[প্রথমপাতা] |
শেখ হাসিনার জাপান
সফর প্রসঙ্গে
প্রবীর বিকাশ সরকার
বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে জননেত্রী শেখ
হাসিনা ১৩ বছর পর জাপান সফর করলেন ২৮ নভেম্বর থেকে
১লা ডিসেম্বর পর্যন্ত। অবশ্য এর আগে বিরোধী দলীয় নেত্রী হিসেবে
সমাজতন্ত্রীদের আন্তর্জাতিক এক সেমিনারে
যোগদান করেছিলেন ১৯৯৪ সালে সেটাই ছিল তাঁর প্রথম জাপান আগমন। দ্বিতীয়বার
১৯৯৭ সালে এসেছিলেন
রাষ্ট্রীয় সফরে। এবার পাঁচ দিনের জন্য এসেছিলেন সুবৃহৎ এক দল নিয়ে সর্বমোট
তাঁর সঙ্গে ছিলেন ৯৭ জন।
এঁদের মধ্যে ছিলেন ব্যবসায়ী, গণমাধ্যমকমর্ী এবং সরকারি কর্মকর্তাবৃন্দ।
নিঃসন্দেহে গতবারের চেয়ে এবার তাঁর সফর ছিল উজ্জ্বল তবে নানাদিক দিয়েই আরও
তাৎপর্যপূর্ণ এবং স্মরণীয়
হতে পারত এই সফর বলে অনেক জাপানি ও বাঙালি মনে করেন। ১৯৯৭ সালে তাঁর আগমনের
প্রাক্কালে এক
অনভিপ্রেত হত্যাকান্ড ঘটে টোকিওতে স্থানীয় আওয়ামী কর্মীদের অন্তর্গত
কোন্দলের কারণে। ফলে প্রবাসীদের
মধ্যে যেমন একটা শীতল ভীতি ও বিষণ্নতা বিরাজ করতে থাকে তেমনি
প্রধানমন্ত্রীকে প্রদত্ত বাংলাদেশীদের
নাগরিক সংবর্ধনায় তেমন উপস্থিতি পরিলক্ষিত হয়নি। মনে মনে নিশ্চয়ই তিনি খুব
বিব্রত বোধ করেছিলেন।
এবারের প্রধান কর্মসূচির মধ্যে ছিল, জাপানের প্রধানমন্ত্রী নাওতো কানের
সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক আর্থ-বাণিজ্যিক বিষয়ে
আলোচনা বিশেষ করে নির্মাণাধীন পদ্মাসেতুর জন্য অর্থসাহায্য নিশ্চিতকরণ,
ঢাকায় পরিকল্পনাধীন পাতাল রেল,
উড়াল পথ, বিদ্যুত, কৃষি, শিক্ষান্নোয়ন এবং অবকাঠামো নির্মাণ বিষয়ক আলোচনা,
দুদেশের মধ্যে বাণিজ্য ঘাটতি
হ্রাসকরণ, জাপানি ব্যবসায়ীদের সঙ্গে আলোচনা, জাপান-বাংলাদেশ সংসদীয় কমিটির
সঙ্গে সভা, সম্রাটের
সঙ্গে সাক্ষাৎ, হিরোশিমা শান্তি জাদুঘরে বক্তৃতা প্রদান, প্রবাসী নাগরিকদের
সংবর্ধনা গ্রহণ ইত্যাদি। অবশ্য
সেইসঙ্গে ছিল রাজধানী টোকিওর কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত রাজনৈতিকভাবে স্পর্শকাতর
স্থান নাগাতাচোও শহরে
বাংলাদেশ সরকার কতর্ৃক ক্রয়কৃত বাসস্থানে নিজস্ব দূতাবাস প্রকল্প স্থাপনের
ভিত্তিপ্রস্তর উন্মোচন।
উল্লেখ্য যে, সুদৃশ্যমান এই দূতাবাস প্রকল্পটি হবে অষ্টমতলা। এর মধ্যেই
বিভিন্ন দপ্তরসমূহ, মিলনায়তন, গ্রন্থাগার,
অতিথিকক্ষ, রাষ্ট্রদূতের আবাসসহ কাউন্সেলর ও কর্মচারীদের থাকারও ব্যবস্থা
থাকবে। আগামী বছরের মধ্যে এই
ভবন নির্মিত হয়ে যাবে বলে অনুষ্ঠানে রাষ্ট্রদূত একেএম মজিবুর রহমান ভুঁইয়া
জানান। চল্লিশ বছরের মাথায় এসে এই প্রথম জাপানে নিজস্ব জমিতে দূতাবাস তৈরি
