১০ ডিসেম্বর বিশ্ব মানবাধীকার দিবস
-সফিউল্লাহ আনসারী-
মানবাধীকার বিষয়টি বর্তমান বিশ্বের একটি আলোচিত-সমালোচিত বিষয়।যুগ যুগ ধরে
মানুষ তাদের অধীকারের জন্য আন্দোলন সংগ্রাম করেছে।মানবাধীকারের বিষয়টি সকল
ধর্ম,বর্ণ,জাতী নির্বিশেষে সব পর্যায়ের মানুষের জন্য একটি
অপরিহার্য-গুরুত্বপুর্ণ ও আলোচিত বিষয় হিসেবে পরিগনীত হলেও পৃথিবী জুড়ে আজ
বিপন্ন মানবতা।বিপন্ন নির্যাতিত-নিপিড়িত জনগোষ্ঠির অধীকার আদায়ের জন্য কাজ
করে যাচ্ছে অনেক মানবাধীকার সংগঠন।কোন দেশে যেকোন ঘটনা-দুর্ঘটনার সাথে
সাথেই সোচ্চার হচ্ছে মানবাধীকার কর্মীরা ।
আমরা জানি মানুষ তার মৌলিক অধীকার বা যাকে মানবাধীকার(ঐঁসধহ জরমযঃং) বলে।বিশ্বের
বিভিন্ন প্রান্তে লংঘিত মানবতার পক্ষে-প্রতিবাদ,প্রতিরোধ ও সমস্যা সমাধানে
কাজ করছে মানবাধীকার বিষয়ক বিভিন্ন সংগঠন।অত্যন্ত স্পর্শকাতর এ বিষয়টি
দেশ-কাল পাত্রভেদে মানুষের মৌলিক অধীকার হিসেবে মুল্য পাচ্ছে।কেননা মানুষের
মৌলিক অধীকার যা একজন ব্যাক্তি জন্মগতভাবে পাওনাদার। বর্তমান আধুনিক বিশ্বে
মানবাধীকার বিষয়টি ব্যাপক গবেষনা ও প্রয়োগের প্রাথমিক গুরুত্বের বিষয়।
বিশ্বের উন্নত দেশগুলোর পাশাপাশি বাংলাদেশসহ প্রায় সকল দেশেই মানবাধীকার
সংগঠনগুলো সরকার ও বিরোধীদের মানবতা বিরোধী কার্যকলাপ কিংবা প্রশাসনের লোক
দ্বারা হয়রানী,নারী-শিশু নির্যাতনমুলক বিষয়গুলোকে প্রাধান্য দিয়ে
আলোচনা-সমালোচনার মাধ্যমে প্রতিকারের রুপরেখা প্রণয়নে কাজ ও প্রতিরোধের
ব্যাবস্থা সহ আইনীি সহযোগীতা দিয়ে থাকে। এতে করে বিশেষ করে দরিদ্র শ্রেণীর
মানুষগুলো উপকৃত হয়ে থাকে।
মানবাধীকার প্রসঙ্গে আলোচনার প্রারম্ভে জাতিসংঘ কর্তৃক ঘোষিত সার্ব জনীন
মানবাধীকার ঘোষনার ব্যাপারে জেনে নেবো।
১৯৪৮ সালের ১০ ডিসেম্বর প্যারিসে জাতি সংঘের সাধারণ পরিষদের বৈঠকে
সার্বজনীন মানবাধীকারের ঘোষনা গৃহিত হয়।বলে রাখা প্রয়োজন-সর্ব প্রথম আধুনিক
মানবাধীকারের ধারনার সুত্রপাত অষ্টাদশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে।মানবাধীকার
ধারনার প্রেক্ষিতে১৭৮৯ সালে ফ্্রান্সে ঘোষিত হয়- উবপষধৎধঃরড়হ ড়ভ ঃযব ঢ়বড়ঢ়ষবং
জরমযঃং, তারপর মার্কিন সংবিধানে-ঞযব নরষষ ড়ভ জরমযঃং নামে হয়।এসব সূত্র ধরেই
পরবর্তীতে বিশ্বের অন্যান্য দেশে মানবাধীকারের বিষয়টি সর্ম্পকে চিন্তা-চেতনা
ও সংবিধানে সংযোজিত হতে থাকে।
প্রথম বিশ্ব যুদ্ধের ভয়াবহতা ও ব্যাপক হারে মানুষের উপর জুলুম-নির্যাতন
নিপিড়নসহ বিভিন্নভাবে মানবাধীকার লংগিত হতে থাকে যা দিনকে-দিন বেড়েই চলেছে।এসব
কারনে জাতিসংঘ মানবাধীকার ঘোষনার প্রতি জোর দেয় এবং ১৯৪৮ সালের ১০ ডিসেম্বর
