[প্রথমপাতা]

 

 

 

কবি আহসান হাবীবের কাব্যজ উদারতা

 
মম চৌধুরী


বাবার কবিতার পাশে৷ লেখাটি কবিপুত্র মঈনুল আহসান সাবেরের৷ যিনি কবি বাবার পথ ধরে কবিতার ঠিকানা না খুঁজলেও নির্মান করেছেন ভিন্নতর স্থান৷ এই স্থান সাহিত্যের অনন্য আরেকটি শাখা৷ গল্প লিখে অনবদ্য আলোয় আলোকিত হয়েছেন আমাদের আগামী গড়া অনন্যজন মঈনুল আহসান সাবের৷ একটি লেখায় তিনি তার বাবার কথা বলেছেন এভাবে যে, 'এই কিছুদিন আগে আমার ছোট ছেলে তাদের ভার্সিটির ইংলিশ ক্লাবের কবিতা প্রতিযোগিতায় ৫ হাজার টাকা পুরস্কার পেয়ে একই সঙ্গে খুশি ও 'এ আর এমন কী' ভাব নিয়ে যখন বাড়ি ফিরল, আমি খুশি হলাম৷ প্রতিযোগিতায় বসে তাত্‍ক্ষণিকভাবে লেখা কবিতাটা পড়ে আনন্দ বাড়ল, ভালো কবিতা৷ মনে হলো, কবি হিসেবে ও আগের তুলনায় বেশ এগিয়েছে৷ তবে আমি যত না খুশি, ছেলের মা খুশি তার চেয়ে বেশি৷ তার খুশি দেখে একবার মনে হলো, বলিথ 'স্মারক-চেকটা কি বাইরের দরজায় ঝুলিয়ে রাখবি?' বললাম না, কেয়া এমনিতেই আমার নানা খোঁচাখুঁচিতে ২৪ ঘণ্টা অতিষ্ঠ৷ এই খুশি খুশি অবস্থার মধ্যে আমার আব্বার কথা মনে পড়ল৷ কবি আহসান হাবীব যদি দেখতেন তার নাতি ভালো কবিতা লিখছে, তার আনন্দ অন্যরকম হতো৷ আমরা ৪ ভাইবোন৷ বড় বোন অভিনয় আর আবৃত্তিতে গেলেন, ছোট বোনের গানের গলা ছিল অসাধারণ, কাজে লাগালেন না৷ তা আমি কেন কবিতা লিখলাম না? ছোটবেলার একটা ঘটনা বলি, আব্বা রবীন্দ্রনাথের একটা কবিতা দেখে দেখে লিখতে বললেন আমাকে, আমার ৪ বছরের ছোট ভাইকেও৷ লিখে জমা দিলাম৷ দেখা গেল, দেখে-দেখে লিখেও আমি কয়েকটা ভুল করেছি৷ আমার ছোট ভাই একটাও করেনি৷ আব্বা মুচকি হেসে, বাড়ির সবার সামনে জানিয়ে দিলেন, আমার ছন্দের কান নেই, ছোট ভাইয়ের আছে৷ সেই দুঃখেই কি আমি কবিতায় গেলাম না? পারব না বলে? ব্যাপারটা সে রকম না৷ আমি আমার শৈশব-কৈশোরে কবিতার প্রতি কোনো আগ্রহ বোধ করিনি৷ কবিতা পড়তাম না, পড়তাম গদ্য, গল্প-উপন্যাস৷ যখন লেখার চেষ্টা করলাম, গল্পই লিখলাম, ভুলেও কবিতা না৷ কবিতা অনেক পরে কয়েকটা লিখেছি৷ কেউ বলছে, 'কবিতাই লেখা উচিত' রফিক আজাদ একবার বলেছিলেন, এক কবিতা পড়ে, 'বেটা কবিতা লিখো না, অনেকের ভাত মারা যাবে৷ দরকার কী৷' তবু কবিতার প্রতি আমার পক্ষপাত তৈরি হয়নি৷ কবিতা লিখতে পারত আমার ছোট ভাই৷ আহসান জাবের নামে ছড়া দিয়ে শুরু করেছিল, ইচ্ছাটা তীব্র ছিল না সম্ভবত৷ তারপর গত ৩৩ বছর ধরে প্রবাস জীবনই তার কাছে অর্থময়৷ বাকি থাকল আমার বড় ছেলে, ছোট ভাইয়ের বড় মেয়ে৷ তারা দু'জনই গদ্য লেখে৷ এমন একটা কথা প্রায়ই মনে হতো, আব্বার পথে কি তবে কেউ হাঁটবে না? আব্বার কবিতার পথে হাঁটার শুরু সেই কবে! তখন নাম শুধুই 'হাবিব', এক সময় নিজেই সেটা বদলে করলেন আহসান হাবীব৷ মানুষটা কতটা আধুনিক ছিলেন, এই নামকরণ থেকে বোঝা যায়৷ আজ থেকে ৭০ বছরেরও বেশি সময় আগে ছোট, অনুন্নত গ্রামের এক মুসলমান তরুণ পিতার দেওয়া হাবীবুর রহমান পাল্টে রাখছেন আহসান হাবীব, বোঝা যায় রুচি ও সি্নগ্ধতা কোন মাত্রায় বাঁধা ছিল৷ এই সি্নগ্ধ ও রুচিবান কবির কবিতা আমি প্রথম কবে পড়ি, আমার মনে নেই৷ তবে তার কবিতা আমার প্রথম পাঠ অবশ্যই পাঠ্যপুস্তক৷ এর আগে, নিশ্চয় তার ছড়া পড়েছি, পত্রিকায়৷ তবে সেটা যত না উত্তেজনার ব্যাপার ছিল, পত্রিকায় বাবার ছড়া পড়ছিথ ব্যাপার বই কি, কিন্তু তখন এর মাহাত্ম্য বোঝার ক্ষমতা হয়নি, সেটা বুঝলাম এবং নিজেকে বেশ কেউকেটা ভাবতে শুরু করলাম, যখন স্কুলে পাঠ্যপুস্তকে তার কবিতা পড়ার শুরু৷ আরে, এ যে আমার আব্বার কবিতা! আমার আব্বার কবিতা স্কুলের বইয়ে, স্যার পড়াচ্ছেন, আমার ক্লাসের সব বল্পুব্দর পড়ছে, লিখছে; আবার অন্যান্য ক্লাসের অবস্থাও এক, তাদেরও পড়তে হয়৷ আমার মধ্যে মূলত বাংলা ক্লাসে বেশ গম্ভীর একটা ভাব এলো৷ হুঁ, আহসান হাবীব আমার বাবা! বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে এই ভাব থাকল না, একটু একটু করে কমতে শুরু করল৷ সে জায়গাটুকু দখল করে নিল মুগ্ধতা৷ সত্যি কথা যদি বলি, আব্বার কবিতা এসএসসি পাসের আগে আমার তেমন পড়া হয়নি৷ ওই যে বললাম নাথ পাঠ্যবই৷ হ্যাঁ, ওর বাইরে যাওয়া হয়নি তেমন৷ এ এক আশ্চর্য ব্যাপার, কবির ঘরে জন্ম আমার কিন্তু কবিতার প্রতি আগ্রহ নেই৷ আমরা পড়ব বলে আব্বা সেই কত কত বই কিনে রেখেছেন [বই কেনাটা তার শখ ছিল, নিদারুণ অভাবের মধ্যেও তাকে বই কিনতে দেখেছি৷ বুঝতে শেখার পর তার সংগ্রহে থাকা বইয়ের বৈচিত্র্য দেখে অবাক হয়েছি৷ এর মধ্যে ছোটদের পাঠ্য অনেক বই৷ আন্দাজ করি, এসব তিনি কিনেছিলেন তার অনাগত সন্তানদের জন্য], সেসব বই পড়ি প্রবল আগ্রহ নিয়ে, পাশাপাশি মারবেল, সাত চাড়া, দাঁড়িয়াবান্ধা, লাট্টু আর রবিনহুড খেলে বেড়াই; আরেকটু বড় হয়ে ঘুড়ি উড়াই, খেলি ফুটবল, ব্যাডমিন্টন, টেবিল টেনিস আর ক্রিকেট৷ কিন্তু কবিতা পড়া হয় না আমার, আব্বার কবিতাও না৷ সম্ভবত ক্লাস টেনে উঠে পড়লাম, 'ঝরা পালকের ভস্মস্তূপে তবু বাঁধলাম নীড়/তবু বারবার সবুজ পাতার স্বপ্নেরা করে ভীড়৷' যতই বলি, আব্বার কবিতা পড়িনি আগে, কিছুই যে পড়িনি, তা তো নয়, সুতরাং 'এই মন-এই মৃত্তিকা' আগে পড়া, বড় বোনকে এই কবিতা আবৃত্তি করতেও শুনেছি৷ কিন্তু ক্লাস টেনে উঠে যখন আবার পড়তে হলো, তখন ব্যাপারটা কেমন যেন অন্যরকম হয়ে গেল৷ ওই কবিতার শ্রুতি-মাধুর্য বা অন্তর্গত ছন্দের দোলার বাইরে আরও কিছু আছে, মনে হলো, এই মনে হওয়াটা অনেক বড় একটা ব্যাপার৷ জানাটাওথ 'জানতাম না যে সূর্যমুখীর নয়নের আলো কেড়ে/তারি ছায়া তলে কোটি কোটি কীট দিনে দিনে ওঠে বেড়ে৷' আজ থেকে প্রায় ৭০ বছর আগে লেখা৷ আজ ওইভাবে কেউ লিখবেন না, পরবর্তী সময়ে আব্বাও লেখেননি৷ অসাধারণ যোগ্যতায় তিনি সময়কে কখনোই তাকে ডিঙিয়ে এগিয়ে যেতে দেননি৷ তার সঙ্গে গল্প হতো কত, একটি ছিল এ রকমথ এক লোক আব্বার 'রাত্রিশেষ' কাব্যগ্রন্থের আগের লেখা এবং হয়তো ওই গ্রন্থের কবিতাগুলো উল্লেখ করে এক সময় বলেছিলেন, যখন তার আরও ২-৩টা বই বেরিয়েছে, বলছিলেনথ আপনার লেখা আগে খুব ভালো লাগত, এখন আর লাগে না, শুনে আব্বা সামান্য হাসলেন৷ ওই লোক নাছোড়বান্দা, একই কথা বারবার বলে যেতে লাগলেন৷ আব্বার অধঃপতন নিয়ে তিনি খুবই দুশ্চিন্তাগ্রস্ত, একপর্যায়ে আব্বা মৃদু গলায় বললেনথ শুনুন আমার কবিতা আপনার আর ভালো লাগবে না৷ কারণ আমি এগিয়েছি, আর আপনি ওই ওখানেই আটকে আছেন৷ আব্বার বদলে যাওয়ার কথা পরে বলি৷ 'রাত্রিশেষ'-এর কথা শেষ করে নিই৷ স্কুলের উঁচু ক্লাস ঝরা পালকের ভস্মস্তূপে ঘর বাঁধার বিষয়টি আমাকে প্রবলভাবে নাড়া দিয়ে গেলেও 'রাত্রিশেষ' পড়া হয়ে গেল তখন, এমন ঘটল না৷ আরেকটু পড়ে কলেজে ভর্তি হয়েছি, আমার