হতে যাচ্ছে। অবশ্য এই সরকার প্রধান প্রধান দেশগুলোতে নিজস্ব
ভূমিতে দূতাবাস স্থাপনের যে পরিকল্পনা নিয়েছে এটা তারই একটি সফল পদক্ষেপ।
পদ্মাসেতু নির্মাণ প্রকল্পে জাপান সরকার পূর্বেই ৩০০ মিলিয়ন ডলার সাহায্য
প্রদানের অঙ্গীকার করেছিল, সেটা
বাড়িয়ে ৪০০ মিলিয়ন ডলার করা হয়েছে। যদিওবা বাংলাদেশ সরকারের ৪৫০ মিলিয়ন
ডলারের দাবি ছিল।
জাপানি কিছু সংখ্যক ব্যবসায়ীও বিশেষ আগ্রহ প্রকাশ করেছেন বাংলাদেশে বিনিয়োগে।
দুদেশের ব্যবসায়ীদের
মধ্যে ফলপ্রসূ আলোচনা হয়েছে বলে জানা যায়। যদিওবা বিনিয়োগের পরিবেশ ও
সুযোগ-সুবিধা এখনো পর্যাপ্ত
নয় বাংলাদেশে তবুও জাপানি ব্যবসায়ীদের মনে আগ্রহ জন্মানোর কারণ
সামপ্রতিককালে অর্থনৈতিক, সামাজিক
ও শিক্ষাক্ষেত্রে বাংলাদেশের অনেকটা সাফল্য অর্জন। আমেরিকাভিত্তিক ইনভেস্ট
ব্যাংক অ্যান্ড সিকিউরিটিজ
কোম্পানির গবেষণায় উঠে আসা উদীয়মান অর্থনৈতিক শক্তি বা পরবতর্ী একাদশ হিসেবে
যে ১১টি দেশের নামযুক্ত
তালিকা পাওয়া যায় তার মধ্যে রয়েছে বাংলাদেশ__বিশ্বব্যাপী এই প্রচারও একটি
কারণ।
অতিসমপ্রতি জাপানের সবচেয়ে জনপ্রিয় ফ্যাশন ব্রান্ড 'ইউনিক্লো' বাংলাদেশে
বিনিয়োগ করার কারণে ব্যাপক
আলোচনার বিষয়বস্তু হিসেবে উঠে আসছে গণমাধ্যমে। গ ্রামীণ ব্যাংকের সঙ্গে
যৌথভাবে স্যোসাল বিজনেস চাল ুর
লক্ষ্যে গঠন করেছে গ্রামীণ ইউনিক্লো কোম্পানি। ইতিমধ্যে আরও বেশ কিছু বড় বড়
বাণিজ্য প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশে
বিনিয়োগ করেছে বা করার পথে যেমন তোপ্পান ফর্মস কোম্পানি, ফ্যামেলি সুপার
স্টোর সেইইউ,
টেলিকমিউনিকেশন জায়ান্ট এনটিটি দোকোমো, মিৎসুবিশি মোটরস কোম্পানি, তোশিবা
এলিভেটরস, রোহ্তো
পার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানি উল্#৮ে;৭২২;খযোগ্য।
আরও জাপানি পর্যটক ও ব্যবসায়ী বাংলাদেশ সম্পর্কে আগ্রহী হত যদি জাপানে
বাংলাদেশের সঠিক তথ্য প্রচার
করা যেত। এটা অস্বীকার করা যাবে না যে, স্বাধীনতার পর থেকেই বাংলাদেশের
উজ্জ্বল ভাবমূর্তি জাপানসহ
বহির্বিশ্বের কোন দেশেই জোরালোভাবে তুলে ধরা হয়েছে! গণমাধ্যমের বদৌলতে
দারিদ্র, মহামারি, বন্যা, খরা,
খাদ্যাভাব, দুনর্ীতি, লুটপাট, সন্ত্রাসকবলিত অনগ্রসর বাংলাদেশ সম্পর্কে
বিশ্ববাসীর মনে একটা বদ-ইমেজ গড়ে
উঠেছে, যাকে এখনো দূরীভূত করা যায়নি। সামরিক স্বৈরাচারী শাসন এবং চার জোট
সরকারের আমলে মৌলবাদ,
জঙ্গিবাদ উত্থানের কারণে বাংলাদেশকে আরও কয়েক ধাপ এগিয়ে নিয়ে কলঙ্কজনক
সন্ত্রাসী-রাষ্ট্র হিসেবে
পরিচিত করে তোলার ফলে প্রবাসীদেরকে প্রভূত জাতিপরিচয়ের (আইডেনটিটি ক্রাইসিস)