মানবাধীকারের ৩০টি ধারায় ঘোষিত হয় সার্বজনিন মানবাধীকার।
ঘোষনা পত্রের মুখবন্ধে বলা হয়েছে-‘‘যেহেতু জাতি সমুহের মধ্যে বন্ধুত্ব
পুর্ণ সর্ম্পকের উন্নয়নে সহায়তা করা অবশ্যক,যেহেতু জাতী সংঘ ভূক্ত জনগন
সনদের মাধ্যমে মৌল মানবিক অধিকার সমুহ মানুষের মর্যাদা ও মূল্য এবং নারী ও
পুরুষের সমাধীকারের প্রতি আস্থা পুন:ব্যাক্ত করেছে এবং সামাজিক অগ্রগতি ও
ব্যাপকতর স্বাধীনতায় উন্নততর জীবনমান প্রতিষ্ঠাকল্পে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ;যেহেতু
সদস্য রাষ্ট্রসমুহ জাতী সংঘের সহযোগীতায় মানবিক অধিকার ও মৌল স্বাধীকার
সমুহের প্রতি সার্বজনিন শ্রদ্ধা ও মান্যতা বৃদ্ধি অর্জনে
অঙ্গীকারাবদ্ধ;যেহেতু,সকল অধিকার-স্বাধীকারের ব্যাপারে
একটি সাধারণ সমঝোতা উক্ত অঙ্গীকার সম্পুর্ণরুপে আদায় করার জন্য সর্বাপেক্ষা
গুরুত্বপুর্ণ;সুতরাং সাধারণ পরিষদ এক্ষনে জাতী ও জনগোষ্ঠীর অগ্রগতির একটি
সাধারণ মানদন্ড হিসেবে মানবিক অধীকার সমুহের এ সার্বজনিন ঘোঘনাপত্র জারি
করেছে।ঐ লক্ষ্যে প্রত্যেক ব্যাক্তি ও সমাজের প্রত্যেক অঙ্গ ঘোষনা পত্রটিকে
সর্বদা স্বরণ রেখে শিক্ষাদান ও জ্ঞাণ প্রসারের মাধ্যমে এ সকল অধীকার ও
স্বাধীকারের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ জাগ্রত করতে এবং জাতীয় ও আর্ন্তজাতিক পর্যায়ে
প্রগতিশীল ব্যাবস্থাদীর দ¦ারা সদস্য রাষ্ট্র সমুহের জনগন ও তাদের অধীনস্থ
অঞ্চল সমুহের অধীবাসীবৃন্দ উভয়ের মধ্যে ঐ গুলির সার্বজনিন ও কার্যকর
স্বীকৃতি এবং মান্যতা অর্জনের জোর প্রচেষ্ঠা চালাবে’’।
ঘোষনুাপত্রে মানুষের মৌল মানবিক অধীকারের বিষয়ে৩০টি ধারায় এবং একেক ধারায়
অংশগত ধারা সংযোজনের মাধ্যমে জীবনের সকল
পর্র্যায়,রাষ্ট্রীয়-সামজিক,আর্ন্তজাতিকভাবে সকল গুরুত্বপুর্ণ বিষয়ে আলোচনা
করে মানবাধীকারের ঘোষনা করা হয়েছে।
মানবাধীকার ঘোষনার মাধ্যমে এতোকিছুর পরও পরিতাপের বিষয়-আজো মানুষ বিশ্ব জুড়ে
অধীকারহীন,লাঞ্চিত-বঞ্চিত,নির্যাতিত-নিপিড়িত। খেয়ে না খেয়ে যুদ্ধ-বিগ্রহে
সরকার ও অন্যান্য উগ্র জাতী গোষ্ঠির দ্বারা প্রতিনিয়ত মানবাধীকার থেকে
বঞ্চিত হচ্ছে সাধারণ জনগন। বিশ্ব পরাশক্তি রাষ্ট্রগুলো সবচেয়ে বেশী
মানবাধীকার লংঘনের ঘটনায় জাতী সংঘ ঘোষিত এসব ধারা লংঘন করে বৃদ্ধাঙ্গুলি
প্রদর্শন করলেও বিশ্বের জাতীর এ সংস্থাটি তা প্রতিহত করতে পারছেনা।
মানবাধীকার ঘোষনা ও জারি থাকার পরও পৃথীবি ব্যাপি অহরহ হিং¯্রতায়
চলছে-অমানবিক হত্যা যজ্ঞ,যুদ্ধ,হানাহানি,ক্ষমতার বিস্তৃতির নামে সাধারন
মানুষকে হত্যা,উগ্র মৌলবাদী নৃসংস্রতা;চলছে অবৈধ ক্ষমতা দখলবাজদের দ্বারা
