বাবার সেই পুরনো শার্টটি আজো হেঙ্গারে টানিয়ে
রেখেছে মা। মোটা কালো ফ্রেমের চশমাটি অতি যত্নে তুলে রেখেছে কাঁচের সুকেশে
আর কাজ করা একটি ফ্রেমে ঝুলে রয়েছে সাদা-কালো ছবিটি । মনে হয় এ বুঝি বাবা
এসে মাকে বলবে 'এই দাও আমার শার্ট আর চশমাটা'। আর দিনভর মায়ের অপেক্ষার
প্রহরের সাথে আমি আজও যেন প্রতীক্ষায় রয়েছি কখন বাবার ফোন এসে ভেজে উঠবে আর
স্নেহভরা কন্ঠে বলবে 'বাবু' কেমন আছ? -জানি এ অপেক্ষার শেষ নেই...।
অপেক্ষার সাগরে আরো একটি বছর যোগ হয়ে এগারতম বর্ষে পদার্পণ করবে চৌঠা মার্চ,
২০১৬। ভীষণ মনে পড়ছে বাবা তোমায় আজ এ মৃত্যুবার্ষিকীর দিনটিতে...ভীষণ। "রাব্বির
হাম হুমা কামা রাব্বাইয়ানিস সাগিরা" -আল্লাহ তোমায় জান্নাতুল ফেরদৌস দান
করুন...!!
বাবাকে আজ বড্ড মনে পড়ছে- কেমন আছ তুমি? কোথায় আছ তুমি? কি কর তুমি? জানতে
বড় ইচ্ছে হয়! তোমার জন্য আমার বুকের গহীনটায় কেমন যেন পুড়ে দিবারাত্রি। এই
সেই মার্চ মাস যে মাসে তুমি শুধু আমাদেরকেই নয় সমস্ত পৃথিবীকেই বিদায় জানিয়ে
চলে গেছ সকল মায়াজাল ছিন্ন করেছ না ফেরার দেশে। বড় কষ্ট তোমার চলে যাওয়ার
সময় কাছে থেকে শেষ বিদায় জানাতে পারিনি...ক্ষমা করো। যখন তোমাকে দেখলাম তখন
তুমি গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন ছিলে। শত-হাজারো ডেকেছি, তোমায় ধরে কত কেঁদেছি -
শুধু তোমার মুখের একটি বর্ণমালা শুনার জন্য, তা হয়নি - সেজন্য আজও হৃদয়ে
রক্তক্ষরণ থামেনি। তুমি দেখতে পাওনি হাজারো মানুষের ভালবাসায় সিক্ত হয়ে ঠাই
নিয়েছ তোমার আসল বাশের ঘেরা ঘরে। তুমি এও দেখতে পাওনি মায়ের পড়া ধবধবে সাদা
শাড়ির সৌন্দর্যতা! সেই সাদা শাড়ি আজও পড়ে চলেছে মা। হাতে চুড়ি নেই, কানে
দুল নেই, গলায় হার নেই, --এ কেমন মা কে দেখছি-- এ যেন আমার মা নয়! কখনো
রঙ্গীন শাড়ি কিনে দিলে পড়ে না। বলে, "এসব আমার জন্য নয়- কার জন্য পড়ব" -এ
কথার মাঝে যে কতটুকু ব্যাথা জড়িয়ে আছে যদি তুমি শুনতে!
বাবাকে আজ বড্ড মনে পড়ছে- পড়ালেখার জন্য তুমি কত শাসন দিতে মাঝে মধ্যে মার
দিতে, পরক্ষনেই আদর করে 'বাবু' বলে ডাকতে, গোসল করিয়ে দিতে, গল্প শুনাতে,
...বাবা কতদিন হল তোমার হাতে কোন মার খাইনা, খুব ইচ্ছা হচ্ছে মার খেতে,
শুনেছি বাবা-মায়ের হাতে মার খেলে নাকি শরীরের ঐ অংশ বেহেস্তে যায়। জানো বাবা,
তোমার স্নেহ আর শাসনে আজ তোমার তিন ছেলেই অধ্যাপক আর তোমার আদরের একমাত্র
মেয়ের জামাই সেও অধ্যাপক। রেখে যাওয়া তোমার ভিটে-মাটিকে সবাই এখন "প্রফেসর
ফ্যামিলি" বলে। বাবা তোমার অনুভূতি, ভালোবাসা, অস্তিত্ব সবসময় যেন আমাকে
আষ্টেপৃষ্টে ঘিরে আছে, যদিও তুমি আছ অনেক দূরে, অচীনপূরে।
বাবাকে আজ বড্ড মনে পড়ছে- বাবা ছিল আমার অনেকটা বন্ধুর মত । হাজারো কথা
শেয়ার করতাম, টিনের চালা ঘরের বারান্দায় বসে বেশ জমপেশ আড্ডা জমতো। বাবা-ই
বাল্যকালে দৈনিক পেপার পড়ার অভ্যাস গড়ে দিয়েছেন যা আজও চলমান। মনে পড়ে তখন
আমাদের টেলিভিশন ছিল না, থ্রি ব্যান্ডের রেডিও তে বিবিসি, ভয়েস অব আমেরিকা
রাত জেগে কান দিয়ে সংবাদ শুনতেন। তবে আব্দুল আলীমের পল্লীগীতি আর নীনা
হামিদের ভাওয়াইয়া গান শুনাও বাদ দিতেন না। বাবার একেবারে শিয়রের কাছে পাতা
ছিল পড়ার টেবিল। ছোট বেলায় কোন টিউটর ছিল না বলে বাবা নিজে আমাদের পড়াতেন।
বিকেলে বাবার সাথে গায়ের মেঠো পথের হাটার কথা আজও স্মৃতিপটে বিধে আছে। তবে
বাবার একটা অনুশাসন ছিল সূর্য্য ডুবার সাথে সাথে ঘরে ফিরে আসতে হত। স্মৃতিতে
অমলিন হয়ে আছে বাবার সাথে গোমতী নদীতে মাছ ধরার কাহিনী। বাবা কত কাছের বন্ধু
ছিল -তা আজ মনে পড়ছে বাবার সাথে একসাথে সিনেমা দেখা কুমিল্লা দীপিকা হলে,
তখন ক্লাস এইটে পড়ি। আজ শুধু বলতে ইচ্ছা করছে, বাবা তুমি কি পার না আমাদের
মাঝে আবার ফিরে আসতে, আজ ১১ টা বছর তোমাকে ছাড়া আমরা কেমন আছি তোমার কি
একবারো দেখতে ইচ্ছে করে না?