সঙ্কটে ভুগতে হয়েছে
এবং এখনো হচ্ছে। মহাজোট সরকার এসে আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে বহির্বিশ্বে
নতুন করে ভাবমূর্তি গড়ে
তোলার জন্য।
প্রধানমন্ত্রীর এই সফর অর্থনৈতিক দিক থেকে সফল হয়েছে, তারপরেও মনে হয় অনেক
ক্ষেত্রেই অতৃপ্তি রয়ে
গেছে। বিশেষ করে ২১ শতকের আলোকে জাপান-বাংলা সম্পর্কের ক্ষেত্রে নতুন করে
আলো ফেলা যেত।
দুঅঞ্চলের সুপ্রাচীন সম্পর্কের কথা বাদ দিয়ে শুধু যদি আধুনিককালের শিক্ষা,
সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক সম্পর্কের
সূত্র ধরে প্রধানমন্ত্রী সাংবাদিক সম্মেলনে কিংবা কোন উচ্চশিক্ষা
প্রতিষ্ঠানে আয়োজিত সমাবেশে বক্তৃতায় কিছুটা
আলোকপাত করতেন তাহলে একটি বিস্মৃত ইতিহাসের অবগুন্ঠন উন্মোচন হত। তাতে কোন
প্রকার বাধা ছিল না
বরং তাঁর সময়ের প্রজন্মসহ নতুন প্রজন্মের শিক্ষক, গবেষক, রাজনীতিক ও
ব্যবসায়ীরা সহজেই বুঝতে পারতেন
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পর্যন্ত জাপান ও পূর্ববাংলা তথা বাংলাদেশের সম্পর্ক
কতখানি ঘনিষ্ঠ ছিল! কতখানি মর্যাদাসম্পন্ন,
আদরনীয় ছিল! যা সম্পূর্ণ পাল্টে গেছে আমেরিকার প্রভাবে যুদ্ধের পর। যে কোন
দেশের সঙ্গে অন্য দেশের
মৈত্রীবন্ধন ঘটে পারস্পরিক ঐতিহাসিক সম্পর্ককে ভিত্তি করে।
সৌভাগ্যের কথা যে, জাপান ও বাংলাদেশ দুদেশের মধ্যেই সেই সম্পর্কটা কমপক্ষে
শতবর্ষ ধরেই বিদ্যমান।
কিন্তু কেউ সেটা যেমন লিখে রাখেনি তেমনি সরকারিভাবেও গ্রন্থিত করার উদ্যোগ
বিগত চল্লিশ বছরেও গৃহীত
হয়নি। সৌভাগ্যের পাশাপাশি এটা দুর্ভাগ্য বলেও স্বীকার করতে হবে। জানা গেছে,
প্রধানমন্ত্রীর জাপান আগমন
উপলক্ষে প্রবাসী খ্যাতিমান শিক্ষক, সাংবাদিক ও ফরেন করেসপন্ডেন্টস ক্লাবের
প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট মনজুরুল হক
একটি সাংবাদিক সম্মেলনের আয়োজন করেছিলেন অনুরূপ বঙ্গবন্ধু পরিষদ জাপান
শাখার সভাপতি শেখ এমদাদ
কতর্ৃকও স্বনামধন্য আওয়ামা গাকুইন দাইগাকু বিশ্ববিদ্যালয়ে বক্তৃতার ব্যবস্থা
করা হয়েছিল কিন্তু কোন এক রহস্যময়
কারণে দুটোই বাতিল করা হয়। তবে প্রভাবশালী কিয়োদো সংবাদ সংস্থা, এনএইচকে ও
দৈনিক নিক্কেইশিম্বুন
পত্রিকা প্রধানমন্ত্রীর সাক্ষাৎকার গ্রহণ করেছেন বলে জানা যায়, যদিওবা
যথাসময়ে তা প্রকাশিত না হওয়াতে
ফলাফল খুব একটা অনুকূল হবে মনে করা যায় না যেটা হতে পারত সংবাদ সম্মেলনের
মাধ্যমে দ্রুত। এই সুযোগটা
কেন হাতছাড়া করা হল তার কারণ বাস্তবিকই বোধগম্য নয়। এই সম্মেলনের সূত্র
ধরেই সাংবাদিকরা প্রধানমন্ত্রীকে
অনুসরণ করতেন তিনি কোথায় যান এবং কি করেন?
অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় যে, জাপানের প্রধানমন্ত্রী নাওতো কান ও সম্রাট
আকিহিতোর সঙ্গে সাক্ষাৎ; সংসদীয়
সভা, ব্যবসায়ীদের সঙ্গে মতবিনিময়, হিরোশিমা জাদুঘরে বক্তৃতা প্রদান ইত্যাদি
একাধিক ঘটনার সংবাদ কোন
কোন জাতীয় দৈনিকে এসেছে ছবি ছাড়াই অত্যন্ত সাদামাটা ও সংক্ষিপ্তাকারে।
অনেকের মতো প্রধানমন্ত্রীর
সফরসঙ্গী পররাষ্ট্র সচিব এবং একদা টোকিওস্থ বাংলাদেশ দূতাবাসের দ্বিতীয়
সচিব মোহাম্মদ মিজারুল কায়েসও
মনে করেন, বাংলাদেশ মূলত গ্রহীতার ভূমিকায় অধিষ্ঠিত যে কারণে গণমাধ্যমে
গুরুত্ব পায়নি।
শুধু এবারই নয় একমাত্র বঙ্গবন্ধু ছাড়া বাংলাদেশের আর কোন প্রেসিডেন্ট,
প্রধানমন্ত্রী যতবারই জাপান সফর
করেছেন জাপানি জাতীয় গণমাধ্যমে তাঁরা চিত্রসমেত সংবাদের শিরোনাম হতে পারেননি।
এটা সফরকারীদের
কাম্য না হলেও দুদেশের জনগণ এবং প্রবাসীদের প্রত্যাশা পূরণ, ভাবমূর্তি
উজ্জ্বল করার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ বৈকি!
তবে পররাষ্ট্র সচিবের কথামতো এটাও যুক্তিসঙ্গত যে, অর্থ সাহায্য ও
বাণিজ্যিক ঘাটতি কমিয়ে আনার জন্য
প্রচলিত মানসিকতার পরিবর্তন দরকার। তাঁর মতে, জাপানি প্রবীণ কিছু রাজনীতিক,
সাংসদ আছেন যাঁরা
সবসময়ই মনে করে থাকেন বাংলাদেশ দরিদ্র, ঐ দেশে ওডিএ, অর্থ সাহায্য, ঋণ যত
দেয়া যায় ততই ভালো।
বাংলাদেশ কিন্তু যথেষ্ট এগিয়ে গেছে তারপরও এখনো এঁরা এই চিন্তাটাই করেন।
কিন্তু বাংলাদেশ যে এখন থেকে
ওডিএ বা অর্থনৈতিক সাহায্যের চেয়ে বরং অর্থনৈতিক অংশীদারিত্বের মাধ্যমে
বাংলাদেশকে উন্নত করতে আগ্রহী
সেটা তাঁদের বিবেচনা করা দরকার। তাই এবারের সফরে ইপিএ (ইকোনোমিক
পার্টনারশিপ এগ্রিমেন্ট) বিষয়টি
গুরুত্বসহকারে বিবেচিত ও গৃহীত হয়েছে। বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পে যৌথভাবে
কাজ করার জন্য বিশ দফা প্রস্তাবও
গৃহীত হয়েছে কাগজে কলমে। সেগুলো কতখানি বাস্তবায়িত হবে সেটাই দেখার বিষয়।
তথাপি জাপানে বাংলাদেশের দারিদ্রের বা গ্রহীতার ভাবমূর্তি যে খুব দ্রুত
পরিবর্তিত হবে এমনটি মনে করার কারণ
নেই। কাজেই এ ক্ষেত্রে প্রচার মাধ্যমের কল্যাণে অর্থ-বাণিজ্যের বাইরে
দুদেশের সম্পর্ককে যে অন্যরকম একটি
রূপ দেয়া যেত শতবর্ষ সম্পর্কের ইতিহাস থেকে উদাহরণ তুলে সেটা সম্ভব হয়নি
সম্ভবত ইতিহাসটাই না জানার
