প্রথমপাতা  

সাম্প্রতিক সংবাদ 

 স্বদেশ

আন্তর্জাতিক

বাংলাদেশ কমিউনিটি

লাইফ স্টাইল

 এক্সক্লুসিভ

বিনোদন

স্বাস্থ্য

বর্তমানের কথামালা

 শিল্প-সাহিত্য

 প্রবাসপঞ্জী 

আর্কাইভ

যোগাযোগ

 

 

 

 

 

বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত আত্নজীবনী
 
 

অসমাপ্ত আত্নজীবনী
-শেখ মুজিবুর রহমান

প্রথম প্রকাশঃ ২০১২
প্রচ্ছদঃ সমর মজুমদার
পৃষ্ঠাঃ ৩২৪
মূল্যঃ ৫২৫ টাকা
দি ইউনিভার্সিটি প্রেস লিমিটেড
৬১, মতিঝিল বাণিজ্যিক এলাকা, ঢাকা-১০০০।

বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাসের অজানা সত্য প্রকাশিত হলো ২০১১ খ্রিস্টাব্দে। গেল দশকের ঘটনাবহুল টালমাটাল রাজনৈতিক পরিস্থিতির অন্ধকারের মধ্যে ২০০৪ খ্রিঃ যে অতখানি ইতাহাসে আলো ছড়াবে, কেইবা ভেবেছিল? সত্যিই বোমা ফাটানোর মতই ঘটনা। ২০০৪ খ্রিস্টাব্দে গ্রেনেড হামলা থেকে বেঁচে যখন বঙ্গবন্ধু তনয়া শেখ হাসিনা অনেকটা মনোবল হারিয়ে ফেলেছেন তখনই হাতে পান পিতার স্বহস্তে লেখা চারটি খাতা-যা ভূমিকায় শেখ হাসিনা লিখেছেন। হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি, বাঙালি ও বাংলাদেশিদের আশা-আকাঙ্খার প্রতীক, বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের অবিসংবাদিত নেতা শেখ মুজিবুর রহমান (১৯২০-১৯৭৫)। তাঁর শৈশব, ঘটনাবহুল রাজনৈতিক জীবন, আওয়ামীলীগ গঠন ও বাংলাদেশ অভ্যুদয়ের জন্য উতসর্গীকৃত জীবনের ইতিহাস নিজ হাতে ঢাকা জেলে রাজনৈতিক বন্দি হিসেবে অন্তরীণ থাকা অবস্থায় লিখে যান। যা বাংলাদেশের ইতিহাসে এক প্রামাণ্য দলিল হিসেবে নয় বারং দেশি-বিদেশি ইতিহাস গবেষণায় এক অক্ষয় কীর্তি হয়ে থাকবে। বাংলা ভাষার পাশাপাশি ইংরেজি ও সম্প্রতি জাপানি ভাষায় বইটির অনুবাদ প্রকাশিত হয়েছে। একজন পাঠক হিসেবে আমি মনে করি বইটি পাঠে শুধু ইতিহাস উদ্ধারই নয় বরং পাঠকের আত্নসচেতনতা, জাতীয়তাবোধ, দৃঢ়চেতা ও মানব প্রেমিক হতে উদ্বোদ্ধ করবে। ৫২ ভাষা আন্দোলনে যারা বঙ্গবন্ধুকে অস্বীকার করতে চান কিংবা যারা অপরাপর সবাইকে ছাপিয়ে তাঁকে ভাষা আন্দোলনের একক নায়ক ভাবতে চান তাদের জন্যও অসমাপ্ত আত্নজীবনী একটি প্রামাণ্য দলিল।

