[প্রথমপাতা] |
বিচারপতি রাধাবিনোদ
পালের ১২৫তম জন্মবার্ষিকী স্মরণে
প্রবীর বিকাশ সরকার
ভারত যাঁকে ভুলে গেছে, বাংলাদেশ যাঁর নামই জানে
না, তাঁকে স্মরণে রেখেছে জাপান।
তিনি বিচারপতি ডঃ রাধাবিনোদ পাল (১৮৮৬-১৯৬৭)। ১৯৯৭ সালে কিয়োতোতে অবস্থিত
শিন্তোও ধমর্ীয় মন্দির রিয়োওগোকুজেন জিনজার চত্বরে স্থাপিত তাঁর দর্শনীয়
স্মৃতিফলকই তার বড় প্রমাণ। একই স্মৃতিফলক ২০০৫ সালে টোকিওর শিন্তোও মন্দির
ইয়াসুকুনি জিনজার প্রাঙ্গণেও স্থাপিত হয়েছে। এবং এই মন্দিরের অধীন
যুদ্ধবিষয়ক জাদুঘর ইউশুউকান এর ভিতরেও বিচারপতি পালের ছবি সংরক্ষিত আছে।
হিরোশিমা জাদুঘরের কাছাকাছি অবস্থিত কোমাচি হোনশোওজি বৌদ্ধ মন্দিরের
প্রাঙ্গণেও রয়েছে তাঁর স্বহস্তে বাংলা ও সংস্কৃতিতে লিখিত একটি শান্তির বাণী
একটি পাথুরে ফলকে। কানাগাওয়া-প্রিফেকচারের হাকোনে শহরের এক পাহাড়ে স্থাপিত
হয়েছে পাল-শিমোনাকা স্মৃতিজাদুঘর ১৯৭৪ সালে। এইসব খবর ভারত ও বাংলাদেশের
মানুষ জানে না বললেই চলে।
তিনি
যে জাপানের জন্য কতখানি গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি তার প্রমাণ পাওয়া যায় ২০০৭
সালের জুলাই মাসে ভারত সফরকালে জাপানের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শিনজোও আবের
উক্তিতে। তিনি দিল্লীর ভারতীয় জাতীয় সংসদে উদাত্ত কন্ঠে বলেন: “Justice Pal
is highly respected even today by many Japanese for the noble spirit of
courage he exhibited during the International Military Tribunal for the
Far East.” শুধু তাই নয়, ওই সফরের সময় কলকাতার সল্টলেকে প্রতিষ্ঠিত
ভারত-জাপান সংস্কৃতি কেন্দ্র রবীন্দ্র-ওকাকুরা ভবনের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের
সময় তিনি বিচারপতি পালের পুত্র প্রশান্তকুমার পালের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে ডঃ
পালের প্রতি গভীর কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন। উল্লেখ্য যে, প্রধানমন্ত্রী শিনজোও
আবে হচ্ছেন যুদ্ধের পর দুদবার প্রধানমন্ত্রীর পদ অলঙ্কৃত স্বনামধন্য
রাজনীতিবিদ কিশি নোসুকের পৌত্র। কিসির সঙ্গে ডঃ পালের ঘনিষ্ঠতা এবং জাপানে
তাঁর পর্বতপ্রমাণ সম্মান কোন কোন ভারতীয় রাষ্ট্রপরিচালকের ঈষার কারণ হয়েছিল
বলে বর্তমান লেখকের সঙ্গে সাক্ষাৎকালে বিচারপতিপুত্র প্রশান্তকুমার পাল
জানান। তিনি আরও জানান, জাপানে ১৯৯৮ সালে 'প্রাইড' নামে একটি চলচ্চিত্র
বিচারপতি ডঃ পালের ওপর তৈরি হওয়ার কথা ছিল। পরিচালক শুনইয়া ইতো কলকাতায় এসে
