[প্রথমপাতা]

 

 

 

বুকের মধ্যে সুগন্ধি রুমাল
 
 

- বিশ্বজিৎ চৌধুরী -

 


আমি বলছি ১৯৮৬ সালের কথা। গল্পটা আপনাদের বলছি, কারণ যে কথাটি যাকে বলবো ভেবেছি, তাকে কখনো বলতে পারিনি।
আমি বলেছিলাম, ‘তোমাকে একটা কথা বলবো নীলু আপা, অনেকদিন ধরে ভাবছি বলবো...।’ শুনে নীলু আপা অবাক হয়ে বলেছিল, ‘আরে আমিও তো তোকে একটা কথা বলবো বলবো ভাবছি কদিন থেকে।’
‘তাহলে তোমারটা আগে বলো।’
‘না তোরটা আগে বল।’
আগে তুমি, আগে তুই Ñ এই করতে করতে কথা আর বলা হলো না কারোরই। আমরা আগের মতো নানা রকম গল্প করি, ঘরের গল্প, কলেজের গল্প, সহপাঠীর গল্প, সহপাঠিনীর সঙ্গে শিক্ষকের প্রেমের গল্প, এমনকি কাজের বুয়ার সঙ্গে ড্রাইভারের বিশেষ সম্পর্কের গল্প পর্যন্ত। কিন্তু যে কথা বলবো বলে দুরুদুরু দুপুরে ছাদে উঠেছি, গোসলের সময় শাওয়ারের নীচে দাঁড়িয়ে রিহার্সেল করেছি সেকথা আর বলা হয় না। মাঝে মাঝে নীলু আপাকে মনে করিয়ে দিই, একটা কথা বলবে বলেছিলে... নীলু আপার এককথা, আগে তোরটা বল।
আমরা একই বিল্ডিংয়ে থাকি। নীলু আপারা চারতলার ডানদিকে, আমরা তিনতলার মাঝখানের ফ্ল্যাটে। নীলু আপাদের বাড়িতে আমরা ভাড়ায় থাকি। আমি এবার সরকারি কলেজে ঢুকেছি ইন্টারমিডিয়েট ফার্স্ট ইয়ার। নীলু আপার রেজাল্ট ভালো না বলে অনার্সে চান্স পায়নি, গ্র্যাজুয়েশন করছে মহিলা কলেজে।
নীলু আপার সাথে আমার পরিচয় হয়েছিল ছাদে, এক ঘুড়ি ওড়া বিকেলে। বিল্ডিংয়ের ছেলেরা তখন কেউ ঘুড়ি ওড়াচ্ছে, কেউ দর্শক হয়ে কাটাকুটি খেলায় খেলোয়াড়দের উৎসাহ দিচ্ছে। আমাকে একা এককোণে বোগেনভেলিয়ার ঝোপের পাশে বসে থাকতে দেখে এগিয়ে এসে বলেছিলো, ‘তোমরা তিনতলায় নতুন এসেছো?’
মাথা নেড়ে জানিয়েছিলাম, ‘হ্যাঁ।’
সেই থেকে রোজই প্রায় দেখা হয় ছাদে। সেটা ১৯৮৬ সাল। আকাশে ঘুড়ি ওড়ে, খেলোয়াড় ও দর্শকেরা হৈ-হুল্লোড় করে। আমরা তাতে কর্ণপাত করি না Ñ দুজনে বোগেনভেলিয়ার পাশে বসে কত শত বিষয় নিয়ে গল্প করি। কথা ফুরিয়ে গেলে নীলু আপা মাঝে মাঝে গুনগুন করে গান করে, ‘তুমি কি কেবলই ছবি’, ‘আমি যার নূপুরের ছন্দ...।’ গানের গলাটা ভালো, কিন্তু চর্চার অভাবে বোধকরি সুর থেকে সরে যায় কখনো। আমার আনাড়ি কানেও তা লাগে। কিন্তু আমি অকাতরে প্রশংসা করি। শ্রোতার সমর্থন পেয়ে নীলু আপার ফর্সা মুখটা একটু লাল হয়ে ওঠে। এরকমই এক প্রশংসাধন্য মুহূর্তে নীলু আপা তুমি থেকে তুই তে নেমে এসেছিল। আমারও সংকোচ কমে আসছিল, তুমিতে নামতে কোনো সমস্যা হয়নি। আমি এক-আধটু আবৃত্তি করতে পারি। নীলু আপার প্রবল উৎসাহে সুনীল, রফিক আজাদ, আবুল হাসানের কবিতার বই নিয়ে ছাদে উঠি। কখনো আবৃত্তি করিÑ ‘বালক ভুল করে নেমেছে ভুল জলে/পড়েনি ব্যাকরণ পড়েনি মূল বই/বালক ভুল করে পড়েছে ভুল বই...।’ তবে সুনীলের ‘কেউ কথা রাখেনি’ কবিতাটা ভারি পছন্দের নীলু আপার, আমাকে বারবার বলে, ‘এই বয়সে তোর হাস্কি ভয়েজ, খুব ভালো লাগে, ওই কবিতাটা আবার একটু পড় তো।’
আমি চোখ বন্ধ করে মন উজাড় করে আবৃত্তি করি: ‘বুকের মধ্যে সুগন্ধি রুমাল রেখে বরুনা বলেছিল/ যেদিন আমায় সত্যিকারের ভালোবাসবে/সেদিন আমার বুকেও এরকম আতরের গন্ধ হবে/আমি ভালোবাসার জন্য হাতের মুঠোয় প্রাণ নিয়েছি/দূরন্ত ষাঁড়ের চোখে বেঁধেছি লাল কাপড়/সমস্ত বিশ্বসংসার তন্নতন্ন করে খুঁজে এনেছি একশো আটটা নীলপদ্ম/তবু কথা রাখেনি বরুণা’।
প্রতিবার এই কবিতার আবৃত্তি শেষ হলে কেন জানি নীলু আপা বড় করে একটা শ্বাস ফ্যালে, কিছুটা উদাসীনও কি হয়ে পড়ে?
এভাবে প্রতিদিন বিকেলে, কোনো কোনো ছুটির দিন দুপুরের নির্জনতায়ও আমরা ছাদে উঠে আসি। আকাশে কত ঘুড়ি ওড়ে, কত ঘুড়ি কাটা পড়ে, বাতাসে ভেসে অনেক দূরে উড়ে যায়। আমাদের গল্প তখনো শেষ হয় না।
এরমধ্যে একদিন বেপরোয়া হয়ে ভাবলাম বলেই ফেলি, কথার ভার আর বইতে পারছি না। কলেজ থেকে ফেরার পথে নীলু আপার কলেজের সামনে এসে দাঁড়ালাম। রিকশায় একসাথে ফিরবো Ñ পাশাপাশি বসে মুখের দিকে না তাকিয়ে কথাটা বলা অনেক সহজ হবে। আমি গেটের দিকে চোখ রেখে দাঁড়িয়ে আছি। নীলু আপাকে বেরিয়ে আসতে দেখে যখন বুকের ভেতর ঢিপঢিপ শব্দ হচ্ছিলো, তখন হঠাৎ কোত্থেকে একটি মোটর বাইক এসে দাঁড়ালো গেটের কাছে। বাইকে সুদর্শন এক যুবক, খুব ভালো করে চেহারাটা দেখার সুযোগও হয়নি। নীলু আপা উঠে বসলো তার পেছনে, দুহাতে পেঁচিয়ে ধরলো তাকে। ফুস করে নিমেষে দৃষ্টি থেকে হারিয়ে গেল দুজন। সরু ধোঁয়ার রেখার দিকে তাকিয়ে কেমন তোলপাড় হয়ে গেল মনটা। আশ্চর্য! এতো গল্প কথা আমাদের। শুধু এই মানুষটার কথা কখনো আমাকে বললো না নীলু আপা! অভিমানে বুকটা টনটন করে ওঠে। এই নীলু আপার জন্য আমি বন্ধুদের সঙ্গে ক্রিকেট খেলতে যাই না। পাবলিক লাইব্রেরিতে গিয়ে প্রিয় লেখকের বই পড়া হয় না। সাইকেলটা পড়ে আছে বারান্দায়, কলেজ থেকে বাড়ি ফিরে এক চক্কর মাঠে ঘুরে আসার সময় হয় না।
ছাদে ওঠা বন্ধ করলাম। ভাবি, বিকেলটাকে এবার অন্যরকম করে সাজাতে হবে। আবার ক্রিকেট, আবার পাবলিক লাইব্রেরি, সাইকেলে চক্কর...। এরকম বেশ কটা দিন যাওয়ার পর হঠাৎ একদিন সিঁড়িতে দেখা নীলু আপার সঙ্গে।
‘কিরে ছাদে আসিস না আজকাল?’
