|
প্রখ্যাত শিক্ষাবিদ, বিজ্ঞান লেখক, বিজ্ঞানকর্মী আবদুল্লাহ আল মুতী
শরফুদ্দিনের ১৭তম মৃত্যুবার্ষিকীতে শ্রদ্ধাঞ্জলি
নূর মোহাম্মদ নূরু
বাংলাদেশের জনপ্রিয় বিজ্ঞান লেখক, শিক্ষাবিদ এবং ছোটদের মধ্যে বিজ্ঞানকে
জনপ্রিয় করার পথিকৃৎ আবদুল্লাহ আল-মুতী শরফুদ্দিন। তবে তিনি আবদুল্লাহ
আল-মুতী নামেই সমধিক পরিচিত। এমন কিছু মানুষ আছেন, যাঁদের চারিত্রিক
মাধুর্যই তাদের ব্যক্তিসত্তাকে উদ্ভাসিত করে তুলতে মুখ্য ভূমিকা রাখেন।
অপরাপর গুণাবলী সে ক্ষেত্রে সংযোজনীয় কাতারে এসে পড়ে। ড. আবদুল্লাহ আল-মুতী
এমনই বিরল মানুষদের একজন। তবে তার ব্যতিক্রমী বিশেষত্ব হচ্ছে তার ব্যক্তিগত
বৈশিষ্ট্যের কাছে তার অপরাপর বিশিষ্টতার অবস্থানও এক কাতারে; অর্থাৎ গৌন
নয় কিছুই। এর পরও বলা চলে তিনি যদি আর কোনো গুণে-গুণান্বিত এতে হতেন, শুধু
ব্যক্তি চারিত্রিক মহিমার জন্যই তিনি মানুষের আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দুতে
পরিণত হয়েছেন। বাংলা ভাষায় বিজ্ঞান চর্চা প্রসারে আল-মুতী শরফুদ্দিনের
অবদান অসামান্য। তিনি ছিলেন একাধারে বিজ্ঞানী, শিক্ষাবিদ ও সাহিত্যিক।
বিশেষভাবে শিশু সাহিত্যে তার অবদান অপরিসীম। তিনি শিশু কিশোর আর সাধারণ
মানুষের কাছে বিজ্ঞানকে পৌঁছে দিতে চেয়েছেন বিশেষভাবে। বিজ্ঞানের যে কোনো
জটিল বিষয় সহজ সাবলীল ভাষায় প্রকাশের ক্ষেত্রে তিনি ছিলেন অনন্য। দুর্বোধ্য
ভাষা আর জটিলতা তার কাছে ছিল পরিত্যাজ্য। এ কারণেই তার ভাষা যেমন ঝরঝরে,
ভঙ্গিতে তেমন সহজ সরল। তার এ গুণ ও অবদানের জন্য দেশে বিদেশে তিনি নন্দিত
হয়েছেন বিপুলভাবে, ভূষিত হয়েছেন অনেক পুরস্কারে। বাংলাদেশের বিজ্ঞান
লেখকদের মধ্যে তিনি দ্বিতীয় যিনি ইউনেস্কো কলিঙ্গ পুরস্কার লাভ করেন। আজ
আবদুল্লাহ আল-মুতী শরফুদ্দিনের ১৭তম মৃত্যুবার্ষিকী। ১৯৯৮ সালের আজকের দিনে
তিনি ঢাকায় মৃত্যুবরণ করেন। বাংলা ভাষায় বিজ্ঞান চর্চার অগ্রদূতের
মৃত্যুবার্ষিকীতে শ্রদ্ধাঞ্জলি।
আবদুল্লাহ আল-মুতী শরফুদ্দিন ১৯৩০ সালের পয়লা জানুয়ারি সিরাজগঞ্জ জেলার
ফুলবাড়ি গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি আবদুল্লাহ আল-মুতী নামেই সমধিক পরিচিত।
তার পিতা শেখ মইন শরফুদ্দিন এবং মা হালিমা শরফুদ্দিন। ৫ ভাই ৬ বোনের মধ্যে
আবদুল্লাহ আল-মুতী সবার বড়। রক্ষণশীল পরিবারে জন্ম নিয়েও তার বামপন্থী
রাজনীতি তার উদার মনমানসিকতার পরিচায়ক। জীবনভর সরকারের উচ্চপদে অধিষ্ঠিত
থেকেও তিনি ছিলেন সাধারণ মানুষের মতোই সাধারণ। ১৯৪৫ সালে ঢাকার মুসলিম হাই
স্কুল থেকে তিনি ম্যাট্রিকুলেশন (এখনকার এসএসসি পরীক্ষা) পরীক্ষায় কলকাতা
