প্রথমপাতা  

সাম্প্রতিক সংবাদ 

 স্বদেশ

আন্তর্জাতিক

বাংলাদেশ কমিউনিটি

লাইফ স্টাইল

 এক্সক্লুসিভ

বিনোদন

স্বাস্থ্য

বর্তমানের কথামালা

 শিল্প-সাহিত্য

 প্রবাসপঞ্জী 

আর্কাইভ

যোগাযোগ

 

 

 

 

নারী জাগরণের অগ্রদূত বেগম সুফিয়া কামালের ষোড়শ মৃত্যুবার্ষিকীতে শ্রদ্ধাঞ্জলি

 

 

 

নূর মোহাম্মদ নূরু



বিংশ শতাব্দীর প্রায় পুরোটা সময় তিনি ছিলেন এ দেশের মানুষের সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও গণতান্ত্রিক আন্দোলনের সাথি। তাঁর নেতৃত্বে গড়ে উঠেছে বহু সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠন। সুফিয়া কামাল মহিলা পরিষদের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি সুফিয়া কামাল আজীবন সত্য, কল্যাণ ও ন্যায় প্রতিষ্ঠায় বিশ্বস্ত থেকে তিনি দেশের জনগণকে মুক্ত করার প্রচেষ্টায় ব্রতী ছিলেন। মানবকল্যাণপ্রয়াসী কবি সুফিয়া কামালের মানসগঠনে নারী আন্দোলনের অগ্রদূত বেগম রোকেয়ার প্রভাব ছিল অপরিসীম। সুফিয়া কামালের রচনা ও বিভিন্ন সাক্ষাৎকার থেকে এ তথ্য পাওয়া যায়। তাঁর সংগ্রামী জীবনের গুরুত্বপূর্ণ অংশ তিনি ব্যয় করেছেন নারীকে সচেতন করা, সংগঠিত করা ও নারী আন্দোলন গড়ে তোলার কাজে। সমাজ বিকাশের, মানবমুক্তি আন্দোলনের অভিযাত্রায় তাঁর প্রজ্বলিত মশালের আলোর পথরেখা ধরেই অব্যাহত রাখতে হচ্ছে। একুশ শতকের নারী আন্দোলন আজ সম্মুখীন নতুন বাস্তবতার। যুগ যুগ ধরে বহমান নারী আন্দোলনের মাধ্যমে বাংলাদেশে নারীর মানবাধিকার পরিস্থিতি নারীর জীবনে যে সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচিত হয়েছে সেই আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছেন বেগম সুফিয়া কামাল। সুফিয়া কামাল ছিলেন মুক্তি, সাম্য, অধিকার আদায়ের আন্দোলন ও বৈষম্যহীনতার প্রতীক। বহুমুখী দ্বন্দ্বে আকীর্ণ এই সমাজ জনগণকে যখন দিশাহারা করে তুলেছে, তখনই স্মরণ করতে হচ্ছে মানবতাবাদী কবি সুফিয়া কামালকে। ১৯৯৯ সালের আজকের দিনে এই মহীয়সী নারী চলে গেছেন না-ফেরার দেশে। আজ তাঁর ষোড়শ মৃত্যুবার্ষিকী। তাঁর প্রয়াণের এক দশকের বেশি অতিবাহিত হলেও 'জননী সাহসিকা'র অভাব তীব্রভাবে অনুভূত হয় আন্দোলন-সংগ্রামে। নারী জাগরণের পুরোধা ব্যক্তিত্ব কবি সুফিয়া কামালের জন্মদিনে ফুলেল শুভেচ্ছা।