‘একটু ব্যস্ত আছি নীলু আপা।’
অদ্ভুত মুখভঙ্গি করে নীলু আপা বললেন, ‘ব্যস্ত? বাব্বা, একেবারে সরকারের যুগ্মসচিব। আজ বিকেলে আসিস, কথা আছে তোর সঙ্গে।’
ঠিক করেছিলাম যাবো না। কিন্তু বিকেল হতে হতে আমার জেদ টলে গেল। বোগেনভেলিয়ার পাশে দাঁড়িয়ে নীলু আপা বললো, ‘রাগ করেছিস আমার ওপর?’
আমি কোনো ভনিতা না করে বললাম, ‘ওই লোকটির কথা তো কখনো বলোনি আমাকে?’
‘তুই দেখেছিস, না? ওর কথাইতো বলতে চেয়েছিলাম তোকে... বলবো বলবো করে বলা হয়নি।’
নীলু আপার প্রেমিকের নাম শ্যামল বিশ্বাস। অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করেছিলাম ‘হিন্দু? কী করে সম্ভব?
‘কেন সম্ভব না? এর আগে এরকম সম্পর্ক আর হয়নি?’
নীলু আপার জোর দেখে আমি চুপ মেরে যাই। আমাকে নিরুত্তর দেখে নীলু আপা নিজেই আবার একটু বিষণœ গলায় বললো, ‘কেন যে এরকম একটা ভুল করলাম, আম্মু-আব্বু শুনলে কী রকম দুঃখ পাবে ভেবে দ্যাখ, আমিই তো ওদের একমাত্র সন্তান...।’
কথা সত্যি, কিন্তু আমি কি বলবো। নীলু আপা একবার বিষণœ হয়ে, একবার উচ্ছ্বসিত হয়ে শ্যামল বিশ্বাসের গল্প বলতে থাকে। অর্থনীতিতে মাস্টার্স করে বেসরকারি ফার্মে চাকরি করছে। দেখতে যেমন, তেমনি তার মার্জিত আচরণ। বান্ধবী কবিতার বাসায় বেড়াতে গিয়ে ওর ভাই শ্যামলের সঙ্গে পরিচয়। প্রথম দেখাতেই মনে হয়েছিল... ইত্যাদি ইত্যাদি।
আমার শুনতে ভালো লাগে না। তবু বোকার মতো শুনি। এরপর থেকে আমাদের ছাদের গল্পে প্রধান চরিত্র শ্যামল। আকাশে ঘুড়ি ওড়ে, ঘুড়ি কেটে যায়। গল্প ফুরোয় না। নীলু আপা একাই কথা বলে, আমি শুধু হাঁ হুঁ করি। সেটা ১৯৮৬ সাল।
এরমধ্যে হঠাৎ জ্বর বাধিয়ে বসলাম। ভাইরাল ফিবার। সারা শরীরে ব্যথা, মাথায় প্রচণ্ড যন্ত্রণা। একেকবার জ্বর বেড়ে একশো তিন/চার ছাড়িয়ে যায়। জ্বরের ঘোরে উল্টোপাল্টা বকতে থাকি। আমার মা সারারাত কপালে জলপট্টি দিতে দিতে একসময় আমার পাশে শুয়ে পড়ে। বাবা ডাক্তার ডেকে আনেন, দুদিন অফিস কামাই হয় তাঁর। প্রায় নয়দিনের মাথায় জ্বর ছাড়লো। মুখটা তেতো, সবকিছু বিস্বাদ লাগে। একদিন মা বললো, ‘আচ্ছা, শ্যামল বিশ্বাসটা কে?’
‘শ্যামল বিশ্বাস?’Ñআমি চমকে উঠি, ‘কেন?’
‘না, তুই জ্বরের ঘোরে বারবার ওই নামটা বলছিলি।’
আমি উত্তর দিই না। দশ দিনের দিন শেষ বিকেলে দুর্বল শরীরে ছাদে উঠি আমি। ঘুড়িওলাদের হুল্লোড় তখন কমে গেছে। ঘুড়িগুলো নেমে আসছে আকাশে কালো মেঘ দেখে। বোগেনভেলিয়ার পাশে বসে ছিল নীলু আপা। আমাকে দেখে খুশির ঝিলিক তার চোখেমুখে। ছুটে এসে আমার কপালে হাত দিয়ে নিশ্চিত হলো জ্বর নেই।