বিচারপতি পালের কিছু তথ্যাদি জানতে চান তাঁর ডোবার লেন বাসায়। প্রশান্ত পাল
সহোৎসাহে সহযোগিতাও করেন। কিন্তু যখন তিনি ছবিটি দেখেন ১৯৯৭ সালে তখন
অত্যন্ত মর্মাহত হন। সেই চলচ্চিত্রটি মূলত জেনারেল হিদেকি তোজোকে নি্েয়ই করা
হয়েছে যদিওবা বিচারপতি পালের চরিত্রও স্থান পেয়েছে বেশ কিছু অংশ জুড়ে। এই
ঘটনাকে বিশ্বাসের বরখেলাপ বলে সমালোচনা করেন। আরও বলেন, প্রয়োজনের তাগিদে
বিচারপতি পালকে ব্যবহার করা হয়েছে মাত্র।
এহেন বিচারপতি পাল ইতিহাসখ্যাত ইন্টারন্যাশনাল
মিলিটারি ট্রাইবু্যনাল ফর দি ফার ইস্ট তথা টোকিও ট্রাইবু্যনালে (১৯৪৬-৪৮)
অংশগ্রহণকারী ১১ জন বিশিষ্ট বিচারপতির মধ্যে ভারতীয় প্রতিনিধি হিসেবে
মিত্রশক্তি আমেরিকা, বৃটেন ও নেদারল্যান্ডস কর্ত্রিক নির্বাচিত হয়েছিলেন এবং
তাঁর রায়ে যুদ্ধাপরাধী হিসেবে অভিযুক্ত সর্বমোট ২৮ জন জাপানিকে নির্দোষ বলে
সাব্যস্ত করেছিলেন যে কারণে স্বাভাবিকভাবেই জাপানিরা তাঁকে 'ইনোচি নো অনজিন'
বা 'জীবনদাতা' হিসেবে শ্রদ্ধা ও সম্মান জানিয়ে আসছেন। প্রসঙ্গত বলা যায় যে,
জাপানে চারজন বাঙালি আজও স্মরণীয় তাঁরা হলেন মহাবিপ্লবী রাসবিহারী বসু,
কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু এবং রাধাবিনোদ পাল, বলা
বাহুল্য তাঁদের মধ্যে বিচারপতি পালই সর্বাধিক সম্মানের পাত্র। সারা জীবন
তিনি বাকি তিনজনের একনিষ্ঠ অনুসারী ছিলেন। অবশ্য তাঁর রায় নিয়ে যেমন বিতর্ক
আছে তেমনি সমালোচনাও বিদ্যমান। কিন্তু বিভিন্ন গবেষক এই রায়কে বিভিন্ন
দৃষ্টিতে বিচার করেছেন। সমপ্রতি জাতীয় সমপ্রচার সংস্থা এনএইচকে'র একটি
বিশেষ প্রতিবেদন এবং হোক্কাইদোও বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক, অধ্যাপক তাকেশি
নাকাজিমার লিখিত 'পাল হানজি' বা 'বিচারপতি পাল' গ্রন্থে তাঁর রায় সম্পর্কে
নিরপেক্ষ দৃষ্টিভঙ্গি প্রকাশের চেষ্টা লক্ষণীয়। যদিওবা তাদের মতামত নিয়ে
একাধিক জাতীয়তাবাদী রাজনীতিক, গবেষক ও শিক্ষকের সমালোচনাও অব্যাহত, তাঁদের
ভাষ্য: বিতর্কিত এনএইচকে এবং অধ্যাপক নাকাজিমা বিচারপতি পালের রায়কে
সুবিচার করেনি। তবে এটাও ঠিক যে, পালের রায়ের কিছু কিছু বিষয় নিয়ে
জাতীয়তাবাদীরা বেশ মাতামাতি করেছেন। ভুল ব্যাখ্যাও দিয়েছেন। বিদেশী গবেষক
অনেকেই তাঁর রায়কে জাপান-প্রভাবিত বলে আখ্যায়িত করেছেন কারণ তিনি
সাম্রাজ্যবাদী বৃটিশবিরোধী ছিলেন তরুণকাল থেকেই। মনেপ্রাণে ছিলেন
স্বাধীনচেতা জাতীয়তাবাদী। এই মনোভাবেরই প্রতিফলন ঘটেছে তাঁর ঐতিহাসিক রায়ে।