লেখা ছাপা হয়েছে 'বিচিত্রা'য় ও 'দৈনিক বাংলা'র সাহিত্য পাতায়, সে সময় কিংবা কিছু আগে৷ আগে বিচ্ছিন্নভাবে পড়া কবিতাগুলো ক্রমশই অন্যরকম মনে হতে লাগল৷ অসাধারণ মনে হতে থাকে কিছু লাইন, 'কাশ্মিরী মেয়েটির কালো চোখ/ফরিদের ছোট ছেলে সে চোখের কিছুটা ভালো চেয়েছিল৷' আজ আমরা কবিতায় কিংবা গল্পে কতভাবেই না কত কিছু প্রকাশ করি, এই লাইনগুলো পড়লে আজও আমি চমকে যাই, সেই কত বছর আগে এভাবে প্রকাশ করার ক্ষমতা আহসান হাবীব কীভাবে পেয়েছিলেন! 'রাত্রিশেষ'-এর কবিতা, অধিকংশ ক্ষেত্রে তীব্র ও প্রত্যক্ষ তীর যে ছোড়া হয়েছে, সেটি লক্ষ্য স্থির করেই৷ এর পেছনের কিছু কারণ আমি অনুমান করি৷ আমার দাদার আর্থিক অবস্থা ভালোই ছিল৷ তবে শৌখিন মানুষ৷ সন্তান হচ্ছে না, এই কারণে এক এক করে ৪টি বিয়ে, [এই স্ত্রীর ঘরেই সব সন্তান] শখের কবিরাজি, বিলাসিতা, জমি বিক্রি এবং অনিবার্য আর্থিক সংকট৷ আব্বা স্কুল ফাইনাল পাস করে জোর করেই কলেজে ভর্তি হলেন, তবে দাদার এক কথা, পড়াশোনা অনেক হয়েছে, এবার চাকরি নিতে হবে৷ এই চাপটা প্রবল হয়ে উঠল, ততদিনে কবি হওয়ার বাসনা অধিকতর প্রবল হয়ে উঠেছেথ আব্বা বাড়ি থেকে পালালেন৷ কলকাতা৷ তখনও অনেক বড় শহর কলকাতা৷ অজপাড়াগাঁ থেকে যাওয়া আব্বার কাছে তো বটেই৷ সেখানে ২০-২২ বয়সের এই তরুণ কাউকেই চিনতেন না৷ পরে তার মুখে বহুবার শুনেছি সে সময়ের কথা৷ কী যে দিন গেছে একেকটা৷ খাওয়া থাকা পরার সামান্যতম নিশ্চয়তা নেই৷ আব্বা ফুটপাতে ঘুমিয়েছেন, পুরনো পত্রিকা জোগাড় করে হকারি করার চেষ্টা করেছেন, গলার মাফলার বন্ধক রেখে হোটেলে খেয়েছেন, এ রকম আরও কত কি৷ কিন্তু তিনি ফিরে যাননি৷ হীরকখণ্ডের ঔজ্জ্বল্য ও সাহস নিয়ে অচেনা ও নির্বিকার কলকাতায় পায়ের নিচে মাটি তিনি ঠিকই তৈরি করে নিয়েছেন৷ তারপর কিছু থিতু হওয়ার পর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে, অল্প কিছুদিনের চেনা কলকাতা ও মানুষগুলোর আবার বদলে যাওয়া, তখন কবির বোঝার ব্যাপারগুলোও বদলাবে৷ 'রাত্রিশেষ'-এ আমি এই ছবিগুলো পাই৷ এ বইয়ের 'রেড রোডে রাত্রিশেষ' এবং 'রেইনকোট'থ এ দুটো কবিতা পাশাপাশি রেখে পড়লে, কবির তখনকার এবং কোনো সৃজনশীল মানুষের সবসময়ের মনোজগত্‍টি পরিষ্কার হয়ে যায়৷ 'রেইনকোট' আমার প্রিয় কবিতা৷ এই কবিতার বহু পরে লেখা 'বর্ষাবিষয়ক কবিতা : কায়সুলকে' কবিতায় আমরা দেখি আহসান হাবীব লিখেছেন, 'আমি একটি বর্ষাতীর প্রার্থনা জানিয়ে/ তিরিশ বছর আগে যত্রতত্র আবেদনলিপি/ পাঠিয়েছি৷ ডাক বিলি হয়েছে কি হয়নি জানি না/ তবে উত্তরের আশায় এখনো বসে আছি/ টলেনি বিশ্বাস৷' [মেঘ বলে চৈত্রে যাবো]৷ পাঠকের পক্ষে তখন সময় বলি, কিংবা বলি চিরকালীন হাহাকার, বোঝা অনেক সহজ হয়ে যায়৷ আর যে কবি পারেন চিরকাল আর বর্তমানকে, কিংবা বর্তমান আর চিরকালকে মিশিয়ে দিতে, তিনি কবি হিসেবে কত বড়, সে প্রশ্ন তোলার প্রয়োজন পড়ে না৷ মাঝে মাঝে, লিখতে শুরু করার পর তো বটেই, এখনও কখনও, সাক্ষাত্‍কারে বা ব্যক্তিপর্যায়ের কৌতূহলে এই প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হয়েছেথ আপনার অনুপ্রেরণা কে? প্রতিবার বলেছি, আমার কোনো অনুপ্রেরণা নেই৷ আমি সত্যিই অনুপ্রেরণা বোধ বা বিশ্বাস কোনোটাই করিনি৷ তাহলে, অনেক সময় পরের প্রশ্নটা এ রকমথ কার লেখা আপনাকে