হেপাটাইটিস ইংরেজি শব্দ,
যার বাংলা অর্থ লিভার
বা যকৃতের প্রদাহ। এই
প্রদাহ যখন হেপাটাইটিস-বি
ভাইরাস দ্বারা আক্রান্ত
হয় তখন বলা হয়
হেপাটাইটিস-বি। এই রোগটি
সাধারণত যৌনমিলন,
আক্রান্ত রোগীর রক্ত
শরীরে গেলে, ব্যবহৃত
সিরিঞ্জ ব্যবহার করলে,
অশুদ্ধ পানি বা খাবারের
দ্বারাও সংক্রমিত হতে
পারে।
রোগের লক্ষণ ও
উপসর্গ
হেপাটাইটিস-বি এমন একটি
রোগ যা তেমন কোনো লক্ষণ
প্রকাশ না করে শরীরে
চুপ মেরে থাকতে পারে।
বুকের ডান পাশে হালকা
ব্যথা হতে পারে। অজীর্ণ
বা বদহজমের ভাব এমনকি
আলসারের মতো উপসর্গও
দেখা দিতে পারে। যখন
রোগীর লিভার বা যকৃৎ
অনেকটাই ধ্বংস হয়ে যায়
তখন রক্ত পরীক্ষা করলে
বোঝা যায় শিরায়
বিলিরুবিনের মাত্রা
অর্থাৎ জন্ডিস কতটা ও
হেপাটাইটিস-বি ভাইরাস
আছে কি না, অর্থাৎ
এইচবিএসএজি পজিটিভ কি
না।
জটিলতা
হেপাটাইটিস-বি ভাইরাস
সংক্রমণে লিভারের
কোষগুলো তার স্বাভাবিক
কর্মক্ষমতা হারিয়ে
ফেলতে থাকে। এ পর্যায়ে
লিভারের প্রায় সব কোষই
নষ্ট হয়ে যায়। এক
পর্যায়ে লিভার সংকুচিত
হয়ে ছোট হয়ে যায়। এ
অবস্থাকেই বলা হয়
সিরোসিস অব লিভার।
তাছাড়া লিভার
ক্যান্সারও এই রোগের
অন্যতম প্রধান জটিলতা।
অন্যান্য জটিলতার মধ্যে
রয়েছে বিভিন্ন রকম
আর্থ্রাইটিস ও কিডনির
সমস্যা। হেপাটাইটিস-বি
হওয়ার পর একজন রোগীর
দেহে অ্যান্টিবডি তৈরি
হয়ে সে নিজে সক্রিয়
জন্ডিস থেকে সের উঠতে
পারে। আবার রোগের
উপসর্গ প্রদর্শন না
করেও এ রোগের বাহক
হিসেবে কেউ কেউ অনেক
দিন পর্যন্ত বেঁচে থাকতে
পারে।
যা করনীয়
ভাইরাস হেপাটাইটিস
চিকিৎসায় ওষুধের কোনো
ভূমিকা নেই বললেই চলে।
বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই
রোগীর বা রোগীর
আত্মীয়-স্বজনের মন
রক্ষা করার জন্য
চিকিৎসকরা ভিটামিন
জাতীয় কিছু ওষুধ দেন,
যা শরীরে কোনো ক্ষতি করে
না। আবার রোগও সারায়
না। তবে হেপাটাইটিস-এ
ভাইরাসে আক্রান্ত রোগীকে
সম্পূর্ণ বিশ্রামে রেখে
ওষুধ না খাওয়ালেও রোগটি
নিজে থেকেই সেরে যায়।
শুধু লক্ষ রাখতে হবে
খাওয়ার পানি যাতে
অবশ্যই ভালো করে ফোটানো
হয় এবং খাবারটা হয়
টাটকা।
• এ সময় রোগীকে যা
খাওয়ানো যাবে তা হলো
ভাত, রুটি, সুজি, বার্লি,
শাক-সবজি, গ্লুকোজ,
মাখন তোলা দুধ, ছানা,
চর্বিহীন মাছ। তবে মাখন,
ঘি, চর্বিজাতীয় খাবার
একেবারে বাদ। তবে রোগীকে
বেশি করে পানি খাওয়ানো
প্রয়োজন।
• হেপাটইটিস-এ আক্রান্ত
হলে শিশুদেরও বিশ্রামে
রাখুন। এ কথাও সত্য শিশু
মাত্র দৌড়ঝাঁপ করবে।
এক্ষেত্রে শিশুর যদি
রক্তের শিরায়
বিলিরুবিনের মাত্রা খুব
বেশি না হয় তাহলে
স্বাভাবিকই রাখুন।
• বাড়িতে কারো এটা হলে
অন্যদেরকেও সাবধানে
রাখুন। রোগীর
ব্যবহারসামগ্রী বা
বাসনপত্র আলাদা করে দিলে
সংক্রমণের আশঙ্কা কম
থাকে।
• হেপাটাইটিস-বি ভাইরাসে
আক্রান্ত রোগীদের জন্যও
একটি ব্যবস্থা নিতে হবে।
তবে অ্যাক্টিভ
সংক্রমণের রোগীকে
সম্পূর্ণ আলাদা রেখে
পুরোপুরি বিশ্রাম,
প্রচুর তরল খাদ্য,
বিশেষত গ্লুকোজ, ফলের
রস ও সহজপাচ্য অন্যান্য
খাবার খাওয়াতে হয়।
• রোগী যদি একেবারেই
খেতে না পারে সে
