@ |
@ কেমন আছ সবুজপাতা
কন্টিনেন্টাল এয়ারলাইন্সের নারিতা-নূআকর্ ফ্লাইট। আমার গন্তব্য আরো দূরে।
নিউজার্সির এই এয়াপোটের্ চারঘন্টা বিরতি দিয়ে আবার ওয়াশিংটন ডিসি-র ডূলাসর্
(Dullus) এয়ারপোর্ট। সোয়াইন ফ্লুর কারণে বিশেষ সতর্কতা- যাত্রায় দেড়ঘন্টা
দেরী, ভালোই হলো ন-আর্ক- এ অপেক্ষার প্রহর কমলো। আসার আগের দিন মিলন ভাইয়ের সাথে দেখা করতে যাই ইকেবকুরোর হোটেল কক্ষে। ইমদাদুল হক মিলন তখন জাপানে, বিবেকবার্তার আমন্ত্রণে জাপানে এসেছেন। মিলন ভাই একটা বইয়ে সাইন করে উপহার দিয়ে বললেন, এবারের বই মেলায় বেড়িয়েছে। পড়ে দেখ, ভাল লাগবে। অপর বইটি মুহাম্মদ জাফর ইকবাল-এর সদ্য প্রকাশিত eমেয়েটির নাম নারিতাf। স্যার নিজেই ডাক মারফত কপি পাঠিয়েছেন জাপানে। উৎসর্গপত্র দেখে চমকে উঠি, বইটি তিনি উৎসর্গ করেছেন জাপান প্রবাসী রাহমান মনি ও তার ছেলে মেয়ে আশিক ও ইফাকে। আরো অবাক হই যখন দেখি রাহমান মনি সেই উৎসর্গপত্রের নীচে লিখেছে--- প্রিয় ইনান, এই বইটি স্যার উৎসর্গ করেছে আমাদের, আর আমরা দিলাম তোমাকে, তোমার গ্রাজুয়েশনে আমাদের উপহার..... ছেলের গ্রাজুয়েশন কনভেশনে এটেন্ড করতেই আমাদের এই যাত্রা। আমার বা ওর মার কেনা সব উপহারই ম্লান হয়ে গেছে eমেয়েটির নাম নারিনাfর কাছে। eপ্রবাস প্রজন্মf জাপানে বেড়ে ওঠা শিশু কিশোরদের মাঝে বাংলাভাষা ও সংস্কৃতি চর্চা জিইয়ে রাখার একটা প্রচেষ্টা। বছরের একটি অনুষ্ঠানে দিনভর মেতে থাকে শিশুরা নানান সাংস্কৃতিক কর্মকান্ড নিয়ে। বাংলাদেশ থেকে আমন্ত্রিত হয়ে আসেন বিশেষ আলোচিত ব্যক্তিরা। প্রথম অনুষ্ঠানে এসেছিলেন সস্ত্রীক মুহাম্মদ জাফর ইকবাল। রাহমান মনির আগ্রহ ও শতভাগ পরিশ্রমের ফসল eপ্রবাস প্রজন্ম-জাপানf। আমরা সহযোগী মাত্র। ডঃ জাফর ইকবাল এর প্রথম জাপান সফরের কটা দিন আমি কিংবা মনি সর্বদাই তার সঙ্গী ছিলাম ফলে দেশপ্রেমী এই আলোচিত মানুষটির যে পরিচয় পেয়েছি তাতে মনে হয়েছে এরকম দশটা মানুষ দেশকে এগিয়ে নিতে পারে অনেকটাই। প্লেনে আমার সহযাত্রী তাইওয়ানের বয়সের ভারে নূজ এক বৃদ্ধা। তাইওয়ান থেকে নারিতা হয়ে একই প্লেনে যাচ্ছি। আমেরিকায় মেয়ের কাছে যাচ্ছেন সময় কাটাতে। পেশায় ডাক্তার, প্রচুর বিত্ত-বৈভব বোঝা যায়। নিজেরই কটি হাসপাতাল আছে তাইওয়ানে। আমি বাংলাদেশের শুনেই ব্যাগ থেকে অনেকগুলো বই বের করলেন এবং বেছে বেছে ডঃ ইউনুসের গ্রামীণ ব্যাংকের ওপর একটা পেপার ব্যাক নিয়ে পাতা উল্টাতে থাকলেন। আমার আগ্রহ-অনাগ্রহের কথা বিবেচনায় না নিয়ে উনি বললেন..... ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র শিল্প কারখানা স্থাপন ছাড়া পৃথিবীর কোন দেশের অর্থনৈতিক উন্নতি সম্ভব নয়..... আমরা এটা করেই দাঁড়াতে পেরেছি... ইত্যাদি। ৩০ মিনিটের মধ্যেই উনি ঘুমিয়ে পড়লেন। সেই ঘুম আর মাঝে মধ্যে জাগরণে কেটে গেল পুরো সময়টাই। খাবার দিয়ে যাচ্ছে না খেয়েই ঘুমিয়ে যাচ্ছেন। অর্ধেক খাওয়া খাবার, হাতের বই পড়ে যাচ্ছে। খুউব মায়া হলো। বার্ধক্য মানুষকে কতটা নিঃশেষ করে ফেলে। তাকে ডিঙ্গিয়ে আমাকে উঠতে হয় তাই যতদূর সম্ভব সিটে বসেই eকেমন আছ সবুজপাতাf পড়তে মনযোগ দিলা। বিক্রমপুরকে নিয়ে এত কথা, এত ঘটনা আর তার মর্মষ্পশী উপস্থাপনা চরিত্রগুলো জীবন্ত যেন আমার শৈশবের-কৈশরের সেই গ্রাম। সেই আত্মীয়-পরিজনরা, কাছের মানুষরা এতদিন পর ঘনিষ্ট হয়ে আমার মুখোমুখি। লেখকরা লেখা সাজান, লেখায় কল্পনামিশ্রিত আখ্যানের প্রলেপ দেন, পাঠকদের কথা ভেবে রস-রঙ্গ এর যোগান দেন। কিন্তু e এই বইয়ের লেখক লেখায় সে ধরণের কারসাজি করেন নি। তার চিরচেনা বিক্রমপুর, তার শৈশবের আবাসন বিক্রমপুরের, জাপানিতে বলি ফুরুসাতো (Furusato) বা জন্মগ্রাম বিক্রমপুর। তার আত্মীয়-স্বজন, প্রতিবেশী, বন্ধ-বান্ধব, প্রকৃতি সবাইকে নতুন করে কালি ও কলমে তুলে এনেছেন। অসীম আকাশে প্রশান্ত মহাসাগরের ওপর প্রচন্ড বিস্তারে ছুটে চলা এক চিলতে প্লেনের ভেতর বসে আমি দেখছি বাংলাদেশকে। বাংলাদেশের একটি গ্রাম। ইমদাদুল হক মিলনের বিক্রমপুর, আমার ভোগডাঙ্গা কিংবা ভিন্ন নামের একটি নিরীহ গ্রাম। শত প্রতিকুলতায় বেড়ে ওঠা হত-দরিদ্র একটি গ্রাম কঠিন মমতায় সিক্ত সেই জন্ম গ্রামটি আহ্বান জানায় ফিরে এসো, ফিরে এসো সবুজ পাসপোর্ট নিয়ে আমেরিকান হোমল্যান্ড সিকিউরিটির নানা দূর্ভোগের কাহিনী অনেক পড়েছি। অযথা হয়রানী আর সময় ক্ষেপনের ভাবনায় বইটি উপভোগ করার আনন্দ বিঘ্নিত হয়। কিন্তু পড়তে যেয়ে যে অনুভব সেটি সব কিছুকেই তাচ্ছিল্ল্য করে হোক না যা কিছু হবার। অর্ধেক পড়ে বইটি রেখে দেই। নূআর্ক এয়ারপোর্টের হয়রানির কথা জেনেই পাসপোর্টটি ইমিগ্রেশনে জমা দিই। আমার বেলা তেমন হলো না। একবার হাত বদল হয়ে বিশেষ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে হোমল্যান্ড সিকিউরিটির যে অফিসারটি আমাকে আমেরিকায় ছাড়পত্র দিলেন তিনি আমার স্বদেশী পকেটের নেমট্যাগ আর তার সহকর্মীর.... নাও তোমার স্বদেশী বলে আমার পাসপোর্টটি তাকে ধরিয়ে দেয়ার সময় বুঝলাম। যদিও বাংলায় এক বর্ণ কথাও হয়নি আর আমার কানেকটিং ফ্লাইটের গেট পর্যন্ত একটি সুটকেস টানতে টানতে উনি যখন সহযোগিতা করলেন তখন কৃতজ্ঞতায় মনটা ভরে গেল। তবে eধন্যবাদf কথাটা বলা গেল না বলতে হলো Thank you. শুনেছি এই কাউন্টারে নাকি শাহরুখ খানকেই জেরা করা হয়েছিল। বিষয়টি আমার কাছে অতিরিক্ত বলে মনে হয়েছে। ভারতের সাবেক প্রেসিডেন্টের ভারতের কোন এয়ারপোর্টে তল্লাশি করাটা মেনে নেয়া যায় না। কিন্তু নূআর্ক এয়ারপোটের্ ভিনদেশী এক হোমল্যান্ড সিকিউরিটির অফিসারের শাহরুখ খানকে চিনবার কথা নয় ভারতীয় ছবি দেখা তার জন্য বাধ্যতামূলক নয় তাই অন্য যে কোন একজন যাত্রীর