বেগম সুফিয়া কামাল ১৯১১ সালের ২০ জুন বরিশালের শায়েস্তাবাদে মামার বাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম সৈয়দ আব্দুল বারী। সৈয়দ আবদুল বারী ছিলেন একজন আইনজীবী। তিনি ছিলেন তৎকালিন বৃহত্তর কুমিল্লার (বর্তমানের ব্রাহ্মণবাড়িয়ার) বাসিন্দা । যে সময়ে সুফিয়া কামালের জন্ম তখন বাঙ্গালি মুসলিম নারীদের কাটাতে হত গৃহবন্দি জীবন। যে পরিবারে সুফিয়া কামাল জন্মগ্রহণ করেন সেখানে নারীশিক্ষাকে প্রয়োজনীয় মনে করা হতোনা। স্কুল কলেজে পড়ার কোনো সুযোগ তাদের ছিলো না। পরিবারে বাংলা ভাষার প্রবেশ এক রকম নিষিদ্ধ ছিল। ঐ বিরুদ্ধ পরিবেশে সুফিয়া কামাল প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার সুযোগ পাননি। তিনি পারিবারিক নানা উত্থান পতনের মধ্যে স্বশিক্ষায় শিক্ষিত হয়েছেন। মা সাবেরা বেগমের কাছে পড়তে শেখেন তিনি। মাত্র বারো বছর বয়সে সৈয়দ নেহাল হোসেনের সাথে প্রথম বিয়ে হয় তার। স্বামীই সাহিত্য পাঠে তাকে আগ্রহী করে তোলেন। যা তাকে পরবর্তীকালে সাহিত্য রচনায় উদ্বুদ্ধ করে তোলে। ১৯২৩ সালে তিনি রচনা করেন প্রথম গল্প 'সৈনিক বধূ' যা বরিশালের তরুণ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। ১৯২৬ সালে সওগাত পত্রিকায় তার প্রথম কবিতা বাসন্তী প্রকাশিত হয়। ১৯২৩ সালে ১২ বছর বয়সে সৈয়দ নেহাল হোসেনের সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। সুফিয়া কামালের স্বামী নেহাল হোসেন ছিলেন প্রগতিবাদী ও নারী শিক্ষার সমর্থক। স্বামীর উৎসাহ ও অনুপ্রেরণায় কবি সুফিয়ার লেখালেখির গতি দ্রুত বৃদ্ধি পায়। স্বামীর ঐকান্তিক সহযোগিতায় সুফিয়ার লেখা পত্রিকায় প্রকাশের সুযোগ ঘটে, যা ছিল তখনকার সময়ের জন্য অকল্পনীয় ব্যাপার। স্বামীর সঙ্গে কলকাতায় অবস্থানকালে কাজী নজরুল ইসলাম, সওগাত সম্পাদক মোহাম্মদ নাসিরুদ্দিন, কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসু প্রমুখ বিশিষ্ট ব্যক্তিত্বের সাক্ষাৎ লাভের অভূতপূর্ব সুযোগ তিনি লাভ করেন। যা তাকে সাহিত্যচর্চায় আরো অনুপ্রাণিত করে। শুধু তাই নয় স্বামীর উৎসাহ-উদ্দীপনায় সুফিয়া বিভিন্ন সামাজিক-সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে যোগদান করতে লাগলেন এমনকি কংগ্রেস সম্মেলনেও যোগ দিয়েছিলেন। সময়ের বিচারে স্বামী নেহাল হোসেনের এ সহযোগিতা আন্তরিকতা যুগান্তকারী পদক্ষেপ হিসেবে বিবেচিত। কিন্তু দুঃভা্গ্য! ১৯৩২ সালের ১৯ ডিসেম্বর সুফিয়ার স্বামী সৈয়দ নেহাল হোসেন মৃত্যুবরণ করেন। স্বামীর আকস্মিক মৃত্যু তাঁকে আর্থিক সমস্যায় ফেলে।এই সমস্যা কাটিয়ে ওঠার জন্য তিনি ১৯৩২ থেকে ৪১ সাল পর্যন্ত কলকাতা কর্পোরেশন প্রাইমারী স্কুলে শিক্ষকতা করেন। এ সময় করপোরেশনের শিক্ষকদের মধ্যে কবি আবদুল কাদির, কবি খান মোহাম্মদ মঈনুদ্দিন, কবি জসীমউদ্দীন, কাজী নজরুল ইসলামের মতো কবি-সাহিত্যিকদের সহকর্মী হিসেবে পান। সব দুঃখ, দারিদ্র্য ও মানসিক অশান্তির মধ্যে দেশের সাহিত্যিক বুদ্ধিজীবীদের সান্ত্বনা তাকে নতুন প্রেরণায় বাঁচতে শেখায়। এর মাঝে ১৯৩৮ সালে তার প্রথম কাব্যগ্রন্থ 'সাঁঝের মায়া' প্রকাশিত হয়। যার ভূমিকা লিখেছিলেন কাজী নজরুল ইসলাম। আর রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এর প্রশংসা করেছিলেন। সাদত আলি আখন্দই সর্বপ্রথম সুফিয়াকে কবি হিসেবে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি প্রদান করেন।


