প্রথমপাতা  

সাম্প্রতিক সংবাদ 

 স্বদেশ

আন্তর্জাতিক

বাংলাদেশ কমিউনিটি

লাইফ স্টাইল

এক্সক্লুসিভ

বিনোদন

স্বাস্থ্য

বর্তমানের কথামালা

 শিল্প-সাহিত্য

 প্রবাসপঞ্জী 

আর্কাইভ

যোগাযোগ

 

 

 

 

ঢাকায় ভূমিকম্পের ঝুঁকি ও আমাদের করণীয়

 

ছবিঃ টেলিগ্রাফ।


সঙ্গীতা রাজবংশী দাশ


বাংলাদেশে ঘন ঘন ঘূর্ণিঝড় আর বন্যা হওয়ার একটি প্রধান কারণ যে এর ভৌগলিক অবস্থান, তা আমরা অনেকেই জানি। কিন্তু ভূমিকম্পের ঝুঁকির ক্ষেত্রেও যে বাংলাদেশ, বিশেষ করে ঢাকা ও তার আশপাশের এলাকাগুলো বেশ বিপদজনক অবস্থানে আছে, তা আমরা অনেকেই জানিনা। ভূতত্ত্ববিদ ও গবেষকরা অনেক দিন থেকেই এ বিষয়ে আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে আসছেন।

 

http://www.amnh.org/explore/curriculum-collections/earthquake-risk-in-bangladesh
 

গত ৩০শে সেপ্টেম্বর (২০১১ সাল) পরবাস ও জেটিভি বাংলার আমন্ত্রণে সাড়া দিয়ে এক আলোচনা অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করেন ঢাকা থেকে আসা কয়েকজন স্বনামধন্য স্থপতি। তাঁরা টোকিওতে UIA (International Union of Architects) আয়োজিত সপ্তাহব্যাপী কংগ্রেসে অংশগ্রহণ করতে এসেছিলেন। আলোচনা পর্বে স্থপতিদের পক্ষ থেকে বক্তব্য রাখেন স্থপতি ইকবাল হাবিব। তিনি শুধু একজন সফল স্থপতিই নন, তিনি ‘বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন’ (বাপা) এর সদস্য সচীব এবং ‘নগরায়ন ও সুশাসন’ এর যুগ্ম-সম্পাদক। তাঁর বক্তব্যে বেরিয়ে আসে ঢাকা শহরের ভবন নির্মাণ ও নগর পরিকল্পনার বাস্তব কিছু চিত্র।

 

৩০ সেপ্টেম্বর ২০১১, টেকিও র কিতা-কু,কিতা আকাবানে কুমিন সেন্টারে "পরবাস" ও "জেটিভি বাংলা" আয়োজিত ভূমিকম্প বিষয়ক সেমিনারে বাংলাদেশ থেকে আগত আমন্ত্রিত অতিথি ও আয়োজকবৃন্দ।

 


নগরী হিসেবে ঢাকার সমস্যা অনেক এবং তা নিয়ে আমাদের প্রত্যেকেরই যার যার মতামত রয়েছে। এরকম একটি শহরে শক্তিশালী ভূমিকম্প আঘাত হানলে কি হতে পারে তাও আমরা মোটামুটি অনুমান করতে পারি। কিন্তু সঠিক তথ্যের অভাবে বিভিন্ন দিক থেকে ব্যাপারটিকে বিশ্লেষণ করে দেখার সুযোগ আমাদের খুব একটা হয় না। স্থপতি ইকবাল হাবিবের বক্তব্যে যে আমরা শুধু মূল্যবান কিছু তথ্য পেয়েছি তাই নয়, বর্তমান পরিস্থিতির সাপেক্ষে নিজেদের আওতার ভেতরে কি করা যায় সে সম্পর্কে কিছু বাস্তব ধারনাও পাওয়া গেছে।