কিন্তু ১৯৫২ সালে জাপান সফরে এসে তিনি সব ধরনের অভিযোগ, ভুল ধারণার
প্রতিবাদ করে বলেছিলেন, তাঁর রায় সম্পূর্ণভাবে নিরপেক্ষ যা পঠনকালে গভীর
মনোযোগের দাবি রাখে। টোকিওর ইমপ্রেরিয়াল হোটেলের কক্ষে বসে আড়াই বছরব্যাপী
১৯১৮ থেকে ১৯৪৫ সাল পর্যন্ত জাপানের ঘটনাসমূহের ইতিহাসসহ প্রায় ৩০০০ গ্রন্থ
ও দলিলপত্রাদি গবেষণা করে এই রায় লিখেছিলেন। এই রায়টিকে ভালো করে পড়ার
অনুরোধ জানিয়েছিলেন তিনি জাপানের ওয়ার্ল্ড ফেডারেলিস্ট মুভমেন্ট সংস্থা
কতর্ৃক আয়োজিত প্রথম আন্তর্জাতিক শান্তি সম্মেলনসহ বিভিন্ন শহরে অনুষ্ঠিত
একাধিক সংবর্ধনা সভা ও আইনজীবী সেমিনারে। এই সফরে তিনি বারংবার জাপানি
ইতিহাস পাঠ্যপুস্তকের কঠোর সমালোচনা করে বলেছেন, সঠিক ইতিহাস লিখুন।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস লিখে জাপানের প্রকৃত ভূমিকা তুলে ধরুন
আগামী দিনের নাগরিক তথা বর্তমান শিশু ও তরুণ
প্রজন্মের
কাছে। জাপান এশিয়ায় সাম্রাজ্যবাদী ছিল না, ছিল পাশ্চাত্যের শ্বেতাঙ্গ জাতির
দেশগুলো। চীনে যদি জাপানি রাজকীয় সেনাবাহিনী নিরপরাধী জনসাধারণকে হত্যা করে
যুদ্ধাপরাধী হয়ে থাকে তাহলে আমেরিকাও হিরোশিমা ও নাগাসাকি শহর দুটিতে আণবিক
বোমা নিক্ষেপ করে লক্ষ লক্ষ নিরপরাধী শিশু-নর-নারীকে হত্যা করে একই অপরাধে
অপরাধী। সুতরাং আমেরিকারও বিচার হওয়া উচিত। এইসব কথা তিনি প্রকাশ্যে বলেছেন
যা আর কোন রাজনীতিক বা রাষ্ট্রপ্রধান বলতে সাহস করেননি। এই জন্যই তাঁকে
ন্যায়দন্ডের প্রতীক আখ্যায়িত করে তৎকালীন দেশ-বিদেশের সংবাদপত্রগুলো। ওই
সময় বিশ্বব্যাপী ঝড় তোলেন তিনি তাঁর অসাধারণ দুঃসাহসিক বক্তব্য প্রকাশ করে।
তাঁর অবস্থানকে 'পাল ছেনপুউ' বা 'পাল-হাওয়া' হয়ে বলে জাপানি গণমাধ্যম
আখ্যায়িত করে। এর প্রমাণ বিধৃত আছে পাল-শিমোনাকা স্মৃতিজাদুঘরে রক্ষিত
বিভিন্ন পত্রপত্রিকার কাট-আউটগুলোতে। তাঁর আজীবন পুত্রতুল্য শিষ্য
প্রভাবশালী লেখক, গবেষক ও রাজনৈতিক চিন্তাবিদ মাসাআকি তানাকা লিখিত 'নিহোন
মুজাইরোন' বা 'জাপান নির্দোষ রায়তত্ত্ব' নামক গ্রন্থ যা বিচারপতি পালের
রায়কে উপজীব্য করে লিখিত এই সালে প্রকাশিত হয় এবং পরবতর্ী দুই দশকের বেশি
সময় ধরে বেস্টসেলার্স হিসেবে জাপানে আলোড়ন তোলে। অবশ্য পরে পালের মূল ইংরেজি
রায়ও প্রকাশিত হয়েছিল তিন খন্ডে।
১৯৫৩ সালেও তিনি জাপানে আমন্ত্রিত হয়েছিলেন তাঁর বন্ধু মৃৎশিল্পী,
শিক্ষাবিদ ও আধুনিক প্রকাশনা জগতের পথিকৃৎ ইয়াসাবুরো শিমোনাকা কতর্ৃক
ইয়োকোহামা শহরস্থ ওওকুরায়ামা কিনেন কান মিলনায়তনে অনুষ্ঠিত এক আন্তর্জাতিক