১৯৩৯ সালে সুফিয়া কামালউদ্দীন আহমেদের সাথে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। সুফিয়া নামের সঙ্গে যুক্ত হয় স্বামী নামের অংশ বিশেষ। তখন থেকে সুফিয়া কামাল নামে তার নতুন পরিচিতি ঘটে। দ্বিতীয় স্বামী কামালউদ্দিন সুফিয়ার কাব্য প্রতিভাকে সম্মান করতেন। তিনি সুফিয়ার কাব্য বিকাশের প্রতি অত্যন্ত যত্নবান ছিলেন। ১৯৩৭ সালে প্রকাশিত হয় তার প্রথম গল্পগ্রন্থ্থ 'কেয়ার কাঁটা' ও ১৯৩৮ সালে কাব্যগ্রন্থ 'সাঁঝের মায়া'। কবি বেনজীর আহমদ নিজ খরচায় 'কেয়ার কাঁটা' ও 'সাঁঝের মায়া' প্রকাশের দায়িত্ব নিয়েছিলেন এবং লেখক সম্মানীর ব্যবস্থাও করেছিলেন। এভাবেই সাহিত্য সমাজে নতুন পরিচয়ে আবির্ভাব ঘটে সুফিয়ার। কৃতজ্ঞতার নিদর্শনস্বরূপ তিনি তার মন ও জীবন কাব্যগ্রন্থটি বেনজীর আহমদকে উৎসর্গ করেন। কাজী নজরুল ইসলাম স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে 'সাঁঝের মায়া'র ভূমিকা লিখে সুফিয়ার সাহিত্যিক মর্যাদা দিয়েছিলেন। নজরুলের যে কোনো বই প্রকাশ হলেই তিনি সুফিয়াকে এক কপি উপহার পাঠাতেন। একই সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের প্রশংসা ও আশীর্বাদ বাংলা সাহিত্যে তাকে একটি স্থায়ী আসনে অধিষ্ঠিত করে। বেনজীর আহমদের মাধ্যমে নৃপেন্দ্রকৃষ্ণ চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে সুফিয়ার পরিচয় ঘটে। এই সূত্র ধরে তিনি-ই প্রথম মুসলমান মহিলা হিসেবে অল ইন্ডিয়া রেডিওতে স্বরচিত কবিতা পাঠের সুযোগ লাভ করেছিলেন। কলকাতায় সওগাত অফিস থেকে প্রকাশিত সাপ্তাহিক বেগমের প্রথম সম্পাদিকা মনোনীত হয়েছিলেন কবি সুফিয়া। বেগম সুফিফা কামাল ছিলেন মানবতা ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের পক্ষে এবং যাবতীয় অন্যায়, দুর্নীতি ও অমানবিকতার বিরুদ্ধে সোচ্চার এক সমাজসেবী ও নারীনেত্রী। তিনি ছিলেন শিল্প-সাহিত্য অঙ্গনের এক সৃষ্টিশীল মহীয়সী নারী। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি রাজনীতিবিদ, সাহিত্যিক ও সংস্কৃতিকর্মীদের অনুপ্রেরণা যুগিয়েছেন। বাংলার মানুষ তাকে 'জননী সাহসিকা' উপাধিতে ভূষিত করে। কবি সুফিয়া কামাল ছিলেন বেগম পত্রিকার প্রথম সম্পাদক। কবি সুফিয়া কামালের প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থগুলো হচ্ছেঃ "সাঁঝের মায়া, মায়া কাজল, মন ও জীবন, শান্তি ও প্রার্থনা, উদাত্ত পৃথিবী, দিওয়ান, মোর জাদুদের সমাধি পরে প্রভৃতি। গল্পগ্রন্থঃ 'কেয়ার কাঁটা'। ভ্রমণকাহিনী 'সোবিয়েত দিনগুলি'। স্মৃতিকথাঃ 'একাত্তুরের ডায়েরি'। সাহিত্যচর্চার জন্য সুফিয়া কামাল ৫০টিরও অধিক পুরস্কার ও সম্মাননা লাভ করেছেন। ১৯৬১ সালে পাকিস্তান সরকারকর্তৃক জাতীয় পুরস্কার 'তমঘা-ই-ইমতিয়াজ' লাভ করেন। তবে ১৯৬৯ সালে বাঙালিদের ওপর অত্যাচারের প্রতিবাদে তিনি তা বর্জন করেন। এছাড়া বাংলা একাডেমি পুরস্কার, একুশে পদক, নাসিরউদ্দিন স্বর্ণপদক, উইমেন্স ফেডারেশন ফর ওয়ার্ল্ড ডিস ক্রেস্ট, বেগম রোকেয়া পদক, দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ স্বর্ণপদক ও স্বাধীনতা দিবস পুরস্কার লাভ করেন বেগম সুফিয়া কামাল।