যা জানলাম


 ঢাকা শহরের কোন মাষ্টার প্ল্যান নেই। একটি শহরের কোন কোন জায়গা আবাসিক, কিংবা বাণিজ্যিক, কিংবা বিনোদনমূলক এলাকা হবে তা মাষ্টার প্ল্যান এ নির্ধারণ করা থাকে। এছাড়া কোন এলাকায় ভবনের সর্বোচ্চ উচ্চতা কত হবে, কোন এলাকায় ভবন তৈরীই করা যাবেনা—এসব গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তও লেখা থাকে মাষ্টার প্ল্যানে। ১৯৬৯ সালে একবার একটি মাষ্টার প্ল্যান তৈরীর কাজ শুরু হয়। তখন ঢাকা শুধু একটি প্রাদেশিক রাজধানী ছিল। তার পর প্রায় তিন দশক ধরে ঢাকার সীমানা বেড়েছে বহুগুণ, কিন্তু দুঃখজনক হল পুরোটাই বেড়েছে অপরিকল্পিতভাবে। ৯০ দশকের শেষ দিকে আবার মাষ্টার প্ল্যানের কাজ শুরু হয় এবং ২০০৬ এর দিকে সেটা প্রায় পরিণতির রূপও পায়। কিন্তু তার প্রয়োগ এখনও যথাযথভাবে শুরু হয়নি এবং পরিশোধন বা পরিমার্জনের কাজ শেষ করতে প্ল্যানটি মূলত এখনও টেবিলেই আছে। অথচ এদিকে বিপদজনক এলাকাগুলোতেও জনবসতি তৈরী হচ্ছে এবং তাতে লোকসংখ্যা বেড়েই চলেছে। সামান্য খোলা জায়গা বা জলাশয়ও ভরে যাচ্ছে। যেসব জায়গায় আগে থেকেই ঘন বসতি ছিল সেসব জায়গায় লোকসংখ্যা আরও বাড়ছে। যত দিন যাচ্ছে মাষ্টার প্ল্যানের প্রয়োগের সুযোগ বা সম্ভাবনা তত কমে আসছে।

 ঢাকার শতকরা ৭০ থেকে ৮০ ভাগ ভবনই
Non-engineered। অর্থাৎ এগুলো তৈরির সঙ্গে কোন প্রশিক্ষনপ্রাপ্ত স্থপতি বা প্রকৌশলী সরাসরি জড়িত ছিলেন না। বাকী ২০ বা ৩০ ভাগেরও অধিকাংশই নিয়ম ভঙ্গ করেছে, যেমন ৪ তলা ভবনের অনুমোদন নিয়ে ৬ তলা তুলেছে, কিংবা ৬ তলা ভবনের অনুমোদন নিয়ে ১০ তলা তুলেছে। হাতেগোনা যে কয়টি ভবন ঠিকমত স্থপতি বা প্রকৌশলীদের নির্দেশমত হয়েছে, তার মধ্যেও যে কোন খুঁত নেই তা বলা যাবে না। যাদের হাতে একটি ভবন আসলে তৈরী হয়, সেসব নির্মাণকর্মীদের হাতের কাজের ওপরেও তার স্থায়িত্ব অনেকটা নির্ভর করে। এছাড়া নির্মাণ সামগ্রীর শুদ্ধতাও একটি বড় বিষয়। মোট কথা, ঢাকার প্রায় ৯০ ভাগ ভবনেরই কোথাও না কোথাও বড় ধরণের খুঁত থাকার সম্ভাবনা আছে। এ অবস্থায় কত ভাগ ভবন ভূমিকম্পে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে সে হিসাব কারও জানা নেই।

 ঝুঁকিপূর্ণ ভবনগুলো সনাক্ত করার জন্য কোন কাঠামোগত নীতিমালা নেই। সনাক্ত করা গেলে তা সেরে নেওয়ার একটা সুযোগ থাকতো। কোন ভবন কতটা ঝুঁকিপূর্ণ তা না জেনেই তাতে অর্থ বিনিয়োগ হচ্ছে, কিংবা বছরের পর বছর ব্যবহার হচ্ছে। বিদেশী সংস্থাগুলো মাঝে মাঝে নিজেদের ভবন পরীক্ষা করিয়ে নিচ্ছে প্রকৌশলীদের দিয়ে। এছাড়া একবার প্রায় ৬৪ হাজার ভবনের নিরাপত্তা নিরীক্ষণ করা হয়েছে, তবে শুধুমাত্র চোখে দেখে, কোনরকম বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে নয়।

 সর্বোপরি, ভূমিকম্প সম্পর্কে সাধারণ জনগণের সচেতনতা নেই বললেই চলে। ভূমিকম্পের আগে, ভূমিকম্পের সময় এবং বিশেষ করে তার পরে কি করা উচিত, সে সম্পর্কে সঠিক ধারণা রাখা প্রয়োজন। এ সম্পর্কে সাধারণ জনগণকে সচেতন করার কোন উদ্যোগ আজও নেওয়া হয়নি।

আরও যা জানা দরকার


এখানে বলে রাখা প্রয়োজন যে ভূমিকম্পে ক্ষয়ক্ষতির সম্ভাবনা শহরাঞ্চলেই বেশী। ভূমিকম্পের সময় অধিকাংশ ক্ষেত্রে প্রাণহানি ঘটে ভারী আসবাবপত্র অথবা নির্মাণ সামগ্রীর (যেমন ইট বা কংক্রিট) নীচে চাপা পরে। শহরাঞ্চলের ভবনগুলোতে সে সম্ভাবনা বেশী থাকে। এছাড়া শহরগুলোতে গ্রামের তুলনায় ঘনবসতি বেশী এবং খোলা জায়গা কম। কাজেই সহজে নিরাপদ আশ্রয় নেয়া যায়, এরকম জায়গা নেই বললেই চলে। সার্বিক ভাবে চিন্তা করলে ঢাকার ঘনবসতিপূর্ণ এলাকাগুলোই এখন সারা দেশের মধ্যে সবচাইতে বেশী ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় আছে।