বোর্ডে ২য় স্থান লাভ করেন। ১৯৪৭ সালে ১১ তম স্থান নিয়ে সাফল্যের সঙ্গে আই
এ পাশ করেন ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন। ১৯৫২ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
থেকে তিনি পদার্থবিজ্ঞানে বিএসসি(অনার্স) ডিগ্রি অর্জন করেন। এরপর বৃত্তি
নিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে যান এবং সেখানে শিক্ষাবিষয়ে পড়াশুনা করেন শিকাগো
বিশ্ববিদ্যালয়ে। সেখান থেকে ১৯৬০ সালে এমএ ডিগ্রি এবং ১৯৬২ সালে পিএইচডি
ডিগ্রি লাভ করেন। যৌবনে বামপন্থী আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন আবদুল্লাহ
আল-মুতী শরফুদ্দিন। ১৯৪৮ ও ১৯৫৪ সালে পাকিস্তান সরকার কর্তৃক গ্রেফতার
হয়েছিলেন। পরে রাজনীতি ছেড়ে দেন। কর্মজীবনে তিনি প্রথম প্রবেশ করেন সরকারী
শিক্ষাবিভাগে। ১৯৪৭ সালে মুকুল ফৌজ আন্দোলনে যোগ দিয়ে পরবর্তী বছরে মুকুল
নামে কিশোর পাক্ষিক পত্রিকা বের করেন। কেন্দ্রীয় কচি কাচার মেলা -এর
অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা। ইত্তেফাক, আজাদ, মোহাম্মদী পত্রিকার নিয়মিত লেখক
ছিলেন। ,জাতীয় শিশু-কিশোর সংস্থা সহ নানা সংঠনের উপদেষ্টা ছিলেন। ১৯৫৪ সালে
রাজশাহী সরকারী কলেজে পদার্থবিজ্ঞানের প্রভাষক হিসেবে যোগ দেন এবং ছয়মাস
পরেই অধ্যাপক হন। সেখান থেকে ঢাকার টিচার্স ট্রেনিং কলেজে বদলি হন ১৯৫৬ সালে।
ছয়বছর পর পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ও প্রধান হয়ে চট্টগ্রাম সরকারি
কলেজে চলে যান । ১৯৭৫ সালে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে যুগ্মসচিব হিসেবে যোগ দেন।
তারপর শিক্ষা প্রশাসন ও সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ে গুরু দায়িত্ব পালন
করেন। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের সচিব পদ থেকে অবসর গ্রহণ করেন
১৯৮৬ সালে। তার প্রকাশিত বিজ্ঞান ও শিক্ষা বিষয়ক মৌলিক গ্রন্থের সংখ্যা
২৭, অনুদিত গ্রন্থের সংখ্যা ১০, সম্পাদিত গ্রন্থের সংখ্যা ১০। এছাড়াও কিছু
পান্ডুলিপি রয়েছে, যার অনেক গুলো এখনও অপ্রকাশিত। রেডিও এবং টিভিতে তাঁর
উপস্থাপিত অনুষ্ঠান বিশেষভাবে জনপ্রিয় হয়েছিল। তিনি লেখালেখি শুরু করেন
ছাত্রজীবন থেকেই। বিজ্ঞানের জটিল, সূক্ষ বিষয়কে সহজ ভাষায় সর্বজনবোধ্য করে
তোলার জন্য তার দক্ষতা ও সাফল্য ছিল তুলনাহীন। শিক্ষা, সংস্কৃতি, সাহিত্য
অঙ্গনে অজস্র সংগঠন প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে তিনি সম্পৃক্ত ছিলেন আমৃত্যু।
আবদুল্লাহ আল-মুতী জাতীয় পর্যায়ে শিক্ষা সংস্কার ও আধুনিকরণের কর্মকান্ডে