প্রভাবিত করেছে? এ প্রশ্নের উত্তরেও আমাকে বলতে হয়েছেথ কেউ না৷ সত্যিই আমার মনে হয়নি কেউ আমাকে প্রভাবিত করেছেন৷ এবার আমাদের কৃষিজীবী সাহিত্যিক হোসেন উদ্দীন হোসেন বললেন, আমার লেখার মধ্যে তিনি ন্যাথানিয়েল হর্থন-এর মিল খুঁজে পান৷ আমার কিছু লেখা পড়ে বাংলা ভাষার প্রখ্যাত লেখক শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায় চিঠি লিখে জানালেনথ 'সাবের, তোমার লেখায় আমি মহান রুশ লেখকদের মিল পেলাম৷' হর্থন আমি সেভাবে পড়িনি, আর রুশ মহান লেখকরা সত্যিই মহান, আমি মনে করি, আমি আমার মতোই৷ অথচ এই যে লেখাটা লিখছি, লিখতে গিয়ে আমার নিজের লেখার কথা মনে পড়ছে৷ এবং আমি অস্বীকার করতে পারছি না, আব্বার লেখা আমাকে কিছু মাত্রায় প্রভাবিত করেছে৷ তার প্রকৃতি চেতনা, তার ব্যঙ্গ বোধ, অসহায়ত্ব, মধ্যবিত্তের দ্বন্দ্বথ এ রকম অনেক কিছু আমাকে ছেড়ে যায়নি৷ 'রাত্রিশেষ' বের হয়েছিল ১৯৪৮-এ৷ দ্বিতীয় বই, ১৯৬২তে 'ছায়া হরিণ'৷ ১৪ বছর পর! কেন? নানা কারণ ছিল৷ আর্থিক সংকটে কত কী লিখতে হয়েছে৷ স্থায়ী চাকরি ছিল না, সংসার বড় হচ্ছে, এসব মিলে কবিতা যে সময় দাবি করে, দেওয়া যাচ্ছে না৷ তবে সবচেয়ে বড় যে কারণ, তা হলোথ কবিতা নির্মাণে আহসান হাবীবের বদলে যাওয়া৷ 'ছায়া হরিণ'-এর 'জল পড়ে পাতা নড়ে' আমার খুব প্রিয় কবিতা৷ 'সোনামুখী নারকেলের শাখায় শাখায়/আর দুধ-সুপুরির বনে/এখনো কি হাওয়া বয় বঙ্গোপসাগর থেকে/বিকেলে? সোনালি রোদ/এখনো কি মুখ দেখে জোয়ারের জলে?... এখনো কি মেঘ বেলা/মুগের ক্ষেতের পাশে পথ ভেঙে/ঘরে ফিরে যেতে যেতে/কালো চোখ তুলে কোন জেলে-বৌ/প্রশ্ন করে :/ এলো না কি?/ এখনো কি ম্লান মুখে মাথা নাড়ো/আর বলো :/ যে গেছে সে গেছে৷/যে গেছে সে কি ভুলে গেছে...৷'এভাবে উদ্ধৃতি দিলে সময় ও স্থান কিছুতেই কুলোবে না৷ তবে কিছু প্রিয় কবিতার কথা বলা দরকার৷ 'রাত্রিশেষ' প্রথম, 'বিদীর্ণ দর্পণে মুখ' শেষ৷ ১৯৪৮ থেকে ১৯৮৫৷ ৩৭ বছরে ৮টি কবিতার বই৷ এত কম লেখার বেশ কিছু কারণ আমি জানি৷ একটি প্রধান কারণ আর্থিক টানাপড়েন, কবিতা লিখে পয়সা নিই, মাস শেষে বেতনের পয়সা যথেষ্ট নয়, ৪ সন্তানের [১৯৬৯-এ বড় বোনের বিয়ে হয়ে যাওয়ার পর থেকে ৩ জনের] সংসার, দাদা ও চাচাদের সাহায্য করাথ এসব সামাল দিতে বিপর্যস্ত হয়তো হয়ে পড়তেন, আবার সন্তানদের আবদার পূরণের জন্য বাড়তি একটা কাজ হাতে নিতেও পিছপা হতেন না৷ এর সঙ্গে যোগ হয়েছিল স্থিতিহীন জীবনের কারণে নেওয়া একটি স্বাক্ষরের মানসিক চাপ৷ এত কিছুর পরও আমি অবাক হয়ে লক্ষ্য করি, কবিতার প্রতি কী প্রবল ভালোবাসা তাঁকে ঋজুও রেখেছিল৷ না হলে সবকিছু সামাল দিয়ে বারবার কবিতার কাছে ফিরে আসা কঠিন ব্যাপার৷ আরও কঠিন ব্যাপারথ মনমতো না হলে, নিজের রুচির সঙ্গে না মিললে, কবিতা না লেখা৷ তাই ৩৭ বছরে বই ৮টি৷ কিন্তু কী পেলেন এই বইয়ে বইয়ে বদলে যাওয়া সি্নগ্ধ রুচির কবি? 