ক্ষেত্রে স্যালাইনের
মাধ্যমে তার প্রয়োজনীয়
পুষ্টি মেটানো হবে। এ
ধরনের রোগীর ক্ষেত্রে
অবশ্যই একজন অভিজ্ঞ
চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে
হবে।
প্রতিরোধ
ভাইরাসজনিত হেপাটাইটিস
রোগ প্রতিরোধ করতে হলে
যা করণীয় তা হলো
• যেখানে সেখানে পানি
পান করবেন না। খোলা
খাবার খাবেন না। খাবার
পানি অন্তত ৩০ মিনিট ধরে
টগবগ করে ফুটিয়ে ঠাণ্ডা
করে তবেই পান করবেন।
ক্লোরিনেশন বা পানি
বিশুদ্ধকরণ বড়িতে এসব
ভাইরাস ধ্বংস হয় না।
গ্রামে-গঞ্জে
টিউবওয়েলের পানি পান
করবেন।
• নালা-নর্দমার পানি
যাতে কোনোক্রমেই
খাওয়ার পানির সঙ্গে না
মিশতে পারে সেদিকে লক্ষ
রাখতে হবে। যেখানে
সেখানে মলত্যাগ করা
বন্ধ করতে হবে।
• রক্ত সঞ্চালনের
ব্যাপারেও যথেষ্ট
সাবধানতা অবলম্বন করতে
হবে। সিরিঞ্জ ব্যবহারের
প্রয়োজন হলে সব সময়ই
তা ডিসপোজেবল হওয়া
উচিত।
• হাত-পায়ে ক্ষত নিয়ে
কোনো ব্যক্তি
হেপাটাইটিস-বি তে
আক্রান্ত রোগীর
সেবা-যত্ন মোটেই করবেন
না। খুব প্রয়োজন হলে
হাতে গ্লাভস পরে নেয়া
ভালো।
• তাছাড়া অবাধ
মেলামেশাও পরিহার করতে
হবে। মনে রাখবেন রোগ
প্রতিকারের চেয়ে
প্রতিরোধই শ্রেয়।
• হেপাটাইটিস-এ অর্থাৎ
ইনফেকটিভ হেপাটাইটিসের
ক্ষেত্রে প্রতিরোধের
কোনো প্রতিষেধক টিকা
এখনো আবিষ্কৃত হয়নি।
তবে সবচেয়ে মারাত্মক
সংক্রামক ব্যাধি
হেপাটাইটিস-বি-র
প্রতিষেধক টিকা বর্তমানে
পাওয়া যায়। এই
প্রতিষেধক টিকা নিয়ে
প্রাণঘাতী হেপাটাইটিস-বি
রোগ থেকে রেহাই পাওয়া
সম্ভব।
• নবজাতক থেকে শুরু করে
শিশু, কিশোর,
পূর্ণবয়স্ক সবাইকে এই
টিকা দেয়া যায়। তবে
যাদের এইচবিএসএজি
পজিটিভ তাদের এ
প্রতিষেধক টিকা দেয়া
হয় না। তার এইচবিএসএজি
পজিটিভ কিনা তা জানা
যায় রক্ত পরীক্ষা করে।
তাই টিকা দেয়ার পূর্বে
চিকিৎসকের পরামর্শ
অনুযায়ী ভালো কোনো
ল্যাবরেটরি থেকে রক্ত
পরীক্ষা করে জেনে নিন
আপনার বা আপনার
পরিবারের সদস্যদের
এইচবিএসএজি পজিটিভ কি
না।
• আর প্রতিষেধক টিকায়
যদি কারো অ্যালার্জি বা
হাইপারসেন্সিটিভিটি থাকে
সে ক্ষেত্রে চিকিৎসকের
পরামর্শ নিন।
• প্রাথমিক প্রতিষেধক
হিসেবে তিনটি ডোজ নিতে
হয়। এ তিনটি ডোজ
নেয়ার নিয়ম (০, ১, ৬
সিডিউল): প্রথম ডোজটি
যেদিন নেয়া হবে তার এক
মাস পর দ্বিতীয়টি এবং
তৃতীয়টি নিতে হবে
প্রথম ডোজ নেয়ার দিন
থেকে ৬ মাস পর।
প্রাথমিক কোর্স সম্পন্ন
করার ৫ বছর পর
বুস্টারের এক ডোজ নেয়া
যেতে পারে। তবে
এক্ষেত্রে চিকিৎসকের
পরামর্শ নিতে হবে।
• উপরোক্ত সিডিউল (০,
১, ৬) ছাড়াও আরেক
সিডিউলে টিকা নেয়া যায়।
এক্ষেত্রে প্রথম ডোজটি
যে দিন নেয়া হবে তার
এক মাস পর দ্বিতীয় এবং
তৃতীয়টি নিতে হবে
প্রথম ডোজ নেয়ার দিন
থেকে দুই মাস পর। এই
সিডিউলে পরপর তিন মাসে
তিনটি টিকা নিলে সে
ক্ষেত্রে প্রথম ডোজ
নেয়ার দিন থেকে ১২ মাস
পর একটি বুস্টার টিকা
নিতে হয়। এ বুস্টার
নেয়ার ৮ বছরের মধ্যে
আর দ্বিতীয় বুস্টার
নেয়ার প্রয়োজন হয়
না। তবে কোন সিডিউলটি
আপনার ও আপনার পরিবারের
সদস্যদের ক্ষেত্রে
প্রযোজ্য হবে তা
চিকিৎসকই নির্ধারণ করে
দেবেন।