তিনি প্রত্যক্ষভাবে যুক্ত থেকে উজ্জ্বল অবদান রেখে গেছেন। তিনি জাতীয়
শিশু-কিশোর সংস্থা সহ নানা সংঠনের উপদেষ্টা ছিলেন। ১৯৮৮-৯০ সাল পর্যন্ত
সভাপতি হিসেবে এশিয়েটিক সোসাইটি অব বাংলাদেশের দায়িত্ব পালন করেছেন এবং
১৯৮৬-৯০ পর্যন্ত বাংলা একাডেমী ও বিজ্ঞান শিক্ষা সমিতির সভাপতি ছিলেন। তিনি
আরো যেসব দায়িত্ব পালন করেছেন সেগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো- প্রধান
উপদেষ্টা, প্রথম ঢাকা মহাকাশ উৎসব "বেক্সিমকো স্পেসফেস্ট ১৯৯৬',
চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ অ্যাস্ট্রনমিক্যাল অ্যাসোসিয়েশনের দশম বর্ষপূর্তি
উদযাপন কমিটি (১৯৯৮), উপদেষ্টা, দ্বিতীয় ঢাকা মহাকাশ উৎসব স্পেসফেস্ট
১৯৯৯। প্রধান উপদেষ্টা, ঢাকা প্রস্তাবিত স্পেস সেন্টার, উপদেষ্টা, মেঘনাদ
সাহা বিজ্ঞান তথ্যকেন্দ্র ও গ্রন্থাগার (১৯৯৭-৯৯)। এসব গুরুদায়িত্ব পালনের
পাশাপাশি প্রচুর লেখালেখি করেছেন আবদুল্লাহ আল-মুতী শরফুদ্দিন। তিনি
লেখালেখি শুরু করেন ছাত্রজীবন থেকেই। বিজ্ঞানের জটিল, সূক্ষ বিষয়কে সহজ
ভাষায় সর্বজনবোধ্য করে তোলার জন্য তার দক্ষতা ও সাফল্য ছিল তুলনাহীন। তিনি
বড়দের জন্যে লিখেছেন বিজ্ঞান ও মানুষ (১৯৭৫), শিক্ষা ও অন্যান্য প্রসঙ্গ
(১৯৭৫), এ যুগের বিজ্ঞান (১৯৮১), বিচিত্র বিজ্ঞান (১৯৮৫), বিপন্ন পরিবেশ
(১৯৮৫), প্রাণলোকঃ নতুন দিগন্ত (১৯৮৬), বিজ্ঞানের বিস্ময় (১৯৮৬)। অনুবাদ ও
সম্পাদনা করলেন কিছু। আর ছোটদের জন্যে লিখেছেনঃ জানা-অজানার দেশ (১৯৭৬),
সাগরের রহস্যপুরী (১৯৭৬), আয় বৃষ্টি ঝেঁপে (১৯৮০), মেঘ বৃষ্টি রোদ(১৯৮১),
ফুলের জন্য ভালোবাসা (১৯৮২), সোনার এই দেশ (১৯৮৩), তারার দেশের হাতছানি
(১৯৮৪), ছবিতে আমাদের পরিবেশ (প্রথম ভাগ ১৯৮৭, দ্বিতীয় ভাগ ১৯৯০),
টেলিভিশনের কথা (১৯৮৭), কীটপতঙ্গের বিচিত্র জগৎ (১৯৮৮), বিজ্ঞান এগিয়ে চলে
(১৯৯১), চোখ মেলে দেব (১৯৯২), ফারিয়া নাদিয়ার মজার সফর (১৯৯৬), আকাশ অনেক
বড় (১৯৯৮)। এছাড়াও তিনি আরও অনেক বই লিখেছেন।
ড. আবদুল্লাহ আল-মুতী ছিলেন অত্যন্ত সুশৃঙ্খল মানুষ। তার নাম উচ্চারণেই চোখে
ভাসে তার শান্ত-সি্নগ্ধ, প্রসন্ন ছবি। ফর্সা পাতলা গড়নের মানুষটি ছিলেন বড়
বেশি সজ্জন আর অমায়িক। ছিলেন সদালাপী, সহযোগী; বন্ধুবৎসল, অতিথি রসজ্ঞান।
আকর্ষণীয় বাচনভঙ্গি বয়সীদের প্রতি বিনম্র। পরমত সহিষ্ণুতা, সংযম, বিনম্রতা,
সুগভীর জ্ঞানচর্চা, লেখার জন্য অবিচল সাধনা, মানুষের প্রতি বিশ্বাস ও
শ্রদ্ধা, মানুষের জন্য ভালোবাসা তাঁর জীবনে সাফল্যে চরম উৎকর্ষ সাধনের
সহায়ক। ছোটদের জন্য উজাড় করা স্নেহ। তুখোড় বক্তা, ধৈর্যশীল শ্রোতা ড.