আধ্যাত্মিক দর্শন সম্মেলনে বক্তৃতা করার জন্য। এরপর ১৯৬৬ সালে প্রাক্তন
অ্যার্টনী জেনারেল আইনজীবী কিয়োশি ইচিরো ও কিশি নোবুসুকের আমন্ত্রণে জাপানে
আসেন এবং শোওয়া সম্রাট হিরোহিতোর কাছ থেকে রাষ্ট্রীয় পদক প্রথম শেণীর 'অর্ডার
অব দি সেক্রেট ট্রেজার' বা 'Order of the Sacred Treasure' গ্রহণ করেন।
প্রকৃতপক্ষে জাপানে বিচারপতি পালের বহু ঘটনা রয়েছে। জাপান-বাংলা সম্পর্কের
রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক বন্ধনের তিনি হচ্ছেন সবচেয়ে বড় মর্যাদাসম্পন্ন কৌশলী।
এই ক্ষেত্রে টোকিও ট্রাইব্যুনাল ছিল তাঁর জন্য একটি অপ্রত্যাশিত সুযোগ। যা
তিনি যথার্থই বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে ব্যবহার করেছেন। সেই দৃষ্টিকোণ থেকে টোকিও
ট্রাইব্যুনালকে এই প্রথম শ্বেতাঙ্গ সাম্রাজ্যবাদী গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে একটি
তীব্র প্রতিবাদের অগি্নপ্রতীক হিসেবে বিবেচনা করা যায় সহজেই। বিচারপতি পাল
প্রথম থেকেই এই মিলিটারি ট্রাইবু্যনালকে আমলে নেননি। একে 'ভিক্টরস জাস্টিজ'
বা 'বিজিতের ওপর বিজয়ীর বিচার', 'বিচারের নামে প্রহসন' ইত্যাদি খেতাবে
ভূষিত করেছেন। এটা যে ছিল সাজানো একটি ষড়যন্ত্রমূলক প্রহসন এর প্রমাণ খুব
দ্রুতই পাওয়া গিয়েছিল মিত্রশক্তির প্রধান সেনাপতি ও জাপানস্থ জেনারেল হেড
কোয়ার্টারের (জিএসকিউ) প্রশাসক জেনারেল ডগলাস ম্যাক-আর্থারের স্বীকারোক্তির
মধ্য দিয়ে। অবসরপ্রাপ্ত জেনারেল এই বিচারকে সম্পূর্ণভাবে মার্কিন
প্রেসিডেন্ট হ্যারি এস. ট্রুম্যান তথা মার্কিনীদের ষড়যন্ত্র এবং একটি ভুল
বিচার বলে আখ্যায়িত করেছেন। প্রভাবশালী নিউইয়র্ক টাইমস্ পত্রিকার এক
সাক্ষাৎকারে স্বকন্ঠে এই স্বীকরোক্তি করেন এবং মার্কিন কংগ্রেসের
উচ্চকক্ষের আইসভায় আহুত হয়ে একই কথা বলেন। এছাড়াও গবেষণায় দেখা যায় এই
বিচারের পেছনে ছিল বিশ্বরাজনীতি ও অর্থনীতির নিয়ন্ত্রক ইহুদিদের গভীর গভীর
প্রভাব ও চক্রান্ত মূলত এশিয়া মহাদেশকে নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য। বিচারপতি
পালের রায় যে শ্বেতাঙ্গ জাতিগুলোকেও প্রচন্ড নাড়া দিয়েছিল তার প্রমাণ তিনি
জাতিসংঘের অধীন আন্তর্জাতিক আইন কমিশন (আইএলএল) কতর্ৃক ১৯৫২ ও ১৯৫৮ সালে
দুবার বিশেষ অধিবেশনে সভাপতির আসন অলঙ্কৃত করার জন্য র্নিবাচিত হয়েছিলেন। এ
রকম বিরল সম্মান একমাত্র বাঙালি হিসেবে তিনিই পেয়েছেন।
রাধাবিনোদ পাল বাংলাদেশের কুষ্টিয়া জেলার (ভূতপূর্ব নদিয়া) প্রত্যন্ত অঞ্চল