১৯৪৭ সালে দেশবিভাগের পর সুফিয়া কামাল পরিবারসহ ঢাকায় চলে আসেন। ভাষা আন্দোলনে তিনি নিজে সক্রিয়ভাবে অংশ নেন এবং এতে অংশ নেয়ার জন্য নারীদের উদ্বুদ্ধ করেন। ১৯৫৬ সালে শিশুদের সংগঠন কচিকাঁচার মেলা প্রতিষ্ঠা করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম মহিলা হোস্টেলকে 'রোকেয়া হল' নামকরণের দাবী জানান। ১৯৬১ সালে পাকিস্তান সরকার কর্তৃক রবীন্দ্রসঙ্গীত নিষিদ্ধের প্রতিবাদে সংগঠিত আন্দোলনে তিনি জড়িত ছিলেন। এই বছরে তিনি ছায়ানটের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। ১৯৬৯ সালে মহিলা সংগ্রাম কমিটির সভাপতি নির্বাচিত হন এবং গণঅভ্যুত্থানে অংশ নেন। ১৯৭০ সালে মহিলা পরিষদ প্রতিষ্ঠা করেন বেগম সফিয়া কামাল। ১৯৭১ সালের মার্চে অসহযোগ আন্দোলনে নারীদের মিছিলে নেতৃত্ব দেন। মুক্তিযুদ্ধের তাঁর ধানমন্ডির বাসভবন থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের সহায়তা দেন। স্বাধীন বাংলাদেশে নারীজাগরণ আর সমঅধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে তিনি উজ্জ্বল ভূমিকা রেখে গেছেন। ১৯৯০ সালে স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনে শরিক হয়েছেন, কার্ফ্যু উপেক্ষা করে নীরব শোভাযাত্রা বের করেছেন। মুক্তবুদ্ধির পক্ষে এবং সাম্প্রদায়িকতা ও মৌলবাদের বিপক্ষে আমৃত্যু তিনি সংগ্রাম করেছেন। প্রতিটি প্রগতিশীল আন্দোলনে অংশ নিয়েছেন। তিনি ছিলেন মানবতা ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের পক্ষে এবং যাবতীয় অন্যায়, দুর্নীতি ও অমানবিকতার বিরুদ্ধে সোচ্চার একজন সমাজসেবী ও নারী নেত্রী। ১৯৯২ সালে গঠিত একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি এবং গণআদালতে গোলাম আজমসহ যুদ্ধাপরাধীদের প্রতীকী বিচার প্রক্রিয়ার সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে যুক্ত ছিলেন তিনি। তিনি আমৃত্যু একাত্তরের নরঘাতক যুদ্ধাপরাধীদের বিচার চেয়েছেন।

নারী জাগরণের পুরোধা ব্যক্তিত্ব কবি সুফিয়া কামাল ১৯৯৯ সালের ২০ নভেম্বর ঢাকায় মৃত্যুবরণ করেন। তাঁকে পূর্ণ রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় সমাহিত করা হয়। বাংলাদেশী নারীদের মধ্যে তিনিই প্রথম এই সম্মান লাভ করেন। প্রথিতযশা কবি, লেখিকা, নারীবাদী ও নারী আন্দোলনের অন্যতম পথিকৃত কবি সুফিয়া কামালের আজ ১৬তম মৃত্যুবার্ষিকী। বাংলাদেশের প্রথিতযশা কবি, লেখিকা, নারীবাদী ও নারী আন্দোলনের অন্যতম পথিকৃত কবি সুফিয়া কামালের মৃত্যুদিনে শ্রদ্ধাঞ্জলি।

 

 

 

WARNING: Any unauthorized use or reproduction of 'Community' content is strictly prohibited and constitutes copyright infringement liable to legal action. 

[প্রথমপাতা]



 

লেখকের আগের লেখাঃ

 

[লেখক আর্কাইভ]