কারণে। কিন্তু এটা ছিল একটা বিরাট সুযোগ বিশেষত শেখ হাসিনার জন্য কারণ
বাঙালি জাতীয়তাবাদের প্রশ্নে
তিনি যদি জাপানে আজও স্মরণীয় নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর স্মারকমূর্তিটি
পরিদর্শনে যেতেন যা টোকিওর মধ্যেই
বিদ্যমান তাহলে মহাভারত অশুদ্ধ হত না। আমরা জানি যে, বঙ্গবন্ধুর আদর্শ
ছিলেন নেতাজি। এবং তাঁকে অনেক
রাজনীতিসচেতন জাপানি জানেন নেতাজির শেষ উত্তরসূরি হিসেবে।
এই মূর্তি পরিদর্শন প্রসঙ্গে যখন এখানকার কোন কোন আওয়ামী লীগ নেতার সঙ্গে
কথা বললাম, তারা জানালেন
যে, প্রধানমন্ত্রী নেতাজি দর্শনে গেলে পরে রাজনৈতিকভাবে প্রশ্ন উঠবে বিরোধী
মহল থেকে! কারণ নেতাজি এখন
বাংলাদেশের কেউ নন, তেমনি টোকিও ট্রাইব্যুনালের বাঙালি বিচারপতি ডঃ
রাধাবিনোদ পালও। তাঁরা ভারতীয় বলে পরিচিত। কিন্তু এ দুজন নমস্য বাঙালি এবং
রবীন্দ্রনাথ বিষয়ে বিরোধী মহলের কি চিন্তাভাবনা তা অবান ্তর
প্রশ্ন। অর্বাচীনরা তো কত কিছুই বলে! তাদের মূল্যহীন কথাবার্তা শুনে
ইতিহাসকে পাশ কাটানো তো আওয়ামী
লীগের রাজনীতি হতে পারে না! নেতাজি ও পাল যদি ভারতীয় হবে তাহলে তো
রবীন্দ্রনাথকে বাদ দিতে হয়
বাংলাদেশ থেকে!
তিনি তো বাংলাদেশে জন্মগ্রহণ করেননি তাহলে তাঁর গান কেন আমাদের জাতীয়
সঙ্গীত হবে? নোবেল বিজয়ী
অমর্ত্য সেনকে কেন বাংলাদেশে সংবর্ধনা প্রদান করা হয়? বিচারপতি পালের জন্ম
বাংলাদেশের কুষ্টিয়াতে, মানুষ
হয়েছেন ভারতে, জীবনের প্রথম বেশ কয়েকটি বছর চাকরি করেছেন ময়মনসিংহ জেলার
আনন্দমোহন কলেজে,
জাপানিরা তাঁকে সম্মান দিচ্ছেন, এবং তাঁরা কারা? এই প্রভাবশালী জাপানিরা
তাঁরাই যাঁরা বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠ বন্ধু
বা শুভাকাঙ্খী ছিলেন এবং আছেন এখনো, যেমন মাসাআকি তানাকা, কাকুয়েই তানাকা,
তাকেশি হায়াকাওয়া,
ইতো কোওসুকে, তাদামাসা ফুকিউরা, হিরোশি মিৎসুজুকা, শিন সাকুরাই, তামোন
ইশিকাওয়া, ডঃ কাজুও আজুমা,
ডঃ পেমা গিয়ালপো প্রমুখ।
কানাগাওয়া-প্রিফেকচারের হাকোনে শহরে অবস্থিত পাল-শিমোনাকা স্মৃতিসদনে
পদার্পণ করে, টোকিওর
ইয়াসুকুনি মন্দিরে রক্ষিত স্মৃতিফলকের সামনে দাঁড়িয়ে কিংবা জাতীয় সংসদে বসে
ভিন্নভাষী ভারতীয় নেতারা
যদি সম্মান জানাতে পারেন তাহলে বাঙালি হিসেবে নেতাজি, বিচারপতি পালকে
শ্রদ্ধা জানালে ক্ষতিটা কোথায়?