বিরোধীদের উপর অমানবিকতা। নিরপরাধ নারী-শিশু নির্যাতনের দৃশ্য দেখে মনে
হয়-দুনিয়ার সর্বত্রই চলছে মানবধীকার লংঘনের মহোৎসব।
জাতি সংঘকে কোন রকম তোয়াক্কা না করেই এমেরিকা,ইসরাইলী হিং¯্রতা ও বিভিন্ন
উগ্র মৌলবাদীদের দ্বারা মধ্য প্রাচ্য সহ বিশ্বজুড়ে চলছে মানুষ হত্যার মতো
অমানবিকতা।ক্ষমতাধর রাষ্ট্রগুলোর পাশাপাশি বিশ্বের অনেক রাষ্ট্রই খেয়াল-খুশি
মত মানুষের অধীকার হরন করছে,চালাচ্ছে গণহত্যা,জবরদখল,অন্যায়ভাবে সন্ত্রাস
নির্মুলের নামে তারা একের পর এক সন্ত্রাসী কর্মকান্ড চালিয়ে মানবাধীকারের
বারোটা বাজিয়ে তাদের অবস্থানে তারা দৃঢ়।বিশ্বের শক্তিধর দেশগুলো বিভিন্ন
সময় অজুহাতে দুর্বল দেশগুলোর উপর অন্যায়ভাবে আক্রমন করে জান-মালের ব্যাপক
ক্ষতি সাধন করে যা মানবাধীকারের চরম লংঘন।ইদানিং ক্ষমতাধর রাষ্ট্রযন্ত্রের
মাধ্যমে যেমন নারী-শিশুসহ অসংখ্য মানুষের অধীকারে আঘাত করে প্রাণ কেড়ে
নিচ্ছে তেমনি সামাজিক অবক্ষয়ের মাধ্যমে বিকৃত মানুষিকতায়ও মানবাধীকার
লংঘনের ঘটনা ঘটছে,যা আধুনিক বিশ্বে কোনমতেই কাম্য নয়।উগ্রবাদীদের লোমহর্ষক
উন্মত্ততায় আজ শিহরিত ও ভীত সন্ত্রস্ত মানবতা।
মধ্যপ্রাচ্যসহ বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলে কায়েমি স্বার্থবাদীরা
অসামাজিক,অর্থনৈতিক,ধর্মীয় ও রাজনৈতিক অগ্রাসনে মানবতাকে পদদলিত করে
মানুষের মৌলিক অধীকারকে খর্ব ও লাঞ্চিত করছে।অনেক ক্ষেত্রে এ সময়ে
মানবাধীকারের বুলি আওড়িয়ে অনেক দেশ ও ধর্মীয় উগ্রবাদীরা হিং¯্রতায় মানবতাকে
সীমাহীন নিপীড়নে অস্থিরতায় ঠেলে দিচ্ছে।
সভ্যতার আড়ালে অসভ্য বর্বরতা ক্রমেই উদ্বেগের কারন হয়ে বিশ্বময় ছড়িয়ে
দিচ্ছে অমানবিকতা। আমাদের দেশেও এর ব্যাতিক্রম নয়। মানবাধীকার লংঘনের মতো
কদাচার আমাদের সমাজেও চলছে।নারী নির্যাতন,ধর্ষন,খুন-খারাবী,রাহাজানি
সর্বত্র্য সন্ত্রাসী কার্যকলাপ ব্যাপক আকার ধারন করেছে।মানবাধীকার লংঘনের
ব্যাপকতা ও অনেকাংশে সরকারের উদাসীনতায় সমাজ বিশারদ-সংস্কারবাদী ও
মানবাধীকার কর্মীরা আগ্রহ হারাচ্ছে।সরকার পরিচালিত মানবাধীকার কমিশন তাদের
কর্মকান্ডে দেশব্যাপী কর্মসুচিতে মানবাধীকার উন্নয়নে কাজ করছে।বর্তমান সময়ে
বৈশ্বিক পরিবর্তন ও সংস্কৃতির পরিবর্তনে পারিবারিক-সামজিকভাবে অত্যাচারিত
হচ্ছে নারী-শিশুসহ সমাজের সাধারণ জনগণ।মিডিয়ার সচেতনতায় এসব
অত্যাচার-অনাচার তুলে আনছে মানবাধীকার লংঘনের মতো ঘটনা।তারপরও সামাজিক
ন্যায় বিচারের অভাব ও অসচেতনায়ও ঘঠছে মানবাধীকার লংঘন ও সঠিক মৌল-মানবিক
অধীকার ভোগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে সাধারন জনগন-এক্ষেত্রে জনগনের অজ্ঞতা ও
