[প্রথমপাতা]
|
পরাজিত হলেও রাজাকার পর্ব শেষ হয়ে যায়নি
শরীফা বুলবুল
সাম্প্রদায়িকতা বাংলাদেশের মানুষের সহজাত প্রবণতা নয়। এটা এবারের নির্বাচনে
বাংলাদেশের অসাম্প্রদায়িক মানুষ আবারও তা প্রমাণ করে দিয়েছে। ধর্মব্যবসায়ীদের
এতে হার হয়েছে ঠিকই। কিন্তু এরা অন্যরূপে আবির্ভূত হচ্ছে। ভিন্ন ভিন্ন নামে।
চল্লিশ বছর ধরে এরা বাঙলার মানুষের কাছ থেকে একাত্তরের শোধ নিয়েছে। নিচ্ছে
নানাভাবে, নানা কায়দায়। বাংলাদেশে এক শ্রেণীর অপরাজনৈতিক শক্তির ছত্রছায়ায়
নির্বাচনউত্তর নিপীড়নের যে মর্মান্তিক ঘটনা ঘটানো হয়েছিল এটাও কারো অজানা নয়।
আর এ নির্মম অপরাজনীতির বলী হয়েছিল অধিকাংশ নীরিহ সংখ্যালঘু মানুষ। অন্ধকার
অপশক্তি প্রথম সুযোগেই ঝাঁপিয়ে পড়ে নিরীহ অরক্ষিত সংখ্যালঘুর উপর। লুণ্ঠন করে
নেয় তাদের সর্বস্ব-জানমাল-ইজ্জত। এককথায় চিরতরে পঙ্গু করে দেয় তাদের। অথচ যাদের
হারিয়ে গেল বা যায় তাদের অধিকাংশই রাজনীতির ‘র’ও বোঝে না। জীবনে রাজনৈতিক দলের
সাথে হয়ত সম্পৃক্তও হয়নি তারা। কিন্তু বরাবরই হীন স্বার্থে আমাদের দেশে ধর্মের
রাজনৈতিক ব্যবহার আগেও ঘটানো হয়েছে এখনও হচ্ছে। কারা কি কারণে এখানে
সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্ট করতে চায়, তা বুঝতে অপরাজনীতির এহেন জিঘাংসার
পিছনে যে আর্থ-রাজনৈতিক কারণ নিহিত আছে তা উপলব্ধি করার ক্ষমতা আমাদের
আমজনগোষ্ঠির নেই, এটাই আমাদের এক দূর্ভাগ্য।
এতো বড়ো পরাজয়ের শোধ নেবে না এটা ভাবার কোনো কারণ নেই। এদের ছড়িয়ে দেয়া নানা
বিষবাষ্পে দেশের বাতাস ভারী হয়ে আছে। এখনও চারপাশে উচ্চকণ্ঠে উচ্চারিত হয়
বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরুদ্ধে অশ্লীল গালাগাল। প্রগতিবিরোধী নানা তৎপরতা। এখন
যেদিকে তাকাই এখনও দেখি রাজাকার। এরা নানা কৌশলে ঢুকে যাচ্ছে সরকারের ভেতর।
বিভিন্ন অফিসে, বিভিন্ন ভবনে, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ে, সংস্কৃতির অলিগলিতে, জাতির
মননের প্রতীক বাংলা একাডেমিতে, গাড়িতে এমনকি গাড়ির নীচেও। বাংলাদেশ এখনও ডুবে
আছে প্রতিক্রিয়াশীলতার অতল আবর্জনার মধ্যে। একে বদলে দেয়ার শক্তি অর্জন করতে
চাই আরো বেশী সাহসীকতার সাথে সিদ্ধান্ত নেয়া। এসবের জন্য প্রতিভার দরকার হয় না।
প্রয়োজন কৌশল এবং দৃঢ়তা। সরকার বদলের সাথে সাথে এইসব নর্দমার কীটেরা এখন ভোল
পাল্টে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে ঘাপটি মেরে আছে। সুযোগ পেলেই এরা রাষ্ট্রের উপর
রাষ্ট্র হয়ে উঠবে। সামনে ধর্মের পতাকা রেখে। এ কথা কে না জানে ভেতরে পাপ বেড়ে
গেলে বাইরে ধর্মের পতাকা খুব বেশী ওড়াওড়ি করে। এই তো বছরখানেক আগে চট্টগ্রামের
আনোয়ারা থানার বন্দর বধ্যভূমির স্মৃতিফলক উদ্বোধনের আগের দিন রাজাকাররা প্রায়
অর্ধশতাধিক মুক্তিযোদ্ধাকে কুপিয়ে জখম করেছে। যেখানে একাত্তরে পাকি হানাদার এবং
তাদের এ দেশীয় দোসররা শত শত নীরিহ মানুষকে নির্বিচারে গুলি করে হত্যার মহোৎসবে
মেতে উঠেছিল। অথচ এখন মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি এবং একটি গণতান্ত্রিক সরকার
ক্ষমতায়। সরকারকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের আক্রমন করে গুরুতরভাবে
জখম করেছে। অতএব পরাজিত হলেও এটা ভাবার কোনো কারণ নেই যে বাংলাদেশের
বাস্তবতাজুড়ে এরা নেই। রাজাকার পরাজিত হলেও রাজাকার পর্ব এখনও শেষ হয়ে যায়নি।
এরা আমাদের বাস্তবতা এবং স্বপ্নলোক জুড়েই আছে।
এই স্বার্থান্বেষী ও দুষ্ট চক্র তাদের দূষিত জলবায়ু ছড়িয়ে দিয়ে ক্ষুদ্র
অচলায়তনে বন্দি করে ফেলেছে নিজেকে এবং তার সম্প্রদায়কে। যে কারণে স্থায়ীভাবে
