|
@
@
(এক)
কে যেনো আমাকে একটি ধারাল ছুরি ঢুকিয়ে দিলো বুকের বাদিকে ! বাম হাতের উপরের
মাংশপিন্ডটি কেমন ধড়াক ধড়াক করে উঠল বেশ কয়েকবার , আর তারপর সেই ধারাল ছুরি
আমার বাঁদিকটা ফালি ফালি করে কাটতে লাগল । ঘটনাটা এতো দ্রুত ঘটে গেল যে আমি
কিছু বোঝার সময়টুকুও পেলাম না । চিৎকার করে গড়িয়ে পড়লাম ম্যানহাটানের
ব্যাস্ততম এলাকা স্টক এক্সচেঞ্জ এর পাশের রাস্তায় । এক্সচেঞ্জ প্লেস এর উপরে
ওয়াল স্ট্রীটের উল্টোদিকে যেখানে হাইরাইজ বিল্ডিঙের মাথার হ্যাট সরিয়ে
রাস্তা কখনো আকাশ দেখে না ঠিক সেইখানটায় আমার চিৎকার আমার কানে এসে বাড়ি
খেয়ে হারিয়ে গেল, আমি আর কিছুই মনে করতে পারলাম না ! কেবল পাশে থমকে দাঁড়িয়ে
থাকা নয় বছরের সিদ্ধার্থের দিকে চেয়ে চিৎকার করে বলা এই আর্তনাদটুকু ছাড়া '
বাবা হেল্প মি ! আই এ্যাম হ্যাভিং এ হার্ট এ্যাটাক ! হেল্প হেল্প হেল্প '
২০০২ এর সামার তখন, আমেরিকার ইতিহাসে ভয়াবহ সেই নাইন ইলেভেন ঘটে গেছে প্রায়
এক বছর হল , এই এলাকার বন্ধ করে রাখা রাস্তা গুলো কিছুদিন হল মাত্র খুলে
দেয়া হয়েছে । ঠিক ঐ এলাকাতেই 'স্যাংচুয়ারী ফর ওমেন' নামে একটি সংগঠন । এখানে
পারিবারিক জীবনে দুর্ভাগ্যতাড়িত নারীদের জন্য ফ্রী আইনি সহায়তা দেয়া হয় ।
প্রতিদিন এখানে নানান দেশের , নানান ভাষার , নানান সংস্কৃতির মানুষ আসে
অকল্পনিয় সব দুর্ভাগ্যের ঝুলি বয়ে কুঁজো হয়ে , নত মুখে । তারা কেউ হাসে না
! প্রায় সবার মুখে একটা মেঘলা রঙের অসুখী ছায়া ঝুলে থাকে । আমি এটাকে ঠিক
বেদনা বলি না কারন এ কেবল নিরেট বেদনা নয় এর সাথে মিশে থাকে ভয় , ভাবনা ,
নিরাপত্তাহীনতা , অনিশ্চয়তা, উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা, অশ্রু, দীর্ঘশ্বাস, অপমান,
অসুস্থতা, আরো অনেক কিছু নিয়ে অসুখী সময়ের পারাবার ।
আমার এটর্নী লরা ক্লিন্টন খুবই ব্যাস্ত মানুষ । ভালো এটর্নী বলে এ শহরে তার
নাম আছে । কিন্তু তার সময় নেই ! তবু আমি তার কাছে আসি । আজ এসেছিলাম কিছু
কাগজপত্র সাইন করতে । ছেলেকে কারো কাছে রেখে আসব তার ব্যাবস্থা নেই ওর বেবী
সিটার অসুস্থ । স্কুল ছুটি হয় বেলা তিনটায় , আমাকে পৌছাতে হবে সাড়ে তিনটায়
না হলে লরাকে পাওয়া যাবে না । ফলে স্কুলের গেট থেকে ওকে তুলে নিয়ে যত দ্রুত
পারা যায় ড্রাইভ করে উডসাইড ট্রেন ষ্টেশনের কাছে গাড়ী পার্ক করে সেভেন
ট্রেন, আর ট্রেন ধরে ধরে যখন পৌছালাম তখন লরা প্রায় বেরিয়ে যাচ্ছে ! আমাকে
বসিয়ে রেখে সে আবার আমার ফাইল পত্র ঘাটছে ! আমার বাড়ী বিক্রি হয়ে গেছে ,
বাড়ীর প্রথম মর্টগেজ এর উপরে আবার দ্বিতীয় দফা মর্টগেজ প্রায় একলক্ষ ষাট
হাজার ডলার আমার মাথার উপরে , আমার চাকরী নেই , রাস্তায় বেরুলেই আমি আনমনা
, গাড়ী চালাচ্ছি ,একের পর এক এক্সিডেন্ট করছি , বিশাল বাড়ী ছেড়ে ছোট
এপার্টমেন্টে উঠেছি আরো কত কত কতকিছু ! তবু আমার হাসি ফুরোয় না । খুব কাছের
বন্ধু বলে যাদের জানতাম তারা বলে ওকে দেখলে তো মনে হয় না কিছু ! আমি হাসি ,
আমি তো তাই চাই !