স্বাধীনচেতা বীরশ্রেষ্ঠ মানুষ এবং মনীষীরা তো জাতপাতদেশকালধর্মের ঊধের্্ব।
আমরা কিন্তু তাঁদেরকে এই শ্রদ্ধা
জানানোর বিষয়টি বিএনপি, জাতীয় পার্টি ও জামাতের কাছে আশা করতে পারি না
সঙ্গত কারণেই।
তবুও মনে হয় ইতিহাসটা জানা না থাকার কারণে শেখ হাসিনা তাঁর পরিকল্পনায়
স্থান দেননি নেতাজি, পালকে
শ্রদ্ধা জানানোর বিষয়টিকে। জানেন না বলেই হয়ত হিরোশিমা জাদুঘরে শান্তির নামে
বক্তৃতা দিয়েছেন সেই
জাদুঘরের কাছেই হোনশোজি বৌদ্ধমন্দির প্রাঙ্গণে ছিল স্বনামধন্য শান্তিবাদী
আন্দোলনকমর্ী বিচারপতি ডঃ
রাধাবিনোদ পালের স্বহস্তে মাতৃভাষায় লিখিত ও পাথরে খোদিত শান্তির বাণী।
বক্তৃতায় তিনি বলতে পারতেন
(জানি না বলেছেন কিনা) যুদ্ধের পর পরই হিরোশিমাকে কেন্দ্র করে যে
বিশ্বশান্তি আন্দোলনের জন্ম হয়েছিল তার
অন্যতম প্রধান উদ্যোক্তা ছিলেন উক্ত বিচারপতি ডঃ পালই, যিনি ১৯৬৬ সালে
জাপানের শোওয়া সম্রাট
হিরোহিতোর হাত থেকে রাষ্ট্রীয় পদক গ্রহণ করেছিলেন।
সেই সম্রাটের পুত্র আকিহিতো আজকে সম্রাট। তিনি যখন যুবরাজ ছিলেন যুবরানিকে
নিয়ে ১৯৭৫ সালের
ফেব্রুয়ারি মাসে নেপাল যাওয়ার পথে বাংলাদেশে গিয়েছিলেন। তাঁর এই ভ্রমণকে
উৎসাহিত করেছিলেন বঙ্গবন্ধুর
ভক্ত ও বন্ধু রেডক্রস জাপানের প্রাক্তন প্রধান কর্মকর্তা, পতাকা বিশেষজ্ঞ,
ইউরেশিয়া গবেষণা সংস্থার চেয়ারম্যান,
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ওপর লিখিত প্রামাণ্য গ্রন্থের একমাত্র জাপানি
লেখক তাদামাসা ফুকিউরা। প্রধানমন্ত্রীর
সফর উপলক্ষে আয়োজিত কোন অনুষ্ঠানেই তাঁকে দেখা যায়নি। দেখা যায়নি যিনি
জাপানিতে প্রায় সাড়ে পাঁচশ
পৃষ্ঠার বাংলাদেশের ইতিহাস গ্রন্থ লিখেছেন, বাংলাদেশকে নিয়ে সবসময় ভাবেন,
শেখ হাসিনার সফর নিয়ে
উদ্বিগ্ন ছিলেন প্রাক্তন জাপানি রাষ্ট্রদূত মাৎসুশিরো হোরিগুচিকেও।
আরও অনেক জাপানি শুভাকাঙ্খীকেও দেখা যায়নি। এমনকি কিংবদন্তীতুল্য
রবীন্দ্রগবেষক ও বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠ বন্ধু
অধ্যাপক ডঃ কাজুও আজুমা যে মৃতু্যযশ্যায় শায়িত তাও শেখ হাসিনা জানতেন না!