'রাত্রিশেষ' যখন প্রকাশ পেল, তখন সময়ের বিচারে খুব আধুনিক কবিতার বই, তারপর ছায়া হরিণ, সারাদুপুর, আশায় বসতি, মেঘ বলেছে চৈত্রে যাবো, দু'হাতে দই আদিম পাথর, প্রেমের কবিতা ও বিদীর্ণ দর্পণে মুখ৷ প্রতিটি বইয়ে তিনি অন্যরকম৷ খুব একটা সচেতন পাঠক হতে হয় না, বইগুলো পরপর পড়লেই বোঝা যায় নতুন বইটির আহসান হাবীব আগের বইটির আহসান হাবীবকে ছাড়িয়ে গেছেন৷ আর আধুনিকতা? সময়কে ধারণ? এবং বর্তমান সময়কে চিরকালের সঙ্গে বেঁধে রাখা? এই কাজও তিনি করে যান অনবদ্য দক্ষতায়৷ 'বিদীর্ণ দর্পণে মুখ' তার শেষ বই৷ ফেব্রুয়ারি বইমেলায় বের হলো, ১০ জুলাই তিনি মারা গেলেন৷ শেষ বইটির কিছু কবিতা আমাকে বিস্মিত করে৷ যেমন- বসবাস নিবাস, রূপান্তর নাইলের বৃক্ষটি, হিমেনিথের গাধা, যাবো না৷ এই কবিতাগুলোর মূল্যায়ন হয়নি৷ যেমন তামসিক একটি মুহূর্ত, হক নাম ভরসা, ৮ প্রেম নারী মানুষ ঘোষণা, ছহি জঙ্গেনামা, পুতুল, প্রাত বণিকের প্রার্থনা, নৈঃশব্দে নিহিত আমি, কাহিনী নিরন্তর, সামনে ধু-ধু নদী, বাস নেই, বিচ্ছিন্ন দ্বীপের আমরা, অসুখ, যতবার এবং এবার, মনীষা মনীষা বলে, আমার সন্তান, আবহমান, থাকো মধ্যম সারিতে, পারঙ্গম একজন, গন্তব্য ইথাকাথ এবং আরও কবিতা৷ মন খারাপ হয়, আহসান হাবীব তার প্রাপ্যের প্রায় কিছুই পাননি৷ না পাওয়া একটা কারণ, তিনি আড্ডা ও জমায়েতের কবিতা খুবই কম লিখেছেন৷ এই দেশে কবিতার চেয়ে কলরব বড়৷ আব্বার সঙ্গে তার কবিতা নিয়ে, আমার কথা খুব কমই হয়েছে৷ আমরা বাংলা সাহিত্য নিয়ে আলোচনা করেছি, বিশ্বসাহিত্য নিয়ে আলোচনা করেছি, আমার লেখা নিয়ে তার মন্তব্য আমার খুবই দরকারী ছিল৷ কিন্তু তার কবিতা নিয়ে আলোচনা বলতে যা বোঝায়থ তা হয়নি৷ বিচ্ছিন্নভাবে কিছু হয়েছে৷ আমি কখনও আমার ভালো লাগার কথা বলতাম, শেষ দিকে তার কোনো নতুন কবিতা নিয়ে কথা বললে, জানতে চাইতেন মাঝে মাঝে, আমার বল্পুব্দরা কে কী বলেছে৷ এটা জানতে চাইতেন বোঝার জন্য তিনি তরুণদের সঙ্গে আছেন কি-না৷ লেখাটা শুরু করেছিলাম অন্যভাবে৷ সেখানে ফিরে যাই৷ আমার ছোট ভাইয়ের মেয়ে পূর্ণা ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়েছে [কিংবা কমেন্টে বলেছে], আমাদের রক্তে লেখালেখি৷ ঠিকই বলেছে, লেখালেখিটা আমাদের ইচ্ছায় আর ভালোবাসায়৷' এই ভালোবাসার সূত্র ধরেই মঈনুল আহসান সাবের নিমর্াণ করেছেন আলোঘর৷ যেই ঘরে শুধূ আমাদের আলোকমানুষ আহসান হাবিব-ই নয়, কবিতার জন্য নিবেদিত হয়েছেন দুই প্রজন্ম পরের উত্তরাধিকারেরা৷ এই আনন্দ তিনি দেখে যেতে না পারলেও তার সনত্মান মঈনুল আহসান সাবের, ভাবসনত্মান কবি নাসির আহমেদসহ অনেকেই দেখতে পাচ্ছেন৷ কবিতার উদার জমিন কতটা উদার প্রয়োজন? সময়ের সাহস আলোয় আলোকিত হওয়া কবি মোমিন মেহেদীর এমন এক প্রশ্নের উত্তরে দেশের প্রধান কবি শামসুর রাহমান বলেছিলেন, 'যতটা উদার নীল আকাশ, ততটা উদারতা প্রয়োজন কবিতার জন্য৷' কবি শামসুর রাহমান যেই আকাশসম উদারতার কথা বলেছেন, সেই উদারতা ছিল কবি আহসান হাবিবের কবিতায়-কবি মানসেও৷ যে কারনে আজকের নাসির আহমেদ পেয়েছেন প্রতিষ্ঠা৷ কবি মুহম্মদ নূরম্নল হুদা, অসীম সাহা, রেজাউদ্দিন স্টালিন, মোহন রায়হানসহ শত শত কবি পেয়েছেন কবিতার পথ, পেয়েছেন কবি হিসেবে প্রতিষ্ঠা৷ কেননা, কবি হিসেবে যতটা উদার ছিলেন কবি আহসান হাবিব; ততটাই উদার ছিলেন সাহিত্য সম্পাদক হিসেবে৷ তার উদারতা ছিল এমন যে লেখা ভালো হলেই তুলে ধরেছেন সাহিত্য পাতায়৷ আর তখন দৈনিক বাংলা'র সাহিত্য পাতায় একটি কবিতা প্রকাশিত হওয়া মানেই সামনের পথ অননত্ম সুন্দর হয়ে যাওয়া৷ যেই পথ দিয়ে হেটে হেটে অনেক কবিই হয়েছেন কোটিপতি; বনে গেছেন ব্যবসায়ীও৷ কিন্তু কবিতা? থেকেছে পিছু পিছু৷ এখন যেমন কবি আল মাহমুদের সাথে