তিনি যে কতটা বড় মাপের ও মনের মানুষ ছিলেন তার পরিচয় বইটির শুরুতেই পাওয়া যায়। বইটির শুরু করেছেন এভাবে, “বন্ধু-বান্ধব বলে, তোমার জীবনী লেখ। সহকর্মীরা বলে, রাজনৈতিক জীবনের ঘটনাগুলো লিখে রাখ, ভবিষ্যতে কাজে লাগবে। আমার সহধর্মী একদিন জেলগেটে বসে বলল, বসেই তো আছ, লেখ তোমার জীবনের কাহিনী। বললাম, লিখতে যে পারি না; আর এমন কী করেছি যা লেখা যায়! আমার জীবনের ঘটনা গুলো জেনে জনসাধারণের কি কোন কাজে লাগব? কিছুই তো করতে পারলাম না......। মহৎ মানুষ বোধকরি এমনই বিনয়ী হয়। তিনি যে শুধু দেশকেই ভালবাসতেন তা নয়, দেশের মানুষের প্রতিও ছিল তার প্রগাঢ় ভালবাসা। গোপালগঞ্জের ৫৪ খ্রিস্টাব্দের যুক্তফ্রন্টের নির্বাচনি প্রচারে এক বৃদ্ধ মহিলার তার প্রতি ভালবাস এবং এক পর্যায়ে বঙ্গবন্ধুর অশ্রুসিক্ত নয়নে মনে মনে যে প্রতিজ্ঞা করেছিলেন তাতে তার মানুষের প্রতি ভালবাসা ফুটে উঠে। সেই পরিস্থিতির বর্ণনায় তিনি বলেন, “নীরবে আমার চক্ষু দিয়ে দুই ফোঁটা পানি গড়িয়ে পড়েছিল, যখন তার বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসি। সেইদিনই আমি মনে মনে প্রতিজ্ঞা করেছিলাম, ‘মানুষেরে ধোঁকা আমি দিতে পারব না (পৃঃ ২৫৬)।‘ হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গার সময় শুধু মুসলিমদের পক্ষই নেননি। হিন্দুদেরকেও সাধ্যমত দাঙ্গা থেকে বাঁচিয়েছেন। আদমজির বাঙ্গালি-অবাঙালিদের দাঙ্গায় জীবনের ঝুঁকি নিয়ে মিলের ভিতরে প্রবেশ করে দাঙ্গাকারীদের শান্ত করেছেন এবং কয়েকজন পুলিশ ও মোহন মিয়াকে সঙ্গে নিয়ে প্রায় তিনশত আহত লোককে হাসপাতেলে পাঠিয়েছিলেন। বিহার দাঙ্গায় অক্লান্ত ভাবে যেচ্ছাসেবী হিসেবে পড়াশুনা রেখে ত্রাণকাজে যোগ দিয়েছেন। তিনি ছিলেন অসাম্প্রদায়িক। তাইতো হিন্দু সহপাঠীদের বাড়িতে অপমানিত হয়েও হিন্দু বন্ধু ননীকুমার দাসকে নিজের বাড়িতে ঢুকার ব্যপারে কোন রূপ বাঁধা-নিষেধ রাখেননি। ঘটনার বর্ণনায় তিনি বলেছেন, “ননী আমাকে বলল, তুই আর আমাদের বাসায় যাস না। কারণ তুই চলে আসার পরে কাকীমা আমাকে খুব বকেছে তোকে ঘরে আনার জন্য এবং সমস্ত ঘর আবার পরিস্কার করেছ পানি দিয়ে ও আমাকেও ঘর ধুতে বাধ্য করেছে। বলালাম, ‘যাব না, তুই আসিস (পৃঃ ২৩)।’ ৪৭ এর দেশ বিভাগের পরও তাইতো দেশ ছেড়ে যাওয়া লোকদের ফেরাতে আপ্রাণ চেষ্টা করে গেছেন। এমকি কলকাতায় শহিদ সহরোয়ার্দীর সরনাপন্ন হয়েছেন। তিনি যে সত্যিকারের এক অসাম্প্রদায়িক চেতনায় বিশ্বাসী তার প্রমাণ আর একবার পাওয়া যায় আওয়ামী মুসলিমলীগ থেকে মুসলিম শব্দটি বাদ লিয়ে আওয়ামীলীগ গঠনের মাধ্যমে।

সাহিত্যিক না হয়েও তাঁর শৈশব থেকে ছাত্র জীবনের নানা বাঁকে রাজনৈতিক চর্চা, বিহার দাঙ্গা, ৪৩’র দুর্ভিক্ষ, ৪৭’র দেশ ভাগ, আওয়ামীলীগ গঠন এবং লালকেল্লা ও তাজমহল দর্শন, চীন সফর ও পশ্চিম পাকিস্তান সফরের বর্ণনায় মুন্সিয়ানার পরিচয় দিয়েছেন। ব্রিটিশ শাসন থেকে শুরু করে, পাকিস্তান সৃষ্টি ও নতুন রাজনৈতিক মেরুকরণ এবং পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালিদের সাথে অধিকার ও প্রাপ্তির প্রশ্নে যে অন্যায় আচরণ করা হয়েছে তা সুচারুভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন। রাজনৈতিক জীবনে গান্ধীজী থেকে শুরু করে, হোসেন শহিদ সোহরাওয়ার্দী, পীর মানকি, মাওলানা আকরম খাঁসহ পশ্চিম পাকিস্তানের নেতৃবৃন্দ, এ কে ফজলুল হক, মাওলানা ভাষানী, শামসুল হক, মানিক মিয়াসহ রাজনৈতিক ব্যাক্তিবর্গের সাথে অন্তরঙ্গতা ও মতের মিল-অমিল সবিস্তারে উঠে এসেছে তার এই গ্রন্থে। ছাত্র রাজনীতির সময় থেকেই তার রাজনৈতিক প্রজ্ঞার পরিচয় পাওয়া যায়। সিদ্ধান্ত গ্রহণে তার দৃঢ়তা ও প্রজ্ঞা এতটাই দূরদর্শী ছিল যে তৎকালীন ঝানু নেতৃবৃন্দেরও প্রশংসা কুড়াতো। হোসেন শহিদ সাহেব গোলাম মোহাম্মদ আলীর আইনমন্ত্রী হওয়া ও তার পরিণতি তিনি কতটা অনুধাবন করতে পেরেছিলেন সেটা জানা না গেলেও শেখ মুজিব যে আদ্যপান্ত সইব অনুধানব করতে পেরেছিলেন তার বর্ণনা শহিস সাহেবের সাথে সাক্ষাত পর্বেই বুঝা যায়। তার বর্ণনায় তিনি বলেছেন, “পূর্ব বাংলায় যেয়ে সকলের সাথে পরামর্শ করে অন্য কাউকেও তো মন্ত্রিত্ব দিতে পারতেন। আমার মনে হয় আপনাকে ট্র্যাপ করেছে (পৃঃ ২৮৬)।“ গান্ধীজিকে হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গায় সহকর্মী মিস্টার ইয়াকুবের তোলা ছবি কৌশলে উপহার দেয়া তার দূরদর্শী প্রজ্ঞাকেই সমর্থন করে। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর ছয় দফা দাবী উত্থাপন তার রাজনৈতিক প্রজ্ঞারই প্রতিফলন।

