হিটস্ট্রোকঃ প্রতিরোধে প্রচুর পানি পান করুন
ডা. স্বপন কুমার মন্ডল
গ্রীষ্মকাল। সূর্যের সঙ্গে যুদ্ধ করে মেঘগুলো হেরে গেছে। ফলে সব মেঘখন্ড
হিমালয়ে একত্র হয়ে আবার আক্রমণের প্রস্তুতি নিচ্ছে। এদিকে গ্রামবাংলার
মাঠ-ঘাট ফেটে চৌচির। নদী-নালার পানি রেখা একেবারে তলায় ঠেকে গেছে। অসংখ্য
ফলজ গাছের ফুলের রেণু তাপে শুকিয়ে যাচ্ছে। পানির অভাবে ক্ষেতের ফসল কেমন
যেন হাহাকার করছে। ভোর হওয়ার পর থেকেই সূর্যের প্রচন্ড তাপ পৃথিবীর বুকজুড়ে
দগ্ধ কেয়ামতের সংকেত দিয়ে যাচ্ছে। নীরব-নিথর দুপুরবেলা রাখালেরা গাছের
ছায়ার গরুগুলোকে বেঁধে গামছাটা শীতল ঘাসের ওপর বিছেয়ে শুয়ে পড়ে। কৃষক গাছের
ছায়ায় বসে লুঙ্গি দিয়ে দেহের ঘাম মোছে, মাথার বিড়া দিয়ে বাতাস করে। তাপে
তাদের হাত-পা-মুখ লাল হয়ে আছে। এদের দেখে মনে হয় যেন, এরা আগুন থেকে উঠে
এসেছে। এই ভ্যাপসা গরমের মধ্যে কেউ কেউ হিট-স্ট্রোকে আক্রান্ত হয়ে হঠাৎ করে
জ্ঞান হারিয়ে ফেলছে।
হিট-স্ট্রোক কি?
কাঁঠাল পাকা গরমে বাংলাদেশসহ প্রতিবেশী দেশগুলোর মানুষের এক্কেবারে ত্রাহি
মধুসূদন অবস্থা! গাছের পাতার কোনও নড়ন-চড়ন নেই। হাওয়া হঠাৎ কখন এসে গাছের
পাতাগুলোকে ছুঁয়ে দিয়ে বলবে আর একটু অপেক্ষা কর, বৃষ্টি আসবে। অপেক্ষা
চলছে, বৃষ্টিও নেই, বাতাসও নেই। এ অসহনীয় গরমের কারণে সৃষ্টি হতে পারে নানা
শারীরিক সমস্যা, বিশেষ করে হিট-স্ট্রোক। প্রচন্ড রোদে পথ চলতে চলতে হঠাৎ
করে নিজে বা অন্য কেউ এতে আক্রান্ত হতে পারেন। দেহের তাপমাত্রা কোনও কারণে
অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে গেলে স্নায়ুতন্ত্রের কিছু পরিবর্তন হয় এবং শারীরিক
কিছু লক্ষণ প্রকাশ পায়। মানুষের শরীরের স্বাভাবিক তাপমাত্রা ৯৮ ডিগ্রি
ফারেনহাইট। কোনও কারণে যদি তা ১০৪ ডিগ্রি ফারেনহাইটের ওপর চলে যায় তাহলে
হিট-স্ট্রোক হতে পারে। এটি জীবনের জন্য হুমকিস্বরূপ। এ বিপদের হাত থেকে
রক্ষা পাওয়ার সহজ কিছু কৌশল জেনে রাখাটা সবার জন্যই ভালো। হিট-স্ট্রোকের
লক্ষণগুলো হঠাৎ করেই প্রকাশ পায়।
হিট-স্ট্রোকের লক্ষণ
শরীর ব্যথা করে, দুর্বল লাগে এবং খুব বেশি পিপাসা লাগে। পরে অত্যধিক
ক্লান্তি দেখা দেয়, শ্বাস-প্রশ্বাস দ্রুত হয়, মাথাব্যথা করে, ঝিমঝিম করে,
তাপমাত্রা দ্রুত ১০৫ ডিগ্রি ফারেনহাইট ছাড়িয়ে যায়, ঘাম বন্ধ হয়ে যায়, ত্বক
শুষ্ক ও লাল হয়ে যায়, নাড়ির স্পন্দন ক্ষীণ ও দ্রুত হয়, রক্তচাপ কমে যায়,
মাংসপেশির খিঁচুনি, চোখে ঝাপসা দেখা, খিটখিটে মেজাজ, রোগী অসংলগ্ন আচরণ
করতে থাকে, হ্যালুসিনেশন, কনফিউশন, এমনকী রোগী অজ্ঞান হয়ে যেতে পারে।
হিট-স্ট্রোক কেন হয়?