থেকে থেকে যুদ্ধাপরাধী সমর্থক গোষ্ঠি ছাত্র শিবিরের তথাকথিত আবিদ আজম ( মুহম্মদ আলী আজম) সহ অনেকেই নাম পরিবর্তন করে সাংবাদিকতার সাইনবোর্ড লাগিয়ে সুযোগ নিচ্ছে প্রথম আলো, ইত্তেফাকসহ বিভিন্ন পত্রিকা থেকে; সে সুযোগ কখনোই আহসান হাবিবের মত বিচৰণ সাহিত্য সম্পাদকের কাছ থেকে পায়নি বর্তমান যুদ্ধাপরাধী সংগঠন জামায়াতে ইসলামের সাহিত্য বিভাগের নেতা মোশারর হোসেন খান বা অধ্যাপক মতিউর রহমানের মত কোন বর্ণচোরা তথাকথিত কবি৷ কবি আহসান হাবিব একজন কবির আদর্শিক দিকটিও জেনে নিতেন কৌশলে৷ কেননা, কবিতার সাথে পথ চলা এই অনন্য কাব্যজন ছিলেন মনে প্রানে বাঙালী৷ স্বাধীনতার-স্বাধীকারের পৰে ছিল তার আপোষহীন ভালোবাসা৷ এই ভালোবাসা ছিল বলেই কোন নারী কবিকেও তিনি সুযোগ দেননি, কবিতা হয়ে ওঠার আগে৷ তিনি নারী কবিদের কবিতা ডেস্কে আসার সাথে সাথে আগে মন দিয়ে পাঠ করতেন৷ তারপর যদি কবিতা হয়ে উঠতো তবেই কেবল প্রকাশের জন্য নির্বাচন করতেন, তা না হলে প্রথমে দলাইমলাই এবং পরে বাতিলঝুড়িতে৷ কিন্তু বর্তমানে দেখছি কিছু কিছু পত্রিকায় মহিলা হওয়ায় নীহার মোশারফ, শেলী রেজা, আফরোজা সোমাসহ বেশ কিছু নারীর এলামেলো কথাগুলো প্রকাশ করছে কবিতা হিসেবে৷ যা দেখলে কবি আহসান হাবিব মনে এতটাই কষ্ট পেতেন যে, বেদনাহত হয়ে থাকতো পুরোটা সকাল-বিকাল৷ কখনোই তিনি পাঠকের সামনে তুলে দেননি কোন প্রহসন৷ নিজের মত করে সাজিয়েছেন তার সাহিতপাতা, সাহিত্যজীবন আর সাহিত্যঘর৷ কবি অসীম সাহা তার এক লেখায় লিখেছেন, 'অনেকে প্রশ্ন করেন, কবিতা কেন লিখি? আমি কি নিজেও জানি কিংবা পৃথিবীর কোনও কবি সত্যি কি জানেন কেন তিনি কবিতা লেখেন? অবশ্য অনেকে বলেন, না লিখে থাকতে পারি না, তাই লিখি৷ আমি তা ভাবি না৷ আমি কবিতা না লিখেও থাকতে পারি৷ কেননা, আমি কবিতাকে আমার জীবনের দ্বিতীয় সাধনার স্তর হিসেবে ভাবি৷ আমার সাধনার প্রথম স্তরে রয়েছে মানুষ হয়ে ওঠবার সাধনা, প্রকৃত মানুষ৷ আমি যদি কবি না হতাম, তা হলে পৃথিবীর কি এমন ক্ষতি হতো? কিছুই না৷ কিন্তু আমি যদি প্রকৃত মানুষ হয়ে উঠতে পারতাম, তা হলে সামান্য হলেও পৃথিবীর মানুষের কাজে লাগতাম৷ এখনও আমি সেই সাধনাই করে যাচ্ছি৷ জানি, একজন মানুষের পক্ষে সত্যিকার অর্থেই সম্পূণর্রূপে প্রকৃত মানুষ হয়ে ওঠা সম্ভব নয়৷ কিন্তু তা যদি না-ও হয়, তা হলেও আমি মানব-সাধনার স্তর থেকে নিজেকে কিছুতেই সরিয়ে নেবার চেষ্টা করব না৷ সেই সাধনায় কবিতা যদি আমার সহযোগী শক্তি হিসেবে কাজ করে, তা হলে মনে করব, আমার জীবনের সাধনা সত্যি হয়েছে৷ আর সেই সাধনায় সিদ্ধিলাভের চেয়ে বড় কবিতা আর কিছু হতে পারে বলে আমি বিশ্বাস করি না৷ তাই আবারও বলি, কবিতা আমার মানুষ হয়ে ওঠবার সাধন-সঙ্গী মাত্র, অন্য কিছু নয়৷' সেই দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে কবি আহসান হাবীব ছিলেন প্রকৃত মানুষ৷ আর একজন প্রকৃত মানুষই কেবল কবি হয়ে উঠতে পাওে; প্রকাশনা ব্যবসাকে পূঁজি করে কোন পুসত্মক ব্যবসায়ী বা কাড়িকাড়ি অর্থকে কাজে লাগিয়েও কবি হয়ে ওঠা সম্ভব নয়৷ কবি হতে হলে প্রয়োজন শুধুমাত্র উদারতা আর মনুষত্য৷ যা কবি আহসান হাবীবের মধ্যে ছিল৷ ছিল কবিতার জন্য আলাদা একটি সংসারও৷ এই সংসাওে কবিতা ছিল তার দ্বিতীয় সহধর্মিনী৷ অধ্যাপক আনিসুজ্জামান কবি আহসান হাবীব প্রসঙ্গে