বইটি পড়ে তিনি যে কতটা সৎ ছিলেন তার প্রমাণ পাওয়া যায়। শুধু দেশ প্রেমের প্রশ্নেই নয়, যে কোন অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে দিয়ে তিনি ছাত্রজীবনে যে মারামারি পর্যন্ত করেছেন সে কথাও অকপটে কৃত্রিমতা বর্জিত ভাবে স্বীকার করেছেন। অথচ চাইলে নিঃসংকোচে তিনি তা গোপন করে যেতে পারতেন। তার বর্ণনায় লিখেছেন, “আমার একটা দল ছিল। কেউ কিছু বললে আর রক্ষা ছিল না। মারপিট করতাম (পৃঃ ১০)।“ রাজনৈতিক পথ-মতের পার্থক্য থাকবেই। গণতান্ত্রিক রাজনীতির এ এক সৌন্দর্য। তা বঙ্গবন্ধু জীবদ্দশায় চর্চা করে গেছেন। তাইতো বিরোধী রাজনীতিকদের সাথে সম্মানের সাথে কথা বলেছেন এমনকী অনৈতিক ভাবে ভোট কেনা বেচার মাধ্যমে প্রাদেশিক সরকারের নির্বাচনে হেরে গিয়ে তাদের সমালোচনা করলেও অপামান-অপদস্ত হয় এমন কিছু করেননি। এমনকি তাদের নাম পর্যন্ত গোপন রেখেছেন। তিনি তার আত্নজীবনীতে যে সুরুচিবোধের পরিচয় দিয়েছেন, অগ্রজ রাজনীতিবীদদের প্রতি যে শ্রদ্ধাবোধ দেখিয়েছেন দেখিয়েছেন তা যুগে যুগে অনুকরনীয়।

বইটির নাম “অসমাপ্ত আত্নজীবনী” প্রায়োগিক অর্থেই যথার্থ হয়েছে। একদিকে দিয়ে বইটি তিনি শেষ করে যেতে পারেননি অন্য দিক ভাবতে গেলে স্বাধীন বাংলাদেশের জাতি গঠনের কাজও তিনি শেষ করে যেতে পারেননি। তার আগেই ১৯৭৫ খ্রিস্টাব্দের ১৫ আগস্ট সেনাবাহিনীর কতিপয় উচ্চাভিলাসী বিপথগামী সদস্যের হাতে নির্মম ভাবে নিহত হত। সেই অর্থে বইটির নাম যথার্থ হয়েছে এবং বহুমাত্রিকতা পেয়েছে। বইটিতে তিনি বাঙালি জাতিকে পরশ্রিকাতর ও বিশ্বাসঘাতক বলে উল্লেখ করেছেন (পৃঃ ৪৭)। রাগে ক্ষোভে এমনটি হয়তো করেছেন। কিন্তু আত্নজীবনীতে এমন করে বিষোৎগার না করলেও পারতেন। এছাড়াও বিভিন্ন আঞ্চললে সফরের সময় নেতা-কর্মীদের সাথে কথোপকথনের বর্ণনা আঞ্চলিক ভাষায় বিধৃত হলে সাহিত্যিক গ্রহণযোগ্যতা আরও বাড়তো। সর্বোপরি গ্রন্থটি শুধু শেখ মুজিবের আত্নজীবনী হয়েই থাকবে না, যতদিন বাংলাদেশ থাকবে ততদিন বাংলাদেশ অভ্যুদয় ও এ অঞ্চলের মানুষের জাতিসত্তার আত্নপরিচয়ের একটা আত্নজীবনী হয়ে থাকবে।

 

–আকাশ মামুন
 


 

 

ARNING: Any unauthorized use or reproduction of 'Community' content is strictly prohibited and constitutes copyright infringement liable to legal action. 

[প্রথমপাতা]

 

 

 

লেখকের আগের লেখাঃ