লরা কাগজ পত্র এনে সামনে দিল । আমি সাইন করে বেরিয়ে এলাম । দ্রুত পা
চালাচ্ছি , সিদ্ধার্থ স্কুল থেকে বেরিয়ে কিছু খায় নি । ব্যাগের ভেতরে ওর
জন্যে একটা ছোট আপেল জুসের প্যাক আর ছোট এক প্যাকেট চিপস নিয়ে বেরিয়েছিলাম
বাসা থেকে কিন্তু ও কিছুতেই এসব খাবে না । বাসার কাছের দোকান থেকে চাইনিজ
খাবে বায়না ধরল । আমি জোর , জোর , আরো জোরে পা ফেলছি আর ঠিক তখুনি ছুরি
বসাল আমার বুকে ! তখনি গড়াগড়ি, চিৎকার , রাস্তায় লোক জড় , ৯১১ কল ,
এ্যাম্বুলেন্স , প্যারামেডিক্স আমাকে স্ট্রেচারে তুলে নাকে অক্সিজেনের নল
ফল ঢুকিয়ে নিয়ে গেল নিউইয়র্ক ডাউন টাউন হসপিটালে । আমার ছেলেটা হারিয়ে গেল
। দুই রাত একদিন পরে আমি চোখ খুলে দেখি সব সাদা ! সাদা বিছানা , সাদা ঘর
সাদা সাদা পর্দার মত দিয়ে এক রুগীর বেড থেকে আর এক রুগীর বেড আলাদা করা ।
চারিদিকে তাকিয়ে আমার মনে পড়ল আমার বাচ্চার মুখ ! ওই অত লোকের ভিড়ে আমার
হাত ব্যাগটি বুকে জড়িয়ে ভীত হরিন শাবকের মত কান দুটো খাড়া করে ঠোট দুটো
সামনের দিকে ঝুলিয়ে থর থর করে কাঁপছে শেষ দেখা সেই মুখ !
এক লাফে হাসপাতালের বেড ছেড়ে চিৎকার করে নার্সদের ষ্টেশনে এসে দাঁড়ালাম !
আমার ছেলে কই ? কোথায় আমার বাচ্চা ! হি ইজ নাইন ইয়ার্স ওল্ড, হি ইজ ইন
ফোর্থ গ্রেড , হি ওয়াজ উইথ মি ! আমি আবার নার্স স্টেশনের সামনের ফ্লোরে
গড়াচ্ছি । ওরা আমাকে হেল্প করার চেষ্টা করছে কিন্তু আমি পাগলের মত কেবল
চিৎকার করছি ! আমার পাঁচ বছরের বাচ্চাটাকে নিয়ে একদিন আত্মঘাতী অভিমান নিয়ে
এই অজানা দেশে পাড়ি দিয়েছিলাম ! আজ আমি তাকে প্রটেক্ট করতে পারলাম না ! সারা
পৃথিবী হাতড়ে কেবল একটি নাম্বারই আমি মনে করতে পারছি যাকে আমি কল করে কোনো
হেল্প পাব না জানি ! কেমন করে জানিনা মনে পড়ল আমার ছোট বোনের বন্ধু
মঞ্জুরের নাম্বার তাকে কল করে জানলাম সিদ্ধার্থকে পাওয়া গেছে , সে আছে আমার
বাড়ীর পাশে এক নেইবারের বাসায় !