লিখেছেন, কবি রচিত এ ছড়াটি তখন ছেলেবুড়ো সবার মুখে মুখে ফিরত৷ কবি আহসান হাবীব তখন আকাশবাণী কলকাতা কেন্দ্রের গল্পদাদুর আসরের নিয়মিত শিল্পী ও এর পরিচালক৷ পাশাপাশি তাঁর আরো একটা পরিচয় ছিলো৷ পরিচয়টা হলো দৈনিক ইত্তেফাক পত্রিকার ছোটদের পাতা 'মিতালী মজলিস'-এর সম্পাদকও ছিলেন কবি আহসান হাবীব৷ মিতালী ছিল তার আরেক নাম৷ কবি আহসান হাবীবের জন্ম ১৯১৭ সালের ২ জানুয়ারি পিরোজপুর জেলার শংকরপাশা গ্রামে৷ ছোটবেলা থেকেই কবি একটু অন্য রকমের ছিলেন৷ সবার মধ্যে থেকেও একাকী থাকতেন৷ নির্জনতাকে পছন্দ করতেন একটু বেশীই৷ কিশোর এ ছেলেটিকে দেখে সবাই ভাবতেন, বড় হলে এ ছেলে আর দশজনের চেয়ে আলাদা হবেই হবে৷ এর মধ্যে ঘটল ভারী অদ্ভুত এক ঘটনা৷ আহসান হাবীব তখন ষষ্ঠ শ্রেণীর ছাত্র৷ পড়াশোনা করেন পিরোজপুর সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ে৷ মেট্রিক পাস করার পর আহসান হাবীব ব্রজমোহন কলেজে ভর্তি হলেন বটে কিন্তু তাঁর বুকের ভেতর তখন রাজহাঁসের পাখা বড় হচ্ছে একটু একটু করে৷ তাকে আরও বড় হতে হবে৷ নিজের পায়ে দাঁড়াতে হবে৷ সংসারের বাড়তি দায়িত্বও তাঁর কাঁধে এসে পড়ল৷ তিনি বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয়-স্বজন কাউকে কিছু না বলে পাড়ি জমালেন কলকাতা৷ সালটা ১৯৩৭৷ মাত্র বিশ বছর বয়সে তিনি দৈনিক তকবির পত্রিকার মাধ্যমে সাংবাদিকতা শুরু করলেন৷ শুরু হলো তার কঠোর জীবন সংগ্রাম৷ তকবির থেকে দৈনিক আজাদ, মাসিক বুলবুল, মাসিক সওগাত, শিশু সওগাত ও দৈনিক ইত্তেহাদে কাজ করলেন৷ দেশ ভাগের পর ১৯৫০ সালে ইত্তেহাদ বন্ধ হয়ে গেলে আহসান হাবীর তার পরিবার নিয়ে ঢাকায় চলে এলেন৷ ঢাকায় এসে মাসিক মোহাম্মদীর ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক, দৈনিক আজাদের সাহিত্য সম্পাদক, ঢাকা থেকে প্রকাশিত দৈনিক ইত্তেহাদের সাহিত্য সম্পাদক পাশাপাশি ছোটদের পাতার সম্পাদনাও করেছেন৷ তারপর ১৯৬৪ সালে যোগদান করলেন দৈনিক পাকিস্তানে৷ মৃত্যুর শেষ দিন পর্যন্ত তিনি দৈনিক বাংলার সাহিত্য পাতা সম্পাদনায় থেকে এদেশের কবিতা-গল্প-প্রবন্ধসহ মননশীল সব রচনার ভাণ্ডারকে সমৃদ্ধ করেছেন৷ কবি আহসান হাবীব বড়দের পাশাপাশি ছোটদের জন্যও অনেক লেখা লিখেছেন৷ তার ছড়া-কবিতায় বাংলার গ্রাম ও প্রকৃতির বিচিত্র মন-কাড়া প্রতিভাত হয়েছে৷ ছোটদের জন্য লিখতে গেলে যে তাদের মনোজগতের ভেতরে প্রবেশ করতে হয় সে ব্যাপারে আহসান হাবীব সদা সতর্ক থাকতেন৷ আহসান হাবীবের স্নেহ, সানি্নধ্য যাঁরা পেয়েছেন পরবর্তীকালে তারা বাংলাদেশের সাহিত্যে তাদের অবস্থানকে সুসংহত করেছেন৷ তিনি একেবারে নবীন যে কবি-ছড়াকার গল্পকার কাউকেই নিরুত্সাহিত করতেন না৷ দৈনিক বাংলার সাহিত্য পাতা সম্পাদনা করার সময় তিনি দুই বাংলার অন্যতম সেরা সাহিত্য সম্পদকে পরিণত হয়েছিলেন৷ সাদাসিধে নিরহংকার, স্নেহশীল, দায়িত্ববান, সত্, মার্জিত রুচি- সম্পন্ন, আপোষহীন থাকার কারণে আহসান হাবীব জীবিতকালে নিজেই হয়ে উঠেছিলেন নিজের প্রতিদ্বন্দ্বী৷ দৈনিক বাংলার সম্পাদক আহমেদ হুমায়ুন কবিকে নিয়ে এক লেখায় উল্লেখ করেছেন, "সাদাসিধে নিরহংকার স্নেহশীল একজন মানুষ, যাকে কোনদিন শক্ত কথা বলতে শুনিনি, কাড়াকাড়ি করতে দেখিনি, কারও বিরুদ্ধে কিছু বলতেও শুনিনি৷ তাঁকে ঘিরে ছিল এক প্রসন্নতার বিভা, যদিও