যে শহরের অধিকাংশ ভবনই অদক্ষ কারিগরের তৈরী, যে শহরের বর্তমান বা ভবিষ্যৎ নিয়ে কোন লিপিবদ্ধ পরিকল্পনা নেই, সে শহরে দুর্যোগ মোকাবিলার জন্য ব্যক্তি পর্যায়ে সচেতন ও প্রস্তুত হওয়া ছাড়া অন্য কোন পথ নেই। আমাদের দেশে দুর্যোগ দমন অধিদপ্তরসহ কিছু সরকারী সংস্থা রয়েছে, বেসরকারী সংস্থাও অনেক আছে। তবে স্থপতি ইকবাল হাবিবের মতে তাদের নিজেদের মধ্যে সমন্বয়ের অভাবে খুব বেশী কিছু তারা করতে পারছে না। আরও একটি ব্যাপার এখানে মনে রাখতে হবে যে, আমাদের দেশের প্রধান প্রাকৃতিক দুর্যোগ হচ্ছে ঘূর্ণিঝড় বা বন্যা। কাজেই দুর্যোগ মোকাবিলার নীতিমালাও সেভাবে তৈরী। ভূমিকম্পের ক্ষয়ক্ষতির ধরণ বন্যা বা ঘূর্ণিঝড়ের চাইতে একেবারেই আলাদা। এ অবস্থায় প্রবল ভূমিকম্প আঘাত হানলে সঠিক ব্যবস্থাপনার অভাবে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ আরও বেড়ে যাবে।

এক্ষেত্রে করনীয় একটিই; তা হল জনসাধারণকে সচেতন করে তোলা। আমরা যদি প্রত্যেকে নিজে ভূমিকম্প বিষয়ে সচেতন হই এবং নিজের পরিবারকে সে বিষয়ে প্রস্তুত করি, তাহলে কিন্তু ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ অনেকটাই কমিয়ে আনা যায়। ভবন তৈরীর সময় নির্মাণ বিধিমালা কঠোর ভাবে পালন করা, নিয়ম করে নির্দিষ্ট সময় পর পর নিজেদের ভবন পরীক্ষা করিয়ে নেয়া, সর্বোপরি জরুরী অবস্থার কথা ভেবে কিছু খাবার ও প্রয়োজনীয় সামগ্রী প্রস্তুত রাখা—এই সব সাধারণ কিছু জিনিস খেয়াল রাখলেই কিন্তু নিরাপত্তা অনেকটা নিশ্চিত করা যায়।

জাপান পৃথিবীর সবচাইতে ভূমিকম্পপ্রবণ দেশগুলোর একটি। অথচ ভূমিকম্পের ব্যাপারে সবচাইতে প্রস্তুত দেশও কিন্তু জাপান। আমরা যারা বহু বছর ধরে এদেশে বাস করছি, বিশেষ করে যারা ২০১১ সালের ১১ই মার্চের বিপর্যয়ের সময় ও তার পরবর্তীকালে এখানে ছিলাম, তারা ভূমিকম্প সম্পর্কে প্রায় একজন জাপানী নাগরিকের সমান পরিমাণ জ্ঞান রাখি। আমাদেরই পরিবারের সদস্য, বিশেষ করে যারা ঢাকা বা চট্টগ্রামের মত বড় শহরগুলোতে বাস করেন, তাঁদের জন্য হলেও আমাদের উচিত কোন না কোন উদ্যোগ নেয়া। সেমিনার বা ওয়ার্কশপ এর আয়োজন করে হোক, সরকারী-বেসরকারী সংস্থাগুলোর সাথে হাত মিলিয়ে হোক, ছোট ছোট শিশুদের জন্য স্কুলে স্কুলে শিক্ষামূলক ভিডিও প্রদর্শনের মাধ্যমে হোক, সর্বস্তরের জনগণের কাছে পৌঁছানোর জন্য বড় মিডিয়াগুলোর সাহায্য নিয়ে হোক—আমাদের করার অনেক কিছু আছে। অন্তত অন্যান্য দেশের NRBদের চাইতে জাপান প্রবাসীরা এই ক্ষেত্রটিতে অনেক বড় ভূমিকা রাখতে পারে বলে আমি বিশ্বাস করি। আর সেজন্য তৎপর হওয়ার সময় এখনই।

_________________________________

সঙ্গীতা রাজবংশী দাশ

স্থপতি, কানাগাওয়া, জাপান।
sangita001@yahoo.com

 

 

WARNING: Any unauthorized use or reproduction of 'Community' content is strictly prohibited and constitutes copyright infringement liable to legal action। 

 

 

[প্রথমপাতা]