তাঁকে জানানো হয়নি। ২০০৪
সালের ২১শে আগস্ট আওয়ামী লীগ নেত্রীর ওপর যে প্রাণঘাতী বোমাহামলা হয়েছে
তাঁর খবর যখন অধ্যাপক
আজুমাকে দিয়েছিলাম তিনি অাঁতকে উঠেছিলেন! দুশ্চিন্তাগ ্রস্ত হয়ে পড়েছিলেন
অসুস্থ শরীর নিয়ে। বিরোধী দলের
নেত্রী হিসেবে শেখ হাসিনা একটি চিঠি পাঠিয়েছিলেন বিশ্বের বিভিন্ন দেশের
বন্ধু ও শুভাকাঙ্খীদের কাছে।
জাপানে সেই চিঠি নিয়ে এসেছিলেন অনুজপ্রতিম বন্ধু শেখ এমদাদ, বঙ্গবন্ধু
পরিষদ জাপান শাখার সভাপতি।
তার অনুরোধে সেই চিঠিসহ তাকে নিয়ে যাই অধ্যাপক আজুমার কাছে। অসুস্থ শরীর
নিয়ে কয়েক দিন লাগিয়ে
সেই চিঠি ইংরেজি থেকে জাপানি ভাষায় অনুবাদ করেন, সাংবাদিককে আমন্ত্রণ জানিয়ে
পত্রিকায় প্রকাশের ব্যবস্থা
করেন। প্রভাবশালী জাপানিদের কাছে সেই চিঠি পৌঁছে দেয় এমদাদ, স্থানীয় আওয়ামী
লীগের কেউ সেটা
করেননি। ২০০৮ সালের নির্বাচনে ক্ষমতাসীন হওয়ার পর আজুমা স্যারকে স্বয়ং
নেত্রী, কোন নেতা বা রাষ্ট্রদূত
'ধন্যবাদ' জানিয়েছেন বলে জানা নেই।
যদি ধরে নিই জাপানিরা কিছু না কিছু সংবাদ বা কৌতূহল হলেও রাখেন বাংলাদেশ
সম্পর্কে যেমন প্রধানমন্ত্রী
নাওতো কান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে বলেছেন, যখন আপনার পিতা বাংলাদেশের
পতাকাটি তৈরি করেন তখন নিশ্চয়ই তাঁর মনে ছিল জাপানের পতাকার কথা। জাপানের
পতাকার সঙ্গে বাংলাদেশের পতাকার নিবিড় মিল
লক্ষণীয়। তাই আমার মনে হয়, বাংলাদেশ ও জাপানের সম্পর্ক ভাইভাই সস্পর্ক।
নাওতো কান শেখ হাসিনাকে বোন বলেও সম্বোধন করেছেন। এ পর্যন্ত প্রচুর বই
প্রকাশিত হয়েছে জাপানি ভাষায়
বাংলাদেশ সম্পর্কে। প্রশ্ন জাগে, সেই তুলনায় আমরা কতখানি জাপান সম্পর্কে
জানি বা কয়টা গ্রন্থ লিখেছি? চিন্তা
করলে সুস্পষ্টভাবেই দেখা যায় যে, বাঙালির মানসিক দীনতাই বাঙালির অর্থনৈতিক
দারিদ্রের জন্য দায়ী। তাই
জাপানের সঙ্গে সুপ্রাচীন সম্পর্ক থাকা সত্ত্বেও তাকে উন্নয়নের কাজে লাগাতে
ব্যর্থ হয়েছে বঙ্গবন্ধুর উত্তরাধিকারী
অনুসারীরা। আওয়ামী লীগ জাপান শাখাও বিগত বিশ বছরে জাপানিদের সঙ্গে শিক্ষা,
সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক
কোন দিক দিয়েই বিনিময় সম্পর্ক গড়ে তুলতে পারেনি। সে আগ্রহও কারো আছে বলে
মনে হয় না।
থাকলে এক যুগ পর বঙ্গবন্ধুকন্যা প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনার এবারের
জাপান সফর সত্যি অন্যরকম হত।
উচ্চশিক্ষা ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রটিও গুরুত্ব পেত, এক তরফা