‘কদিন খুব ভুগলি, না? কেমন রোগা হয়ে গেছিস... তোকে দেখতে যাবো ইচ্ছে করছিল খুব, আবার আন্টি কী মনে করেন...।’
আকাশে বিজলি চমকায়। ঘুড়িওলারা পাততাড়ি গুটিয়ে দুদ্দাড় করে নেমে যায় ছাদ থেকে। আমরা সিঁড়িঘরের কার্নিশের নিচে বসি। আমি কথা খুঁজে না পেয়ে জিজ্ঞেস করি, ‘শ্যামল দা কেমন আছে?’
হঠাৎ ঘন মেঘের বিষণœতা নেমে আসে নীলু আপার চেহারায়, এরমধ্যে একবার যেন বিজলি চমকাল চোখে, ‘ওই নামটা আর কখনো মুখে আনবি না আমার সামনে।’
‘কেন, কী হয়েছে নীলু আপা?’
নীলু আপা নিরুত্তর, তার দৃষ্টি সজল। তখন আকাশ ঝাঁপিয়ে বৃষ্টি নামে। বৃষ্টির ছাঁট বাঁচাতে আমরা কার্নিশের আরো ভেতরের দিকে সরে আসি। সন্ধ্যার আগেই ছাদে অন্ধকার নেমে আসে। কার্নিশের অল্প পাওয়ারের বাল্বের আলোতে বৃষ্টির ফোঁটাগুলোকে অদ্ভূত রহস্যময় মনে হয়।
‘ওকে বিশ্বাস করে আমি বড় ভুল করেছিলাম, ভালোই হলো...।’ নীলু আপার হাহাকার যেন বৃষ্টির শব্দে হারিয়ে যায়।
হঠাৎ কী মনে করে নীলু আপা বললো, ‘অনেকদিন বৃষ্টিতে ভিজি না, তুই এখানে বোস, আমি একটু বৃষ্টিতে ভিজে আসি।’
দুহাত মেলে দিয়ে নাচের ভঙ্গিতে বৃষ্টিতে ভিজছে নীলু আপা। আলো-আঁধারিতে কী অপূর্ব দেখাচ্ছে ওকে। আজ মনে হলো নীলু আপার চেয়ে সুন্দর মেয়ে আমি জীবনে দেখিনি।
কার্নিশের নিচে ফিরে এলে আমি অবাক হয়ে নীলু আপার দিকে চেয়ে থাকি। জামা কাপড় ভেজা, চুল চোখ মুখ বেয়ে জল গড়াচ্ছে। আমার কাছ থেকে চোখের জল আড়াল করার জন্যেই কি বৃষ্টিতে ভিজে এল নীলু আপা? Ñএরকম একটি কথা আমার মনে আসতেই কালো-আকাশকে দু ফালি করে দিয়ে বিজলি চমকালো। কার্নিশের একমাত্র আলোটিও নিভে গিয়ে ঝুপ্ করে নেমে এলো অন্ধকার। কেন জানি হঠাৎ গভীর আবেগে নীলু আপাকে জড়িয়ে ধরলাম আমি। নীলু আপা একটু কেঁপে উঠেছিল, কিন্তু সরিয়ে দিলো না, বরং আমার মাথাটা টেনে নিলো মমতায়।
‘তোমাকে একটা কথা বলবো ভেবেছিলাম... বলতে পারিনি।’
আমার চুলে বিলি কাটতে কাটতে নীলু আপা বললো, ‘সব কথা কি মুখে বলতে হয় রে বোকা?’
তাইতো, সব কথা কি মুখে বলতে হয়? আমি মুখে কোনো কথা বলি না। নীলুর আপার বুকে নাক ডুবিয়ে সুগন্ধি রুমালটা খুঁজি, মনে মনে আবৃত্তি করিÑ‘বুকের মধ্যে সুগন্ধি রুমাল রেখে বরুণা বলেছিল/যেদিন আমায় সত্যিকারের ভালোবাসবে/সেদিন আমার বুকেও এরকম আতরের গন্ধ হবে...।’
তখন ১৯৮৬ সাল।

 

ARNING: Any unauthorized use or reproduction of 'Community' content is strictly prohibited and constitutes copyright infringement liable to legal action. 

[প্রথমপাতা]