তারাগুনিয়া ইউনিয়ন, দৌলতপুর উপজেলার সালিমপুর গ্রামের এক অত্যনত্দ দরিদ্র
পরিবারে জন্ম গ্রহণ করেন ১৯৮৬ সালের ২৭ শে জানুয়ারি। ছেলেবেলা থেকেই
প্রচন্ড পরিশ্রম ও মেধার বলে মানুষ হয়েছিলেন তিনি। ১৯০৭ সালে কলকাতা
প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে গণিতে বি.এ. অনার্স উত্তীর্ণ হবার পরের বছরই একই
প্রতিষ্ঠান থেকে একই বিষয়ে এম.এ. পরীক্ষায় প্রথম শ্রেণী লাভ করেন। মেধাবী
রাধাবিনোদ পাল জীবনের প্রথম চাকরিতে নিযুক্ত হন ১৯১১ সালে ময়মনসিংহ জেলার
বিখ্যাত আন্দমোহন কলেজের অধ্যাপক হিসেবে। এখানে ১৯২০ সাল পর্যনত্দ থাকা
অবস্থায় কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মাস্টার অব ল' পরীক্ষায় প্রথম শ্রেণীতে
প্রথম হওয়ার গৌরব অর্জন করেন ১৯২০ সালে। ১৯২১ সালে কলিকাতা উচ্চআদালতে
আইনজীবী হিসেবে যোগ দেন। ১৯২৪ সালে কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এল.এল.ডি
অর্থাৎ ডক্টর অব ল'। বিশেষ ডিগ্রী লাভ করেন 'মনুসংহিতা পূর্ব বৈদিক ও উত্তর
বৈদিক যুগে হিন্দু আইন-দর্শন' বিষয়ে সন্দর্ভ লিখে। একমাত্র তিনিই যিনি
তিন-তিনবার কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের দুর্লভ 'টেগোর ল' প্রফেসর' এর আসনে
নির্বাচিত হন যথাক্রমে ১৯২৫, ১৯৩০ ও ১৯৪৮ সালে। তাঁর আগে যাঁরা এই আসনে
ছিলেন তাঁরা হলেন: স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায়, স্যার গুরুদাস
বন্দ্যোপাধ্যায়, ড.বিজনকুমার মুখোপাধ্যায় এবং হার্ভাড ল' স্কুলের অধ্যাপক
রোসকো পোন্ড (Roscoe Pound).
এই বিরল সম্মানের কারণে ভারত সরকার কর্তিক ১৯২৭-৪১ সাল পর্যনত্দ জাতীয় আয়কর
দপ্তরের আইন উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্বপ্রাপ্ত হয়েছিলেন। ১৯৪১ সালে কলিকাতা
উচ্চআদালতের বিচারপতি নির্বাচিত হন এবং ১৯৪৩ সালে অবসর নিয়ে পুনরায় ওকালতিতে
ফিরে যান। কিন্তু পরের বছর আবার ডাক পরে কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের
উপাচার্যের দায়িত্ব গ্রহণের জন্য। দূরপ্রাচ্য টোকিয়ো আন্তর্জাতিক মিলিটারি
ট্রাইবুনালের বিচারপতি হিসেবে যোগদানের পূর্বে ১৯৪৬ সাল পর্যন্ত এই পদে
আসীন ছিলেন। এই বিচারে তিনি যে ৭০০ পৃষ্ঠার রায় দিয়েছিলেন তা আজ
বিশ্বইতিহাস। আন্তর্জাতিক আইনের ক্ষেত্রে এক অপরিসীম অবদান। ১৯৫৭ সালে
জাতীয় অধ্যাপক এবং ১৯৬০ সালে ভূষিত হন ভারতের দ্বিতীয় শ্রেষ্ঠ জাতীয় সম্মান
'পদ্মভূষণ' পদকে। আজীবন রবীন্দ্রভক্ত ড.পাল জড়িত ছিলেন জাতীয়তাবাদী