বাবাকে আজ বড্ড মনে পড়ছে- মনে হয়, আমার মাথার উপর বটবৃক্ষের ছায়াটা নেই।
সন্তানের একটু ব্যাথা ও কষ্ট হলে তোমার সহ্য হতোনা। বাইরে থেকে বাড়ি ফিরতে
একটু দেরি হলে ব্যাকুল হয়ে পড়তে। সব সময় আগলে রেখেছিলে অক্টোপাসের মত ।
কোন কারনে মন খারাপ থাকলে বা কিছুতে ভেঙ্গে পড়লে, তোমার মত করে কেউ শান্তনা
দেয়নি, সাহস দেয়নি তুমি যেমন দিতে, মাথায় হাত ভুলায়নি তুমি যেমন
ভুলিয়েছিলে। সপ্তাহান্তে চিঠির খামে বা পোস্টকার্ডে কত সুন্দর হাতে চিঠি
লিখতে। তবে বাবা তোমার হাতের লেখা কিছু চিঠি যক্ষের ধনের মত আজো যতনে রেখে
দিয়েছি সবার নাগালের বাইরে। বাজারে মোবাইল ফোনের দোকানে বসে থাকতে একটি
কলের অপেক্ষায় । বাবা যে কি পরম বস্তু তা আজ বুঝছি-যখন আমিও আজ একজন "বাবা"।
কতদিন বাবা ডাকা হয়নি তোমায়- আর হবেনা কোনদিনই? প্রবাসে থেকে তোমাকে এখনো
মাঝেমধ্যে স্বপ্নে দেখি, আমি আর তুমি হাঁটছি পাশাপাশি। জানো বাবা, বুকের
গভীরে একটা স্মৃতিসৌধের আয়না আছে যার মুখোমুখি দাঁড়ালেই তোমাকে দেখতে পাই,
অনুভবে স্পর্শ করতে পারি তোমার অস্তিত্ব।
বাবাকে আজ বড্ড মনে পড়ছে- আমার বাবা জনাব আব্দুর রশীদ সরকার ছিলেন একজন
আদর্শবান ও কর্তব্যপরায়ন একচিলতে মানুষ । মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি বিভিন্ন
সমাজ সেবামূলক কাজ করে গেছেন। অপরের দু:খে তিনি দূ:খিত হতেন, হাত বাড়িয়ে
দিতেন অনায়াসে। তিনি নিজের সন্তানের চেয়েও অপরের সন্তানকে বেশি ভালবেসেছেন।
সরকারী চাকুরী করায় এলাকার সবাই "রশীদ সাব" বলেই ডাকতো। তুমি ছাড়া আমি একজন
অসম্পূর্ণ মানুষ। তুমি থাকলে যা শিখতাম, তা হয়নি আর আমার জীবনে। তবে বাবা
তোমার আদর্শ যেন জীবনে প্রতিফলিত হয় আর তোমার এ আদর্শ নিয়েই আগামী পথগুলো
যেন চলতে পারি সে দোয়া কর।
বাবাকে আজ বড্ড মনে পড়ছে- বাবা তোমাকে নিয়ে লিখলে শেষ হবে না আমার হৃদয়ের
হার্ডডিস্কের এক মেগাবাইটটা । ডিলেট করতে পারিনা তোমার হাজারো স্মৃতির কোন
ফাইলটা । স্মৃতিপটে রয়ে যাবে তোমার স্মৃতি চিহ্নটা । শুধু মন খারাপ হয়ে যায়-
হাত বাড়ালে তোমাকে আর ছোঁয়া যাবে না, পা ছুঁয়ে সালাম করা হবে না, কোনদিন
আর আদর করবে না, খুশী হবে না আমার সাফল্যে। মনে পড়ে, একবার তুমি আর মা
দু'জনে মিলে আমাকে ফুলের তোড়া উপহার দিয়েছিলে । সৃষ্টিকর্তা তোমাকেও এভাবে
ফুলের তোড়া দিয়ে জান্নাতে রাখুন ।-আমীন!!