ক্ষমতাধরদের অগ্রাসীনীতি অনেকটা দায়ী।এছাড়াও সমাজবিশারদদের মতে-সামাজের
সর্বস্তরে হানাহানি,বৈরী মনোভাব,ক্ষমতার অপব্যবহার,আইন প্রয়োগকারী সংস্থার
সদস্যদের অত্যাচার ও আমাদের অর্থনৈতিক দুর্বলতা এই দেশের অতীত ও বর্তমান
সময়ে মানবাধীকার লংঘনের মতো নিত্য-নৈমিত্তিক ব্যাপার হয়ে দাড়িয়েছে।বিভিন্ন
সময় সরকার পরিবর্তন হলেও আশাতীতভাবে সাধারণ মানুষের ভাগ্য তথা মৌলিক
অধীকারের খুব বেশী পরিবর্তন আজো সময়ের ব্যাপার হয়েই আছে।আমাদের দেশ
তথ্যপ্রযুক্তিতে ব্যাপক এগিয়েছে।তার সাথে মানুষের জীবনযাত্রার মানও
বেড়েছে।ব্যাক্তি চিন্তার বিকাশ ও ব্যাক্তি স্বাধীনতার বিকাশে সামাজিক
সচেতনতার অভাবও স্বার্থন্বেসী মহলের ব্যাক্তিকেন্দ্রিক চিন্তার কুফল হিসেবে
অধীকার বঞ্চিত বিশাল জনগোষ্ঠী আজো দারিদ্রতার নির্মম কষাঘাতে পেষিত হচ্ছে
যুগ-যুগ ধরেই।
মানবাধীকার সুরক্ষায় বর্তমান সময়ে সবচেয়ে দরকার সামাজিক ব্যাধী
নির্মুল,সমাজের সর্বস্তরে জনসচেতনতা বৃদ্ধি,মানবতার সার্বিক কল্যাণে সরকার
,বিশ্ব সংস্থা ও ব্যাক্তি পর্যায়ে সহযোগীতা-সহমর্মীতামুলক সহাবস্থানে
আন্তরিকতা। মানবাধীকার লংঘনের মতো চরম ভয়াবহ অবস্থা থেকে আমাদের মুক্তির
পথনির্দেশনায় প্রয়োজন-বিশ্ব
শান্তি,জাতীগত-শ্রেণীগত,ধর্মীয়-রাজনৈতিক,সামাজিক ও সাংস্কৃতিক
ঐক্য।এক্ষেত্রে সংকীর্ণ মনোভাবের পরিবর্তন করে মানবিক সৌহার্দ্যপুর্ণ আচরন
ও আইনের শাসনের যথাযথ প্রয়োগের কোন বিকল্প নেই। বর্তমান উত্তাল
মধ্যপ্রাচ্যসহ বিশ্ব পরিস্থিতির আলোকে যথাযথ মুল্যায়নে জাতী সংঘের দূঢ়
অবস্থান থেকে বিশ্ব ব্যাপি সমাধীকার ভিত্তিতে মানবাধীকার সনদের প্রয়োগ আজ
প্রত্যেকটা জীবন ও সময়ের অপরিহার্য দাবী।
মানবতার চরম অবমূল্যায়ন ও উদ্বীগ্ন বিশ্ববাসীর চরম দুর্দিনে বিশ্ব
নেতৃবৃন্দ ও মানবাধীকার সংগঠনগুলোর প্রতিকারমুলক ব্যাবস্থা গ্রহন ও
ধর্মীয়-জাতীগত বৈষম্য দুর করে বিশ্ব শান্তি ফিরিয়ে আনা অতীব জরুরী হয়ে
পড়েছে যা অস্বীকার করার মতো নয়।বিশ্ব মানবাধীকার দিবসে আমাদের
প্রত্যাশা-বিশ্ব অশান্তির এ পরিবেশ থেকে মানবতাকে রক্ষায় রাজনৈতিক,ধর্মীয়
নেতৃবৃন্দ,বিশ্ব সংস্থাগুলোর ঐক্যের মাধ্যমে মানবতার মৌলিক বিকাশ,মানবিক
অধীকার সচেতনতার জাগরণ,স্বাধীনতা-স্বাধীকারের প্রতি
শ্রদ্ধাবোধ,সমঝোতা-সহিঞ্চুতায় সকল জাতী-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে বন্ধুত্বপুর্ণ
সম্পর্ক উন্নয়নে সকলের অংশগ্রহন নিশ্চিত করে বিশ্ব শান্তির রোডম্যাপ তৈরী
করে মানবাধীকার রক্ষা করা।
_______________________________________
সফিউল্লাহ আনসারী
(শিক্ষক-সাংবাদিক-কবি)
|