দেহের বিপাক ক্রিয়ার ফলে আমাদের শরীরে তাপ উৎপন্ন হয়। ঘামের মাধ্যমে দেহ
অতিরিক্ত তাপ বের করে দেয়। কিন্তু অত্যধিক গরম ও আর্দ্রতার কারণে এ তাপ বের
করে দেওয়ার কাজটি যখন সম্ভব হয় না, তখনই হিট-স্ট্রোকের সম্ভাবনা দেখা দেয়।
হিট-স্ট্রোকের আরেকটি কারণ হল ডিহাইড্রেশন বা পানিশূন্যতা। একজন
ডিহাইড্রেটেড ব্যক্তি ঘামের মাধ্যমে দ্রুত তাপ বের করে দিতে পারেন না। ফলে
শরীরের তাপমাত্রা অস্বাভাবিক রকম বেড়ে গিয়ে হিট-স্ট্রোক হতে পারে।
যাদের হিট-স্ট্রোকের ঝুঁকি বেশি
শিশু (শরীরের তাপ নিয়ন্ত্রণ করার সিস্টেম পরিপূর্ণভাবে গড়ে না ওঠায়), বৃদ্ধ
(শরীরের তাপনিয়ন্ত্রণ করার সিস্টেম দুর্বল হয়ে পড়ে), ক্রীড়ামোদী বা
শ্রমজীবী, প্রচন্ড রোদে যারা বাইরে কাজ করেন যেমন দিনমজুর এ চার শ্রেণি
হিট-স্ট্রোকের জন্য সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিপূর্ণ।
হিট-স্ট্রোকের প্রাথমিক চিকিৎসা
প্রথম এবং প্রধান করণীয় হবে আক্রান্ত ব্যক্তির তাপমাত্রা কমিয়ে আনার
ব্যবস্থা করা। দ্রুত ছায়াঘেরা ঠান্ডা জায়গায় এনে আক্রান্ত ব্যক্তিকে চিত
করে শুইয়ে দিতে হবে। গায়ের ভারী কাপড় খুলে দিতে হবে এবং ঠান্ডা বরফ-পানি
দিয়ে গা মুছে দিতে হবে। পা ও নিতম্ব কিছুটা উঁচুতে রাখতে হবে। মাথার কাছে
ফ্যান চালিয়ে দিতে হবে। বগল ও দুই উরুর খাঁজে কিছুক্ষণ আইস-ব্যাগ রাখলে
ভালো হয়। যদি আক্রান্ত লোকটি পানি খাওয়ার মতো অবস্থায় থাকে তাহলে তাকে ঘন
ঘন ঠান্ডা পানি ও তরল খাবার দিতে হবে। একটি থার্মোমিটার দিয়ে শরীরের
তাপমাত্রা মেপে দেখুন এবং নরমাল তাপমাত্রায় না আসা পর্যন্ত রোগীকে ঠান্ডা
হতে দিন। মুখে খেতে না পারলে এবং হিট-স্ট্রোক হয়ে জ্ঞান হারিয়ে ফেললে যত
তাড়াতাড়ি সম্ভব স্থানীয় হাসপাতালে নিতে হবে। মনে রাখতে হবে, হিট-স্ট্রোক এক
প্রকার মেডিক্যাল ইমার্জেন্সি বিষয়, যেখানে সঙ্গে সঙ্গে রোগীকে যথাযথ
চিকিৎসা না দেওয়া হলে রোগী মৃত্যুবরণ করতে পারে।
হিট-স্ট্রোক প্রতিরোধে কী কী করবেন?
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থাটি হবে দেহকে পানিশূণ্য হতে না
দেওয়া। এ জন্য প্রচুর পরিমাণে পানি, ফলের রস খান। প্রচন্ড রোদে একনাগাড়ে
পরিশ্রমের ফাঁকে মাঝে-মাঝে ছায়ায় বসে বিশ্রাম নিতে হবে। কিছুক্ষণ পর পর তরল
খাবার যেমনÑ পানি, ফলের রস, ডাবের পানি, শরবত ইত্যাদি পান করতে হবে। পানীয়
যেন সফট ড্রিংক, চা ক্যাফেইনসমৃদ্ধ না হয়। বেশি গরমে ভারী কাজ পরিহার করা
উচিত। যদি করতেই হয় তাহলে কাজের ফাঁকে ফাঁকে প্রচুর তরল পান করতে হবে। রোদে
বের হলে সঙ্গে ছাতা ব্যবহার করতে হবে। খুব গরম পড়লে দিনে দু-তিন বার গোসল
করা যেতে পারে। ব্লাডপ্রেশার কম থাকলে আহারের সময় সামান্য পরিমাণে কাঁচা
লবণ, প্রয়োজনে মাঝে-মাঝে খাবার স্যালাইনও খেতে হবে। এ সময় হালকা রঙের, সাদা
রংয়ের ঢিলেঢালা সুতি কাপড় পরিধান করাই ভালো। কালো কাপড়ের পোশাক পরা যাবে
না। বৃদ্ধ ও শিশুরা গরমের সময় সহজেই আক্রান্ত হয়। তাই তাদের ব্যাপারে বিশেষ
সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে।
ARNING:
Any unauthorized use or reproduction of 'Community' content
is strictly prohibited and constitutes copyright infringement liable to
legal action.
[প্রথমপাতা] |