শরফুদ্দীনের তুলনা হয় না। নিখুঁত পাঠাভ্যাস আর কঠোর পরিশ্রমী ছিলেন তিনি।
অকারণ সময় অপচয় ছিল তার নীতিবিরুদ্ধ। মানুষকে সম্মান জানানো ছিল তার
বৈশিষ্ট্য। সম্মান প্রদর্শনে পদমর্যাদা তার কাছে আদৌ বিচার্য ছিল না।
বিজ্ঞান লেখক, বিজ্ঞান কর্মী এবং সরকারি কর্মকর্তা আবদুল্লাহ আল-মুতী শিক্ষা,
সংস্কৃতি, সাহিত্য অঙ্গনে অজস্র সংগঠন প্রতিষ্টানের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন।
শিক্ষাক্ষেত্রে অবদানের জন্য তিনি বহু পুরস্কার ও্ সম্মাননা লাভ করেছেনঃ
তিনি পেয়েছেন বাংলা একাডেমী পুরস্কার, অগ্রণী ব্যাংক শিশু সাহিত্য পুরস্কার,
গণশিক্ষামূলক সাহিত্যের ইউনেস্কো পুরস্কার, বিজ্ঞানে শ্রেষ্ঠ কীর্তির জন্য
ঋষিজ শিল্পগোষ্ঠী পুরস্কার, ইউনেস্কোর আন্তর্জাতিক কলিঙ্গ পুরস্কার।
শিক্ষাক্ষেত্রে অবদানের জন্য লাভ করেন একুশে পদক এবং বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির
ক্ষেত্রে অবদানের জন্য পেয়েছেন রাষ্ট্রীয় পুরস্কার স্বাধীনতা পদক। সবশেষে
অসুস্থ অবস্থায় পান শিশু একাডেমীর শিশু সাহিত্য পুরস্কার।
১৯৯৮ সালে দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়ে একই বছর ৩০শে নভেম্বর ঢাকায়
মৃত্যুবরণ করেন ড. আবদুল্লাহ আল-মুতী শরফুদ্দিন। মৃত্যুর সময় রেখে গেছেন
স্ত্রী ও দুই ছেলে ও এক মেয়েকে। আজ তাঁর ১৭তম মৃত্যুবার্ষিকী। ব্যথিত হতে
হয় এমন মানুষটি কী দ্রুততার সাথে বিস্মৃতির অন্তরালে চলে গেলেন। তাঁর
সম্পর্কে লেখালেখি, আলোচনা, স্মরণসভা কোথাও তেমনভাবে হয়েছে বলে আমাদের জানা
নেই। জাতির স্বার্থেই এমন একজন দুর্লভ গুণে গুণান্বিত ব্যক্তিত্বকে নতুন
প্রজন্মের কাছে তুলে ধরার প্রয়োজন আজ বড় বেশি। বাংলা ভাষায় বিজ্ঞান চর্চার
অগ্রদূত ড. আবদুল্লাহ আল-মুতী শরফুদ্দিনের মৃত্যুবার্ষিকীতে শ্রদ্ধাঞ্জলি।
WARNING:
Any unauthorized use
or reproduction of
'Community' content is
strictly prohibited
and constitutes
copyright infringement
liable to legal
action.
[প্রথমপাতা] |
লেখকের আগের লেখাঃ
[লেখক আর্কাইভ]
|