জীবনের হাতে, সমাজের হাতে হাবীব ভাই কম মার খাননি৷ কিন্তু নিজের তিক্ত অভিজ্ঞতা দিয়ে অন্যকে কখনো তিনি তিক্ত করেননি৷ হাবীব ভাইয়ের নিজের ভাষায়, 'আমি সামান্য সুখকে অনেক বড় করে এবং অনেক বড় দুঃখকে লক্ষ লক্ষ দুঃখী মানুষের তুলনায় ক্ষুদ্র করে দেখার চেষ্টা করেছি৷ সেদিক থেকে নিজেকে আমি এ জীবনে সুখীই বলতে পারি৷' এমন একজন মানুষকে দুঃখ দেয়, সে সাধ্য কার! আমাদের এই সমাজে যখন খ্যাতি নিয়ে, প্রতিষ্ঠা নিয়ে, অমার্জিত যশের জন্যে কাড়াকাড়ি দেখেছি তখন হাবীব ভাই থেকেছেন তাঁর নিভৃত বেদনা আর নিভৃত সুখের জগতে৷ 'আমি মেঘনা পাড়ের ছেলে আমি মেঘনা পাড়ের ছেলে'্তএই অসাধারণ কিশোর কবিতাটি কে না পড়েছে! এই কবিতাটি পড়ার সময় সবার কল্পনার ভেতর এই ভাবটি জাগ্রত হয়, আমিই বুঝি মেঘনা পাড়ের সেই ছেলেটি...৷ আহসান হাবীব তাঁর সুদীর্ঘ সাংবাদিকতা ও সাহিত্য সাধনায় একটি জিনিস কখনোই মেনে নিতে পারতেন না৷ ভুল বানান তিনি কখনো সহ্য করতে পারতেন না৷ ভুল বানান গল্প, কবিতা, ছড়া, প্রবন্ধ, ফিচার, রিপোর্টে তো নয়ই উল্টো দোকানপাটের সাইনবোর্ডেও যদি কোথাও ভুল বানান তাঁর চোখে পড়ত তাহলে তা না শোধরানো পর্যনত্ম বসে থাকতেন৷ ষাটের দশকে শহীদ দিবসে বিক্ষোভকারীদের প্রতিরোধের মুখে ঢাকার অফিস-আদালত, দোকানপাটের সাইনবোর্ডগুলো বাংলা বানানে লেখা শুরু হয়েছে কেবল৷ দেখা যায় অনেক সাইনবোর্ডের বানানই ভুল বানানে লেখা৷ আহসান হাবীব সেসব দোকানপাটের সাইনবোডের্র ভুল বানান দেখে দুঃখ পেতেন, বিছুটি লাগার মতো জ্বালা অনুভব করতেন৷ একবার ঢাকা স্টেডিয়ামের দক্ষিণ দিকের এক পাঞ্জাবী মালিকের রেস্টুরেন্টের ভুল বানানের সাইনবোর্ড আহসান হাবীবের চোখে পড়ল৷ আহসান হাবীব রেস্টুরেন্টের মালিককে খুঁজে বের করে ভুল বানানের বিষয়টি বোঝালেন৷ তারপর মমতা মেশানো গলায় তিনি মালিক ভদ্রলোককে বুঝিয়েও বললেন৷ পাঞ্জাবী মালিক ভদ্রলোক আহসান হাবীবের কথায়, মাতৃভাষার প্রতি কবির অপার ভালবাসা দেখে মুগ্ধ হলেন৷ পরে ভুল বানানের সাইনবোর্ডটি উঠিয়ে শুদ্ধ বানানের সাইনবোর্ড লাগানো হয়েছিল৷ ছোটদের জন্য অজস্র লিখেছেন তিনি৷ তাঁর সব লেখা বই আকারে বের হয়নি৷ বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় তাঁর লেখা ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে৷ ছোটদের জন্য তিনি লিখেছেন রানীখালের সাঁকো (উপন্যাস), ছুটির দিন দুপুরে (ছেড়া-কবিতা), বিষ্টি পড়ে টাপুর টুপুর (ছড়া কবিতা), জ্যোত্স্না রাতের গল্প (অনুবাদ)৷ তিনি সব সময় কম কথা বলতেন৷ মানুষের কথা আগ্রহ নিয়ে শুনতেন৷ অন্যদেরও তাই করতে বলতেন৷ আর ছোটদের খুব আদর করতেন৷ আহসান হাবীর তাঁর কবিতায় উচ্চারণ করেন, 'যে যায় সে যায় ফিরে আসে না'্তআসলে কী তা সত্য? তিনি তাঁর রচনার মধ্য দিয়ে বারবার আমাদের কাছে ফিরে আসবেন৷ বরিশালের শংকরপাশা গ্রামে ফিরে আসবেন৷ ফিরে আসবেন এই বাংলায়৷ তার ফিরে আসা হবে কবিতার পঙতিতে পঙতিতে৷ কবিতা, ছড়া, সাহিত্যকর্ম আর শিষ্য-সামনত্মদের কাব্যজ কর্মকান্ডের মধ্য দিয়ে কবি আহসান হাবীব মূল্যায়িত হবেন আজন্মকাল৷ সেই মূল্যায়নের আলোঘরের আলোয় আলোকিত হবে আমাদের অন্ধকারঘেরা বর্তমান।

www.banglareport24.com

[প্রথমপাতা]

 

 

লেখকের অন্যান্য লেখাঃ

 

>>এই আকাশ কবির আকাশ, কবির সাথে পথ চলে