পাগোলের মত আমি এক দৌড়ে হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে এলাম , রাস্তায় মানুষ কে
জিজ্ঞেস করলাম সাবওয়ে কোন দিকে , আমার হাতে হাসপাতালের রুগীর নাম্বার লেখা
ব্যান্ড, আমি দৌড়চ্ছি , আমি খালি পায়ে , আমার পায়ের স্যান্ডেল খুলে রাস্তায়
পড়েছিল দু দিন আগে যখন আমাকে এ্যাম্বুলেন্সে তুলে আনে ! সাবওয়ে স্টেশনের
বুথে মহিলাকে হাতের ব্যান্ড দেখিয়ে বললাম আমার কাছে টিকেট দেবার অবস্থা নেই
আমাকে টিকিট ছাড়াই ডোর খুলে ভিতরে যেতে দিল ! আমি সামনে যে ট্রেন পেলাম
তাতেই লাফ দিয়ে উঠলাম । ট্রেন থেকে নেমে দেখি আমার গাড়ী নেই উডসাইড ট্রেন
লাইনের নীচে ! গাড়ী থাকলেই বা কি ! আমার কাছে তো চাবী নেই ! মনে পড়ল আমার
এক বড় ভালো মানুষ ছোট ভাই , আলী আযমের কথা ! রাস্তার পাশের দোকানে ঢুকে কল
করলে সে সাথে সাথে তার বন্ধু রেজাকে সাথে নিয়ে এসে আমাকে তুলে নিল । ওদের
সাথে গিয়ে ছেলেকে তুলে নিলাম , সাথে আমার গাড়ীর চাবী নিয়ে গাড়ী নিয়ে ছেলেকে
বুকে জড়িয়ে ঘরে ফিরলাম ! কেমন করে সিদ্ধার্থ ম্যানহাটান থেকে মঞ্জুরের বাসা
পর্যন্ত এসেছিল সেই রহস্য আজো খুলতে পারিনি ! আমার নয় বছরের ছেলে এখন ২২
বছর বয়স ! সে এ কথা উঠলে সব সময় এড়িয়ে যায় ! আজ যখন এই লেখা লিখছি তাকে
সামনে পেয়ে আবারো জানতে চাইলাম । এখন সে বড়, তার কথাও বড়দের মত , আমাকে বলল
' মা সব কথা না জানাই ভালো ! কেন নিজেকে কষ্ট দাও !' আমার মন তবু মানে না !
এপর্যন্ত নানা ভাবে যেটুকু উদ্ধার করতে পেরেছি তা হল , রাস্তা থেকে কেউ দয়া
করে আমার বাচ্চাকে ট্রেনের পরে ট্রেন বদলে ম্যানহাটান থেকে কুইন্সের উডসাইডে
মঞ্জুরের বাসার সামনে দরজায় পৌঁছে দিয়ে চলে গেছে । মঞ্জুর বাসায় ছিল না বলে
ভেতর থেকে কেউ ডোর খোলেনি , বিল্ডিঙের নিচে সে দাঁড়িয়েছিল রাত অবধি ,আমার
কালো হাত ব্যাগটি বুকে জড়িয়ে ধরে । মঞ্জুর বাসায় ফিরে নিচে ওকে দেখে ওকে
নিয়ে আমার ব্যাগ থেকে চাবী নিয়ে আমার গাড়ীতে করে আমার পুরনো প্রতিবেশীর
বাড়ীতে নামিয়ে দিয়ে গেছে !
কাকে ,কাকে ধন্যবাদ দেব আমি ! মঞ্জুর , আযম , রেজা , আমার প্রতিবেশী ! আমি
কেন মনে করতে পারি না আর কোনো মুখ ! আমার এই যাত্রা পথে কেনো মনেপড়ে না
কোথাও একটি দরদী কন্ঠ ! আমি জানি আমার অনেক আপনার জনও জানে না এসব ! না
জানুক তাতে কি ! আমার হাসি কিন্তু তবু বন্ধ হয় না ! কিছুতেই না ! যেদিন
হাসতে ভুলে যাব সেদিন তো আমি নেই !!!
@
WARNING:
Any unauthorized use
or reproduction of
'Community' content is
strictly prohibited
and constitutes
copyright infringement
liable to legal
action.
[প্রথমপাতা] |
@
|