রাজনীতির সঙ্গেও। শেষ জীবনে শান্তিবাদী কর্মী হিসেবে ১৯৬৭ সালে কলকাতায়
নিজগৃহে মৃত্যুবরণ করেন।
১৯৪৬ থেকে ১৯৬৬ সাল পর্যন্ত বিশ বছরে বিচারপতি পাল জাপানে এসেছেন মোট
পাঁচবার। টোকিও মিলিটারি ট্রাইব্যুনাল চলাকালীন স্ত্রীর অসুস্থার সংবাদ পেয়ে
কলকাতায় ফিরে যান। প্রহসনমূলক এই ট্রাইবুনালে ফেরার উৎসাহ হারিয়ে ফেলেন।
কিন্তু তাঁর মহীয়সী স্ত্রী তাঁকে বলেন, জাপানের ভাগ্য আজ বিচারের কাঠগড়ায়
সেই ক্ষণে তোমার ফিরে না যাওয়ার অর্থ নীরব ভূমিকা পালন করা। তা হতে পারে
না, তুমি যাও। আমার জন্য কোন চিন্তা করো না।
এর মধ্যে জেনারেল ম্যাক-আর্থার তাঁর নিজস্ব বিমান পাঠিয়ে বিচারপতি পালকে
ফিরিয়ে নিতে কলকাতায় পাঠানো হয়। তারপর ডঃ পাল টোকিও ফিরে আসেন বলে মাসাআকি
তানাকার লেখা থেকে জানা যায়। তারপর ১৯৫২, ১৯৫৩ এবং ১৯৬৬ সালে শেষবারের মতো
জাপানে আসেন। এই বছরগুলোতে তিনি জাপানের বিভিন্ন স্থান পরিভ্রমণ করেন যেমন
কিয়োতো, ওসাকা, হিরোশিমা, ফুকুওকা, ইয়োকোহামা প্রভৃতি। সর্বশ্রেণীর মানুষের
সঙ্গে মেলামেশার সুযোগ লাভ করেন। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও বিশ্ববিদ্যালয়ে
বক্তৃতা করেন, অর্জন করেন বিশেষ ডক্টরেট ডিগ্রি সেইসব সমাবেশের দুর্লভ
ছবিসহ তাঁর জীবনের ছবিও স্মৃতিজাদুঘরে সংরক্ষিত আছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য
একটি ছবির ক্ষুদ্র অ্যালবাম লেখকের দেখার সৌভাগ্য হয়। সেটি প্রকাশিত
হয়েছিল জাপানের অন্যতম প্রধান মোটর গাড়ির ইঞ্জিন ও ট্রাক প্রস্তুতকারী
প্রতিষ্ঠান ইসুজু জিদোওশা কাবুশিকি কাইশা বা ইসুজু মোটরস কোম্পানি কতর্ৃক
কিন্তু কত সালে তার কোন উল্লেখ নেই। সম্ভবত ১৯৫২ কি ১৯৫৩ সালে বিচারপতি পাল
ইসুজু কোম্পানির একটি কারখানা পরিদর্শন করেছিলেন। অ্যালবামের পনেরোটি ছবির
মধ্যে চারটি অত্যন্ত দুর্লভ আলোকচিত্র রয়েছে ডঃ পালের। অ্যালবামটি অযত্নের
অভাবে বিনষ্ট হয়ে গেছে বলা যায়। এই রকম আরও অনেক ছবি, লেখা ও ব্যবহারিক
জিনিসপত্র বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে যেগুলো সংগ্রহ বা কপি করে
সংরক্ষণের গুরুত্ব রয়েছে বলে মনে করি। বাংলাদেশ সরকার বা সংস্কৃতি
মন্ত্রণালয় বিচারপতি পালের একটি স্মৃতিজাদুঘর প্রতিষ্ঠা করতে পারে তাঁর
জন্মস্থান কুষ্টিয়া বা ঢাকায় জাপান-বাংলা দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের ভিত্তিতেই।
আগামী বছর ২০১১ সালের ২৭শে জানুয়ারি তাঁর ১২৫তম জন্ম বার্ষিকী।
probirsrkr06@gmail.com
[প্রথমপাতা] |
|