সাথে তার জন্য বিশেষ আচার আচরণ আশা করা যায় না। হ্যাঁ কাছে পাশে কেন ভারতীয়, বাংলাদেশী, পাকিস্তানী, নেপালী কেউ থাকলে বিষয়টা এমনটা গড়াতো না। ডুলাস এয়াপোর্টে নেমেই দেখা হলো ডিকোর সাথে, সংগে ওর স্ত্রী শান্তা। ও ডাক্তার, ইন্টার্নিশিপ শেষ করেই বিয়ে । দুজনই খালুকে সালাম করল। শান্তার সাথে আমার ঢাকায় ওদের ধানমন্ডির বাসায় দেখা হয়েছে। ওদের বিয়ের সময় আমি যেতে পারিনি তবে পরে ওদের ওখানে গিয়েছি। ওর আম্মা, আব্বার আতিথেয়তার কথা ভূলবার নয়। যতবারই দেশে গেছি, খবর পেলেই ভাবীর বিভিন্ন স্বাদের রান্নার টিফিন ক্যারিয়ারে আমার বাসা ভরে যেত। ডিকোর সাথে আমার দেড়যুগ পড়ে দেখা। জাপানের উদ্দেশে যেদিন প্রথম ঢাকা ছাড়ি সেদিন ও ছিল এয়ারপোর্টে। তারপর ওর কানাডার ওয়াটার লু থেকে ইঞ্জিনিয়ারিং পরে ইন্ডিয়ানা থেকে MBA এবং পরে DC তে চাকরী। ওর আগ্রহেই আমার দেড় সপ্তাহের এই ভ্রমন। অফিস থেকে ছুটি নিয়ে ও সারা আমেরিকা ঘুড়িয়েছে ক্লান্তিহীন ড্রাইভ, পৃথিবীর সব দেশেই মনে হয় এধরণের প্রবাসীদের সন্ধান পাওয়া যায়। ভার্জিনিয়াস্থ ওদের বাসায় রাতে ফিরে নিশ্চিন্ত একটা ঘুম দেই। গেটলক-টক নয় টেনশনেই ঘুম ভাংগে ভোর বেলা। ছোট ছেলেকে নিয়ে ওর মা আসছে ঢাকা থেকে দূবাই হয়ে নূআর্কের এর JFK তে কিভাবে এই বাক্সপেটরা সামলাবে? জাপান থেকে এসেছে এমনিতেই ঘড়ির কাটা পিছিয়েছে ওরা আসতে আরও দেড়দিন। শান্তার অতিযত্নে আমি আরও অসূস্থ। তবে শান্তাকে দেখে আমার প্রথম মনে হলো প্রতিটি বাবা-মার অন্তত একটা মেয়ে থাকা উচিত। জানিনা ও কি আমাদের মধ্যে ওর বাবা-মাকে খুঁজতে চেষ্টা করেছিল কিনা।
সব টেনশন কাটলো eকেমন আছ সবুজপাতাfর বাকী অংশ পড়ে। বিক্রমপুর একটি সমৃদ্ধ
জনপদ। বিঊমপুরের বহু কৃতিজন রাষ্ট্রীয়ভাবে ও আন্তর্জাতিকভাবে পরিচিত।
লেখকদের সংখ্যাও কম নয়। কিন্তু বিক্রমপুরকে নিয়ে এত লেখা, এত ভাবনা একমাত্র
মিলন-ই করেছেন, করে চলেছেন। বিক্রমপুরের কাছে তার সব ঋণ যেন তিনি একাই শোধ
করবার ব্রত নিয়েছেন। আর বিক্রমপুরবাসীরাও দেশে, প্রবাসে যেখানেই থাকুন
মিলনকে তাদের আপনজন হিসেবে প্রাণের গভীরে ঠাঁই দিয়েছেন। তার লেখায় পড়েছি,
তিনি নানীর বাড়ীতে থাকতেন, সামান্য বেতনের সরকারের সৎ চাকুরে বাবার সবাইকে
নিয়ে ঢাকার টানাপোড়েনের সংসারে একটি স্বস্তি দিতে ছেলেকে মেদিনীমন্ডল গ্রামে
নানীর কাছে পাঠিয়েছিলেন। সেখানেই তার শৈশব ও কৈশরের নানা ঘাত-প্রতিঘাত,
ইমদাদুল হকের লেখক হবার সূচনা। বিক্রমপুর আমাদের কাছে একটি উপমা। আমাদের
সবারই একটা গ্রাম আছে। আছে নানা স্মৃতিমালা। বিক্রমপুর আমাদের কাছে একটি
প্রতিকী গ্রাম। আমাদের ঠিকানা। ভিন্ন জেলায় ভিন্ন নাম এর নামকরণ। প্রিয় পাঠক, শিরোনামে আমি এই বইটির নাম-ই ব্যবহার করেছি, লোভ সামলাতে পারিনি। মিলন ভাই ক্ষমা করবেন।
|
@ |