অর্থনীতি-বাণিজ্যের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকত না। আওয়ামী
অনুসারীদের সত্যিকার আগ্রহ যদি থাকত তাহলে দূতাবাস এবং বিশিষ্ট প্রবাসীদের
নিয়ে সহযোগিতা, অভিজ্ঞতার
ভিত্তিতে প্রধানমন্ত্রীকে প্রদত্ত নাগরিক সংবর্ধনাটি আরও সুশৃঙ্খল, অর্থবহ
এবং স্মরণীয় অনুষ্ঠানে পরিণত করা যেত।
এমন একটি দুর্লভ অনুষ্ঠানে অনেক বিশিষ্ট জাপানি ও প্রবাসীকে নিমন্ত্রণ করা
হয়নি বলে অভিযোগ শোনা যাচ্ছে।
আরও দৃষ্টিকটূ ঠেকেছে অনেক জাপানি অতিথি খাবার পাননি দেখে। কোমল পানীয়ও না
পেয়ে খালি মুখেই
ফিরে গেছেন। অতিথিদের তত্ত্বাবধান করার মতো কেউ ছিল না।
উক্ত নাগরিক সংবর্ধনায় প্রধানমন্ত্রী তাঁর বক্তৃতায় প্রথমেই বলেছেন 'জাপান
স্বপ্নের দেশ', 'জাপান উন্নত দেশ' এবং
শেষের দিকে বলেছেন 'গ্রামীণ কৃষি সভ্যতা থেকে কিভাবে জাপান শিল্পোন্নত দেশে
রূপান্তরিত হয়েছে তা
আমাদেরকে বিস্মিত করে! আমরাও জাপানের মতো বাংলাদেশকে গড়তে চাই।' বঙ্গবন্ধুও
জাপান সফরকালে
এই স্বপ্ন দেখেছিলেন। তিনি গড়তে পারেননি। কিন্তু শেখ হাসিনা সফল হতে পারেন
যদি সত্যিকার দেশপ্রেমিক,
জাতীয়তাবাদী চেতনায় উদ্বুদ্ধ প্রবাসীদেরকে তিনি নিজস্ব তত্ত্বাবধানে
বিদ্যালয়ে, মাঠে, ময়দানে, গ্রামে, নদীতে,
সাগরে কাজে লাগাতে পারেন।
জাপান গণতন্ত্রের উষালগ্ন মেইজি যুগেই (১৮৬৮-১৯১২) বহির্বিশ্বের শিক্ষা,
জ্ঞান, প্রযুক্তি, বিজ্ঞান এবং
পদ্ধতিসমূহ শিক্ষালাভের জন্য বহু ছাত্রকে বিভিন্ন উন্নত দেশে পাঠিয়েছিল,
অনেক বিদেশী শিক্ষক ও প্রযুক্তিবিদকে
জাপানে আমন্ত্রণ করে আনা হয়েছিল বিভিন্ন উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে। ঘরে-বাইরে
সুশিক্ষাপ্রাপ্ত দেশাত্মবোধে উদীপ্ত
তরুণরাই আধুনিক জাপানকে গড়ে তুলেছিল। আজকে বহু প্রবাসী বিদেশে শিক্ষাবিদ,
প্রযুক্তিবিদ, বিজ্ঞানী,
ব্যবসায়ী তাঁদেরকে ফিরিয়ে নিতে হবে সম্মান দিয়ে, কাজে লাগাতে হবে। দেশীয়
'আন্দাজি' উপদেষ্টা, মন্ত্রী,
সচিব, ছাত্রনেতা, দুর্বল প্রবাসী নেতাদের দিয়ে স্বপ্নের দেশ বা সোনার বাংলা
গড়া যাবে না বলাই বাহুল্য।
বঙ্গবন্ধু খাঁটি কথাই বলেছিলেন, সোনার বাংলা গড়তে হলে সোনার মানুষ চাই, সেই
সোনার মানুষের সন্ধানেই
নেত্রীকে বের হতে হবে। মানুষকে চাটুকার করা সহজ, সহযোগী কর্মী করা সহজ নয়
এটা তাঁকে বুঝতে হবে এই
সফর আমাদেরকে তাই মনে করিয়ে দিল।
probirsrkr06@gmail.com
[প্রথমপাতা] |
|