নষ্ট হয়ে যাচ্ছে এদেশের শান্তি ও সংহতি, উন্নয়ন ও স্থিতিশীলতা। এর সাথে যুক্ত
হয়েছে রাজনীতি। এরা জনগণকে বারবার বিভ্রান্ত করছে ধর্মের রাজনৈতিক অপব্যবহারের
মাধ্যমে। অথচ এরা প্রকৃত ধর্মও চায় না। চায় কায়েম করতে মধ্যযুগ। চায়
সাম্প্রদায়িক বিষবাষ্প ছড়াতে। সাম্প্রদায়িক বিষবাষ্প থেকে তাই আমরা বেরিয়ে আসতে
পারছি না। তা অন্ধ দৈত্যের মতো আমাদের পায়ে পায়ে বেড়ি পরিয়েই চলেছে।
বলাবাহুল্য তা মূলে কাণ্ডে শাখায় প্রশাখায় বেড়েছে আশংখাজনকভাবে। মানুষের
সামগ্রিক পরিচয়ে এ সাম্প্রদায়িকতা মানবতারই বিশাল অধঃপতন বলে ধরে নেয়া যায়।
আমরা দেখি পুঁজিবাদী বিশ্বের সংকট থেকে মুক্তির উপায় খুঁজতে অন্ধ মানুষ ঝুঁকছে
ধর্মান্ধতার দিকে। আবার সাম্রাজ্যবাদও সুবিধা মতো সওয়ার হতে চাচ্ছে এ
অন্ধশক্তির পিঠে। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির অভিনব উৎকর্ষের এ যুগে এহেন
পশ্চাতমুখীনতা এক অদ্ভুত প্রহেলিকা ও সংকট সৃষ্টি করছে বারবার আমাদের সামনে।
সভ্য উন্নত সংস্কৃতির মানুষকে এ সংকট থেকে মুক্তির উপায় খুঁজতে হচ্ছে
প্রানপণভাবে। কারণ সাম্প্রদায়িক পরিচিতি মানুষে মানুষে মিলনে কখনও প্রতিবন্ধক
হতে পারে নি আমাদের দেশে। সম্ভবত পৃথিবীর অন্য কোনো দেশেও না। কেননা ধর্মের মূল
ব্যাপারটা যেহেতু বিশ্বাস সজ্ঞাত, সেটি বিরাজ করে অন্তঃলোকে, একান্ত নিজস্ব
সত্তায়। তার মর্মবাণী যে মানুষ অন্তরে সংবহন করে তার পক্ষে সংকীর্ণ এবং
কুপমণ্ডুক হওয়া অসম্ভব। যারা উদার দৃষ্টিভঙ্গীতে ধর্মকে অনুধাবন করতে পারেন না
তারাই ক্ষুদ্র অচলায়তনে বন্দী করে ফেলে নিজেকে। এইসব সাম্প্রদায়িক নাগিনীরা
নানা রূপে নানা মুখোশের আড়ালে মুখ লুকিয়ে দেশজুড়ে আবার তেড়ে আসছে বিষাক্ত
নিঃশ্বাস ফেলে। দ্রুত ছুটে আসছে এক অন্ধকার অপশক্তি যারা
মানবতা-সভ্যতা-সাহিত্য-সংস্কৃতি- এসবের কিছুই বোঝে না। বুঝতে চায়ও না। হালাকু
খানের মতো সমস্ত গ্রন্থাগার গুঁড়িয়ে দিয়ে তারা কায়েম করতে চায় এক বর্বর
সাম্রাজ্য। কিন্তু যারা এদেশের ফসল খেয়ে ফসিল হবে, তারা বাংলাদেশে বসে নানা
অপতৎপরতা চালাবে আর আমরা তা সহ্য করবো? এক বিন্দু রক্ত থাকতে আমরা তা কিছুতেই
হতে দেবো না, না কিছুতেই না। আমাদের মায়ের সম্ভ্রমের বস্ত্র আমরা আর কিছুতেই
লুণ্ঠিত হতে দেবো না। শহীদের রক্তের শপথ। এখানে কেউ স্বাধীনতা বিরোধী কথা কেউ
উচ্চারণ করলে যে যার অবস্থান থেকেই প্রতিহত করুন। যারা পারেননা তারা পারার
অভ্যাস করুন, আমরা অভ্যাস করিনা বলেই পারি না। আসুন আমরা অভ্যাস করি মুখোশের
আড়ালে লুকিয়ে থাকা মুখোশধারীদের মুখোশ খুলে নেয়ার। আর ভয় নয়।
দিন বদলের সরকারের কাছে আমাদের প্রত্যাশা আর দেরী নয়। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার
প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে বাংলাদেশকে প্রকৃতই স্বাধীন করে তুলুন। নয়তো আবারও নামবে
রাক্ষস, দৈত্য মূর্খের মিছিল! যাদের কালো চুল আবারও ঢেকে ফেলবে চতুর্দিক! যাদের
লোভের শিকার বাংলাদেশ। আমাদের প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশকে মুক্তি দেয়া হোক এই
অনির্দিষ্টকালের গ্রাস থেকে। কারন বেঁচে থাকা আর টিকে থাকা এক কথা নয়।
আমাদের বর্তমান এখনও ডুবে আছে প্রতিক্রিয়শীলতার ছায়ার নীচে, ভবিষ্যতও কি ডুবে
থাকবে?
লেখক: কবি ও সাংবাদিক
WARNING:
Any unauthorized use
or reproduction of
'Community' content is
strictly prohibited
and constitutes
copyright infringement
liable to legal
action.
[প্রথমপাতা] |
|