পারেনি। বাল্য বিয়ে ও
চাকুরীর নামে আজো নারী নির্যাতনের শিকার হচ্ছে। কর্মক্ষেত্রে বৈষম্যের
শিকারও নারীই ।
নারী শিক্ষার হার বাড়লেও পারিবারিক ও সামাজিক কুসংস্কার ও মেয়ে শিশুকে
গুরুত্ব না দেয়ায় নারীর অবস্থান আশানুরুপ পর্যায়ে পৌঁছতে পারেনি। বিগত
বছরগুলোতে নারী দিবস পালিত হয়েছে,সমতা উন্নয়ন শান্তি, কাবিন ছাড়া বিয়ে নাই,
বিয়ে হলেই কাবিন চাই, নারী নির্যাতন বন্ধ করুন, সুখী জীবন গড়ে তুলুন,শিক্ষা,
প্রশিক্ষণ, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে সমসুযোগ নিশ্চিত করবে নারীর কর্মসংস্থান
ও উন্নয়ন, গ্রামীণ নারীর ক্ষমতায়ন : ক্ষুধা ও দারিদ্র ঘোচাও,এ হোক অঙ্গীকার,
নারী নির্যাতন নয় আর-নারীর তথ্য পাওয়ার অধিকার, ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার
অঙ্গীকার’ এবং এবছর ‘অধীকার মর্যাদায়,নারী-পুরুষ সমানে সমান’ শ্লোগানকে
সামনে রেখে, নারীর সামাজিক সমতা উন্নয়নে পালিত হচ্ছে-আন্তর্জাতিক নারী দিবস।
সত্যিকার অর্থে দিবস পালনের স্বার্থকতা সেখানেই,যেখানে নারী তার প্রাপ্য
সঠিকভাবে পাবে,নারীর মূল্যায়ন সর্বক্ষেত্রে পুরুষের চেয়ে কম হবেনা।
অস্বীকার করার জো নেই-এতোকিছুর পরও বাংলাদেশের নারীরা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই
পুরুষের তুলনায় পিছিয়ে রয়েছে; ঘরে-বাইরে ও শ্রমজীবি নারী কর্মক্ষেত্রে
পুরুষের সমান কাজ করেও মজুরী বৈষম্যের শিকার হচ্ছেন। পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠির
বেশীর ভাগেই নারী। নারীর ক্ষমতায়নেও রয়েছে বৈষম্য। বিশ্বায়নের জাগরন ও
আধুনিকায়নের এ যুগে একজন নারীর ক্রীতদাসের জীবন নিয়ে আমরা কোন ক্ষেত্রেই
একশত ভাগ সফলতা কামনা করতে পারিনা। কারন একজন নারী একজন মানুষও। একজন
নারী-মা,বোন,স্ত্রী,সহকর্মী।আমাদের দেশের প্রধানমন্ত্রী নারী,¯পীকার
নারী,বিরোধী দলের নেত্রী ও বড় দলের প্রধানও নারী। তারপরও নারী সমাজের
দুর্গতি লেগেই আছে। আমাদের পারিবারিক মানুসিকতার পরিবর্তন,সামাজিক
আন্দোলন,নারী স্বাধীনতার বাধা দুর করা,বিশেষ করে চিন্তা-চেতনায় বৈষম্য ও
হিনমণ্যতাকে বিদায় করে একটি সুখী সমৃদ্ধ সমাজ বির্নিমানে নারী-পুরুষ
সমানে-সমান ভেবে এগিয়ে যাওয়া উচিত। নারীর প্রতি সামাজিক আচরণ ও ছোট করে
দেখার দৃষ্টিভঙ্গিই নারীর ক্ষমতায়নের পথে সবচেয়ে বড় অন্তরায়। আর এ অন্তরায়
দুর করতে সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গির পরিবতনের বিকল্প নেই।
উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে বাংলাদেশের মানুষ নীতি-দুর্নীতির পার্থক্যকে
অনেকক্ষেত্রেই গুরুত্ব দিতে সময় নেয়;ভূল করে। যার পরিপ্রেক্ষিতে নারীর
অবস্থান, মর্যাদা ও ক্ষমতায়ন নিয়ে আমাদের নারী আন্দোলনকারীদের নতুন করে
ভাবতে হয়। সেই ভাবনার সূত্র ধরেই এবারের প্রতিপাদ্য ‘অধীকার
মর্যাদায়,নারী-পুরুষ সমানে সমান’শ্লোগানকে ধারন করে নারী অধীকারে সোচ্চার
হই,একজন নারীকে শুধু ভালো বউ, ভালো মেয়ে হিসেবে না চেয়ে,হই নারীর
সহযোদ্ধা-কর্মে-কাজে ও মানবিকতায়।
(লেখাটি-(উইকিপিডিয়া),ইন্টারনেট ও পত্রিকায় প্রকাশিত লেখা থেকে তথ্য নেয়া)
_______________________________________
সফিউল্লাহ আনসারী
সাংবাদিক
|